#হিয়ার_মাঝে ২৫.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️
রাত থেকেই মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে নুবাহর। তবে রাগের পাশাপাশি ভয়ও কাজ করছে। আজকে নিরবকে সেই লেভেলের ধোলাই দেবে। তার সাহস দেখে সে রীতিমতো অবাক। কত বড় বে,য়াদব। তার বিনা অনুমতিতে তার মায়ের নাম্বারে কল দেওয়া। কিন্তু অন্যদিকে ইমদাদুল হক জাকীর ভয়টাও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কি হবে আজ তার সাথে? যদি জাকী তার সামনে এসে দাঁড়ায়। ক্লাসে প্রবেশ না করেই সোজা লাইব্রেরি চলে আসল। কিছু বই লাগবে পড়ার জন্য। তার উপর আবার বির্তকের জন্য স্কিপ্ট তৈরি করতে হবে। তাই নিজ থেকেই কিছু বই খুঁজে যাচ্ছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর নিজের কাঙ্খিত বই পেয়ে সে লাইব্রেরির এককোণে বসে পড়ল। বিতর্কের জন্য কিছু স্কিপ্ট তৈরি করছে। শান্ত নিস্তব্ধ লাইব্রেরির ভেতরের পরিবেশ। অল্প কিছুসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী তারা নিভৃতে বই পড়ছে।
আচমকাই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল নিরব। দপ করেই নুবাহর সামনে চেয়ার টেনে বসতে গেল। নুবাহ মাথা তুলে তাকালো না। নত মস্তকে খুব সতর্কতার সঙ্গে নিজের বাম পা’ উপরে তুলে চেয়ারটাকে এক ধাক্কা দিল। আর অমনি নিরব বসতে গিয়ে চিৎপটাং হয়ে মেঝেতে গিয়ে পড়ল। শব্দহীন লাইব্রেরি মুহুর্তে সরব হয়ে উঠল। যা কয়েকজন নিশব্দে বই পড়ছিল। তারা সবাই চোখ তুলে তাকালো। কারো মুখে বিরক্তি, কারো মুখে হাসি। মুখ টিপে হাসছে অনেকেই। নুবাহ আগের মতই চুপচাপ বসে আছে। কিন্তু বেচারা নিরব পুরাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। লজ্জায় আড়ষ্ট হল সে। সবাই কেমন ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। নুবাহর দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। মেয়েটা তাকে এভাবে অপমান করল। কোনো রকম ভাবে শরীরটাকে টেনে তুলল সে। গলা খাঁকারি দিয়ে নুবাহর দিকে ফের অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। ক্ষীণস্বরে বলে উঠল,
‘নিশাত, কাজ’টা কি ঠিক হল। এভাবে অপদস্ত করলে কেনো?’
নুবাহ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। নিরবের কথায় কর্ণপাত করল না। নিজের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ল। নিরব পেছনে অসহায়ের মত থ’ হয়ে আছে। নিশাত তার সাথে কথা বলছে না কেনো? সে পিছু ছুটল নুবাহর। পেছন থেকে ডাকল,
‘নিশাত, দাঁড়াও। এভাবে এড়িয়ে যাচ্ছো। কি করেছি আমি।’
লাইব্রেরির দরজার বাইরে দাঁড়ানো নুবাহ। নিরব তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অনুনয় বিনয় করছে। ‘নিশাত, আমার সাথে কথা বলছো না কেন?’
নুবাহ দীর্ঘ সময় পর মুখ খুললো। তিরিক্ষি গলায় বলে উঠল, ‘পা ভেঙেছে তোর?’
