#হিয়ার_মাঝে ৩৫.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️
নীলাভ জিমানের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। ড্রয়িংরুমে তাদের সবাইকে নাস্তা দেওয়া হয়েছে। অথচো নীলাভ উপর তলায় উঠে এসেছে। পাশে হৃদিও আছে। দু’জনের চোখ দুই পুরুষ অবয়বের দিকে নিবদ্ধ। একজন চিন্ময়তে মজেছে, অন্যজন জিমানের মাঝে। নিভান রিদান এরা নিচে ড্রয়িংরুমে বসে নাস্তা করছে। গরম গরম চিকেন স্যুপ দেয়া হয়েছে দু’জনকে। খুব বেশি ভারী নাস্তা দেওয়া হয়নি। তাদের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে। নীলাভ হৃদি কোনোভাবে খেয়ে উপরে উঠে এসেছে। নুবাহর নানুকে দিলারার সাথে রাখা হয়েছে। তিনি দিলারার সাথে খোশগল্পে মজেছেন। জয়তুন পান খাওয়া লালচে দাঁত নিয়ে হাসছেন। দিলারা পান সুপারি একদমই পছন্দ করেন না। তার মতে এটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। পান অনেকটাই সিগারেটের মতই বিষাক্ত। তার উপর পানের লালচে পিক যেখানে সেখানে ফেলে পরিবেশ দূষণ করে। দেখতেও বিচ্ছিরি লাগে তার কাছে। তাই পান ছুঁয়েও দেখেন না। কিন্তু জয়তুন এসেছেন ঘন্টা খানেক মাত্র। এর মাঝেই তিনি দু’বার পান খেয়ে নিয়েছেন। আরেক দফা খাওয়ার জন্য নিজের পুটলি বের করছেন। দিলারা নিজমনে ফুঁসছেন। তার বেসিনটা কিছুসময়ের মধ্যে লালচে করে দিয়েছে। নেহাৎ তার নতুন আত্নীয় হয়, নয়ত এই মুহুর্তে কিছু কথা অবশ্যই বলতেন। দাঁতে দাঁত চেপে জয়তুনের পান খাওয়া দেখছেন। জয়তুন পান চিবুচ্ছে, রসে লাল হয়ে আছে তার শুকনো ঠোঁট। খাওয়ার ফাঁকে বলল,
‘বুবু আম্নেরে একখান পান বানাইয়া দিই, খাইবেন নি।’
দিলারা কিঞ্চিৎ হাসলেন। মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘না আপা, আমি পান খাইনা। পান কোনোদিন ছুঁইয়াও দেহি নাই।’
জয়তুন লাল রসে ভেজানো দাঁত দেখিয়ে হেসে উঠলেন। ‘কি যে কন বুবু, আমার তো পান ছাড়া চলেই না। পান না খাইয়া এক মুহুর্ত চলবার পারি না।’
কথা শেষে জয়তুন নিজের হাতে রাখা রুমাল দিয়ে মুখের চারপাশের রস মুছে নেন। আবার কিছুসময় পর পর বেসিনে গিয়ে পানের পিক ফেলে আসেন। পিক ফেলে মনে পড়লে বেসিনে পানি দেন নয়তো ফেরত আসেন। দিলারা বেশ কষ্টে হজম করছেন এই মহিলার নোংরা স্বভাব। তার সুবিধার্থে পুরো রুম সেই ভাবেই সাজিয়েছেন তার ছেলে। তার নিজস্ব বেসিন বাথরুম আছে রুমের মধ্যে। এমনকি খাট বানিয়েছেন তার সুবিধেমত নিচু করে। বিছানার সাথে জরুরি এলার্ম বোটাম রেখেছে। যাতে দরকার হলে তিনি সবাইকে ডাকতে পারেন। রুমে তার বিছানা ছাড়াও আরো একটি বাড়তি বিছানা রাখা হয়েছে। মাঝে মাঝে তার ছেলে রুমে ঘুমান। রাতে তার সুবিধে অসুবিধে দেখার জন্য। আবার মাঝেমধ্যে তার ছেলের বউও এই ঘরে ঘুমান তার দেখভাল করতে। তার পরিবার কত সচেতন তাকে নিয়ে। তার রুম প্রতিদিন দু’বার করে পরিষ্কার করে। যাতে কোন রোগ জীবাণু না থাকে। সে অসুস্থ না হয়। কিন্তু এই নোংরা মহিলা তো তাকে একদিনেই অসুস্থ করে দিবে। মহা জ্বালায় আছে সে। নিজমনে বিড়বিড় করছে এই মহিলাকে অন্যরুমে দেয়া উচিৎ ছিল। তার লগে ক্যান দিল? তার রুমটায় নোংরা কইরা দিল।
