হিয়ার_মাঝে ২৪. #মেঘা_সুবাশ্রী ®️

0
530

#হিয়ার_মাঝে ২৪.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

বন্ধুমহলের একান্তই ব্যক্তিগত মেসেঞ্জার গ্রুপ ‘বাচ্চার দল’ সহসাই টুংটাং শব্দ তুলল। জিতু মাত্রই রাতের খাবার খেয়ে নিজের রুমে ফিরেছে। প্রথম মেসেজ’টা সিমির ছিল। ছোট্ট একটা বাক্য।

‘ফিরছি আগামীকাল, দেখা হবে প্রিয় কলেজপ্রাঙ্গণ।’

আচমকাই সিমির মেসেজ দেখে মুখের কোণে হাসি ফুটল জিতুর। ঠিক কতদিন পর তাদের মৃত বন্ধুমহল জাগ্রত হবে। ভাবতেই আনন্দে চোখের জল জমল। সিমির মেসেজের পর পরই সানির রিপ্লাই,

‘জাপানে গিয়ে এখনো কি হাড্ডিমন্ত্রী আছিস নাকি একটু বেলুনের মত ফুলেছিস সীমারেখা?’

সানির প্রতিত্তোরে লরিনের রিপ্লাই,

‘তুই খেয়ে বাঁচলেও তো আমরা খেতাম। যেভাবে চারজনের খাবার একা খাস, ইন্ডিয়ান সানলাইট।’

সিমি অবাক হল। দ্রুতই জবাব দিল।

‘কিরে লরিন, সানলাইট আবার কবে ইন্ডিয়ান হল’রে।

লরিন হা হা ইমুজি দিল সাথে সাথে। কিন্তু লরিনের পরিবর্তে জবাব দিল রকি।

‘জানিস, সেদিন ভার্সিটিতে কি কান্ডটাই না ঘটল। ভাগ্যিস, তুই ছিলি না।’

এর মাঝেই আগমন ঘটল চিন্ময়ের। সবার কথার মাঝেই হুট করে সে রিপ্লাই দিল।

‘আরে, ওটা তো বাসি খবর। তাজা খবর হচ্ছে,,, থাক আগামীকাল বলব সবার সামনে। সবাই ভালো করে দাঁত ব্রাশ করে আসবি। বেশ রসালো খবর কিন্তু।’

সাথে সাথে লরিন, সিমি, রকি, সানি অবাক হওয়ার ইমুজি দিল। চারজনেই একই জবাই দিল,

‘তাজা খবর’টা কি?’

চিন্ময়ের হা হা ইমুজি। ফের রিপ্লাই করল,

‘এত অধৈর্য হলে কেমনে হবে বাছা। তবে খবর’টা কিন্তু সেই একটা খবর। সবার চোখ কপালে উঠার মত।’

এর মাঝেই জিমানেরও আগমন ঘটল। সেও রিপ্লাই করল,

‘আমি জানি, তবে এখন বললে জিতু আমাকে উষ্ঠা মেরে খাট থেকে নিচে ফেলে দেবে। আসলে এখন আমি জিতুর রুমে তার সাথে তার খাটে ঘুমাচ্ছি। কিছুদিন পরে তো ঘুমাতে পারব না। তাই এখন ভালো করে ঘুমিয়ে নিচ্ছি।’

সাথে সাথেই সানির রিপ্লাই,

‘কেনো ঘুমাতে পারবি না। দরকার হলে আমরাসহ ঘুমাবো ওর সাথে।’

জিমান রিপ্লাই দেয়ার আগে মুবিন আসল। সে গম্ভীর গলায় বলল,

‘সানি তোর সানলাইটের বাত্তি জ্বালা। জিতু কি সারা জীবন একা থাকবে না’কি? বিয়ে-শাদী করবে না, বেকুব।’

