পারবনা আমি ছাড়তে তোকে ❤❤ #লেখিকাঃ লামিয়া ইসলাম তন্নি ❤ #পর্বঃ ৪২ (#অন্তিম_পর্ব)❤ .

0
909

#পারবনা আমি ছাড়তে তোকে ❤❤
#লেখিকাঃ লামিয়া ইসলাম তন্নি ❤
#পর্বঃ ৪২ (#অন্তিম_পর্ব)❤
.
.
🍁
.
দেখতে দেখতেই কেটে গেল ৫টি মাস। সাফরানের বয়স ৫মাস চলছে। জন্মের পর যতটা কিউট ছিল এখন তার দ্বিগুণ কিউট সে। মাঝে মাঝে কিসব অদ্ভুত শব্দ করে। আম্মু বলেন ও নাকি কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু বলতে পারেন না। এই ৫মাসে সাফরানের সাথে আমার বেশ ভালো সময় কেটেছে। যখনই ইচ্ছে হতো হুট করে এসে কোলে তুলে নিতাম। ঘুমিয়ে থাকলেও মানতাম না। ঘুমের মধ্যে সাফরানকে এক্সট্রা কিউট লাগতো! তাই তখন আরও বেশি আদর করতাম! ভাইয়া তো প্রায়ই বলে আমি নাকি ছোটবেলায় অনেকটা সাফরানের মতো দেখতে ছিলাম। একদম এতোটা কিউট! মিষ্টি। কিন্তু আমি তা বিশ্বাস করতে নারাজ! আমার মতে আমার ভাতিজা অনেক কিউট! আমি তার একগুণও ছিলাম না!
.
এই ৫মাসে সবাইকে ভীষণ জ্বালিয়েছিও বটে! সব থেকে বেশি জ্বালিয়েছি সূর্যকে। হুটহাট যখন তখন এটা ওটার বায়না করতাম। রাতে ঘুম থেকে উঠে কান্না জুড়ে দিতাম। কখনো তো শীতের মাঝেও উনাকে সারাটা রাত বসিয়ে রেখে কোলে মাথা রেখে ঘুমাতাম। কখনো পেটের ব্যথায় তো কখনো মাথা ব্যথায়! কখনো উনি খেতে বসলেই বমি করতাম। উনি খাওয়া রেখে আমার কাছে চলে আসতেন। আবার কখনো কুয়াশায় আচ্ছন্ন রাতে সোডিয়ামের আলোতে হাঁটার বায়না করতাম! উনি নির্দ্বিধায় সব মেনে নিতেন। প্রচুর জ্বালিয়েছি। আজ থেকে ৫ মাস আগে উনার চেহারায় যতটা স্নিগ্ধতা ছিল এখন আর তা নেই। এখন উনার ঐ স্নিগ্ধতায় ঘেরা মুখটা ক্লান্তির আভায় ছেয়ে আছে। দেখে মনে হয় কতোদিন ঘুমায় না। ঠিকমতো খেতে পারেনা! মাঝে মাঝে তো বড্ড মায়া হয়! নিজের উপরই খুব রাগ হয়। কিন্তু কিছুই করতে পারিনি! মাঝে মাঝে তো নিজে নিজের সাথে কথা বলি কখনো আর উনাকে জ্বালাবো না এই সেই! কিন্তু তা আর হয় কই?

