#হিয়ার_মাঝে ৩.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️
ক্লাস শুরু হওয়ার দশমিনিট পূর্বেই প্রবেশ করল নুবাহ। হ য ব র ল পুরো ক্লাস জুড়ে। এসব পাশ কাটিয়ে দ্বিতীয় বেঞ্চে তমার পাশে গিয়ে বসল। তাকে দেখেও সাড়াশব্দ নেই তমার। দৃষ্টি নিচের দিকে। নুবাহ বেশ অবাক হল। নিজের এক ভ্রু উঁচিয়ে ধরল। ‘কি ব্যাপার! এমন বেলুনের মত ফুলে আছিস কেন?’
জবাবে উল্টো তমা কিঞ্চিৎ মুখ বাঁকালো। লম্বাটে শুভ্রবর্ণ মুখশ্রীতে সূক্ষ্ম রাগের আভাস। নুবাহ ফের বলল।
‘তুই কি জানিস, গাল ফুলিয়ে রাখলে তোরে কিন্তু রিনা খানের মত জোস লাগে।’
কথাগুলো বলেই নুবাহ দন্তপাটি দেখিয়ে হেসে দিল।
তমার চোয়াল পূর্বের চেয়ে দ্বিগুণ শক্ত করল।
‘কাল কোথায় ছিলি নিশিরাত? কতবার কল দিলাম রাতে। কল রিসিভ করলি না কেন?’
নুবাহ আৎকে উঠল। মুখে এক হাত চেপে ধরল।
‘ইয়া আল্লাহ আমার ফোন। কালরাতে রিংটোন অফ করে বিছানার নিচে রাখছিলাম। স্কুলে আসার সময় মনেই ছিল না। এখনো বিছানার নিচেই আছে। কিন্তু তুই কেন কল দিয়েছিলি।’
তমার সন্দিহান দৃষ্টি।
‘রিংটোন অফ করছিলি কেন, আগে সেটা বল?’
‘আরে, আব্বু আসছে তাই।’
‘তো, আঙ্কেল আসলে রিংটোন অফ করতে হবে কেন!’
নুবাহ উত্তর দেয়ার জন্য দু’ঠোঁট ফাঁক করল মাত্র। সবচেয়ে রগচটা স্যার প্রবেশ করল তৎক্ষণাৎ। সবাইর সাথে তারা দু’জনও উঠে দাঁড়াল। স্যারের হাতে ক্লাস টেস্ট পেপার। নুবাহ ভীত চোখে তাকাল সেইদিকে।
নিজাম স্যার একে একে সবার নাম নিলেন। দৈবাৎ বলে উঠল,
‘নিশাত নুবাহ’
নুবাহ আৎকে উঠল। ধীর কদমে গিয়ে পেপার নিল। হাতে নিয়ে দেখে যা’ ভেবেছে তাই। স্যার কঠিন গলায় বেশ কথা শোনালেন।
‘নিশাত তোমাকে বিজ্ঞান বিভাগে কে আসতে বলেছিল? শুধুমাত্র টেনেটুনে পাশ করার জন্য। পঞ্চাশের মধ্যে রসায়নে বিশ, পদার্থে ঊনিশ, জীববিজ্ঞানে পঁচিশ, আর উচ্চতর গণিতে ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে কম নাম্বার তোমার। মাত্র সতের। কতটা হাস্যকর তোমার রেজাল্ট। এটা কোন পাশ হল। এভাবে পড়লে তোমার ভালো রেজাল্ট তো দূরে থাক, তুমি পাশ করবে কিনা এখন সেটাই সন্দিহান। দেখ শেষবার বলছি, এখনও প্রায় দু’মাস সময় আছে। একটু সিরিয়াস হও। এভাবে পড়াশোনা করে নিজের সুনাম ক্ষুন্ন করিও না। যাও এখন।’
পেপার হাতে নিজের বেঞ্চে গিয়ে বসল। পুরো ক্লাসে আঁড়চোখে দেখল, মেয়েরা তার দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে। জেবা, লিমা, ফারহানা মিটমিট করে হাসছে। তমা তাকে সান্ত্বনা দিল। মন খারাপ করিস না। ফাইনালে দেখবি তুই অনেক ভালো রেজাল্ট করবি। ছলছল চোখে নুবাহ তমার দিকে তাকাল। আদৌ কি সে পারবে ভালো রেজাল্ট করতে। তমার রেজাল্ট বরাবরই ভালো। আজও তার বিপরীত হল না। পঞ্চাশের মধ্যে চল্লিশের মধ্যে তার সব বিষয়।
