#পারব না আমি ছাড়তে তোকে ❤❤
#লেখিকাঃ লামিয়া ইসলাম তন্নি ❤
#পর্বঃ ২৯ ❤
.
.
.
ঘরের দরজায় পা রাখতেই মনের মাঝে অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে গেল। মনে হচ্ছে ঘরে ঢুকলেই আজ কপালে দুঃখ আছে। ঘরের লাইট অফ। এখন তো ভয় আরও বেশি না জানি কই কি ফেলে রাখছে। উফহ্ আল্লাহ্ আমারে তুইলা নাও। আর ভাল্লাগে না! না চাইতেও ভয়ে ভয়ে ঘরে ঢুকে লাইটটা অন করলাম। নাহ্! কোথাও কিছু নেই তো! আমি শুধু শুধুই ভয় পাচ্ছিলাম। কিন্তু উনি তো শান্ত থাকার মানুষ নয়। তার ওপর রুমেও নেই! কাহিনী কি?
.
আমি কিছু না ভেবে শুয়ে পড়লাম। কারণ এই মুহূর্তে আমার কিচ্ছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না। শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। এখন যদি আবার মায়া দেখিয়ে ওনার খবর নিতে যাই তাহলে দেখা যাবে বাঁশটা আমিই খাব। আবার নিশ্চয়ই থাপ্পড়! নো! আর থাপ্পড় খেতে চাইনা। এর চেয়ে ভালো ঘুমিয়ে পড়ি। উনার সময় হলে নিজেই চলে আসবে। আমি আর কিছু না ভেবে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাড়ি জমালাম ঘুমের রাজ্যে!
.
🍁
.
সকাল ১০টা। বাহিরের কড়া রোদ চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল। জৈষ্ঠ্য মাসের মাঝামাঝি দিক হওয়ায় সকাল ৮টা না বাজতেই রোদের দেখা মিলে। আর এখন তো প্রায় অর্ধেক সকাল গড়িয়ে দুপুর পড়ছে। রোদ তো কড়া হবেই! আড়মোড়া দিয়ে উঠে বসলাম। আর শুয়ে থাকা যাচ্ছে না। এই মুহূর্তেই শাওয়ার নিতে হবে আমায়। কথাটা ভেবে এলোমেলো চুলগুলো হাত খোপা করতে করতে আলমারি থেকে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। শাওয়ারটা ছেড়ে দিয়ে তার নিচে বসে আছি। খুব ভালো লাগছে। এট লিস্ট ঘেমে চুপসে যাওয়া শরীরটা একটু ঠান্ডা হয়েছে।এতোক্ষণ কি অস্থিরটাই না লাগছিল।
.
প্রায় ৪০-৪৫মিনিট পর ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে চুলটা টাওয়ালে পেঁচিয়ে বিছানা থেকে ওড়নাটা নিয়ে সোজা নিচে নেমে গেলাম। সোজা গিয়ে টেবিলে বসে পড়লাম।
.
—- আম্মু! এই আম্মু! আম্মু!
.
আমাকে এভাবে চেঁচাতে দেখে আম্মু রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বেড়িয়ে এলো। আমার কাছে এসে বললেন…….
.
—- এই তোর সমস্যা কি? ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছিস কেন? আর এভাবে ডাকার কি হলো? কেউ মরেছে নাকি?
.
আমি আম্মুর কথার পাত্তা না দিয়ে বললাম…….
.
—- আম্মু! খুব ক্ষিদে পেয়েছে। প্লিজ খেতে দাও না গো!
.
—- এহ্! আসছে নবাব সাহেবা!
.
—- আমি আম্মুর দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে হুট করেই বললাম…..
.
—- আম্মু! ইউ আর রং! কারণ আমি তো মহিলা হইনি! তাহলে সাহেবা কিভাবে হলাম? আমার মতে তুমি ৩বাচ্চার মা। সো মহিলা হয়ে গেছো। ইনফেক্ট মহিলা শেষে তো বুড়িতে পা রেখেছো। সো আমার মতে তুমি হবে মেম সাহেবা আর আমি তার মেয়ে! তো দু’দিকে মেম সাহেবার মেয়ে তো নবাব শাহাজাদী হবে আম্মু !
