হিয়ার_মাঝে ৪. #মেঘা_সুবাশ্রী ®️

0
730

#হিয়ার_মাঝে ৪.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

পাঁচদিন পর, কিসের অঘটন ঘটল! ছেলেটা কল দিয়েছিল তোকে আবার?
রুবির জিগ্যেসু দৃষ্টি জোড়া। এক হাত নিজের থুতনিতে রেখে ব্যগ্রকন্ঠে বলে উঠল।

অথচ নুবাহর শীতল দৃষ্টি। মাথা ঈষৎ নাড়াল। গলার স্বর ভীষণ নমনীয়।
‘নাহ, খালামনি। কল আসেনি। বরং তার আগে একটা অঘটন ঘটেছিল। যেটা আমার জীবনের কালঝড় বয়ে এনেছিল। আমি কখনো ভাবেনি এমনটা হবে। হয়ত সেদিনটাই ছিল আমার জীবনের চরম অভিশাপ।’

‘কি হয়েছিল?’
রুবি ফের বলে উঠল।

‘শনিবার ওবায়দুল স্যারের মেয়ের আকীকার অনুষ্ঠান ছিল। আর সেদিন আমি কালো রঙের একটা গ্রাউন পরে গিয়েছিলাম। কিন্তু যাওয়ার আগে আমাদের ঘরে লঙ্কাকান্ড ঘটে গিয়েছিল। নীলাভ যবে থেকে শুনেছে আমি ওবায়দুল স্যারের বাড়ি যাব। তার মেয়ের আকীকা অনুষ্ঠানে। তখন থেকে গো ধরে বসেছিল। সেও যাবে। সাথে নিভানকেও উসকে দিল। দু’জনেই যাবে। বিশ্বাস কর খালামনি, আমি তো লজ্জায় শেষ। দু’জনকে কীভাবে নিয়ে যাবে? কিন্তু তুমিতো জানো, নীলাভ তো নীলাভই। যা বলে তাই করে। রুমের এককোণে বসে পুরো দু’ঘন্টা কেঁদেছিল।’

‘তারপর।’

নুবাহ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ফের নিজের অতীতে ডুব দিল,,,

রশিদের বলা কথামত পরেরদিন ভোর পাঁচটায় উঠল। গায়ে কম্বল জড়ানো। চেয়ারেও বিছালো একটা। তার উপর নুবাহ পড়তে বসল। তবু হিমশীতল ঠান্ডায় ঠকঠক করছে প্রতিটা সময়। এভাবে সময় গড়ালো সকাল সাতটার মাঝে। খিদে পেল বেশ। কিন্তু ভয়ে উঠতেও পারল না। তার নিষ্ঠুর বাপ ডাইনিং এ বসে আছে। তার বাপ ডাকলেই তো পারত। অগত্যা না পেরে নিজের চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল। খিদের জ্বালা সহ্য হল না আর। ডাইনিং এ উঁকি দিল। না, তার জাঁদরেল বাপ নেই। পা টিপে টিপে কিচেনে গেল। তাকে দেখে রুকাইয়া ভাবলেশহীন। শান্ত গলায় বলে উঠল,
‘এসেই যখন পড়েছিস, খেয়ে যা।’

নুবাহ খুশি হল মনে মনে। যাক বাবা অবশেষে নাস্তা পেল। তার মা খোলা চিতই পিঠা বানাচ্ছে। সুযোগ বুঝে চারটা নিজের পেটে চালান করে দিল। আহ! গরম গরম খোলা থেকে নামানো চিতই পিঠা। খেতে ভারী মজা। বেশ আরাম করে চা দিয়ে খেয়ে বের হয়ে এল। কিন্তু কিচেন থেকে বের হয়ে এসে তার পা’ থমকে গেল। চক্ষুদ্বয় কোঠর থেকে বের হবার উপক্রম। নীলাভ এখনো টেবিলে বসে পড়ছে। আজকে ডিমওয়ালা পিঠা খেতে বায়নাও ধরল না। অথচ রোজ এই মেয়ে সবার আগে এই পিঠার জন্য বসে থাকত। কিন্তু আজকে চুপচাপ ডাইনিং এর এককোণে পড়ছে। অবিশ্বাস্য! পরে মনে পড়ল রাতের কথা।