সানি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। দ্রুতই রিপ্লাই করল,

‘সত্যিই জিতু বিয়ে করবে। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না। সে তো মেয়েটার জন্য যা পাগলামি করছে, তাকে যেমন ভালোবাসতো, আমার মনে হয় না অন্য কাউকে সে বিয়ে করবে। না কখনও কাউকে মেনে নিতে পারবে।’

চিন্ময় রাগের ইমুজি দিল দ্রুতই। সানিকে কোপিত কন্ঠে বলল,

‘সানি তোর মাথায় গিলু আছে। দ্রুত এ মেসেজ রিমুভ দেয় জিতু দেখার আগে। ডাঃ বার বার নিষেধ করছে, জিতুর সামনে যেনো ওর অতীত নিয়ে কথা না বলি। তুই আসলেই বেকুব, তোকে পাইলে এখন আমি যে কি করতাম।’

অন্যদিকে সানি নিজের জিহ্বা কামড় দিল। তড়িৎ নিজের মেসেজ রিমুভ দিল। চিন্ময়ও তার রিপ্লাই করা মেসেজ রিমুভ দিল। এর মাঝে জুঁই এসে হায় হায় করল। বাপরে! ১৫৪ আনরিড মেসেজ। এত মেসেজ সে কখন পড়বে। সে রাগের ইমুজি দিয়ে বলল,

‘এই তোরা আস্তে ধীরে কথা বলতে পারিস না। কতগুলো মেসেজ জমাইলি। এগুলো পড়ব কখন আর উত্তর দেব কখন? এখন আমার জন্য মই পাঠা জলদি। আমি অত উপরে উঠতে পারবো না। পা ব্যথা করছে।’

জুঁইয়ের কথায় সবাই হা হা ইমুজি দিল।

মোবাইল হাতে বসে থাকা জিতু সবই দেখল। দু’চোখ থেকে আপনা আপনি পানি গড়িয়ে পড়ল। সে জানে, সবাই তার জন্য কেমন চিন্তা করে। প্রতিক্ষণ কেউ না কেউ তার পাশে থাকে। তাকে হাসানোর চেষ্টা করে। যেনো অতীত স্মৃতি তার পুনরায় রোমন্থন না হয়। কিন্তু সবকিছু কি এতই সহজ। চাইলেই ভোলা যায়। নিজের হাতে রাখা মোবাইল রেখে দিল টেবিলের উপর। টুংটাং শব্দ করে হচ্ছে মেসেজের। বন্ধুমহলের মেসেজ ছাড়াও একসময় এমন মেসেজের টুংটাং শব্দ হত তার মুঠোফোনে। কোন এক বোকা মেয়ে তাকে মেসেজ দিত। সে মেসেজগুলো পড়ত আর নিরবে হাসত। বোকা মেয়ে’টা কত কি লিখত ভয়ে ভয়ে। একবার তার রাগ ভাঙালো আজব এক সম্মোধন করে।

‘বস, আপনি কি এখনও রেগে আছেন।’

জিতু সহসাই হেসে উঠল। বোকা মেয়েটার ছোট ছোট আবদারগুলোও ছিল বেশ বোকা টাইপের। একদিন রাতে যখন তার ঘুম আসছিল না সে হঠাৎই কল করে বসল। ঘড়ির কাটায় তখন রাত ১১:৪৫। তার কল দেখে বোকা মেয়েটা বলে উঠল,

‘স্যার, আপনি কি ম্যাজিশিয়ান? কি করে বুঝলেন, আপনাকে আমার প্রয়োজন। জানেন, আজকে আমার পদার্থ বিজ্ঞানের শেষ প্রশ্নগুলো মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ভেবেছিলাম আপনাকে জানাবো। আপনি ঘুমাচ্ছেন ভেবে কল দেয়া হয়নি। কিন্তু দেখুন না, আপনি নিজেই কল দিয়েছেন। তার মানে আপনি ম্যাজিক জানেন। কেমন করে বুঝে গেলেন আপনাকে আমার ভীষণ প্রয়োজন।’

