মোহ_মায়া #সানজিদা_বিনতে_সফি #পর্ব_৮

0
410

#মোহ_মায়া
#সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_৮

পুরো চেয়ারম্যান বাড়ি স্তব্ধ হয়ে আছে।মাঝে মাঝে মিসেস মাহতাবের আহাজারিতে পরিবেশ ভাড়ি হয়ে উঠছে।
একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে পাগল প্রায় সম্রাটের মা। তার আদরের সন্তান তাকে ছেড়ে চলে গেছে এটা তিনি কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছেন না।

কিছুক্ষণ আগে,,,,,

ঢাকা থেকে বাড়িতে ফিরছে সম্রাট। তার পাশেই ড্রাইভ করছে ইসহাক। পিছনে সুমন, তায়েফ সহ ওদের আরো কিছু বন্ধু।সম্রাটের অবস্থা খুব একটা ভালো না। তখন কান্না করলেও এখন সে খুব একটা কথা বলছে না।চোখ দুটো রক্তিম আকার ধারন করেছে। মনে হচ্ছে এখুনি বুঝি বুকের রক্তক্ষরণ চোখ থেকে বেরিয়ে আসবে।

গ্রামের বাড়িতে পৌছাতে পৌছাতে বিকেল ৩টা বেজে গেলো। গাড়ি গেট দিয়ে ঠুকতেই অস্থির হয়ে গেল সম্রাট। পাগলের মতো মাথার চুল খামছে ধরলো। সম্রাটের অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেল বাকিরা।সুমন অস্থির হয়ে গাড়ি থেকে নেমে সম্রাটকে জাপটে ধরলো।

– নিজেকে সামলা ভাই।পাগলামি করিস না।তুই এমন করলে আংকেল আন্টিকে কে সামলাবে বল তো।
সম্রাটকে কথা গুলো বললেও নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলো না সুমন। ডুকরে কেঁদে উঠলো। দারোয়ান মফিজ মিয়া ওদের এই অবস্থায় দেখে ঘাবড়ে গেল। তবু্ও নিজের জায়গায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।

– আমি বাবা মা কে কি জবাব দিবো?আমি তাদের কথা দিয়েছিলাম, আমি পুতুলকে তাদের কাছে সহিসালামত ফিরিয়ে আনবো।আমি তদের কিভাবে বলবো আমার পুতুল আর নেই। ওরা ওকে বাচতে দেয় নি। নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে আমার কলিজা কে।জানোয়ার গুলো আমার বোন কে কতটা কষ্ট দিয়ে মেরেছে। আমরা কেউ ছিলাম না ওর পাশে। ও হয়তো আমাদের চিৎকার করে ডেকেছে। বারবার বাবা, ভাই বলে ডেকেছে।কিন্তু আমাদের কাওকে পায় নি। কতটা অসহায় লেগেছিল ওর কাছে!আমি কেমন ভাই হলাম! আমি আমার বোন কে জানোয়ার দের হাত থেকে বাচাতে পারলাম না।

কথা গুলো বলতে বলতে পাগলের মতো আচরণ করছে সম্রাট।নিজের বোনকে সে কতটা ভালবাসে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

কোন রকম তাকে সামলে বাসার ভিতরে নিয়ে এলো সুমন। বাকিরা ও ওদের অনুসরণ করলো।

সম্রাটকে আসতে দেখেই মিসেস মাহতাব ছুটে এলেন। অস্থির হয়ে বললেন,

– সাফা কে পেয়েছিস আব্বু! আমার মেয়ে কোথায় আছে?ও সুস্থ আছে তো?ওকে বাড়িতে চলে আসতে বল।আর বিদেশ পড়া লাগবে না। কি হলো, কথা বলছিস না কেন?আমার মেয়ে কোথায়?

শেষের কথা টা চিৎকার করে বলাতে সম্রাট অশ্রু সিক্ত চোখে মায়ের দিকে তাকালো। মেয়ের জন্য পাগল হয়ে যাওয়া এই মাকে সে কিভাবে বলবে তার মেয়েকে ওই জানোয়ার গুলো মেরে ফেলেছে। তার মেয়ে আর কোন দিন তাকে মা বলে ডাকবে না।কোন দিন তাকে জরিয়ে ধরবে না।তার হাতে খাওয়ার বায়না করবে না। তার কোলে মাথা রেখে ঘুমাবে না।
কথা গুলো ভাবতেই মায়ের পায়ের কাছে ফ্লোরে হাটু ভেঙে বসে পরল সম্রাট।ছেলের এই বিধ্বস্ত রুপ দেখে বুক মোচড় দিয়ে উঠলো তার।তার মন বলছে তার মেয়ের সাথে খুব খারাপ কিছু একটা হয়েছে।

– কি হয়েছে সাফার?ও ঠিক আছে তো?