_____________________

রাত ২টা বেজে ৫০ মিনিট! একটু আগেই অপারেশন থিয়েটার থেকে আমাকে কেবিনে ট্রান্সফার করা হয়। রাত ১২টার দিকে ওয়াশরুমে পা স্লিপ করে পড়ে গিয়েছিলাম। যার ফলস্বরূপ প্রচন্ড ব্লেডিং এবং প্রচন্ড ব্যথায় আমাকে হসপিটাল নিয়ে আসা হয়! ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ধরে তো নিয়েছিলাম হয়তো আজই এই সুন্দর দুনিয়া, পরিবার-পরিজন, ভালোবাসার মানুষ সবাইকে ছেড়ে চলে যাব। খুব অসহায় লাগছিল। কিন্তু না! মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন আমার সেই ধারণাটা ভুল প্রমাণ করে আমাকে আমার পরিবার,ভালোবাসার মানুষ আর আমার সন্তানের সাথে থাকার আরেকটা সুযোগ করে দিলেন। ভাবনার মাঝেই কেবিনের দরজা ঠেলে একে একে ভেতরে ঢুকে এলেন আম্মু, বড় আম্মু, ভাইয়া, বাবাসহ সবাই! সেই সঙ্গে একজন ইয়াং বয়সী নার্সও এলো। তার কোলে একটা বাচ্চা আছেন। সে ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমি আস্তে আস্তে উঠে বসতে নিতেই ভাইয়া আমাকে ধরে আধ শোয়া করে বসিয়ে দিলো। আমি কিছুটা আগ্রহ নিয়ে হাত বাড়াতেই নার্সটি তার কোলে থাকা বাবুটাকে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি বাবুকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলাম। মনে হচ্ছে আমার কতোশত প্রাপ্তী ওর মাঝেই লুকায়িত! ওকে পেয়েই আমি সব ভুলে গেছি। আমি আমাদের সন্তানের কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে মাথা তুলে চারদিকে সূর্যকে খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু, মহাশয়ের দেখা মিললে তো! সে আসেনি। হয়তো খুব রেগে আছেন। আমারই বা কি দোষ? আমি কি ভেবেছি নাকি এমন কিছু হবে? আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল তখন যা মনে হয়েছে তাই বলেছি।
.
ফ্লাসব্যাক……

আমাকে হসপিটালে নিয়ে এলেই ডক্টর বলেন—- “পেশেন্টের কন্ডিশন খুব খারাপ। এমুহূর্তে অপারেশন না করা হলে মা বা বাচ্চার কাউকেই বাঁচানো সম্ভব হবেনা!” কথাটা শুনে সূর্য থমকে গিয়েছিল। হয়তো আবারও হারানোর ভয় তাকে ঘিরে ধরেছিল!
.
ওটিতে নেওয়ার সময় আমি সূর্যর ডান হাতটা আকরে ধরেছিলাম। রুদ্ধশ্বাসে বলেচিলাম…..
.
—- ভালোবাসি! অনেক ভালোবাসি! আমাকে একটা কথা দিবেন? আপনি কখনো নিজের ক্ষতি করবেন না প্লিজ! আপনি আমাদের সন্তানকে খুব ভালোবাসবেন। আপনি… আপনিই ওর বাবা হবেন আর আপনিই ওর মা। কখনো ওকে আমার কমতিটা বুঝতে দিবেন না প্লিজ! ওকে আপনার মতো করে বড় করবেন। আর…. আর আমি যদি আপনাদের ছেড়ে চলে যাই আপনি একদম কষ্ট পাবেন না। একদম কাঁদবেন না। আমাদের সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে সব ভুলে যাবেন কেমন? জানেন? আজ আমি সত্যিই খুব খুশি কেন জানেন? কারণ, আমি সবসময় চাইতাম যাতে আপনার আগে আমার মৃত্যু হয়! কারণ…
.
কথাটা শেষ করার আগে উনি ঠাস করে আমার বা গালে একটা চড় বসিয়ে দিলেন! রাগী কন্ঠে বললেন……
.
—- চুপ! একদম চুপ। তোকে আমি পরে দেখে নিব। আগে সুস্থ হয়ে ফিরে আয়।
.
কথাটা বলে আর একমুহূর্তও সেখানে দাঁড়ায় নি!
.
ভাবনার মাঝেই ভাবী বললেন…..
.
—- ভাইয়াকে খুঁজে লাভ নেই! ভাইয়া এখনও খুব রেগে আছে। মাথা ঠান্ডা না হওয়া পর্যন্ত তোমার কাছে আসবেনা! তোমার ভাইয়া ডেকেছিল আসেনি।
.