.
আম্মু আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। হয়তো আমার কথার মানেটা বোঝার চেষ্টা করলো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেই হুট করেই টেবিল থেকে চামচটা নিয়ে আমাকে ধাওয়া করা শুরু করল। আমিও কি বোকা নাকি? আমি বসে বসে মার খাব নাকি? কিন্তু যাব কই? ভাইয়া তো বাসা নেই ? বড় আব্বুও অফিসে! এখন উপায় ? আমি দৌড়াচ্ছি আমার পিছে আম্মু দৌড়াচ্ছে আর বলছে…..
.
—- আজকে তোকে শুধু হাতে পেয়ে নিই! ফাজিল মেয়ে! কতো বড় সাহস তোর? তুই আমাকে বুড়ি বলেছিস? আজকে তোর একদিন কি আমার একদিন!
.
আম্মুর কথা শুনে আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। আম্মু বলে কি ? বুড়িকে বুড়ি বলব না তো ছুঁড়ি বলব নাকি?
.
—- আম্মু! তুমি তো বললে তোমাকে কেন বুড়ি বললাম? তাহলে কি বলব আম্মু? আমার জানামতে তো বুড়িদের বুড়িই বলে। কিশোরী না ।
.
—- আজকে তুই দাঁড়া! তোকে একবার হাতে পাই শুধু!
.
—- আমাকে তুমি পাবে না। তুমি কেন কেউই পাবে না !
.
এইটুকু বলে দৌড়ে মেইন ডোরের দিকে যেতেই হঠাৎ কোনো বড় লোহার সাথে বাড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম।
.
—- আল্লাহ্ গো! আমি মরে গেছি গো! আমারে মেরে ফেলছে গো!
.
আম্মু আমাকে পড়তে দেখে থেমে গেছে। আর ধাক্কা দেওয়া ব্যক্তি…..
.
—- এই চুপ! একদম চুপ! কিসের এতো দৌড়াদৌড়ি তোর? এতো বড় ধিঙ্গী মেয়ে! সারা বাড়ি জুড়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। লোকে দেখলে কি বলবে হ্যাঁ? এই মেয়ে নাকি আজ বাদে কাল মেডিকেলে পড়বে!
.
আমি অবাক হয়ে তার কথা শুনছি। খচ্চর ব্যাটায় বলে কি? আমি ধিঙ্গী?? ওহ্ মাই আল্লাহ্! এই খচ্চররে এতো বড় মিথ্যা কথা বলার শাস্তি দেও। এখনই দেও। ওরে এখনই এই ফ্লোরে আছার মেরে ফালাও! তুই ধিঙ্গী সালা! তোর বউ ধিঙ্গী! আমি দৌড়োলে তোর কিরে? তোর চৌদ্দ গোষ্ঠীর কি আমি দৌড়োলে? একদম মেরে নাক ফাটিয়ে দিব তোর। হুহ ! মনে মনে এতো কিছু বললে মুখে কিছুই বলতে পারলাম না।
.
—- আপনি আমায় বকছেন কেন ? আমার কি দোষ ? আপনার ছোটমাই তো আমাকে দৌড় করাচ্ছিল । এখন আবার আপনি ধাক্কা দিলেন! জানেন কতোটা ব্যথা লেগেছে ?
.
উনি কিছু বললেন না। আমাকে ডিঙিয়ে চলে গেলেন। আমার মনটাও খারাপ হয়ে গেল। ভেবেছিলাম হয়তো কোলে না তুললেও ধরে তুলে দিবে। কিন্তু তাও দিল না। আমি ওঠার চেষ্টা করতেই কোমড়ে দারুণ ব্যথার অস্তিত্ব টের পেলাম। তবুও কষ্ট করে উঠতে নিলেই কেউ একজন হেঁচকা টানে আমাকে তার বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়েই কোলে তুলে নিলেন।
.
—- একি আপনি? আপনি না রুমে চলে গেলেন?
.
উনি কিছু বললেন না। আমি আবার বললাম…..
.
—- আমাকে নামান! আমি হেটে যেতে পারব।
.
উনি এবারও কিছুই বললেন না। বরং সিঁড়ির দিকে হাঁটা দিলেন।
.