নিরব কিঞ্চিৎ হেসে উঠল, ‘নাহ, ভাঙেনি। শুধু কোমরে একটু লেগেছে, এই আর কি। সমস্যা নেই, ভালো হয়ে যাবে।’
নুবাহর মুখে কুটিল হাসি। তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠল,
‘আমিও তো তাই বলছি, এবার তো শুধু কোমরে লেগেছে। পরের বার কিন্তু সরাসরি পা’য়ে গিয়ে লাগবে। এজন্য সতর্কতা স্বরূপ শেষবার বলে দিচ্ছি, আমাকে পিছু করা ছেড়ে দেয়। আমার মায়ের নাম্বারে দ্বিতীয়বার কল দিবি না আর। নাম্বার কোথায় পেয়েছিস, সেটা জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। আমি জানি তুই আমার ফাইলের ঠিকানা থেকে নাম্বার তুলে নিয়েছিস। কিন্তু পরবর্তীতে ভুল করেও সেই নাম্বারে কল দিবি না। কারণ, আমার আম্মু’রা আমার সাথে থাকেন না। উনারা চট্রগ্রাম থাকেন। তাই দয়া করে বিরক্ত করবি না আর। আর যদি বিরক্ত করিস, তোর চলার জন্য এই পা’দুটোও আর থাকবে না। সেগুলো তোর গলায় ঝুলিয়ে দেব আমি। মনে থাকে যেন।’
কথাগুলো বলে হনহনিয়ে চলে গেল নুবাহ। নিরব বেশ অবাক হল। রীতিমতো তাকে হুমকি দিল। মন খারাপ হল বেশ। আনমনে লাইব্রেরির পাশের বেঞ্চিতে গিয়ে বসল। নিশাত তাকে পছন্দ করে না কেন? সে কি দেখতে ভালো না। ছলছল দু’চোখ। অদূরে দাঁড়ানো লরিন সবই নিজের মুঠোফোনে ভিডিও করল। সে বন্ধুমহলের ‘বাচ্চার দল’ গ্রুফে ভিডিও সেন্ড করল সাথে সাথেই। তাতে ক্যাপশন হিসেবে লিখল,
‘বাপরে! মেয়ে তো নয় যেন আগুনের ফুলকি।’
সবার আগে সিন করল জিতু। ভিডিও দেখে তার প্রচন্ড রাগ হল। একটা ছেলে ওকে পছন্দ করতেই পারে। তাই বলে এভাবে অপমান করবে। না’কি ঐ ম্যাথ বিভাগের জাকীর জন্য নিরবকে এভাবে অপমান করল। সে একটা সিদ্ধান্ত নিল। নুবাহর সাথে সে কথা বলবে এই নিয়ে। সেমিনার রুম থেকে বেরিয়ে এল। বন্ধুমহলের বাকি’রা এখনো আসে নি। সে আর চিন্ময় এসেছে মাত্র। তাদের ক্লাবের বিভিন্ন কার্যক্রম আছে তা নিয়ে কথা বলছে দু’জন। চিন্ময়কে নিয়ে দুজন বেরিয়ে পড়ল নুবাহর সাথে কথা বলার উদ্দেশ্য। জিতু খুঁজে খুঁজে হয়রান। নিজমনে নুবাহকে ধমক দিল। এই কালরাত লুকিয়ে আছে কোথায়? পেলে আচ্ছা জব্দ করবে আজকে।
বিজ্ঞান ভবনের এক ফাঁকা রুমে বসে আছে নুবাহ। জিতুর মেজাজ’টা আরও থরথর করে বাড়ল। মেয়েটার সাহস’টা দেখ, ফাঁকা রুমে একা মহারানী বসে আছেন। এদিকে যত বাজে ছেলেদের আড্ডা বসে। আর সে এখানে। সে রাগে হিসহিস করতে করতে সামনে গেল। অতর্কিত জিতুকে দেখে নুবাহ আৎকে উঠলো। ভাবল, হয়তো তার কাছে পাওনা টাকা ফেরত নিতে এসেছে। তড়িঘড়ি বেঞ্চ ছেড়ে উঠল সে। কাঁপা কাঁপা ভেজানো গলায় বলল,
‘আমি ভেবেছি, আপনি এখনো কলেজে আসেন নি, তাই আপনার টাকা ফেরত দেওয়া হয় নি।’
জিতু মূহুর্তে ভ্রুদ্বয় কুঁচকালো। সে কি টাকা চাইতে এসেছে এখানে। কিন্তু জবাব দিল তার উল্টো,
