গল্পের নাম: #বৃষ্টি_থামার_পরে
পর্ব_৯ : #অপশন
লেখিকা: #Lucky_Nova
“চুপচাপ যাবা? নাকি তুলে নিয়ে যাব?”
মিহি হতবাক হয়ে গেল এরোনের কথায়। অনেক ক্ষণ ধরেই ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে মিহি। কিন্তু তাতে যেন এই ছেলেটার কোনো মাথা ব্যথাই নেই।
এতসময় এত কিছু বলার ফলাফল দাঁড়ালো শূন্য।
“আমি ত বললাম আমি যাব না। কেনো জোর করছেন?” কাঁদতে কাঁদতেই রাগী গলায় বলল মিহি।
এই প্রশ্ন যেন আগুনে ঘি ঢালার মত হয়ে দাঁড়ালো।
এরোন রেগে এগিয়ে এসে মিহির দিকে ঝুঁকতেই মিহি চমকে মেঝেতে বসা অবস্থাতেই পিছিয়ে গেল।
“ওঠো নাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবেনা।”
“আমি কোত্থাও যাব না।” ক্ষীপ্ত গলায় বলল মিহি।
“আমার মাথা গরম হয়ে গেল কিন্তু তুমি জানোই আমি কি করবো। আশা করি আরো ঝামেলা চাচ্ছ না!”
মিহি ছলছল করা চোখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
এরোন ওর ওড়নার এক প্রান্তভাগ হাতের মুঠোয় ধরেতেই মিহির হকচকিয়ে গেল।
“তোমাকে ত আবার টাসও করা যাবেনা! সতি সাবিত্রী কিনা তুমি আবার!” দাতে দাত চিপে ব্যঙ্গাত্বক কন্ঠে বলল এরোন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ওড়নাটা হালকা নাড়িয়ে কঠোর গলায় বলল, “জলদি।”
মিহি তেতে গিয়ে চোখ মুছতে মুছতে সিড়ির দিকে তাকাতেই ওর বাবাকে দেখতে পেল। চোখে চোখ পরতেই তিনি শক্ত মুখ করে তাকিয়ে আবার নিজের কক্ষের দিকে পা বাড়ালেন। আর যেতে যেতে বুলুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “বুলু, এই মেয়েকে বাসা থেকে বের করে দরজা লাগিয়ে দে। এসব মেয়ের কোনো দরকার নেই আমার। আমার মেয়ে মরে গেছে।”
বুলু নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
শেষ কথাগুলোতে অনেক বড় ধাক্কা খেল মিহি।
একদম থম মেরে গেল সে।
এরোনের এগুলোতে মাথাব্যথা করার সময় নেই। কারণ এগুলো নিয়ে মাথাব্যথা করা মানেই মিহিকে অন্য কারো হতে দেওয়া। সেটা অসম্ভব।
তাই সে ওর ওড়নাটার প্রান্ত ভাগ ধরে দাঁড়িয়ে রইল।
মিহি এখনো বসেই আছে।
ক্ষানিকটা সময় পরে এরোন আবার মিহির ওড়নাটা একটু নাড়িয়ে চোখের ইশারায় উঠে দাঁড়াতে বলল।
মিহি দাতেদাত চিপে উঠে দাঁড়ালো। তারপর তেতে উঠে বলল, “কি শুরু করেছেন আপনি? কি চান টা কি আপনি?”