ভাবীর কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। বড় আম্মু আমার পাশে বসে মাথায় হাত রেখে বললেন…..
.
—- মন খারাপ করিস না মা! আমার ছেলেটা একটু বেশিই রাগী। তবে চিন্তা করিস না। রাগ কমলেই তোর কাছে ছুটে আসবেন। এখন তুই রেস্ট নে আমরা এখন আসি!
.
কথাটা বলে আমার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে বাবুকে নিয়ে একে একে সবাই বেড়িয়ে গেল। আমিও শুয়ে পড়লাম। মনটা খুব বিষাক্ত লাগছে কেন যেন! তার থেকেও বেশি রাগ লাগছে উনার উপর।কিসের এতো রাগ হুম? এতো রাগ কিসের? এই মুহূর্তে যদি খাটাশটারে সামনে পেতাম না? কিযে করতাম আমিও জানিনা! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়লাম!

_____________________

কপালে কারো ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে ঘুম ভেঙে গেল! চোখ খুলে চারপাশে তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু, দরজা এখনও নড়ছে! তারমানে রুমে কেউ এসেছিল। কিন্তু কে? কথাগুলো ভেবে ডানদিকে তাকাতে বেডের পাশের ছোট টেবিলটাতে চোখ গেল। টেবিলের উপর ফোনটা দেখে আর বুঝতে বাকী রইল না রুমে কে এসেছিল। আমি টেবিল থেকে ফোনটা নিয়ে সময় দেখে আবার আগের জায়গায় ফোনটা রেখে দিয়ে উল্টোদিক ফিরে শুয়ে পড়লাম। কালকে যেটা রাগ ছিল আজ সেটা অভিমান। ধীরে ধীরে অভিমানেরা জড়ো হচ্ছে আমার ছোট্ট মনটাতে! তার ভীষণ ইচ্ছে করছে সূর্য নামক মানুষটাকে একটু বকে দিতে। ইচ্ছে করছে তার থেকে অনেক অনেক দূরে চলে যেতে। আচ্ছা, আজ যদি সত্যিই আমি মরে যেতাম সে কি পারত রাগ করে আমার কাছে না এসে থাকতে? পারতো না তো! তাহলে এখন কেন এমন করছে? এখন তো মনে হচ্ছে মরে গেলেই ভালো হতো! কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চোখ থেকে দু’ফোটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ল!

.
সকাল ১০টা বেজে কিছুক্ষণ হবে। হসপিটালের বেডে আধ শোয়া হয়ে বসে আছি আমি। আমার ঠিক সামনে খাবার প্লেট হাতে নিয়ে বসে আছে সূর্য! প্রায় ৩০ মিনিট যাবৎ উনি এভাবে বসে আছেন। যখনই খাবারটা মুখের সামনে আনেন তখনই মুখটা ঘুরিয়ে ফেলি। না উনি একটা কথা বলেছেন না আমি! আমার কথা হলো এতোগুলো মানুষের সামনে মেরেছে ভালো কথা। তাই বলে কথা বলবেনা? কি এমন করেছি আমি? কালকে আমাকে ওটি থেকে আনার পর আমার সাথে একটিবারের জন্য দেখা করতে আসেনি। কথা বলা তো দূরের কথা। এখন আসছে নেকামি করে খাওয়াতে। খাওয়াতে আসছে তো আসছে সেই ৩০ মিনিট ধরে রোবটের মতো আমার মুখের সামনে খাবার আনছে। একটা বারের
জন্য বলছে না মুখ খোল বা খেয়ে নাও! দেখে মনে হচ্ছে এর মাঝে কোনো মেমোরি সেট করা। একে যা বলা হচ্ছে তাই করছে! কিন্তু, রোবট তো তবুও একটু কথা বলে। উনার মাঝে সেটাও নাই! ইচ্ছা করছে ধাক্কা দিয়ে ৬ তলা থেকে ফেলে দেই। অসভ্য কোথাকার!