নীলাভ হৃদি করিডোরের এককোণে দাঁড়ানো। ঈশিতা এসে তাদের পাশের রুমে ঘুমানোর জায়গা করে দিল। রাত তো কম হয়নি। তাদের তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে বলল। তাদের পাশে রিদান নিভান এদের কেও রাখতে বলল। রুমে দু’তলা বিশিষ্ট খাট। হৃদি নীলাভ নিচের তলায় আর নিভান রিদান উপর তলায় শুয়েছে। কিন্তু হৃদি নীলাভের চোখে ঘুম নেই। হৃদি আচমকাই বলে উঠল,
‘নীলাভ, নুবাহ আপুর শ্বশুর বাড়ি কত বিশাল। যেদিকে তাকায় সেদিকেই ফাঁকা। কত্ত খোলামেলা বাড়ি। কতগুলো রুম আছে এই বাড়িতে আল্লাইহ জানে। আমি তো অল্প কয়টা দেখেই অবাক। আচ্ছা, তুই কি জানতি নুবাহ আপুর শ্বশুর এত্ত বড়োলোক।’
নীলাভ কিঞ্চিৎ মাথা নাড়াল। উৎসুক হয়ে বলল, ‘না আপু, আমিও জানি না। শুধু শুনছি, উনাদের পাঁচতলার একটা সুপারমল আছে। কিন্তু বাড়ি চৌদ্দতলার, এটা এখন এসে দেখলাম। আপুর শ্বশুর নয় আর আট তলা মিলিয়ে ডুপ্লেক্স বানিয়েছে। আর বাকি বাড়িতে ভাড়াটিয়া থাকে। আমি নিজেও অবাক এত বড় বাড়ি দেখে।’
‘আচ্ছা, নীলাভ আমাদের কে নুবাহ আপুর পাশের রুমটায় থাকতে দিল না কেন? ঐ রুমটাও তো খালি ছিল। জারিব ভাইয়ার পাশের রুমে কেন থাকতে দিল। আবার আপুর রুমেও ঢুকতে দিল না। দুলাভাইয়ের বন্ধু জিমান আমাদেরকে বলল আমরা না’কি পিচ্চি। তাই এসব দেখা বারণ। কাল সকালেই দেখতে পারব। কি অদ্ভুত তাই না!’
নীলাভ কিছু একটা ভাবল। কিছুসময় পর জবাব দিল, ‘আপু, আমার মনে হয় বাসর ঘর সাজিয়েছে। তাই হয়তো ঢুকতে দেইনি।’
হৃদির মনটা বিষিয়ে গেল। সে তো অজুহাত দিয়ে চিন্ময়ের পাশে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু বিধিবাম জিমান মাঝখানে কাবাবের হাড্ডি হয়ে তাদের প্রবেশই করতে দেয় নি। উল্টো তাদের সুন্দর করে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,
‘বেয়ান সাহেবা আপনি অনেক পিচ্চি, আজ কে আপনাদের প্রবেশ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। কাল সকালেই আসিয়েন।’
ঈশিভাবী তাদের নিয়ে এই রুমে দিয়ে গেল। জিমানটাকে তার বড্ড বিরক্ত লেগেছে। লম্বা মানুষ আসলে একটু বুঝে বেশি।
নীলাভ হৃদির শব্দ না পেয়ে ফের প্রশ্ন করল।
‘আপু ঘুমাচ্ছো।’