পরের ক্লাসে আসলেন আতাউর স্যার। তিনি ম্যাথ টিচার। তবে আজকে অন্য টিচারের পরিবর্তে এসেছেন। নুবাহ অবাক হল। ওবায়দুল স্যার কোথায় আজকে? কিন্তু তার বিভ্রম দূর হল স্যারের কথায়। ওবায়দুল স্যারের মেয়ে হয়েছে তাই তিনি আজ স্কুলে আসেননি। আজকে তোমাদের ক্লাস আমি নেব। নুবাহ খুশিতে লাফ দিয়ে উঠল। স্যারের মেয়ে হয়েছে। তমা তাকে শান্ত করল। তোকে কালরাতে বলার জন্যই কল দিছিলাম বদমাইয়া।
আতাউর স্যার একটা বিশেষ ঘোষণা দিলেন।
‘সুদীর্ঘ বার বছর পর বাবা হওয়ার খুশিতে ওবায়দুল স্যার শনিবার দুপুরে নিজ বাড়িতে বিশাল ভোজনের আয়োজন করেছেন। সেখানে স্কুলের সকল শিক্ষার্থী আর শিক্ষক আমন্ত্রিত। তোমরা কিন্তু সময়মত চলে এস।’
উচ্ছ্বাস পুরো ক্লাসের শিক্ষার্থীদের মাঝে। স্যারের বাড়িতে দাওয়াত। এ তো পরম আনন্দের ব্যাপার!
___________
ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফিরার জন্য স্কুল থেকে কয়েক কদম পা বাড়াল মাত্র। আচমকাই চোখ পড়ল অদূরে দাঁড়ানো বাবলু মির্জার দিকে। তমা নুবাহকে টিপ্পনী মারল। ঐ দেখ তোর ‘মণ মাণুশ’ দাঁড়িয়ে আছে। বেচারা তোর অপেক্ষায় প্রহর গুনছে’রে নিশিরাত। নুবাহ লাভার মত ফুঁসে উঠল। চুপ কর’ ঐ মদনার বাচ্চার কথা একদম বলবি না’তো। জাষ্ট বিরক্তিকর! মন চাইলে তুই যা’। তমা মুচকি হাসল। দুজনে পায়ের কদম বাড়াতেই বাবলু মির্জা এগিয়ে এল। কাচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়াল তাদের সামনে। গায়ে তার সাদাকালো মিশ্রিত ফকফকা নতুন শার্ট। প্যান্ট পায়ের গোঁড়ালি ছুঁয়ে জুতোর মাঝে মিশে আছে। নায়ক জিৎ এর মত স্টাইল করে প্যান্টের ভিতর অর্ধেক শার্ট গুজে রাখা। বাকি অর্ধেক শার্ট ঝুলে আছে বাইরে। তবে এত সাজার পরও তাকে দেখে সেই মদন আলীই লাগছে। শ্যামবর্ণ গায়ে একদম বেমানান এই শার্ট। বাবলু মির্জার অপরূপ সাজ দেখে নুবাহর বুক ফেটে যাচ্ছে হাসার জন্য। সুপ্তমনে একটাই বাক্যেই মনে এল। ‘আহ! কি সুন্দর, ফুটফুটে সুন্দর’।
বাবলুর মুখের কোণে ঈষৎ হাসি ঝুলছে। নুবাহর দিকে তার লাজুক দৃষ্টি। ব্যাকুল বদনে অভিমান জড়ানো গলায় বলল,
‘নেশারানী, আমার চিডির জবাব দাওনা ক্যা? আর কয়দিন অপেক্ষা করতে অইব?’
নুবাহ পড়ল মহাবিপদে। এখন কি উত্তর দেবে। জবাব হাতড়ে বেড়াচ্ছে আনমনে। কিন্তু তমা হুট করে বলে উঠল,
‘আরে, বাবলু ভাই এত অধৈর্য হলে হবে। আরও একটু অপেক্ষা করুন। অপেক্ষার ফল কিন্তু বেশ মিষ্টি হয়। আপনি জানেন না।’
বাবলু মুচকি হাসল। আনমনে মাথার চুলে হাত বুলালো। নেশালো দৃষ্টি নুবাহতে নিবদ্ধ তখনও। তমা মুচকি হাসল। তার হাতে নিশাতের হাত মুষ্টিবদ্ধ। দ্রুত কদমে পা বাড়ালো সামনের দিকে। নুবাহ তেতে উঠল। তমার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি দিল। কিছুদূর যেতেই খেকিয়ে বলল, তুই মদনার বাচ্চার সাথে এত নরম করে কথা বললি কেন? আর অপেক্ষা করব মানে? এসব কি তমা?’