.
আমার ভাবনার মাঝেই উনি ধমকে উঠলেন………
.
—- সমস্যা কি?
.
উনার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। আমার তাকানো দেখে উনি আবার বললেন…….
.
—- খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে!
.
এবার আমিও হালকা নড়েচড়ে বসলাম। শান্ত স্বরে বললাম….
.
—- তো আমি কি করব?
.
এবার যেন উনি আরও রেগে গেলেন। চোখ লাল করে বললেন….….
.
—- কি করবে মানে? ৩০ মিনিট যাবৎ তোমার সামনে খাবার নিয়ে কেন বসে আছি তুমি জানোনা?
.
আমি কোনো জবাব না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। উনি আবার বললেন……
.
—- ভালোয় ভালোয় খেয়ে নাও আলো! নয়তো ভালো হবেনা বলছি!
.
—- আমি খাব না।
.
—- কালকের একটা থাপ্পড়ে কাজ হয়নি মনে হচ্ছে।
.
—- একটা কেন ১০ থাপ্পড় দিলেও খাব না মানে না!
.
উনি এবার মাথা নিচু করে দু’হাতে মাথা চেপে ধরলেন। হয়তো রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছেন।
.
কিছুক্ষণ পর উনি প্লেট টা পাশের টেবিলের উপর রেখে আমার দিকে ঘুরে বসলেন। ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে নরম স্বরে বললেন…….
.
—- আ’ম সরি আলোরানী! আ’ম রিয়ালি ভেরি সরি। আমি মারতে চাইনি তোমায়। আসলে আমার মাথা কাজ করছিল না। তার ওপর তুমি ওসব কথা বলছিলে! তাই খুব রেগে গেছিলাম। প্লিজ রাগ করে থেকোনা পিচ্চিটা!
.
কথাগুলো বলার সময় আমি একদৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। উনার চোখ জোড়া টলমল করছেন। উনি আবার বললেন…….
.
—- আমি সত্যিই তোমাকে অনেক ভালোবাসি আলোরাণী! হয়তো, চাদের থেকেও বেশি। তাই তো ও চলে যাওয়ার পরেও তোমার জন্য বেঁচে থাকতে পেরেছি। কিন্তু… কিন্তু যদি আজ তোমার কিছু হয়ে যেত আমিই মরে যেতাম।
.
উনি এতোটুকু বলতেই আমি উনাকে জড়িয়ে ধরলাম। ধরা গলায় বললাম…….
.
—- এসব একদম বলবেন না! আমার খুব কষ্ট হয় জানেন না? আর কখনো যেন এমনটা না শুনি!
.
উনি আমাকে আলতো হাতে জড়িয়ে নিলেন। মাথায় চুপু দিয়ে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আমাকে খাইয়ে মেডিসিন খাইয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে আমার পাশে বসে পড়ল! পাগলের মতো মেয়ের কপালে দু’গালে চুমু দিয়ে বলল……….
.
—- আমার প্রিন্সেস! আল্লাহ্-র কাছে অনেক শুকরিয়া আমার ডাক শোনার জন্য! আমার ঘরে নূর দেওয়ার জন্য! আজ আমার নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি সুখী বলে মনে হচ্ছে। বিশ্বাস করো আলোরানী! ( আমার দিকে তাকিয়ে) আমার হোল্ড লাইফে আজকে আমি সবচেয়ে বেশি খুশি! এতটা খুশি আমি আগে কখনো হইনি! কখনো না!
.
আমি উনার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছি। কথাগুলো বলার সময় উনার চোখে মুখে খুশির ঝলক চিকচিক করছে। কতোদিন পর যে উনাকে এতটা খুশি দেখছি আমার ঠিক মনে নেই!
.