কাপাকাপা গলায় মায়ের প্রশ্ন শুনেই ডুকরে কেঁদে উঠলো সম্রাট।

– আংকেল, আমি আপনাদের প্যারিস যাওয়ার ব্যাবস্থা করছি।আপনারা দুই একদিনের মধ্যে প্যারিস যাচ্ছেন।

মাথা নিচু করে বললো সুমন।

এতক্ষণ সোফায় চুপ করে বসে ছিলেন সাইফ সাহেব। সুমনের কথায় মাথা তুলে তাকালেন।সাথে সাথেই দুই চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পরল।কিছুক্ষন আগে যুবরাজ কল করে জানিয়েছে তাকে।ছেলে ওখানে বোনের এই অবস্থা দেখে সাথে সাথেই অজ্ঞান হয়ে গেছে। সাফার লাশ অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। পুলিশ ওখানে কাওকে পায় নি। তবে তারা খুব তারাতাড়ি সমস্ত অপরাধী কে ধরে ফেলবে। ছেলের চিৎকার করে কান্না এখনো তার কানে বাজছে।

ছেলে আর স্বামীর এমন নিরবতা কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না যুথি বেগম (সম্রাটের মা)
চিৎকার করে জানতে চাইলেন,

– আমার সাফা কোথায়? কি হয়েছে ওর?অন্তত এটা বলো আমার মেয়ে বেচে আছে! (চিৎকার করে কান্না করে)

– ও আমাদের ছেড়ে চলে গেছে যুথি।আমাদের মেয়ে আমাদের একা করে চলে গেছে। মরে গেছে তোমার মেয়ে।

সাইফ সাহেব কান্না করে কথা গুলো বলতেই যুথি বেগম স্থির হয়ে গেলো। চোখের পলক ফেলতেও যেন ভুলে গেছেন। ফ্লোরে লুটিয়ে পরতেই সম্রাট তাকে আগলে নিলো।

বর্তমানে,,,,

কালকে নারায়ণগঞ্জ পৌছে আজকেই আবার বাড়িতে চলে আসতে হবে তা ঘুনাক্ষরে ও টের পায়নি আমি।কিছুক্ষণ আগে ওহিদ কল করে সাফার ব্যাপারে বলেছে।মাত্র কয়েক বছর আগে সাফা আপু প্যারিস শিফট করেন।আর কয়েক মাস পরেই তার পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে আসতো। তার আগেই কি হয়ে গেলো। যদিও কি ভাবে মারা গিয়েছে তা এখনো জানি না আমি। কিছুক্ষণ আগেই তারাহুরো করে বের হয়েছি।সম্রাটের মুখোমুখি হতে চাইছিলাম না।কিন্তু এতো তারাতাড়ি আবার আমাদের দেখা হবে ভাবতেই পারি নি।তবে খুব খারাপ লাগছে তার জন্য। লোকটা বোন বলতে পাগল। না জানি এখন কি অবস্থা তার!

———————-

হসপিটালের বারান্দায় নিস্তেজ হয়ে বসে আছে সুমন। কিছুক্ষন আগে যুথি বেগমকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। ডক্টর বলেছেন হার্ট অ্যাটাক করেছেন তিনি। সম্রাট এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। বিপদ যেন ছারতেই চাইছে না।বোনের শোক ভুলে এখন মা কে সুস্থ করায় লেগে গেছে।

– আংকেল আপনি বাসায় গিয়ে রেস্ট করুন।কিছুক্ষন ঘুমান।কাল থেকে আপনি খাওয়া ঘুম ছেরে দিয়েছেন।

– যার মেয়ে লাশ হয়ে ভিনদেশে পড়ে আছে সে কিভাবে খাবে, কিভাবে ঘুমাবে বলতে পারো সুমন? আমার কিছু হবে না। চিন্তা করো না। এখনো মেয়ের মরা মুখ দেখা বাকি,তাকে খাটিয়ায় করে কাধে নেয়া বাকি,তাকে অন্ধকার কবরে দাফন করা বাকি।এতো সহজে ভেঙে পরলে চলবে বলো?

সুমন আর কিছু বলতে পারলো না। নিশ্বব্দে চলে গেলো। বারান্দা পেরিয়ে করিডোরে আসতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো। তার কান্না যে কাওকে দেখানো যাবে না।সে যে একতরফা ব্যার্থ প্রেমিক। সে আপন মনে বিরবিরালো,

– একটা বার ভালবাসি বলার সুজোগটা তো দিতে প্রেয়সী। এই আক্ষেপ যে এই জীবনে মুছবে না! আমার এতো ভালবাসা যে আমি শুধু তোমার জন্য তুলে রেখেছিলাম। সাত বছরের অপেক্ষা এভাবেই শেষ হওয়ার ছিল? এই দেখো তুমি নেই ভাবতেই আমার শ্বাস কিভাবে আটকে আসছে।আমি কি করে বাচবো জান!

ইসহাক দূর থেকে তার প্রিয় বন্ধুদের হাহাকার দেখছে। তাদের এখন শুধু সাফা নামক মানবিকে প্রয়োজন। কিন্তু সে তো নেই।শুধু একটাই দুয়া,আল্লাহ সবাইকে ধৈর্য ধরার তৌফিক দিক।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here