“তোমাকে।” সহজ গলায় উওর দিলো এরোন।
শুনেই অসস্তিতে পরে গেল মিহি।
“আমি যাব না।” ক্ষীপ্ত চোখে তাকিয়ে আবার বলল মিহি। চোখের কোনে জল এখনো চিকচিক করছে তার।
এরোন তাতে ভ্রুক্ষেপ করলো না। সে রেগে এগিয়ে গিয়ে মিহির হাত চেপে ধরলো।
“আহ, কি করছেন?” মিহি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু কোনো লাভ হলো না।
এরোন ওকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে জোর করে বসিয়ে দিয়ে নিজেও এসে বসলো।
ভালোভাবে বলে এই মেয়েকে দিয়ে কিছুই হয়না।এরোন চিন্তা করেছিল হাত ধরবে না কিন্তু ধরাই লাগলো।
মিহি গাড়ির দরজা খোলার জন্য চেষ্টা করেও পারলো না। মিহি অস্থির হয়ে উঠলো। এই ছেলে কি সত্যিই ওকে নিয়ে যাবে নাকি! মিহি আবার কেঁদে ফেলল। এমন একটা মুহুর্তে সব হয়ে গেল, যখন বাসাতে কেউ উপস্থিত নেই। তারা থাকলেও কি আদৌ ওকে বিশ্বাস করতো! এই যেমন ওর বাবাই এমন ভাবে ওকে অবিশ্বাস করেছে যে ও মরে গেলেও তার কিছু যায় আসেনা।
চিন্তা করেই মিহির মুখ মলিন হয়ে গেল আর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরতে লাগলো।
এরোন গাড়ি স্টার্ট না দিয়ে গাড়ির জানালায় হাত ভাজ করে রেখে মিহির দিকে শক্ত মুখ করে তাকিয়ে রইল। মিহি নাক টেনে টেনে কেঁদেই যাচ্ছে।
সে তোয়াক্কা না করে তীব্র রাগের সাথে বলে উঠল, “এখন বলো! বাসা থেকে বিয়ে ঠিক করলো আর তুমি আমাকে কিছুই জানানোর প্রয়োজন মনে করলা না! কেনো? যদি আমি জানতে না পারতাম তাহলে? বিয়ে করে নিতা?”
না জানলেই ত ভালো হত। মনে মনে বলল মিহি। তবে মুখে কিছু বলল না।
মিহিকে চুপ থাকতে দেখে এরোন এবার ধমকে বলে উঠল, “অন্য কাউকে বিয়ে করে নিতা? বাঁধত না! সত্যিই নাটক করেছো এতদিন আমার সাথে?”
মিহি ভয় পেলেও সাহস যুগিয়ে বলল, “বার বার কেনো এক কথা জিজ্ঞেস করছেন? আমি ত বলেছিই আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাইনা। আর হ্যা এসব নাটক ছিল। তাই প্লিজ আমাকে একা ছেড়ে দিন।”
এরোন অবাক হলো। সাথে দোটানায়ও পরে গেল। কারণ মিহি রাগের বশে এসব বলছে নাকি সত্যিই!
মিহি চোখের জল মুছলো। কিন্তু মোছার সাথে সাথে চোখের জল আবার গাল ভিজিয়ে ফেলল।
মিহি গাড়ির দরজা খোলার জন্য পুনরায় হাত দিলো। কিন্তু এবারো খোলা সম্ভব হলো না।
দরজা এরোন লক করেছে এমনটা বুঝতে পেরে মিহি ক্ষোভের সাথে বলে উঠল, “কি চাচ্ছেন আপনি?”
“তোমাকে আমি এখানে রেখে যাব না।”
“এত বার বলার পরেও কেন এমন করছেন! কেন বুঝতে চাইছেন না যে আমি আপনাকে ভালোবাসি না।”
মুহুর্তেই এরোনের মুখে প্রবল রাগ এসে ভিড়লো।মিহি হালকা ভয় পেলে মিহি। কারণ এই ছেলে রেগে গেলে অনেক বিপদজনক হয়ে যায়। এজন্যই এসব রাজনীতি করা ছেলে ওর পছন্দ না। বিয়ের পরে এরা কথায় কথায় গায়েও হাত তুলবে। এ বিষয়ে মিহির কোনো সন্দেহ নেই।
এরোন গাড়ির চাবি ঘুরালো।
মিহি আতংকিত চোখে তাকিয়ে বলল, “কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?”
এরোন উওর না দিয়ে শুধু একপলক তাকালো।
মিহির গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেতে লাগল। কারণ এরোন এখম ওকে তুলে নিয়ে গিয়ে কিছু করলেও কেউ ওকে বাঁচাতে পারবে না।
এমন ভয়ের জন্য এতদিন সত্যিটাও বলতে পারেনি মিহি। নাটক করে গেছে। কারণ সত্যি বললেই ত এরা তুলে নিয়ে গিয়ে একটা মেয়ের জীবন শেষ করে দেয়।
যত্তসব রেপ কেস গুলাতে ত এসব ছেলেদেরই নাম থাকে। মেয়েরা রাজি না হলেই ব্যাস শেষ। আর তার উপর ত রাজনীতি করে বলে দুই সেকেন্ডে কেস ক্লোজড। সর্বনাশ ত মেয়েটারই হয়।
এগুলো থেকেই পালানোর জন্য মিহি কত কি করলো। মেশ ছাড়লো, ভার্সিটি ছাড়লো। কিন্তু শেষ অব্দি কি হলো?