আজ শুধু উনি নয় বরং আমিও ভীষণ খুশি! সত্যিই অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করছে। এখন আমি আর সেই ছোট্ট আলোটা নেই। আমি এখন কারো স্ত্রী! সেই সঙ্গে একজন মা। কেউ আমাকে আধো আধো স্বরে আম্মু ডাকবে। ছোট্ট ছোট্ট হাতে জড়িয়ে ধরবে।ভাবতেই খুব ভালো লাগছে। আজ আমারও মনে হচ্ছে আমি সুখের সাগরে ভাসছি। যেখানে শুধু চারদিকে সুখ আর শান্তি!
.
.
🍁
.
.
দেখতে দেখতেই কিভাবে যে কেটে গেল ২টা বছর বুঝতেই পারলাম না। ভালো সময়গুলো খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় কথাটা হয়তো সত্য! গত দু’বছর অনেক ভালো সময় কেটেছে।অনেক বেশিই ভালো! সবার সাথে হাসি, আনন্দ, আড্ডা, ঘোরাফেরাতেই কেঁটে গেল দু’বছর! আর্যিতাও এখন আধো আধো স্বরে কথা বলতে পারে। সাফরানের কথা অনেকটাই ক্লিয়ার। সে তো আমায় চোখে হারায! সারাদিন ফুপিমনি ফুপিমনি করা তার চাই। যদি কিছুক্ষণ সময় না দেখে তার মাকে পাগল করে ফেলে আমি কই গেছি? কখন আসব? আরও হাজারটা প্রশ্ন! খাওয়ার সময় এমনকি ঘুমানোর সময়ও আমাকে তার সামনে চাইই চাই! নয়তো খাবেওনা আর ঘুমাবেও না! সে সঙ্গে বাড়ি মাথায় তোলা কান্না তো আছেই! এককথায় বলতে গেলে সাফরান আমি বলতেই পাগল! আর আর্যিতা? সে তার বাবা ছাড়া কিচ্ছু বোঝেনা! তার মা যে এখনও জীবিত? তা সে তার বাবাকে পেলে ভুলেই যায়! তবে অনেক ভালো আছি আমি! সবকিছু কম বেশি পাল্টালেও ভাইয়ার ডাকা বুড়ি ডাকটা, সূর্যের ডাকা পিচ্চি আর তাদের দু’জনের স্নেহ, ভালোবাসা একটুও কমেনি! মাঝে মাঝে নিজের উপর নিজেরই হিংসে হয়! এতোটা সুখী কেন আমি? এতো সুখ যদি মোর কপালে নাহি সহে?

________________________

রাত ১টা বেজে ২০ মিনিট! পশ্চিম দিকের জানালার কার্ণিশ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ঐ স্নিগ্ধ রাতের আকাশে! প্রায় ১ঘন্টা যাবৎ এপিঠ ওপিঠ করে একটুও ঘুমাতে পারছিলাম না! কেমন যেন অস্থির লাগছিল! অস্বস্তিতে ভুগছিলাম। তাই উঠে এসে জানারায় দাঁড়ালাম। আজ আকাশটা অনেক স্নিগ্ধ লাগছে। বাহিরে হিমশীতল বাতাসও বইছে। সেই সঙ্গে মনের মাঝেও কেমন যেন এক অস্থিরতা কাজ করছে। যেন মনে হচ্ছে কিছু একটা নেই। কিছু একটা হারিয়ে ফেলেছি! কিন্তু কি সেটা? আমার ভাবনার মাঝেই কেউ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল আমায়! তার গরম নিশ্বাস কাঁধে পড়তেই কেঁপে কেঁপে উঠছি! তবে কিছুই বলছিনা। কেন যেন কথা বলতেও ইচ্ছে করছেনা। মানুষের নাকি মন খারাপ থাকলে কাঁদতে ভালো লাগে। কেঁদে হালকা হয়। যদিও একসময় আমিও হতাম! কিন্তু, আজ না কাঁদতেও ইচ্ছে করছে না! একটুও না!
.
আমার ভাবনার মাঝেই উনি বলে উঠলেন………..
.