নুবাহ নিজমনে আফসোস করল। আহারে! বেচারি বোন আমার। কাল আব্বুর কতগুলো বকা খাইল। ফের নিজের রুমের দিকে কদম বাড়াল। মায়ের রুমে উঁকি দিতে দেখল নিভান এখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। নিশব্দে নিজের রুমে ফিরে এল।
____________________

সময় যেন দ্রুত গড়াল। সেই কাঙ্খিত শনিবার দিনটা আসল। নীলাভের করা বায়না আর আহাজারিতে অবশেষে নুবাহ রাজি হল। তার সাথে দু’জনই যাবে। বাধ্য হয়ে নিয়ে গেল। কালো রঙের গ্রাউন পরল সে। তার সাথে ম্যাচিং করে হিজাব বাঁধল। নীলাভর গায়ে কালো রঙের গোল জামা। নিভানের গায়ে সাদা রঙের গেঞ্জি আর ত্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। তিনজনই মোটামুটি সাজসজ্জা করে বের হল।

ওবায়দুল স্যারের বাড়িতে গিয়ে নুবাহ বেশ অবাক হল। পুরো বাড়ি মানুষে গমগম করছে। স্কুলের স্টুডেন্ট আর টিচারদের জন্য আলাদা রুম রাখা হয়েছে। কেউ কেউ খাবার খাচ্ছে আর কেউ বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের ক্লাসের মেয়েরা অনেকে খুব সাজসজ্জা করেছে। আবার অনেকেই খুব সাদামাটা। তাদের দেখে চেনার উপায় নেই একদম। তবে লিমাকে দেখে পুরোদস্তর অবাক হয়েছে। মেয়েটা আসলেই অনেক সুন্দরী। সাজলে আরও সুন্দর লাগে। কিন্তু স্বভাবটা একটু বিরক্তিকর। যাই পরুক না কেন, তা নিয়ে বেশ অহংকার মেয়েটার মধ্যে। তার মতে, তার মত এত দামী জামা কাপড় কেউ পরে না। সারাক্ষণ নিজের পোশাকের গল্প করে বেড়াবে। আর হিজাব পরুক আর ওড়না, সেটা তার গায়ে ঠিকভাবে থাকেই না। এ নিয়ে তমার সাথে বেশবার ঝামেলা হয়েছিল। সেই থেকেই তমা কথা বলে না। তার নিজেরও পছন্দ না এই মেয়েকে। অসভ্য একটা!

নুবাহ তমাকে খুঁজে তার পাশে গিয়ে বসল। তমা নিভানের সাথে কথা বলছে। নীলাভও মাঝে মাঝে উত্তর দিচ্ছে। চারজনেই খুঁনশুটিতে মত্ত। আচমকাই হুট করে তাদের পাশে লিমা এসে বসল। নুবাহ তো তব্দা খেয়ে গেল। কি ভয়ংকর ব্যাপার স্যাপার! লিমা এসেছে তাদের সাথে কথা বলার জন্য। তমার দৃষ্টি নিচের দিকে। কিন্তু সে হলফ করে বলতে পারে লিমা নিজ কোনো স্বার্থসিদ্ধির জন্যেই এসেছে। নুবাহ, তমা কিছু বলার আগে লিমা নিজ থেকেই কথা বলল।
‘তোরা কি রেগে আছিস আমার উপর। দেখ, আমরা সবাই পরীক্ষা শেষে কে কোথায় যাব, কেউ জানি না।’

হুট করে তমা বলে উঠল,
‘আমি জানি। নুবাহ চট্রগ্রাম যাবে আর আমি ঢাকায়। কিন্তু তুই যাবি শ্বশুর বাড়ি।’

তমার কথায় উপস্থিত সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। তবে অবাক লাগল লিমা রাগ করল না। উল্টো সেও হাসল সবার সাথে। তমার সন্দিহান দৃষ্টি লিমার দিকে। কিন্তু নুবাহ ভাবলেশহীন। লিমার মুখে হাসির আভাস। তবে ছলছল দু’আখি।
‘আমি জানি, তোরা মজা করছিস। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি সত্যিই বলছি। আমরা আর মাত্র কিছুদিন আছি একসাথে। এরপর আর কখনো দেখা নাও হতে পারে। তাই বলছিলাম কি,,

তমা তড়িৎ বলল, কি?

