মোহ_মায়া #সানজিদা_বিনতে_সফি #পর্ব_ ৯

0
429

#মোহ_মায়া
#সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_ ৯

আজ এক সপ্তাহ হলো আমারা বাড়িতে এসেছি। আন্টি এখনো হাসপাতালে।আন্টির অসুস্থতার জন্য সম্রাট ভাইয়ার প্যারিস যাওয়া ক্যান্সেল হয়েছে। তবে আংকেল প্যারিস চলে গিয়েছে। আন্টির অবস্থা খুব একটা ভালো না। এখনো আই সি ইউ তে আছে।সম্রাট ভাইয়া সারাদিন হসপিটালেই থাকেন। নাওয়া খাওয়া ঘুম ছেরে মায়ের পাশে বসে থাকেন। লোকটার জন্য কষ্ট হয় খুব।এ পর্যন্ত যত বার আমাদের দেখা হয়েছে একটা কথাও বলেন নি তিনি।আমিও ঘাটি নি তাকে।তার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি।কয়েক দিনেই চোখের নিচে কালি পড়েছে। শুকিয়েছে অনেকটা। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করছেন না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সামনে তাকাতেই প্রিয়া কে দেখতে পেলাম।

– কি ব্যাপার। এখানে বসে আছিস কেন?

– এমনিই। ভালো লাগছে না কিছু। আপুর জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে।

– হুম। মনি কে আজ নিয়ে আসবে।একঘন্টা লাগবে হয়তো আর।

কথাটা শুনে চমকে উঠলাম। আমি জানতাম না আজ সাফা আপুকে নিয়ে আসবে।

কাপা কাপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম,

– সম্রাট ভাইয়া কোথায়? সে ঠিক আছে তো?

– হুম।মামা নানু কে নিয়ে কিছুক্ষণ আগেই বাড়িতে ফিরেছে। আচ্ছা আদু,তোর কি উচিত ছিল না মামার পাশে থাকা? অন্তত তাকে একটু আগলে রাখতে তো পারতি!রাতে মামা ঘুমায় না।সারা রাত ছাদে অথবা হসপিটালে কাটিয়ে দেয়। তার হাত ধরে একটু সান্ত্বনা কি দেয়া যেতো না? (আফসোস করে)

– আমার কি সেই অধিকার আছে? তার সামনে দাড়িয়ে তাকে বলার অধিকার টুকু নেই যে,আমি আছি আপনার পাশে।ভেঙে পড়বেন না।তার হাতে হাত রেখে সাহস জোগানোর সাহস আমার নেই পিয়ু।আমার যে বড্ড ভয়।নিজের সম্মান হারানোর ভয়।মানুষের কটু কথার ভয়।অনধিকার চর্চা না করে ফেলি তার ভয়।(দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে)

তার হারানোর পরিধি এতটা বড় যে আমার একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে তাকে সান্ত্বনা দিতে ভয় হয়। আসলেই কি কোন সান্ত্বনা এই কষ্ট কে কম করতে পারবে!

– বিপদে আমারা আমাদের আপন মানুষ গুলো কে চাই আমাদের ভরসা হিসেবে। যারা আমাদের ভেঙে পরার থেকে আগলে রাখে।যারা আমাদের সাহস জোগায়। হারিয়ে যাওয়া আপন জনকে তো ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। কিন্তু তাদের কষ্ট ভাগ তো করে নিতেই পারি।তাই না?

– আমি তার আপন কেউ নই পিয়ু।

প্রিয়া আহত ভাবে তাকালো।ভারাক্রান্ত মনে বললো,

– জীবনে এমন কিছু করিস না যেটা নিয়ে পরে আফসোস করতে হয়। কিছু কিছু ভুলের কিন্তু মাফ হয় না,শাস্তি হয়।আশা করবো আমার কথা গুলো একটু ভাববি।

প্রিয়া চলে গেলো। আমি এখনো বসে আছি পুকুর পারে। আমি সব কিছুই বুঝিরে প্রিয়া।শুধু আমাদের সমাজ,পরিবার এরাই বোঝে না। আমি জানি না সম্রাট ভাইয়া কাকে ভালবাসে,আমি জানতে ও চাই না। আমি শুধু এতটুকু জানি, আমি ভালবাসি।প্রচন্ড ভালবাসি।আমার মনের মধ্যে রাজত্য করা মানুষটাকে আমি এমনি এমনি এই অবস্থায় একা ছেড়ে দেই নি। অদৃশ্য শিকল আমার পায়ে পরিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই চাওয়া সত্ত্বেও আমি কিছুই করতে পারছি না।

——————————

এম্বুল্যান্স এর শব্দে গ্রামের অনেকেই চেয়ারম্যান বাড়িতে ভির করছে। মাত্রই এম্বুলেন্স এসে গেটের ভিতর ঢুকেছে। সবাই কৌতুহল নিয়ে দারিয়ে আছে।ফ্রিজিং লাশ বাহি এম্বুল্যান্স এ সাফা কে আনা হয়েছে।পেছনের গাড়িতে যুবরাজ, সাইফ সাহেব, আর সম্রাটের মামা আছে।
সাইফ মাহতাব অনেক দুর্বল হয়ে পরেছেন। পৃথীবিতে সবচেয়ে ভাড়ি জিনিস হচ্ছে বাবার কাধে সন্তানের লাশ।আসাদ(সম্রাটের মামা)সাইফ সাহেবকে গাড়ি থেকে হাত ধরে নামিয়ে আনলেন।