বাবাকে কত বড় কষ্ট দিয়ে ফেলল। তাছাড়া এখন রিজুর সাথে বিয়েটাও ভেঙে যাবে। ফলে পুরো পরিবারের সম্মানও নষ্ট হবে। আশেপাশের মানুষেরা আবার কথা শোনাবে।
তমার কথা শোনার মত ভুল করে আজ সত্যিই অনেক আফসোস হচ্ছে মিহির।
এখন এসবের পরিনতির কথা ভেবেই কেঁদে ফেলল মিহি।
এরোন দাতেদাত চিপে বলতে লাগল, “কাদো কাদো। যত ইচ্ছা কাঁদো। কিন্তু কান্না সব একবারে কাঁদলে হবে? সবে ত নিয়ে যাচ্ছি! এখনো মেহেন্দি বাকি, গায়ে হলুদ বাকি, বিয়ে বাকি, রিসিপশন বাকি, ফুলসজ্জা বাকি, বৌভাত বাকি, হানিমুন বাকি। তাই চোখের জল জমিয়ে রাখো কিছু।”
শুনেই মিহি চমকে উঠল।
মিহি আবার দরজা খোলার জন্য বৃথা চেষ্টা করতে লাগল। যদিও দরজা লক করা। তাও অস্থির হয়ে উঠল দরজা খোলার জন্য।
ওর এমন কাজ দেখে এরোন আরোই রেগে গেল।
মিহির সিটের পাশে একটা বারি দিয়ে বলল, “what’s your problem? হ্যা? এমন কেন করছ?”
মিহি এবার ভয়ে নাকমুখ কুচকে বন্ধ করে নিলো। এরোন বিরক্ত হয়ে সরে এসে নিজের সিটে হেলান দিয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে লাগল। ও সহজ ভাবেই সব মিটাতে চাচ্ছে। কিন্তু হয়ে উঠছেই না।
এরোনের বিশ্বাসই হচ্ছে না যে মিহি সত্যিই ওকে ভালোবাসে না। সাথে বিয়েতে রাজি হবার বিষয়টাও এরোন সহ্য করতে পারছে না। তার উপর অন্য কাউকে ভালোবাসার কথাও নির্দ্বিধায় বলছে।
এদিকে মিহি ত আগের চেয়ে আরো বেশি ভয় পাচ্ছে এরোনকে।
এরোন একটা নিঃশ্বাস ফেলে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
“কো…কোথায় নিয়ে যাবেন আমাকে?” ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে বলল মিহি।
“কোর্টে।” সামনের দিকে তাকিয়ে থমথমে গলায় উওর দিল।
“ক…কোর্টে কেনো?” হতবিহ্বল হয়ে পরলো মিহি।
“প্রেম করবা আমার সাথে, বিয়ে করবা অন্যকারো সাথে, আর আমি বসে বসে চান্না মেরেয়া মেরেয়া গান করবো? লাইক সিরিয়াসলি?” রেগে কড়া চোখের চাহনির সাথে বলল এরোন।
“ম…মানে?”
“বিয়ে করবো তোমাকে। আজই আর এখনি।” সামনেএ দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখে থমথমে গলায় বলল এরোন।
এটা শুনে যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো মিহির।
“অসম্ভব। আমি কোনোদিনো করবো না।” বলে উঠল মিহি।
মেজাজটা যেন এবার আরো বিগড়ে গেল ওর। তাও দাতেদাত চিপে শান্ত ভঙ্গিতে সামনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, “কেনো?”
“আমি ত বার বার কারণ বলছি আপনাকে।” অস্থির হয়ে বলল মিহি।
“বলেছিনা, তোমার পরিবারকে মানানোর দায়িত্ব আমার? এখন চুপচাপ আমি যেটা চাইবো সেটাই করবা তুমি।” কঠোর গলায় বলল এরোন।
“আমার পরিবার মানবে না। আর মানলেও আমি আপনাকে বিয়ে করব না। কারণ আমি আপনাকে ভালোবাসি না।” একটানা কথাগুলো বলে ফেলল মিহি।
কথাগুলো কর্ণগোচর হবার মুহুর্তেই এরোন জোড়ে গাড়ির ব্রেক কষে দিলো।
মিহি প্রায় অনেকখানিই সামনে ঝুঁকে পরলো। কারণ কারণ সিট বেল্ট বাধা ছিল না, আরেকটু হলেই ওর কপালে লেগে যেত।
মিহি রেগে এরোনের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গিয়েও পারলো না বলতে।
কারণ এরোনের মুখাবয়ব দেখে সে নিজেই ভড়কে গেল।
“কি বললা তুমি মাত্র?”