—- দেখুন! ছাড়ুন আমাকে। আম্মু দেখছে। কি ভাবছে বলুন তো!
.
উনি এবারও কোনো জবাব দিলেন না। বরং চুপচাপ আমাকে নিয়ে সিঁড়ির দিকে চলে এলেন।
.
রুমে এসে আমাকে খুব সাবধানে বিছানায় শুয়ে দিলেন। তারপর নিচে গিয়ে একটা বাটিতে করে বরফ নিয়ে এলেন।
.
—- উপুড় হয়ে শো! কোথায় ব্যথা লেগেছে বল।
.
—- কেন কি করবেন?
.
—- বেশি কথা না বলে যা বলছি তাই কর।
.
—- আমার কিছু লাগবে না। এমনিতেই সেড়ে যাবে।
.
—- উপুড় হবি কিনা?
.
আমি আর কথা বাড়ালাম না। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম। কারণ কথা বাড়ালেই আবার রেগে যেতেন। দেখে তো মনে হচ্ছে আগে থেকেই রেগে আছেন। কিছু হয়েছে নাকি কে জানে? আমিও জিজ্ঞেস করতে পারব না। পরে না আবার চড় খাই! আমার ভাবনার মাঝেই বলে উঠলেন…..
.
—- সকালে খেয়েছিস?
.
আমি কিছু বললাম না। কারণ না বললেই শুরু হবে বকবক!
.
আমার কোনো জবাব না পেয়ে উনি আবার বললেন…….
.
—- কিছু জিজ্ঞেস করেছি?
.
আমি এখনও চুপ করে আছি। এবার উনি আমাকে চুপ থাকতে দেখে বেডের পাশে ছোট টেবিলে লাথি দিয়ে চিৎকার করে বললেন…..
.
—- ড্যাম ইট!
.
উনি জোড়ে শ্বাস টেনে নি বললেন…..
.
—- কি বলছি শুনতে পাস নি? একটা কথা এতোবার কেন জিজ্ঞেস করতে হয় তোকে? হোয়াই?
.
আম্মু আর বড় আম্মু দৌড়ে এসেছেন। উনাদের আসতে দেখে আমি অনেক কষ্টে উঠে বসলাম।
.
—- কি হয়েছে সূর্য? এভাবে চিৎকার করলি কেন?
.
—- মা ওকে জিজ্ঞেস করো তো ওকে একটা কথা আমি কতোবার জিজ্ঞেস করেছি! কি হলো জিজ্ঞেস করো?
.
বড় আম্মু এবার আমার দিকে এগিয়ে এলেন। মাথায় হাত রেখে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন…..
.
—- আম্মু! কি হয়েছে বলতো? ঐ ফাজিলটা বলবেনা তুই বল!
.
আমি এবার ভয়ে ভয়ে সূর্যর দিকে তাকালাম। আমার তো ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। যেমন খচ্চর একটা না জানি সবার সামনেই মারধোর শুর করে।
.
আমাকে চুপ থাকতে দেখে বড় আম্মু বললেন…..
.
—- ভয় পাস না মা! আমি আচি তো! বল কি হয়েছে?
.
আমি শুকনো একটা ঢোক গিলে আবার তাকালাম উনার দিকে। উনার দিকে তাকাতেই আমার জান বেড়িয়ে আসার উপক্রম। দেখে মনে হচ্ছে পারছেনা যে চোখ দিয়েই গিলে খাচ্ছে। হঠাৎই মাথায় এক বদ বুদ্ধি খেলে গেল। আমি সাথে সাথে উনার থেকে চোখ সড়িয়ে নিয়ে বড় আম্মুর দিকে তাকালাম।
.
—- বড় আম্মু! তোমার ছেলে খুব ভালো পঁচা । আমাকে কথায় কথায় বকে। মাঝে মাঝে তো মারেও। একটুও আদর করে না।
.
মেডিসিনে বোধহয় কাজ হয়েছে। বড় আম্মু সাথে সাথে চোখ লাল করে সূর্যর দিকে তাকালো।
.
—- আলো কি সব সত্যি বলছে সূর্য?
.
সূর্যের মুখটা এবার জাস্ট দেখার মতো। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি সেই সুযোগে বা চোখটা টিপে দিলাম। সাথে সাথেই উনি আমার দিকে তেড়ে এলেন…..
