#মোহ_মায়া
#সানজিদা_বিনতে_সফি
#শেষ_পর্ব
সময় প্রবাহমান। দেখতে দেখতে কেটে গেছে ৫ বছর।
আদু, আদুসোনা,ওই ছেমরি। আদওয়া কে ডাকতে ডাকতে বিরক্ত হয়ে নাক মুখ কুচকে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে সম্রাট। মেয়েটা ইদানীং ওকে টোটাল পাত্তা দিচ্ছে না। আগে দেখলেই ভয়ে কাপতো।আর এখন উল্টো তাকেই ভয়ের মধ্যে রাখে সারাক্ষণ। একটু এদিকে থেকে ওদিক হলেই বাবার বাড়ি যাওয়ার হুমকি দেয়।নিজে গেলে তবুও মানা যায়।সাথে করে মেয়ে টাকে ও নিয়ে যায়। সব জেনে বুঝেই এমন করে ফাজিল মেয়ে। জানে যে ওদের ছাড়া থাকতে পারে না তাই এই ভয় দেখায় সারাক্ষণ।
— আদু তুই কি আসবি নাকি আমার আসতে হবে।
দাতে দাত চেপে কথাটা বলতেই আদওয়া রুমে হাজির হলো। সম্রাটের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
— এভাবে চেচাচ্ছেন কেন।আপনারা বাপ মেয়ে আমাকে এক মিনিট শান্তিতে থাকতে দেন না।একটু আগেই তো সব কিছু ঠিক করে দিয়ে গেলাম।
— আরে আমি কি করলাম! (অবাক হয়ে)
— নাহ কিছুই করেন নি।এইবার বলেন ডেকেছেন কেন?
— একটা মাত্র বউ তুই আমার। তোকে না ডেকে কাকে ডাকবো জান।আয় একটা চুমু খাই।
— ছিঃ।কথার কি ছিড়ি।সরেন, দূরে সরেন।
আদওয়ার কথায় নাক মুখ কুচকে ফেললো সম্রাট। চেহারায় দুঃখী দুঃখী ভাব এনে বললো,
— আজ একটা রোমান্টিক বউ নেই বলে আমার চুমু খাওয়া হলো না। তবে আমার ও একদিন রোমান্টিক বউ হবে। তাকে আমি সঙ্গে সকাল বিকাল চুমু খাবো।তখন তুই আমাদের দেখে জ্বলে পুড়ে কাবাব হবি নিষ্ঠুর মহিলা।
সম্রাটের কথা শুনে চোয়াল ঝুলে গেলো আমার। কি সব কথা বলছেন উনি।আরেকটা বিয়ে করবে মানে!আমি ওনার দিকে কটমট করে তাকাতেই উনি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে রেডি হতে লাগলো।
— কি বললেন আপনি?
— কি বলেছি?(না জানার ভান করে)
— আরেক টা বিয়ে করবেন বলেছেন এইমাত্র।
— হ্যা তো?তুই তো আর চুমু খেতে দিবি না।তাই আরেক টা বিয়ে তো করতেই হবে। আমার চুমু আমি কিছুতেই ওয়েস্ট হতে দিবো না। না মানে না।
— তা তো ঠিক আছে। কিন্তু আপনাকে কে বিয়ে করবে।(চিন্তিত হয়ে)
— কে বিয়ে করবে মানে!আমাকে বিয়ে করার মানুষের অভাব আছে নাকি।একবার বললেই মেয়েদের লাইন লেগে যাবে।
— আচ্ছা ঠিক আছে। করেন বিয়ে আপনি। আমি আমার মেয়ে কে নিয়ে বাবার কাছে চলে যাচ্ছি। থাকবো না আর এখানে।এখন তো আমি পুরোনো হয়ে গেছি। আমাকে ভালো লাগবে কেন।
আদওয়ার কথা শুনে ওর কোমড় জরিয়ে ধরলো সম্রাট।নাকে আলতো চুমু খেয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।
— ছেড়ে যাওয়ার কথা বললে মেরে ফেলবো একদম। ভালোবাসি তো আদু সোনা।
তোমরা কি করছো বাবাই?