“দে..দেখুন আমি ইচ্ছে করে করিনি। আসলে একটা ভুল বুঝাবুঝি হবার জন্য আপনার মনে হয়েছে। আমি সেদিন…।”
“কি ভুল ছিলো?” মিহিকে থামিয়ে দিয়ে তিক্ত গলায় বলল এরোন।
তারপর কটমট চাহনির সাথে বলল, “এতদিন ত তেমন কিছুই মনে হয়নি? ফোনে কথা বলছো, দেখা করেছো, এমনকি জিজ্ঞেস করেছিলাম কবে থেকে পছন্দ করো তখনও তুমি না করো নি!”
মিহি একটু দমে গেল। কারণ সত্যিই ত নাটক করেছে সে ভালোবাসার। যদিও ভয়ে। কিন্তু এখন কি করে বুঝাবে এরোনকে! তমাকে ফাঁসালে তমাও বিপদে পরবে। সব গোলমেলে লাগছে মিহির।
তাও সাহস যুগিয়ে বলল, “ওগুলো মিথ্যা ছিল। মোট কথা আমি ভালোবাসিনা আপনাকে। এজন্য বাসা থেকে বিয়েটাও মেনে নিয়েছি আমি। এখন প্লিজ দয়া করে ঝামেলার সৃষ্টি করবেন না। আমি কোনোদিনো আপনাকে স্বামী বলে মেনে নিতে পারবো না।”
বলেই মিহি উওরের জন্য চাতক পাখির মত এরোনের দিকে তাকিয়ে রইল। মিহি ঠিক করলো, এরোন যত রাগ হয় হোক। তাও এসবের আজ একটা বিহিত করবে ও। এসব থেকে মুক্তি চাই ওর।
কিন্তু মিহির ভাবনায় জল ফেলে দিয়ে এরোন বাঁকা হাসি সমেত ওর দিকে তাকালো। যদিও তার মেজাজ বিঘড়ে আছে তাও হাসছে!
মিহি ভ্রুকুটি করে বুঝতে চেষ্টা করতে লাগল।
এরোন আবার গাড়ি স্টার্ট দিলো। সাথে সাথে মিহি চমকে গেল। এখন যদি রেগে গিয়ে ওকে কোথাও নিয়ে গিয়ে ওর সাথে আজেবাজে কিছু করে ফেলে! এই চিন্তাতেই শুকিয়ে কাঠকাঠ হয়ে গেল মিহি।
“কো…কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?” শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করল মিহি।
“কোর্টে। আমার সাথে মিথ্যা নাটক করা! এখন আমি যতগুলো মিথ্যা কেসে তোমাকে জেলে ঢুকাবো তুমি সারাজীবনও বের হতে পারবা না।”
মিহি শিউরে উঠল। ও ভুলেই গিয়েছিল যে এই ছেলে রাজনীতি করে। না জানি কি না কি করে বসে!
কিন্তু সত্যিই কেস করবে নাকি? তাছাড়া এমন কোনো আইন আছে নাকি যাতে প্রেমে ধোঁকা দিলে জেল হয়?
“অপশন দুইটা। চয়েজ তোমার। হয় বিয়ে করবা নাহলে জেলে যাবা।” ধ্বংসাত্মক ভঙ্গিমায় একপলক মিহির দিকে তাকিয়ে বলল এরোন।
মিহি বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। কারণ এর মধ্যে একটা অপশনও ওর পছন্দের না। দুটোই জীবন শেষ করার মত অপশন।
“তোমার সাহস কি করে হয় আমার ফিলিংস নিয়ে খেলার! Now just wait and see, আমি কি করি!” দাঁতে দাঁত চিপে বলল এরোন।
মিহি ভয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। কি করবে এখন! মাথায় ত কিছুই আসছে না।
কাঁদতে কাঁদতে চোখের জলও শুকিয়ে এসেছে।
চোখের সামনে নিজের দিদির সাথে যা হয়েছে তা নিজের সাথে ঘটতে দেখতে চায় না মিহি। অকালে ডিভোর্সি টাইটেল পেতে হবে তাহলে। কারণ এসব ছেলেরা কোনোদিনো ভালো হতেই পারেনা। অসম্ভব।
এদিকে বাড়ির দরজাও চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে।
অন্যদিকে জেলে যেতেও চায় না মিহি।
আজ ওর নিজেকে অনেক বেশিই অসহায় লাগছে।
(চলবে…)