.
—- বড় আম্মু দেখেচো তোমাদের সামনেই আমাকে মারতে আসছে ?
.
পাশ থেকে আম্মু আমায় ধমকে উঠলেন….
.
—- আলো! এক চড় দেব। এগুলো কোন ধরনের বেয়াদবি? বরের নামে শ্বাশুড়ির কাছে নালিশ করছিস? সব কিছুর সীমা থাকে আলো! আমি জানি তুইও কম না। যে তোকে সূর্য শুধু শুধু বকবে বা মারবে।
.
আম্মুর কথা শুনে গেল মেজাজটা খারাপ হয়ে।সব জায়গায় কি তার কথা না বললে চলে না? অদ্ভুত! দিলো তো এতো সুন্দর এন্টারটেইনমেন্টে এক সমুদ্র জল ঢেলে। ইচ্ছা তো করছে দু’জনরেই এখন বকা খাওয়াই! এখন যদি বড় আম্মু আমার কথা বিশ্বাস না করে। আম্মুর বাচ্চাআআআআ তোমারে যে কি করতে মন চাইতাছে! আমার ভাবনার মাঝেই বড় আম্মু আম্মুকে থামিয়ে দিয়ে বললেন…..
.
—- রোকসানা! তুই চুপ কর। সবসময় তোরা সূর্যর সাপোর্ট নিবি তা আমি পছন্দ করিনা। ও যে অন্যায় করলেও তা মেনে নিবি এটা কিন্তু ঠিক না। বাড়ির বউ যতই যা করুক না কেন তার গায়ে কেন হাত তুলবে? এটা কেমন শিক্ষা? আর আলো তো এই বাড়ির শুধু বউ না সবার আদরের কলিজা টুকরা ও! তাই ন্যায় অন্যায় দেখে বিচার করতে শেখ। সূর্যকে মাথায় কম তোল!
আর সূর্য! তোকে বলছি! তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস! এমন চলতে থাকলে আলোকে তোর সাথে রাখা যাবেনা। আমি যদি আরেকদিন এসব কিছু শুনেছি তো আমি আলোর শ্বাশুড়ি না বরং মা হয়ে ওকে অন্য কোনো ভালো ছেলের হাতে তুলে দিব। যে ওর গায়ে ফুলের টোকাও পড়তে দেবেনা। মাইন্ড ইট!
.
বড় আম্মুর কথাটা সোজা গিয়ে আমার বুকে বিধল। বড় আম্মুকে দেখে তো মনে হলোনা মজা করে বলেছে। কিন্তু যদি সত্যিই এমন কিছু হয় তখন? এটা আমি কি করলাম? একটু মজা করতে গিয়ে এতোকিছু?আমি সাথে সাথে সূর্যর দিকে তাকালাম। উনি আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। এই চাহনীতে নেই কোনো রাগ। নেই কোনো অভিমান। আছে শুধু হারানোর ভয়! আছে মিনতি! আমাকে তাকাতে দেখে উনি চোখ সড়িয়ে নিলেন। আমি এখনো উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনার চোখ দু’টো টলমল করছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি অশ্রুরা সব অঝোড় বর্ষণে ঝড়ে পড়বে। কিন্তু কেন? আমাকে হারিয়ে ফেলবে এই ভয়ে নাকি আপুর কথা মনে পড়ে গেছে আবার? উত্তরটা শত চেষ্টা করেও পেলাম না। হয়তো নিয়তি এমনই হয়। প্রকৃতি তার বহু রূপ দেখায। কিন্তু সব রূপের নাম জানায় না! হয়তো তারই মতো কিছু গল্পের নাম থাকেনা। কিছু অশ্রুর কারণ থাকেনা। কিছু কষ্টের সুখ থাকেনা। কিছু ভুলের বারণ থাকেনা। আবার সব প্রশ্নের উত্তর থাকেনা! ঠিক তেমনিই নাহয় আমার এই উত্তরটা অজানাই রয়ে গেল। জানিনা কখনো তা পাব কিনা!
#চলবে……..
[রি-চেইক করা হয়নি ভুলক্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ ❤।]