হৃদির উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না। নিশ্চুপ চোখ বুজে আছে। নীলাভ সাড়া না পেয়ে ফোৎ করে নিশ্বাস ফেলল। ভাবল হয়তো হৃদি ঘুমিয়ে পড়েছে। কম্বল’টা টেনে নিজের মুখ আরও ভালো করে ঢেকে নিল। ডান কাত হয়ে সেও চোখ বুঝল। অথচ মন তার আকুপাকু করছে জিমানকে দেখতে।
___
বন্ধুমহল বেশ উদ্বিগ্ন। চিন্ময় এখনও হিসেব মিলাতে ব্যস্ত। বিয়ের মঞ্চেও সে জিতুকে মিটমিট করে হাসতে দেখেছে। কিন্তু বউ নিয়ে গাড়ি থেকে নামতেই তার হুট করে পরিবর্তন হওয়া, এটা বেশ উদ্বেগের কারণ তার কাছে। জিতুর রুমের পাশাপাশি অন্যরুমে বিছানায় গোল হয়ে বন্ধুমহল বসে আছে। চিন্ময় চিন্তার মাঝেও দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে উঠল,
‘শালা, আমাদের ঠকানোর জন্য বাসর ঘর সাজাতে দেয় নি। তার উপর দরজা লাগিয়ে আগে আগে গিয়ে চুপ মেরে বসে আছে।’
রকিও তাতে সুর টানলো। মাথার চুল চুলকাতে চুলকাতে বলে উঠল,
‘আসলেই ফুলসজ্জার টাকা না দেওয়ার ধান্দা ওর। আমরা সব বুঝি।’
সানিও হতাশার সুর তুললো মুখে।
‘হালায় নিজেও বাসর করবে না, আমাদের টাকাও দিল না। আহ, এই হালা পুরাই নিরামিষ। নতুন বউ রেখে কেউ নিজের রুমে লক দিয়ে বসে থাকে।’
চিন্ময়ের মুখে দুষ্ট হাসি। মুখ বাকিয়ে বলে উঠল, ‘আজ বাসর করতে চাইছে না, কাল শুনবি সেই সবার আগে বাপ হয়ে বসে আছে।’
বন্ধুমহলের মাঝে চাপা হাসি। কিঞ্চিৎ শব্দ করেই হেসেই উঠল সবাই।
উত্তেজিত চিন্ময় ফের বলে উঠল, ‘আমি সত্যিই জিতুর জন্য মসজিদে টাকা দিমু। দরকার হলে ফকির-মিসকিন খাওয়ামু। নামাজ পড়ে এই দোয়ায় করমু, এই পোলা সবার আগে যেনো বাচ্চার বাপ হয়। আজকে আমাদের এইভাবে মিসকিনের মত বসাইয়া রাখছে। সেও একদিন এভাবে বাচ্চার ব্যাটালিয়ন নিয়ে মিসকিনের মত বসে থাকবে। দোয়া করে দিলাম।’
তাদের অদ্ভুতুড়ে আলোচনার মাঝে আচমকাই জুঁইয়ের আগমন ঘটল। সে সবার জন্য গরম কপি নিয়ে এসেছে। তার আগমনে চুপচাপ আধবোজা মুবিন দ্রুতই চোখ খুলল। তার শান্ত স্থিরদৃষ্টি জুঁইয়ের মাঝে নিবদ্ধ। জুঁইয়ের গায়ে আসমানী রঙা জামা, মাথায় গোল করে ঘোমটা টানানো। দেখতে কেমন যেনো বউ বউ লাগছে তার কাছে। ইশশ, এমন একটা দিন কি তার জীবনে আসবে। জুঁইফুল তার জন্য গরম চা নিয়ে আসবে। আলতো হেসে তার হাতে তুলে দেবে। আর সে চা নেওয়ার বাহানায় জুঁইয়ের হাত টেনে ধরবে। কাছে টেনে বাম পাজরের মাঝে চেপে রাখবে। লজ্জায় নুইয়ে যাওয়া জুঁইয়ের কপালে সে তার ভালোবাসার পরশ আঁকবে। তারপর কানের কাছে ফিসফিস করে বলবে,
‘জুঁইফুল তুমি এত মিষ্টি কেন? শুধু ভালোবাসার পরশ ছুঁয়ে দিতে মন চায়। কেন এত মায়াবী তোমার ঐ দু’চোখ, আমার দিন কাটে সেই চোখের গভীরতায়। তোমার অপরূপ রূপে নিজেকে হারিয়েছি বার বার। তোমার ঐ লাজুক রাঙানো হাসিতেও আমি দিশাহীন। তোমার এত রূপ কেন জুঁইফুল? কেন এত রূপে ফিরে আসো আমার কাছে? তুমি কি ইন্দ্রজাল জানো? নাকি কোন ঐন্দ্রজালিক?’