তমা আলতো করে এক চাপড় মারল নুবাহর মাথায়। তিরিক্ষি স্বরে বলল,
‘মাথায় ব্যামো আছে তোর? ওদের সাথে গরম করে কথা বললে অস্তিত্ব থাকবে আমাদের। ওর বাপ না হওয়া এমপি এই এলাকার। তাদের ক্ষমতা সম্পর্কে তোর কোনো ধারণাও নাই। তাই মানে মানে পার হয়ে এলাম বদম্যাইয়া।’
নুবাহ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তাহলে এই ব্যাপার! তমার মত তার মাথায় কেন বুদ্ধি নেই। তাই তো বোকা মেয়ে বলে বেড়ায় সবাই। আচামকাই মনে পড়ল সেই ছেলেটার কথা। আনমনে আৎকে উঠল সে। দ্রুতই কদম লাগাল বাড়ির দিকে।
বাড়ি ফিরে সবার আগে নিজের মুঠোফোন খুঁজে নিল। কত কিছু ভেবেছিল নিজমনে। কিন্তু নাহ তার কিছুই হইনি। ছেলেটার ফোন কল নেই। আবারও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। যাক বাবা বাঁচা গেল!
সন্ধ্যায় পড়তে বসল। সবার আগে নিল রসায়ন। রসায়নের রাসায়নিক বিক্রিয়া করতে করতে সে নিজেই নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে। আর পদার্থ পড়ে তার মনটাই অপদার্থ জড়বস্তু এখন। জীববিজ্ঞান তাও চলে কোনভাবে। কিন্তু উচ্চতর গণিত তাকে একদিন পাগলগারদে পাঠাবে নির্ঘাত। অসহ্যকর রসায়ন রেখে উচ্চতর গণিত নিয়ে বসেছে। বার’টা অংকের মধ্যে দু’টো অংক শেষ করেছে মাত্র।
কিন্তু অতর্কিত রশিদের আগমন ঘটল। নুবাহ তড়িৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সারাদিন তার বাবার সাথে দেখা হয়নি। মাত্রই বাড়ি ফিরল। আর এসেই তার রুমে হাজির। ভীত তটস্থ দু’আঁখি। নুবাহ ভয়ে দরদর করে ঘামছে। রশিদ তার টেবিলের সামনে দাঁড়ানো। সে কাঁপা ভেজানো গলায় বলল,
‘আসসালামু আলাইকুম আব্বু।’
রশিদ সালাম নিল। কিন্তু গলার স্বর ভীষণ রুক্ষ। তোমার পড়ালেখার কি অবস্থা। নুবাহ ক্ষীণ স্বরে বলল, জ্বী, ভালো।
রশিদ হুংকার ছাড়ল।
‘এজন্য ক্লাস টেষ্টে ফেইল করছো? পড়াশোনা করছো নাকি ঠেলাগাড়ি চালাচ্ছো। আজ থেকে রাত এগারো পর্যন্ত পড়বে, ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে আবার পড়তে বসবে। জিপিএ যদি ফোর এর নিচে আসে তাহলে আর পড়ার দরকার নাই। শুধু নাম দেখানোর জন্য পড়তে হবে না।’
কঠিন গলায় কথাগুলো বলে গটগট করে রুম থেকে বেরিয়ে যান রশিদ। নুবাহর দু’চোখ শ্রাবণের অঝোর ধারার মত টইটম্বুর। অশ্রু গড়াল চোয়াল বেয়ে টেবিলের বইয়ের পাতায়। তার চিৎকার করে খুব বলতে ইচ্ছে করছিল। আমি তো বিজ্ঞান বিভাগ নিতে চাইনি। কেনও জোর করে চাপিয়েছেন আমার উপর। এখন আমাকেই দোষী বানানো হচ্ছে। এত নিষ্টুর বাবা কেন আপনি? কখনো তো মাথায় হাত বুলিয়ে বলেননি, ‘চিন্তা করিস না নুবাহ, তুই পারবি। একটু চেষ্টা কর।’
তিন বছরের ছোট্ট নিভান এসে দাঁড়াল নুবার সামনে। টেবিলে দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছে দিল। আধো আধো বুলিতে বলল,