—- মন খারাপ কেন ম্যাডামের?
.
উনার কথায় মুখ ফিরিয়ে উনার দিকে একবার তাকালাম। কিন্তু অবাক হলাম না। কারণ, নতুন করে অবাক হওয়ার মতো আর কিছুই নেই! এটা তো পুরোনো কিছুই না যে,আমার মন খারাপ থাকলে উনি বুঝতে পারেন।
.
আমাকে ওভাবে তাকাতে দেখে উনি ভ্রু কুঁচকে হালকা মাথা নাড়লেন! যার অর্থ ‘কি?’
.
আমি মুচকি হেঁসে উনার দিকে ঘুরে উনাকে জড়িয়ে ধরলাম। ইনিই পৃথিবী একমাত্র মানুষ! যাকে দেখলে আমার হাজার কোটি মন খারাপও এক নিমিষেই দৌড়ে পালায়! আচ্ছা, কি আছে মানুষটার মাঝে? কেন এতো ভালবাসি? কেন এতো মায়া তার প্রতি? আচ্ছা? উনি কি ম্যাজিক জানেন?
.
আমার ভাবনার মাঝেই উনি আলতো হাতে আমায় জড়িযে মাথায় চুমু খেলেন! ঘোর লাগা গলায় বললেন…..
.
—- ওমন করে হেসো না সখি গো! প্রাণ যে মোর নাহি বাঁচে!
.
কথাটা বলে উনি আমায় নিজের থেকে ছাড়িয়ে কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁযে বললেন……
.
—- আমি বারবার, শতবার, হাজারও বার এই হাসিতে মরতে রাজি! তবে এই হাসি বিলীন হতে দিতে নয়!
.
আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই কারো আধো আধো স্বর কানে ভেসে এলো……
.
—- বাবা! তুমি একা একা আম্মুতে আদল করো? আমাতে এত্তুও আদল করো না।(মন খারাপ করে)
.
আর্যিতাকে দেখে আমি তাড়াতাড়ি উনার থেকে সড়ে দাঁড়ালাম। মেয়ে বলে কি? এতোটুকু মেয়ে সেও নাকি এসব কথা বলে? উনি গিয়ে আর্যিতার পাশে বসলেন। মেয়েকে কোলে নিয়ে বললেন……
.
—- আম্মু! এসব কি?
.
—- কি তব?
.
—- তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে আম্মু আর বাবার কথা শুনছিলে?
.
—- না তো! ইত্তু তুনছি। বেতি না!
.
—- আম্মু, এগুলো পঁচা কাজ না বলো?
.
—- পতা কেন?
.
—- কারণ বড়দের কথা লুকিয়ে শুনতে নেই!
.
আর্যিতা এবার আমার দিকে তাকালো! কি যেন ভেবে বলল……
.
—- ও আত্তা! আমাতে দাদীর কাতে দিয়ে আতো!
.
আর্যিতার কথা শুনে অবাক হয়ে তাকালাম। মেয়ে বলে কি? এতো রাতে দাদির কাছে যাবে? কিন্তু কেন? আর বাবা পাগল মেয়ে বাবাকে রেখে দাদীর কাছে যাওয়ার কোনো বিশেষ কারণও দেখতে পাচ্ছি না!
.
—- কি হয়েছে মা? এতো রাতে দাদীর কাছে কেন? তোমার বাবা তো আছেই!
.
—- জানি তো আতে! কিন্তু বাবা এথন তোমাল তাথে কথা বলে। আমাল তাথে থেলবে না।
.
মেয়ের কথা শুনে আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছি না। মেয়ে বলে কি? এতো রাতে ঘুম থেকে উঠেছে খেলতে?
.
—- আম্মু! এখন তো অনেক রাত তুমি ঘুমাও। আমরা কাল খেলব?
.
—- না আমি এথন দুমাবো না! আর তোমাদেল তাথে কতাও বলব না!
.