মুবিন মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় জুঁইকে দেখে যাচ্ছে। অথচো তাকে ডেকে ডেকে ক্লান্ত জুঁই। শেষে নিজের হাত দিয়ে মুবিনের সামনে ইশারা করল। এতেই মুবিনের ধ্যানভঙ্গ হল। সহসাই এমন হওয়ায় বিস্মিত হল তার আঁখি জোড়া। হঠাৎই বলে উঠল,
‘কি হয়েছে জুঁইফুল? এমন করছো কেনো?’
জুঁইফুল নামটা শুনেই বেশ লজ্জা পেল জুঁই। হুটহাট মুবিন তাকে জুঁইফুল ডাকে। এই ডাকের মধ্যে কেমন মাদকতা মেশানো। তার কাছে এই ডাক অতীব প্রিয়। মাঝে মাঝে তারও বলতে ইচ্ছে করে আমাকে এই নামেই ডেকো। আমার খুব ভালো লাগে শুনতে। কিন্তু লজ্জায় সে হাসফাস করে যখনই মুবিনের সামনে আসে। কখনই বলা হয়নি তার না বলা এই প্রিয় বাক্য। সে মুবিনের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারল না। কপির ট্রেতে দৃষ্টি রেখেই বলে উঠল,
‘মুবিন কপি খাবে?’
মুবিনের দু’চোখে এক রাজ্যের ঘুম। কপি খেলে ঘুম ফুড়ুৎ হয়ে যাবে। তবুও জুঁইয়ের হাত থেকে কপি খাওয়া সে মিস করবে না। তড়িৎ জবাব দিল, ‘মাথা’টা একটু ধরেছে, কপি খেলে ভালো লাগবে। হুমম, দাও কপি।’
জুঁই এক মগ কপি মুবিনের দিকে বাড়িয়ে দিল। মুবিন কপি টেনে নিল বেশ আলতো হাতে। তবুও আঙ্গুলের কিঞ্চিৎ ছোঁয়া লাগল জুঁইয়ের হাতে। জুঁইয়ের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেনো মুহুর্তে এক অদ্ভুত বার্তা প্রেরণ করল তাকে। তনুমনে যেনো শীতলতা ছুঁয়ে গেল। যার মাঝে পুরো মাদকতা মেশানো। সে এক অদ্ভুত শিহরণ! এখানে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না তার। তার মন মস্তিষ্ক সব অতলে ডুবে যাচ্ছে। সে দ্রুতই মুবিনকে কপি দিয়ে জিমানের কাছে গেল। তাকে জিজ্ঞেস করল কপি খাবে কি’না। জিমান খেতে চাইলো না। অনেক রাত হয়েছে, তার উপর কপি খেলে সহজে তার ঘুম আসবে না। চিন্ময়কে জিজ্ঞেস করার আগেই সে জুঁই থেকে কপির মগ নিয়ে নিল। মুখে তার প্রসন্ন হাসি। আনমনে তার অক্ষিযুগল জুঁইতে নিবদ্ধ। মেয়েটাকে তার কাছে আজ অপ্সরী লাগছে। যেনো গাছে ফোটা এক স্নিগ্ধ জুঁইফুল। চিন্ময় নিজমনে হাসল।
জুঁই কপি দিয়ে দ্রুতই রুম ত্যাগ করল।
সবাই জিতুকে নিয়ে বিভিন্নরকম ভাবনায় ডুবে আছে। কেউ হতাশ, কারো চোখে বিস্ময়। আর কারো চোখে জিতু মানেই রহস্য। কখন কি করে এই ছেলে তারা বুঝে উঠতে পারে না। যখন সবাই জিতুর রহস্য উন্মোচনে ব্যর্থ তখন হুট করে জিমান বলে উঠল,