‘আমার টাকা দিতে দেরি হল কেন? আপনার তো এসেই দেয়ার কথা ছিল। টাকা দিন জলদি।’
নুবাহ চটজলদি নিজের ব্যাগ থেকে একশো টাকার একটা নোট বের করে জিতুর সামনে মেলে ধরলো। জিতুও টাকাটা নিয়ে নিজের চোখের সামনে মেললো। উল্টে পালটে ভালো করে চেক করল। টাকা কয়েকবার ঘষে ঘষে দেখল। পরে বলে উঠল,
‘হুমম, আসল টাকা, জাল টাকা নয়।’
নুবাহ নির্বাক। এই জিতুর ডিম টাকা নিয়েও তাকে অপদস্ত করল। সে জাল টাকা দেবে কোন দুঃখে। নিজমনে গজগজ করল। জিতু নুবাহর দিকে তাকালো না। নিজের মুঠোফোন বের করে নুবাহর ভিডিওটা তাকে দেখালো। নুবাহ আরেকবার অবাক হল। এই ভিডিও করল কে? নুবাহ অজস্র ভাবনায় মগ্ন। হঠাৎই জিতু বলে উঠল,
‘দেখুন, আপনি বিশ্বাস করুন আর না করুন, তবে এটা সত্যিই, নিরব আপনাকে পছন্দ করে। আমি খুব বেশি কিছু বলব না। শুধু এইটুকু বলব, নিরব ছেলে হিসেবে ভালো। আমার চেনা জানা সে। আমাদের পাশের বিল্লিং এ থাকে। তাই বলছিলাম কি আপনি চাইলে নির্দ্বিধায় তার সাথে সম্পর্কে আগাতে পারেন। যদি কোন সাহায্যর প্রয়োজন হয় আমাকে বলতে পারেন। আমি সাধ্যের মধ্যে সবটুকু সাহায্যে করব।’
নুবাহ যেন আকাশ থেকে পড়ল। জবাব কি দেয়া উচিৎ তাই ভাবছে। তার নিশ্চুপতায় জিতু ফের বলে উঠল,
‘দেখুন, ভাবছেন হয়তো আমি বানিয়ে বলছি এসব। কিন্তু সত্যি তো এটাই, নিরব আসলেই অনেক ভালো। আমি হয়তো ছেলে হিসেবে ভালো নই। তবে এইটুকু বিশ্বাস করতে পারেন। নিরব ছেলে হিসেবে অনেক ভালো হবে আপনার জন্য।’
নুবাহ দাঁড়ানো থেকে বসে পড়ল। বইয়ের পাতায় দৃষ্টি তার। নত মস্তক। জিতুর দিকে না তাকিয়ে গলার স্বর দৃঢ় করে বলল,
‘আমি তো ভাবছি এসব হারাম সম্পর্কে না গিয়ে বরং একবারই বিয়ে করে নিতে নিরবকে। কিন্তু আমার কিছু শর্ত আছে বিয়ে করতে হলে।
১ম শর্ত, আমাকে দশ ভরি অলংকারসহ একটা ডায়মন্ডের রিং উপহার দিতে হবে।
২য় শর্ত, বিয়ের লেহেঙ্গা কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার টাকার হতে হবে।
৩য় শর্ত, ঢাকা শহরে একটা ফ্ল্যাট বাড়ি নিতে হবে আমার জন্য।
৪র্থ শর্ত, বিয়ের দেনমোহর দশ লক্ষ টাকা নগত প্রদান করতে হবে।
যদি এসব শর্তে রাজি থাকে নিরব, তাহলে ডাকুন তাকে। আমিও এই সম্পর্কে আগাবো। আর যদি তার দ্বারা এসব সম্ভব নয়। তাহলে আপনিও এবার আসতে পারেন। আর হ্যাঁ, আপনার ভালো মানুষ নিরবকে আমার থেকে একশো হাত দূরে থাকতে বলবেন।’
জিতু নুবাহর ব্যবহারে ভীষণ রকম অবাক হল। আচ্ছা, ঐ জাকীকে পছন্দ করে তাহলে। কিছুটা তাচ্ছিল্যের সুর তুললো মুখে।
‘আমি জানতাম, এমনি কিছু বলবেন। আসলেই আপনার মত কিছু মেয়ের জন্য সব মেয়েদেরই বদনাম হয়। কারণ, আপনাদের মত মেয়েদের জাকীর মত বখাটে বড়লোক ছেলেই পছন্দ হয়।’
‘হ্যাঁ, আমার বখাটে বড়লোক ছেলেই পছন্দ।’
জিতু রুক্ষভাষায় জবাব দিল, ‘গ্রিডি গার্ল।’
চলবে,,,,