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে বাবা মেয়ের কান্ড দেখছি। এইটুকু বাচ্চা মেয়ে নাকি রাগ করে?
.
—- কেন আম্মু? কি করেছি আমরা?
.
—- তোমলা পতা! আমি তোমাদেল তাথে আড়ি!
.
এবার আর আমি চুপ থাকতে পারলাম না। খিলখিল করে হেসে উঠলাম! আর বাবা মেয়ে দু’জনেই চোখ তুলে আমার দিকে তাকালো৷ দু’জনেরই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল!
.
উনি কিছু বলতে যাবেন তার আগেই আর্যিতা বলল….
.
—- কি তুন্দর করে হাসো তুমি?
.
আমি হাসি থামিয়ে ওর দিকে তাকালাম। বেশ উৎসাহ নিয়ে বললাম…….
.
—- তাই নাকি?
.
—- হুম! বাবাও তুন্দর হাসে! আমিই পারিনা!
.
—- না আম্মু তুমি আমাদের থেকেও সুন্দর করে হাসো!
.
—- আম্মুর থেকেও?
.
এবার উনি আমার দিকে চোখ তুলে তাকালেন! কি বলবেন মেয়েকে? হয়তো তাই! আমি কিছু বলব তার আগেই আর্যিতা বলল………
.
—- জানি তো! আম্মুল হাসি তোমাল কাছে তুন্গর লাগে বেতি।তুমি আমাল থেকে আম্মুতে বেতি আদল করো!
.
মেয়ের কথা শুনে আমার চেখ বড় বড় হয়ে গেল! এইটুকু মেয়ে বার বার কি বলে এসব? উনি তাড়াতাড়ি করে বলে উঠলেন…….
.
—- না আম্মু! এমন কিচ্ছু নয়। আসলে আমি জানিনা কে সুন্দর হাসে? তুমি নাকি তোমার আম্মু! জানি না আম্মু! তবে তোমাদের দু’জনের হাসি সবার থেকে সুন্দর!
.
—- কেন জানো না?
.
—- কারণ কখনো আলাদা করার চেষ্টা করিনি!
.
—- ওওও
.
বেশকিছুক্ষণ ওভাবে বসে থেকেই উনার কোল থেকে নেমে শুয়ে পড়ল।
.
—- তা তা! আমি দুমাবো।
.
আমি আর উনি দু’জনেই অবাক! কি হলো? মেযে উঠল কতোগুলো প্রশ্ন করল! পাকা পাকা কথা বলল আবার শুয়ে পড়ল? অদ্ভুত না?
.
উনি আলতো করে মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে গায়ে কাঁথা টেনে দিলেন!
.
____________________
.
রাত ৩টা বেজে ২৫ মিনিট! একটু আগে ছাঁদ থেকে এলাম। শরতের শেষ সময়টা হালকা ঠান্ডা পড়ছে। হিমশীতল আবহাওয়া খুব ভালো লাগছিল ছাঁদে। দু’জনে মিলে নানারকম গল্প করছিলাম। ছাঁদ থেকে নেমে আমাকে রুমে পাঠিয়ে মহাশয় গেছেন কফি বানাতে!
.
আজ অনেকদিন পর আপুর কথা খুব মনে পড়ছে। সে তার কপালের সুখটা আমার নামে লিখে দিয়ে চলে গেল? কি দরকার ছিল এতটা ভালো হওয়ার? এতোটা ভালো না হলেও কি পারত না? আজ তারই ভালোবাসার মানুষের সাথে আমি কতটা ভালো কতটা আনন্দে আছি। আর সে? ভাবতেই নিজেকে ভীষণ দোষী মনে হতে লাগল আমার! মনটা আবার ভীষণ বিষাক্ত হতে লাগল! চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল দু’ফোটা নোনাজল!
.
উনার ডাকে ফিরে তাকালাম!
.
—- নিন ম্যাডাম! (কফির মগটা এগিয়ে দিয়ে)
.
আমি কফিটা নিয়ে মগে একবার চুমুক দিয়ে আবার আকাশের দিকে তাকালাম!