“আমি জানি জিতুর কি হয়েছে? সেই ডায়পার পরা অবস্থা থেকে দু’জন একসাথে বড় হয়েছি। বয়সে ও আমার সাতদিনের বড় মাত্র। তাই ওর নাড়ি নক্ষত্রও জানা আছে আমার। আমি যদি ভুল না হয়, প্রথমত সে নুহাহর সুই,,সাইট মানতে পারেনি। তার একমাত্র কারণ হচ্ছে, সে ভাবে নুহাহ তার জন্যই মা,রা গিয়েছে। তার সময়মত না পৌঁছানো দ্বিতীয়ত সে দীর্ঘ একমাস যোগাযোগ করতে পারেনি। এমনকি সেইদিন মেয়েটা তার অপেক্ষায় পুরোদিন কাটিয়েছিল। যার ফলে পরিবার কোনোভাবে টের পেয়েছে। তার অন্য কোন ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে। এজন্য মেয়েটাকে জোর করে অন্যত্র বিয়ে দিতে চেয়েছিল। ফলাফল স্বরূপ, মেয়েটা নিজেকে বলিদান করে। একমাস তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে মেয়েটা তাকে জানাতে পারে নি। এর জন্যও নিজেকে দায়ী ভাবে জিতু। সে নুহাহকে যতটা ভালোবাসে তার থেকেও বেশি নিজের উপর নিজেই আঙ্গুল তোলে মেয়েটার মৃ,ত্যুর কারণ হিসেবে। এজন্যই নুহাহকে ভুলতে চাইলেও সে ভুলতে পারে না।
আর বিয়ের কথা যদি বলি, নুবাহকে দেখে কিন্তু সে অখুশি ছিল না। নুবাহর প্রতি তার প্রগাঢ় অনুভূতি আছে। তারও একটাই কারণ, নুহাহ আর নুবাহ এই নামের মিল। আমি ওর অনেক খাতায় নুবাহ নুহাহ দুটো নামই একসাথে লিখতে দেখেছি। এমনকি ডায়েরির অনেক পাতায় নুবাহ নুহাহ দুটো নামই লিখা আছে। যবে থেকে নুবাহ নামটা চোখে পড়েছে সে অদ্ভুতভাবে নুবাহর প্রতি দৃষ্টি দিয়েছে। তার কাছে মাঝেমধ্যে নুবাহকেই নুহাহ মনে হয়। কিন্তু যখন মনে পড়ে নুহাহ নেই, হারিয়ে গেছে। আর কখনই ফিরবে না। তখন সে অদ্ভুত আচরণ করে।
এখন যে আচরণ করেছে তার মুখ্য কারণ, সে আসলে নুবাহর থেকে পালাতে চাইছে। নুহার জায়গায় নুবাহকে বসাতে পারছে না। নিজেই নিজের অনুভূতিকে লুকাতে চাইছে। আমি শতভাগ সিওর না হলেও আমার পূর্ণ ধারণা, এটাই হতে পারে তার অদ্ভুত আচরণের মূখ্য কারণ।”
বন্ধুমহল সায় জানালো জিমানের সাথে। হতে পারে। কিন্তু তাদের মাঝে এখনও আফসোস, ফুলসজ্জার টাকা খসাতে না পেরে।
___
গভীর রাত। যান্ত্রিক শহরে এখনও গাড়ি চলার সাই সাই শব্দ ভেসে আসছে। ঘড়ির কাটায় রাত একটা। নুবাহকে জিতুর বরাবর সামনের রুমে রাখা হয়েছে। জিতুর রুমে প্রবেশ করতে ভেতরে মাঝ বরাবর করিডোর। একপাশে তার জন্য মাস্টার বেডরুম। আর করিডোর পেরিয়ে তার সামনের রুম ভবিষ্যৎ বাচ্চাদের কথা ভেবে রুম তৈরি করা হয়েছে। তাই রুমের বাইরে থেকে বুঝার সাধ্য নেই ভেতরেও দুটো রুম আছে। সবাই ভেবে নিবে নুবাহ হয়তো জিতুর সাথে তার রুমেই আছে। নুবাহ নিজেও অবাক হল যখন ঈশিতা তাকে বলল,
‘এই রুম কাদের জানো নুবাহ? এই যে দেয়ালে গোলাপি রঙ করা, তার মাঝে গাছ-ফুল আঁকা। ভাবো তো কার হতে পারে?’