সাঈদার কথা শুনে আদওয়া কে ছেড়ে দিলো সম্রাট। মেয়ে টা সব সময় রোমান্সের মধ্যে ঢুকে পরে।
সম্রাট সাঈদা কে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে শুরু করলো। মেয়ের প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার মোক্ষম উপায় এটা।
— তারাতাড়ি খেতে আসেন।অফিসে লেট হচ্ছে।
আদওয়ার কথা শুনে সম্রাট সাঈদা কে কোলে নিয়েই ডাইনিং এর দিকে এগিয়ে গেলো।
টেবিলে সম্রাটের বাবা মা দুই জন ই উপস্থিত ছিল।বাবা মা কে দেখে মুচকি হেসে ব্রেকফাস্ট করতে বসে পরলো সম্রাট।
— বাবা আমরা কিছু দিনের মধ্যেই ঢাকা সিফট করছি।এখান থেকে অফিসে যেতে অনেক লেট হয়ে যায়। আর সব দিক থেকে বিবেচনা করলে আমাদের ঢাকা থাকাটাই বেটার অপশন। তাহলে কেউ আর ঘনঘন বাবার বাড়ি যাওয়ার হুমকি দিতে পারবে না।
শেষের কথা টা আদওয়ার দিকে তাকিয়ে বললো সম্রাট। আদওয়া কটমট করে তাকিয়ে আছে সম্রাটের দিকে।
সম্রাটের কথা শুনে জোরেই হেসে ফেললো সম্রাটের বাবা। আদওয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
— দেখেছিস তো এবার।আর যাবি ঘনঘন বাবার বাড়ি?
— তোমার ছেলে কে বলে দাও,আমি কোথাও যাচ্ছি না।
— সেটা সময় হলেই দেখা যাবে।
সম্রাট ব্রেকফাস্ট শেষ করে মেয়ের মাথায় চুমু খেয়ে সবাই কে বলে বেড়িয়ে গেল।
সম্রাটের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আদওয়া।
ওদের এক হওয়া টা মোটেও সহজ ছিলো না। অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে।
অতীত,
হাসপাতাল থেকে রিলিজের পর বিয়ের জন্য হুলুস্থুল শুরু করে সম্রাট। আর কোন কিছু তেই বিয়ে পিছানো যাবে না। একের পর এক ঝামেলা লেগেই আছে। সম্রাটের অস্থিরতা দেখে যুবরাজ হতাশ হয়ে বললো,
— তোর বড় ভাই এখনো বিয়ে করে নি আর তুই বিয়ের জন্য পাগল হয়ে গেছিস!বড় ভাইয়ের কথা টাও একটু ভাব ভাই।
— বিয়ে করবা এটা সরাসরি বললেই তো হয় ভাই।অযথা আমার বিয়ের ভিলেন কেন হচ্ছ বলো তো। পছন্দের কেউ থাকলে বলো। দুই ভাই এক দিনেই শুভ কাজটা সেরে ফেলবো।
— থাক ভাই।তোকে আর আমার বিয়ে নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি এভাবেই ভালো আছি।তুই একাই তোর শুভ কাজ সেরে ফেল।
দুই ভাইয়ের কথা শুনে সায়েম ফোড়ন কেটে বললো,
— বিয়া যে কত্ত মজা গো,,,খালি খাওন আর খাওন।
সায়েমের কথা শুনে সবাই হু হা করে হেসে উঠলো। সবার মুখে হাসি থাকলে ও ইসহাকের মুখে হাসি নেই।আজ তানির সেই কথা টা খুব মনে পরছে।
‘একদিন এই নোংরা হাত ধরার জন্য আপনি মরিয়া হয়ে উঠবেন কিন্তু ধরার জন্য আর এই হাতটা পাবেন না ‘