– কোথায়? আমার মেয়ে কোথায়? সাফা,মা আমার।কই তুই?এখনো আমার সামনে আসছিস না কেন?মা কিন্তু রেগে যাচ্ছি। মায়ের সাথে মজা করিস না মা।আয় আমার কাছে আয়।এই সমু দাড়িয়ে আছিস কেন। বোনের কস্ট হচ্ছে তো।আমার সাফা ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না। দরজা খুলে দে গাড়ির। (দরজা টেনে)

এম্বুলেন্সের শব্দে বাসা থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসেন যুথি বেগম। লাশ বাহি গাড়িতে সাফা কে দেখে দরজা ধরে টানতে থাকেন। মায়ের এই অবস্থা দেখে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না আটকে রাখার চেষ্টা করছে সম্রাট। মা কে বুকে জরিয়ে ধরে এম্বুল্যান্স থেকে দূরে নিয়ে এলো।

এম্বুলেন্স এর সাথের দুজন লাশের কফিন বের করতেই চিৎকার করে কেদে উঠলেন যুথি বেগম। সম্রাট ও ডুকরে কেঁদে উঠলো। হামাগুড়ি দিয়ে মেয়ের লাশের পাশে গেল সে।আমার মেয়ে আমার মেয়ে বলেই সেন্স লেশ হয়ে গেলো যুথি বেগম।

সম্রাট এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে সাফার দিকে।শুধু চেহারা দেখা যাচ্ছে। সেখানেই অজস্র আঘাতের চিহ্ন।

– ভাই!
যুবরাজের ডাকে তার দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকালো সম্রাট।

– আ আমার পু পুতুল।

কাপাকাপা গলায় বলতেই জাপটে ধরলো সম্রাটকে। দ্বায়িত্বর নিচে কষ্টটা চাপা পড়ে গেছে যুবরাজের। এখন বড় ভাই হিসেবে আর বড় ছেলে হিসাবে তাকেই সবাইকে সামলাতে হবে।

– নিজেকে সামলা ভাই।অপরাধী দের শাস্তি দিতে হবে তো!ভেঙে পরলে চলবে না।কেউ যেন কিছু না জানতে পারে।তারাতাড়ি দাফন করতে হবে। আমার বোনের কস্ট হচ্ছে।

– হুম।

যুবরাজ সাফার মুখটা ঢেকে দিল।সে চায় না তার বোনের এই মর্মান্তিক মৃত্যু নিয়েও মানুষ আলোচনায় বসুক।

– আপনারা এসেছেন তাই সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমার বোনের মৃত্যু আরো ২৫ দিন আগে হয়েছে।বডি ডিকমপোজড হওয়া শুরু হয়ে গেছে। তাই আধঘন্টার মধ্যে তার দাফন সম্পন্ন করা হবে। সবাই আমার বোনের জন্য দুয়া করবেন। আল্লাহ যেন তার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন।আপনারা মসজিদ মাঠে চলে যান।আমরা লাশ নিয়ে আসছি।দয়া করে কেউ ভির করবেন না।

কথাগুলো বলে সম্রাট ভিতরে চলে গেলো।
————————-

আমি তারাহুরা করে ঢুকলাম বাড়িতে। উঠানে সাফা আপুর কফিন রাখা।দেখতেই বুকটা ধুক করে উঠলো। কাপা কাপা পায়ে এগিয়ে গেলাম কফিনের সামনে। হাত বারাতেই কেউ একজন আমার হাত ধরে ফেললো। সামনে তাকাতেই দেখলাম সম্রাট আমার হাত ধরে আছে।

– দেখতে হবে না। ভয় পাবি।একসিডেন্টে খুব বাজে ভাবে চেহারা থেতলে গেছে।দেখার দরকার নেই।মায়ের কাছে যা।

সম্রাট ভাইয়ার শান্ত গলায় বলা কথা গুলো শুনে প্রচুর পরিমাণ অবাক হলাম। তার তো এতক্ষণে চিৎকার করে কাদার কথা। তিনি এতো শান্ত কিভাবে আছেন।

আমি আর কথা না বারিয়ে বাড়ির ভিতর চলে গেলাম। আন্টি ফ্লোরে বসে আহাজারি করছেন। মেয়ের শোকে পাগল প্রায় অবস্থা। আমার চোখের পানি বাধ মানছে না।আর সে তো মা!

🍁🍁🍁🍁

কিছুক্ষণ আগেই সাফা আপুকে দাফন করা হয়েছে। সম্রাট আর যুবরাজ ভাইয়া সোফায় বসে আছে।দুজনের চোখ গুলো ভয়ংকর ভাবে লাল হয়ে ফুলে আছে। আন্টিকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দেয়া হয়েছে।তাই সে এখন ঘুমাচ্ছে।

– আমরা ঢাকায় যাচ্ছি বাবা।মারিয়াকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। ওর বাবা কল করেছিলো। ওর ভাই নাকি ওকে খুজেছে। কোথাও কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদেরকে যেতে হবে।

সম্রাটের কথা গুলো শুনতেই আমি অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকালাম। একটু আগে নিজের বোনকে কবর দিয়ে এসে এখনই সে ঢাকা যেতে চাইছে।

সাইফ সাহেব হিংস্র বাঘের মতো তাকালো সম্রাটের দিকে।নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললেন,

– যাও।নিজের কতব্যে কোন ত্রুটি রাখবে না।সব গুলো গুনে গুনে পালন করবে।সময় মতো আমি পৌছে যাব।

– সুমনের দিকে একটু খেয়াল রেখো বাবা।ওর অবস্থা খুব একটা ভালো না।আন্টি সারাদিন কান্নাকাটি করছেন। হঠাৎ স্ট্রোক কেন করলো বুঝতে পারছি না। আমার বিপদের দিন যেন শেষই হতে চাইছে না।

– হুম।

– মায়ের খেয়াল রেখো বাবা।খুব শীঘ্রই দেখা হচ্ছে।

চলবে,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here