নুবাহ অবাক হল। কিঞ্চিৎ মাথা নাড়িয়ে না বলল। তখনই ঈশিতা মুচকি হেসে বলল,
‘এটা তোমার বাচ্চার রুম। আমার শ্বশুর মশায় বেশ বুদ্ধিমান। পুরো বাড়ি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে বানিয়েছে। আমাদের রুমটাও এমন। ইনশিয়ার রুমে এখন তোমার বোনদের রেখেছি।’
নুবাহ বাচ্চার কথা শুনে বেশ লজ্জা পেল। সেই থেকেই এখনো লজ্জা মাথায় চেপে বসে আছে। তার রুমের বিছানা ভীষণ সুন্দর। গোলাকার বিছানা, চারদিকে পর্দা টানানো। পাশে বাচ্চাদের জন্য ওয়াল আলমিরা ফিট করা। সবকিছু আগে থেকেই গুছানো। তার শ্বশুর আসলেই বুদ্ধিমান। তাই তো এত সফল আজ। বালিশে মাথা রাখতেই ঘুম যেনো দ্রুতই ছুটে এল তার দু’চোখ জুড়ে। কিন্তু জিতুর করা কান্ড এখনো তার মাথায় ঘুরছে। বদলোক একটা।
____
সময় গড়ালো বেশ। রাত যেনো ছুটে চলেছে নিজ গতিতে। ঘড়িতে ভোররাত চার’টা ছুঁই ছুঁই। জিতু দীর্ঘ সময় ধরে বিছানার এক কোণে জবুথবু হয়ে শুয়ে ছিল। হতাশায় নিমজ্জিত শরীরে অজান্তে কখন ঘুম ধরা দিয়েছে, তার জানা নেই। ঘুম ভাঙতেই হুট করে মনে পড়ল নুবাহর কথা। মেয়েটাকে সে প্রবেশদ্বারের সামনে ছুঁড়ে ফেলে এসেছিল। তারপর মেয়েটার কি হয়েছিল? এখন কোথায় আছে? নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছে তার ব্যবহারে। এভাবে তাকে ফেলে ছুটে আসা তার উচিৎ হয় নি। সবাই তাকে নিয়ে কুটুক্তি করবে এখন। কাজ’টা একদমই বাজে করেছে সে। মনটা তার ভীষণ আকুপাকু করছে। মেয়েটা এখন কোথায় আছে জানতে?
সে দরজা খুলে বের হতেই তার সামনের রুমে চোখ পড়ল। ঈষৎ সবুজ বাতি জ্বলছে সেই রুমের ভেতর। কিঞ্চিৎ অবাক হল। এই রুমে কে আছে? করিডোর পেরিয়ে শব্দহীন দরজার নব ঘুরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। ঈষৎ আলোয় বোঝা মুশকিল কে আছে এখানে। বিছানার চারপাশের পর্দা সরিয়ে যা দেখল তাতে অস্থির মনটা মুহূর্তে শান্ত হয়ে গেল। হুট করে সে মেঝেতে বসে পড়ল। নুবাহর হাত দু’টো ছোঁয়ার বেশ ইচ্ছে জাগল। কিন্তু সাহস হল না, যদি মেয়েটার ঘুম ভেঙে যায়। শুধু অপলক দৃষ্টি দিল তার মুখাবয়বে। কেনো তার এত অস্থির লাগে। আবার এই মুখ’টা দেখলে সে শীতলতা অনুভব করে। কেন এমন হয় তার সাথে? নিজমনে বিড়বিড় করল,
‘নুবাহ তুমি আমার নুহাহ হলে না কেন? খুব বেশি কি ক্ষতি হয়ে যেত আমার নুহাহ হলে? আজ যদি আমার নুহাহ হতে আমাদের রাত’টা হত কত মধুময়। তুমি লজ্জায় নুয়ে যেতে, আমি তোমার লজ্জা আরও বাড়িয়ে দিতাম। কত স্মৃতিমধুর এক স্বপ্নের রাত হত দু’জনের।’
চলবে,,,,,,