কথাটা মনে হতেই ইসহাক চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো। আজ তার মনের হাত দুটো খুব শক্ত করে ধরতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে পারছে না। এটা ঠিক সে তানিয়া কে তখন ভালোবাসে নি।তানিয়ার সাথে শেষবার দেখা হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই অজানা শুন্যতা ঘিরে ধরে তাকে। আস্তে আস্তে বুঝতে পারে এই বাচাল মেয়ের মায়ায় জড়িয়ে গেছে সে।কিন্তু মানতে নারাজ। অনুভুতি গুলো প্রবল হতেই সে দিশেহারা হয়ে গেলো। ঠিক তখনই বনানী তাকে প্রপোজ করলে সাথে সাথেই এক্সেপ্ট করে নেয় সে।বনানী সম্পর্কে চাচাতো বোন হয় তার।একসাথে ছোট থেকে বড় হওয়া।কিশোরী বয়স থেকেই যুবরাজ কে পাগলের মতো ভালোবেসে এসেছে।কিন্তু বরাবরের মতো যুবরাজ তাকে এড়িয়ে গেছে।তাই ইসহাকের সাথে প্রেমের অভিনয় করে প্রেমিক পুরুষকে জ্বালানোর সুপ্ত বাসনা নিয়েই এতো কিছু করেছে সে।কিন্তু ফলাফল শুন্য। যুবরাজ তবুও তাকে পাত্তা দিচ্ছে না। তার জ্বালানো হিংসার আগুন যুবরাজ যেন ফু দিয়ে নিভিয়ে দিচ্ছে। এসব কিছু ভাবতে ভাবতে বনানীর দিকে তাকাতেই দেখলো বনানী যুবরাজের দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে।
ইসহাক মুচকি হাসলো। নিজের বিষাদ ঢাকতেই আবার চোখ বন্ধ করে নিলো।
🌸
অনেকটা ঘরোয়া পরিবেশেই আদওয়া আর সম্রাটের বিয়েটা হয়ে গেলো। তৌহিদ ভাইয়ের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে। ওহিদ সবার সাথে হাসি তামাসা করলেও ওর চোখের কোনে জমা অশ্রু ঠিকই সব বন্ধুদের নজরে পরেছে। ওহিদের কথা চিন্তা করে সবাই মনমরা হয়ে গেলো।
সম্রাট অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার প্রেয়সীর দিকে। হালকা গোলাপি লেহাঙায় অবর্ননীয় সুন্দর লাগছে তাকে।আদওয়া লজ্জায় কারোর দিকে তাকাতে পারছে না। সম্রাটের উপর রাগ হচ্ছে তার। লোকটা নির্লজ্জের মতো বিয়ে করবো বিয়ে করবো বলে সবার মাথা খেয়ে ফেলেছে এইকদিন।অবশেষে সবাই বাধ্য হয়ে কক্সবাজারেই তাদের বিয়ের আয়োজন করে ফেলেছে।সম্রাটের বাবা উপস্থিত হতে না পারলেও জুথি বেগম ঠিকই চলে এসেছে ছেলের বিয়েতে সামিল হতে।
তানিয়া, প্রিয়া ও ঠিক আদওয়ার মতো করেই সেজেছে। দেখে মনে হচ্ছে তিনটা বউ ঘুরে বেড়াচ্ছে। সম্রাটের মতো ইসহাক ও ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। তবে তানিয়া তাকে মোটেও পাত্তা দিচ্ছে না। বনানী তো একটু পর পরই কটমট করে তাকাচ্ছে যুবরাজের দিকে। যুবরাজ সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলছে আর একটু পর পর বনানীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে।যুবরাজের মুচকি হাসি দেখে নিজের রাগ ভুলে লজ্জায় নুয়ে পড়লো সায়েমের উপর। সায়েম আর্তনাদ করে উঠলো। বনানী কে ধাক্কা দিয়ে সরাতে সরাতে বললো,
— আল্লাহ গো,,,আমি এহনো বিয়া করি নাই মুটি।সর সর।তোর মতো হাতির নিচে পড়লে আমার আর বাপ ডাক শোনা লাগবো না। সব ভর্তা হইয়া গেলো ছেমরি।
সায়েমের কথা শুনে মুহুর্তেই লজ্জা ভাব সরে গিয়ে রিনা খান লুক নিয়ে তাকালো বনানী। সায়েম বোকা হেসে উঠতেই কয়েক ঘা পড়লো তার পিঠে।
ওদের কান্ড দেখে যুবরাজ মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেলো অন্যদিকে। যুবরাজ চলে যেতেই বনানীর মুখটা কাদো কাদো হয়ে গেলো।
সম্রাটের ফোনে কল আসতেই সম্রাট একটু দূরে গিয়ে রিসিভ করলো,
— হ্যালো।
— স্যার কাম হইয়া গেছে। এহন কি করমু?