সেদিন সে ভীষণ হেসেছিল। মেয়েটা ছিল ভারী অদ্ভুত। তার কথা তো তার চেয়েও অদ্ভুত। পিচ্চি পিচ্চি বুলির সমাহার যেনো। তার মুচকি হাসির শব্দ কতই না সুমধুর ছিল। একদম হৃদয় ছুঁয়ে যেত তার। প্রথম দিন যখন নাক টেনে কেঁদে কেঁদে বলেছিল,

‘আঙ্কেল, জানেন আমার আম্মু ভীষণ ভয়ংকর। জানলে আমাকে একদম মেরে দিবে। বিশ্বাস করুন, আমার কোন দোষ নেই, ঐ বজ্জাত কাক আমার হিজাবে টয়লেট করে দিয়েছিল। তাই তো মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে চার’টা নাম্বার ভুল করে ফেলেছিলাম। বিশ্বাস করুন, টাকাগুলো আমার। আপনি কি আমাকে বিশ্বাস করছেন না, আঙ্কেল।’

সেদিন সে মুখ টিপে হেসেছিল। সারাদিন উঠতে বসতে মেয়েটার পিচ্চি পিচ্চি বুলির কথা ভেবেই দিন কাটিয়েছিল। দমকা হাওয়ার মত এসে বোকা মেয়েটা তার হৃদগহীনে প্রবেশ করেছিল। কতটা গভীরে তার জায়গা ছিল, হয়তো বোকা পাখির কখনো জানায় হয় নি। কিন্তু ভালোবেসে কিভাবে ত্যাগ করতে হয় তা শিখিয়ে গেছে অবলীলায়। কতটা হৃদয় জুড়ে বোকা মেয়েটা বসে আছে, যাকে মুছে ফেলার সাধ্যি আজও তার হয়নি। অথচ প্রকৃতি তাদের মিলন লিখেই নি। তাকে পাওয়ার আগেই কেড়ে নিল। বিধাতার নির্মম পরিহাস, মিলন হতে হতেই বিচ্ছেদ ঘটালো। কেনো এমন হল তার সাথে? তার বোকা পাখিকে এভাবে চিরনিদ্রায় ঘুম পাড়িয়ে দিল।

দু’গাল ছুঁয়ে নোনাজল গড়ালো তার গলার মাঝে। জিতু নিশব্দে কেঁদে চলেছে। চোখের জল মোছার তাড়না নেই। দু’চোখ মুদিত। আনমনে দীর্ঘশ্বাস বের হল বক্ষস্থল থেকে। চোখ পিটপিট করে তাকালো গগনবক্ষে। সে বড় অসহায়। সে চাইলেও বোকা পাখির জন্য দোয়া করতে পারে না। তাদের মাঝে যে হালাল সম্পর্ক নেই। হালাল সম্পর্ক হবার আগেই তার বোকা পাখি চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল। কেমন শূন্য করে গেল চিরদিনের জন্য। আজও ভাবতেই তার বক্ষস্থল কেঁপে উঠে। এ কেমন মর্মদহনে দগ্ধ হচ্ছে সে। চাইলে ভোলা যায় না, না সহ্য করা যায়। সে পাগল ছিল তো তখন ভালোই ছিল।

নিজ ভাবনায় আচ্ছন্ন যখন, আচমকাই কারও আলতো স্পর্শ পেল সে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে দেখল তার মা দাঁড়ানো। ফরিদা ছেলের বিমর্ষ মুখ দেখলেন। কষ্টগুলো তিনি বোঝেন। তাই তো চোখে চোখে রাখেন। কখন আবার এই ছেলে মাথার তীব্র যন্ত্রনায় কাতর হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে। তার মুখে চিন্তার ছাপ। এই ছেলে আবারও অতীতে ডুব দিয়েছে। কেনো আজও নিজেকে সংযত করতে পারে না। কাছে বসে ছেলের মাথায় হাত বুলালেন। জিতু স্থির হয়ে বসে আছে। মুখের কোণে অসহায়ত্ব হাসি ঝুলছে। মা’কে দেখে দ্রুতই চোখের জল মুছলো। গলার স্বর স্বাভাবিক করে বলল,
‘আম্মু, কিছু বলবে?’