.
—- এবার তো বলেন ম্যাডাম তখন মন খারাপ ছিল কেন?
.
আমি একবার উনাকে দেখে নিয়ে আবার আগের মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম! উনি আবার বললেন……..
.
—- কি হলো?
.
—- কিছুনা! এমনি ভালো লাগছিল না।
.
উনি এবার পাশে থাকা ওয়ারড্রবের উপর উনার কফিটা রেখে দু’হাতে আমাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলেন। কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন……….
.
—- চাঁদকে মিস করছো?
.
আমি এবার ফুপিয়ে উঠলাম! উনি অস্থির হয়ে গেলেন।
.
—- প্লিজ, প্লিজ কান্না থামাও! তুমি কাঁদলে খুব কষ্ট হয় আমার। কেনো বোঝো না?
.
—- আমি খুব খারাপ তাই না? খুব খারাপ! আপনাকে আপুর থেকে কেঁড়ে নিছি!
.
—- একদমই নয়! কে বলেছে আমার আলোরাণী খারাপ? আর তুমি কারো কাছ থেকে আমায় কেঁড়ে নাওনি! আমি তোমারই ছিলাম!
.
—- না! আপনি আপুর ছিলেন। আর আপু আমার জন্যই মালেশিযা চলে যেতে চেয়েছিল! তার কপালের সুখটা আমার নামে লিখে দিতে চেয়েছিল!
.
উনি আমার হাত থেকে কফিটা নিয়ে আগের কাপটার পাশে রাখলেন।আমাকে উল্টোদিক ঘোরালেন।পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললেন………
.
—- শোনেন ম্যাডাম! আমি যদি আপনার ভাগ্যে না থাকতাম? তাহলে চাঁদ যত যাই করতো না কেন? আপনি আমায় পেতেন না! আমি আপনার ছিলাম আপনারই আছি। ভবিষ্যতেও আপনারই! তাই আমাকে আপনিই পেয়েছেন। বুঝেছেন? আপনার মাঝেই আমার শুরু আর আপনার মাঝেই শেষ! আর যেই সুখের কথা বলছেন? তাও আপনার নামেই লিখা তাই পাচ্ছেন!এবার কান্না থামান!
.
আমি কিছু বললাম না!
.
উনি আবার বললেন……..
.
—- “আমি তোমারও মাঝে রহিব বিলীন,
তোমাতে করিব বাস!
দীর্ঘ দিবস,দীর্ঘ রজনী, দীর্য় বরষ মাস!
.
এভাবেই সারাটি জীবন পাশ চাই মানুসটাকে। প্রতিটা মুহূর্ত, প্রতিটা ক্ষণ! আমার সকল সুখে দুঃখে তাকেই আমার চাই! উনার মতো আমারও তারই মাঝে শুরু আর তারই মাঝে শেষ। আমি যুগে যুগ শত যুগ, হাজারও যুগ উনার জন্য বাঁচতে রাজি। উনাকে পেয়েই মরতে রাজি! উনিই আমার দিনের প্রাম্ভ আর রাতের ইতি! উনি আমার আকাশের চাঁদ উনিই সূর্য! উনিই বৃষ্টির পরে আমার আকাশে ভেসে ওঠা রঙধনুর সাত রঙের মাঝে নীল রঙটা! আমার মনের আয়নার একমাত্র অধিকারীও সে! আমার সে!
.
.
_____________❤সমাপ্ত❤_______________
.
[#বিঃদ্রঃ সরি গাইস! এতোদিন অপেক্ষা করানোর জন্য! আমি সত্যিই দুঃখিত! তবে আমি অনেক ব্যস্ত সেই সঙ্গে এখনও পুরোপুরি সুস্থ নই! রাতে পারলে “অসমাপ্ত ভালোবাসা” একটা পর্ব দিব। নয়তো,একদিন পর! সবাই ভালো থাকবেন ধন্যবাদ❤]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here