‘আমাদের একটা গ্রুপফটো নিতে চাই। আমি যত্ন করে রেখে দিব স্মৃতি হিসেবে। আমাদের সাথে ছবি তুল না তমা, নিশাত।’

নুবাহ নিশ্চুপ হয়ে আছে। কিন্তু তমার দৃষ্টি সন্দিগ্ধ। সে ভাবছে অন্যকিছু। লিমার গিরগিটির মত রূপ বদলানো তার কাছে বিষয়’টা বেশ ভাবনার। তমা আর নুবাহর নিশ্চুপতায় লিমা মুখে হতাশার সুর তুলল। ফের বলে উঠল,
‘তোরা আমাকে এত খারাপ ভাবিস কেন? আমি কিন্তু অতটাও খারাপ নই। চল না একটা গ্রুফফটো তুলি। জেবা, ফারহানা বাকীরাও দাঁড়িয়ে আছে। চল না।’

এদের কথার মাঝে নিভান বলে উঠল,
আমিও তুববো।

সহসাই এমন কথায় সবাই একসাথে হেসে উঠল। লিমা বিস্মিত হল। নিভান আর নীলাভের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে বলল, নিশাত এরা তোর ভাইবোন। নুবাহ হেয়ালিসুরে জবাব দিল। ‘নাহ, রাস্তা থেকে উঠায় আনছি। তোর লাগলে নিয়ে যা। আবারও সবাই একসাথে হেসে উঠল। নিভান কিছু না বুঝলেও নীলাভ ঠিকই বুঝল। কিন্তু এখন তার নিশ্চুপতায় শ্রেয়। তাই জবাব দিলো না। লিমা নিজের হাসি থামিয়ে নিভানকে কোলে নিল। আদর করে দিয়ে বলল, মাশআল্লাহ’ দুজনেই কিউটের ডিব্বা। এবার চল গ্রুপফটো তুলি। অগত্যা লিমার একপ্রকার জোরাজুরিতে নুবাহ আর তমা ছবি তুলতে রাজি হল। শেষে সবার একক ছবিও নেওয়াও হল। লিমা বাসায় ফিরার আগে একটা আবদার করে বলল,
‘তোদের দু’জনের ফোন নাম্বার দেয়। যদি রাগ না করিস মাঝেমধ্যে যোগাযোগ করব।’

নুবাহ প্রথমে দোটানায় ভুগল। পরে মন নরম হল। আসলেই দু’দিন পর কে কোথায় থাকবে কারও জানা নেই। তাই নিশ্চিন্তে নিজের মুঠোফোনের নাম্বার দিয়ে দিল। লিমা শেষে তার মায়ের নাম্বারও নিল। লিমার ব্যবহার ছিল বেশ স্বাভাবিক। তাই নুবাহও এত কিছু ভাবল না।

সেদিন সময়টা পরম আনন্দেই কাটল। কিন্তু রাত শেষে হল সেই অঘটন।

ঘড়ির কাটায় তখন মধ্যরাত। আচমকাই মুঠোফোন কম্পিত হল নুবাহর। পড়াশোনার চাপ নিয়ে ঘুম ধরেনি তখনো তার। তাই দ্রুতই উঠে পড়ল। অচেনা এক নাম্বার নিজের ফোনের স্ক্রিনে দেখে থমকাল। তৎক্ষণাৎ কেন যেন মনে পড়ল সেই ছেলের কথা। গত পাঁচদিনে এই ছেলে তাকে দ্বিতীয়বার কল দেয়নি। মনের মাঝে কিঞ্চিৎ আশার আলো ফুটে উঠল। তাহলে কি সেই কল দিয়েছে। কেন জানি তার কলটা রিসিভ করতে ইচ্ছে হল। খুব বেশি সময়ক্ষেপণ করল না। মূহুর্তে কল রিসিভ হল।

‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে নেশালো এক কন্ঠ ভেসে এল।
‘কেমন আছও বউ?’

চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here