ফরিদা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ভেজানো গলায় বলল,

‘তোর নানু বাড়ি থেকে কল এসেছে, পনের দিন বাদেই জহিরের বিয়ে। তোর নানুকে দাফন করার পর আর তোর কখনও যাওয়া হয় নি সেই বাড়িতে। দেখতে দেখতে তিন’টা বছর পার হল। এবার অন্তত চল। তোর নানুর কবর জিয়ারত করবি। কতদিন হল তাকে দেখতে যাস না। তুই তো তোর নানুর কত আদরের ছিলি। কত শখের নাতী। ইমু ছাড়া তিনি কিছুই বুঝতেন না। আমি যেতে দেরি করলেও তিনি চলে আসতেন। তার আদরের নাতী ইমুকে দেখার জন্য। চল না বাবা এবার। সাথে তোর বউকেও নিয়ে যাব। মেয়ে’টাও নানা শ্বশুর বাড়ি দেখে আসবে এই ফাঁকে।’

মুহুর্তে জিতুর চোয়ালদ্বয় শক্ত হয়ে গেল। আনমনে বিড়বিড় করল, বউ। কে এই মেয়ে যাকে সে বিয়ে করছে। তার বোকা পাখির জায়গা যে সে কাউকে দেবে না, কখনই না।
________

নিজের পড়া শেষ করে মাত্রই উঠল নুবাহ। আচমকাই রুবি নিজের মোবাইল নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল। নুবাহর সম্মুখে দাঁড়িয়ে কাঁপানো গলায় বলল, ‘নুবাহ, তুই কাউকে তোদের মোবাইল নাম্বার দিয়েছিস।’

নুবাহ বেশ অবাক হল। নিজের মাথায় হাজার বার ঘুরপাক খেল। তবু মনে পড়ল না সে কাউকে মোবাইল নাম্বার বলেছে। রুবির দিকে মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘নাহ, খালামনি আমি কাউকে নাম্বার বলেনি। বিশ্বাস কর।’

রুবি হতাশ হল। কিন্তু নুবাহর কথা অবিশ্বাস করল না। ফের বলে উঠল, ‘নিরব নামে কাউকে চিনিস?’

‘নিরব, হ্যাঁ চিনি। কিন্তু কেনো কি হয়েছে?’

‘কি আর হবে, তোর মায়ের নাম্বারে কল দিয়েছে। জিজ্ঞেস করতেছে, নিশাতকে দেয়া যাবে।’

নুবাহর চোয়াল শক্ত হল। এই নিরবের বাচ্চা তার নাম্বার পেল কোথায়? তার উপর সরাসরি ফোনকল। কাল গিয়ে এই বজ্জাতকে সে কানের নিচে সরাসরি কয়টা গা দিবে। নিজমনে ফুঁসে উঠল নিরবের উপর। জবাবে রুবিকে বলল, ‘খালামনি নিরব আমার সাথেই পড়ে। তবে বিশ্বাস কর, আমি জানি না। এই ছেলে নাম্বার পেল কোথায়? কাল কলেজ গিয়ে এর মাথায় কয়েক গা দিব আমি।’

‘আম্মু, যাই করিস না কেন? সাবধানে চলিস। নয়তো তুই তো জানিস তোর বাবা কেমন। তখন বিয়ের কাজ আরও দ্রুত করবে।’

মুহূর্তে নুবাহর মুখ’টা বিবর্ণতায় আচ্ছন্ন হল। বিয়ে, সত্যিই বিয়ে হয়ে যাবে তার। ইমদাদকে সে আর খুঁজে পাবে না। কিভাবে খুঁজে পাবে। কত কিছু তো চেষ্টা করল। কিন্তু আগামীকাল অন্যভাবে চেষ্টা করবে সে।

চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here