— মাঝ সাগরে ফেলে দে।
— আইচ্ছা।
ফোন কেটে বাকা হাসলো সম্রাট। সুযোগ পেয়ে তা কাজে না লাগালে পরিনাম ভয়ংকর তো হবেই।
যুবরাজ সম্রাটের কাধে হাত রেখে বললো,
— ওদিকে সব ঠিক আছে?
— হুম ভাই।
— নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা ভাই আমার।
সম্রাট যুবরাজ কে জড়িয়ে ধরলো। ভাইয়ের খুশি দেখে যুবরাজ সস্তির নিশ্বাস নিলো।
🌸
আধঘন্টা ধরে বাসর ঘরে বসে আছে আদওয়া।সারাদিনের ব্যস্ততায় এখন খুব ক্লান্ত লাগছে।ঘুম ঘুম চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে খাটের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো সে।
রাত দেড়টার দিকে রুমে আসলো সম্রাট।এমনি এমনি আসতে পারে নি।তার জন্য মোটা অংকের পেমেন্ট করতে হয়েছে।ঘুমন্ত আদওয়ার দিকে তাকিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো সম্রাট।
দশ মিনিট পরে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আদওয়ার সামনে এসে দাড়ালো। প্রেয়সীর মুখের দিকে তাকিয়ে আনমনে ভাবলো,
— কতো সাধনার রাত এভাবে ঘুমিয়ে কাটাচ্ছে আমার বউ।বউ শব্দটা মনে মনে কয়েক বার আওরালো সে।মুচকি হেসে প্রেয়সীকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরলো।আজ রাত না হয় পুর্নতা নিয়ে জেগেই কাটিয়ে দিবে।
🌸
ইসহাকের দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে আছে তানিয়া। পারলে এখনি গুলি মেরে খুলি উরিয়ে দিত।
— রাত বিরাতের নাটক শেষ হলে আমি কি যেতে পারি?(দাতে দাত চেপে)
তানিয়ার কথা শুনে অসহায় চোখে তাকালো ইসহাক।
— আমাকে ক্ষমা করা যায় না মন?
— নাহ।
— প্লিজ।
— প্রাক্তন কে ক্ষমা করতে নেই।আশা করবো এমন নাটক আর ভবিষ্যতে করবেন না।
হনহন করে রুমে চলে গেলো তানিয়া।ওর যাওয়ার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো ইসহাক। দূর থেকেই তৃপ্তির হাসি হাসলো আরেকজন।
সমাপ্ত।
(গল্পটা যখন লেখা শুরু করেছিলাম তখন থিম অন্য কিছু ভেবেই শুরু করেছিলাম।কয়েক পর্ব যেতেই কয়েকজন তোপের মুখে পরতে হলো। তবু্ও খারাপ লাগেনি খুব একটা। গল্পটা এখানে শেষ করার ইচ্ছা মোটেও ছিল না। আসলে মুল গল্পই শুরু হতো এখান থেকে। সমাজের কিছু কিছু নিম্নমানের মানুষের চিন্তাধারা তুলে ধরার ইচ্ছা ছিল। অসুস্থতার জন্য তা আর হয়ে উঠলো না।১০২°জ্বর নিয়ে আজ শেষ পর্ব লিখলাম।অনেকের খারাপ লাগবে হয়তো। তবে এর পর থেকে আমি আমার গল্পের থিম আর চেঞ্জ করবো না। দয়া করে একটু ধৈর্য নিয়ে পরবেন।বাস্তব জীবন গল্পের মতো হয় না। এখানে সংগ্রাম করে বেচে থাকতে হয়।তাই স্বাভাবিক ভাবে নিবেন আশা করি। এতো দিন পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ। ভালোবাসা সবাইকে। গল্প নিয়ে দুই এক লাইন কমেন্ট করে যাবেন।সবাই নামাজ কায়েম করুন। আল্লাহ হাফেজ।)