‘নিতাত আব্বু বকেতে। কেতো না, আব্বুকে অনেত বদবো।’
নিভানের মিষ্টি কথা শুনে মুচকি হাসল। চোখ বুলাতে দেখল নীলাভও পাশে দাঁড়ানো। তার চোখেও জল। কান্নামিশ্রিত গলায় বলল,
‘আব্বু আমাকেও অনেক বকেছে। আজ থেকে আমি আর আব্বুর সাথে কথা বলব না। আর কিছু চাইব না।’
দশ বছরের নীলাভের মুখে এমন অভিমানী কথা শুনে নুবাহ নিজের কষ্ট মূহুর্তে ভুলে গেল। শব্দ করে হেসে দিল। নীলাভ বোনের মুখে এমন বিদ্রুপের হাসি দেখে তেতে উঠল। তিরিক্ষি গলায় বলল, আব্বু তোরে বকছে না, খুব ভালো করছে। তুই খুব খারাপ।’ এটা বলেই রুম থেকে হনহনিয়ে বের হয়ে গেল। নুবাহ আরও উচ্চশব্দে হেসে উঠল। ড্রামা কুইনের ড্রামা দেখে। তার হাসি দেখে নিভানও খিলখিল করে হেসে উঠল।
শীতের কনকনে রাত। ঠান্ডায় শরীর হিম হয়ে আছে। ঘড়ির কাটায় মাত্র রাত আটটা। অথচ মনে হচ্ছে গভীর রাত। নুবাহ নিশব্দে পড়ছে। সহসাই মুঠোফোন কর্কশ ধ্বনি তুলল। তড়িঘড়ি সে সুইচড অফ করল। স্ক্রিনে তাকাতে দেখল সেই ছেলেটা। বিরক্তবোধ করল বেশ। মেজাজও মূহুর্তে চটে গেল। তাকে আবার কল দেয়ার রিজন কি? কল রিসিভ করে তিরিক্ষি গলায় বলল,
‘তো, বলুন, কি চাই আপনার?’
ওপাশ থেকে ছোট্ট একটা শব্দ ভেসে এল।
‘মানে?’
‘বুঝেন না। না’কি বুঝেও না বোঝার ভাণ করেন। মানলাম, আপনি আমার উপকার করেছেন। তাই বলে কি একটা মেয়েকে যখন তখন কল দিবেন। তাকে বিরক্ত করবেন। এইটুকু কমনসেন্স কি নেই আপনার মধ্যে।’
‘ভণিতা না করে কি বলতে চাও স্পষ্ট গলায় বল।’
‘আপনি আর আমাকে কল দিবেন না।’
‘এই কথা, আগে বললেই পারতেই। এত ভণিতা করার কি দরকার ছিল।’
আচমকাই নুবাহর গলার সুর নরম হল।
‘আসলে হয়েছে কি, আম্মু আব্বু যদি শোনে আমি আপনার সাথে কথা বলি তাহলে আমার সমস্যা হতে পারে। তাই আপনাকে নিষেধ করছি কল না দিতে।’
‘অহহ, এই ব্যাপার। কিন্তু আমাকে একটা সত্যি কথা বলতো। আমি কি তোমাকে বিরক্ত করি।’
‘নাহ।’
‘তাহলে, তুমি কেন বললে আমি বিরক্ত করি। আমার কমনসেন্স নেই। আমি কি তোমাকে প্রেম অফার করছি নাকি কথা বলার জন্য জবরদস্তি করছি। না তোমাকে পটানোর চেষ্টা করছি। না তোমার সাথে ঘন্টায় ঘন্টায় কথা বলার জন্য পাগল হয়ে বসে আছি। বল কোনটা?’
‘আসলে, এমন কিছু নয়। আপনি রাগ করবেন না। আমি কি করব বলেন। আব্বু আম্মু দু’জনেই আমার উপর কড়া নজর রাখে। যদি জানে কারও সাথে কথা বলি। বিশ্বাস করুন, তাহলে কি হবে আমি নিজেও জানি না।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আর কখনো বিরক্ত করব না তোমাকে। আমার ভুল হলে ক্ষমা করে দিও। তবে তোমার যদি কোনো প্রয়োজন হয় আমায় কল দিতে পার। ভালো থেকো। আল্লাহ হাফেজ।’
কলটা কেটে গেল। আচম্বিত এক সূক্ষ্ম চিনচিনে ব্যথা অনুভব হল নুবাহর। কিন্তু এই ব্যথা কিসের বুঝল না। সময় ফুরাল, দিন বাড়ল কিন্তু ছেলেটার কল আর আসল না। কিন্তু একটা অঘটন ঘটল ঠিক পাঁচদিন পর,,,,
চলবে,,,,,,,,