হিয়ার_মাঝে ১৮. #মেঘা_সুবাশ্রী ®️

0
675

#হিয়ার_মাঝে ১৮.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

গগনবক্ষ আজ শুভ্র মেঘে ঢাকা। রাধাচূড়া আর কৃষ্ণচূড়া ফুলে ভরে আছে সামনের দু’টো গাছ। ক্ষণে ক্ষণে আবার কোকিলের কুহু ডাক। প্রকৃতির স্নিগ্ধতায় নুবাহও বেশ আপ্লূত। অন্তঃকরণে যে আজ অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। কখনও লজ্জায় নয়তো কখনও জড়তায়। সে এক অদৃশ্য অনূভুতি। যখন থেকে মধ্যরাতে বিশাল লম্বা এক মেসেজ ইমদাদ তাকে পাঠিয়েছে।

‘আগামীকাল বায়োডাটা নিয়ে আসব। অবশ্যই আপনার জন্য নয় মিস, আমার শ্বশুর মশায়ের মেয়ের জন্য। আমি আবার সোজাসাপ্টা কথা বলতে পছন্দ করি। আপনার উত্তরও যেন হ্যাঁ’ হয়। তারপর আমার শ্বশুর মশায়ের কাছে তার মেয়েকে চাইতে তার মেয়ের শ্বশুর মশায়কে পাঠাব। যদি এই শর্তে রাজি হোন, তাহলে আগামীকাল দেখা করতে চাই। আর যদি হ্যাঁ বলতে লজ্জা পান, সমস্যা নেই। কিছু বলতে হবে না। আপনার নিরাবতায় সম্মতির লক্ষণ ধরে নেব। বরিশাল আসছি কিন্তু। কাল দুপুরেই দেখা হবে। হল থেকে বের হলে আমার মুখখানাই দেখবেন প্রথমে। তখন না হয় প্রথম দৃষ্টি বিনিময় হবে দু’জনের। অবশ্যই, আমার দেয়া কালো হিজাব’টা পরে আসবেন। মনে থাকবে তো মিস।’

সেই রাত থেকেই এই অদ্ভুত অনূভুতির সৃষ্টি।ইসস! নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছে এখনও।

বাংলায় বহুল চর্চিত একটা কথা আছে, সময় এবং স্রোত কখনো কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সময়ের পরিক্রমায় দীর্ঘ এক মাস কেটে গিয়েছে। আজকে নুবাহর ব্যবহারিক পরীক্ষার শেষ দিন। সেই সাথে এস.এস. সি পরীক্ষারও বিদায়ের দিন। কয়েক’টা পরীক্ষা খারাপ হয়েছিল তার। কিন্তু ইমদাদকে জানানোর পর সে হিসেব করে তার জিপিএ নির্ধারণ করে ফেলেছে। জিপিএ ৪.৬৫ থেকে ৪.৭৫ এর মধ্যেই তার থাকবে। তবে ব্যবহারিক বিষয়ের জন্য পয়েন্ট কিছু উঠানামা করতে পারে। তাকে বিচলিত হতে নিষেধ করেছে। অথচ নুবাহ অবাক, এমন রেজাল্ট হবে তার। এটা তো তার জন্য দুঃস্বপ্ন ছিল।

ফোৎ করে দীর্ঘশ্বাস টানল। ব্যবহারিক পরীক্ষার জন্য হলের বাইরে দাঁড়ানো। তমাকে আজ ইমদাদের কথা বলতেই হবে। উশখুশ করছিল কিভাবে এই কথা জানাবে? না জানি এ মেয়ে এখন কেমন রি’অ্যাকশন দেয় তাকে। ব্যবহারিক পরীক্ষা শুরু হতে এখনও ত্রিশ মিনিট আছে। আজকে তার বাবা নেই। তমার সাথেও তার বাবা, ভাই কেউ নেই। দু’জনেই একা। তাই আজ উন্মুক্ত দু’জন। কিন্তু তমাকে বলতে হবে। নয়ত একা ইমদাদের সাথে দেখা সম্ভব নয়। সে’তো লজ্জায় মরে যাবে।

অনেক সাহস নিয়ে তমার সামনে দাঁড়াল। নুবাহ শুকনো ঢোক গিলল। তারপর বলে উঠল, ‘তমা তোর মনে আছে, সাজেশন দিয়েছিলাম তোকে। আসলে ঐ সাজেশন আমাকে একজন দিয়েছিল। তার সাথে আমার মোবাইলে পরিচয় হয়েছে। খালামনির বিকাশের টাকা ভুল করে সেই ছেলের ফোনে চলে গিয়েছিল। তারপর ছেলেটা নিজ থেকে এই টাকা ফেরত দিয়েছিল। সেই ছেলেটাই আমাকে এতদিন গাইড করত হোমটিউটরের মত। আমাকে সাহায্যে করেছে পড়াশোনার ক্ষেত্রে।’

তমা সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল। ‘ওহহহ, আচ্ছা। নেক্স।’

নুবাহ লাজুক ভঙ্গিতে বলে উঠল,
‘আ,,আসলে ছেলেটা আজকে দেখা করবে বলেছে। ঢাকা থেকে তারা রওনা দিয়ে ফেলেছে অলরেডি।’

‘এখন আমাকে বলার কি দরকার? এক বারে বিয়ে করে বাচ্চা-কাচ্চা সমেত আমার সামনে এসে তারপর বলতি। ঔটাই ভালো ছিল।’

নুবাহ ভ্যাবাচ্যাকা খেল। লজ্জায় তমার দিকে তাকাতে পারল না। তমা কপট রাগ দেখাল। বলে উঠল, ‘এভাবে আমার চোখের নিজ দিয়ে এতদূর। অথচ, আমি কিছুই জানি না। আমি সত্যিই তোর বেষ্টফেন্ড? মনেই হয় না। যাই হোক, এটা আমার বড় ব্যর্থতা’রে নিশাত। তবে দোয়া করব, তুই ভালো থাকিস।’

‘সর‍্যিই, আসলে আমি ভয়ে বলিনি তোকে।’

তমা জবাবে আর কিছু বলল না। শুধু জিজ্ঞেস করল, কখন আসবে?’ নুবাহ পরীক্ষার শেষে আসবে বলল।
___________

পরীক্ষা শেষ প্রায় ত্রিশ মিনিট। তমা ত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করেই হাসফাস করছে। নুবাহর দিকে ভ্রু উঁচিয়ে বলল, ‘কিরে তোর হাফ জামাই কখন আসবে?’

তমার এহেন সম্মোধন শুনে নুবাহ নির্বাক। এই মেয়ে তারে আজ লজ্জা দিয়ে দিয়েই মারবে। কিন্তু নুবাহ এই মূহুর্তে কিঞ্চিৎ বিচলিত। দুপুর বারো’টায় শেষ মেসেজ পাঠিয়েছে ইমদাদ। তখন তারা বরিশাল প্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছে। নুবাহর ব্যবহারিক সকাল দশ’টা থেকে। ইমদাদ এক’টার মধ্যেই তাদের হলের সামনে থাকবে বলে তাকে শেষ মেসেজে বলেছে। এরপর আর কোন মেসেজ আসেনি। সেও আর কোনো মেসেজ পাঠাতে পারেনি, হলে ছিল বলে।

নুবাহ ইমদাদের নাম্বারে কয়েক’টা মেসেজ পাঠাল। মেসেজের জবাব না পেয়ে শেষে কল দিল। তমাও বেশ চিন্তিত। উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ‘এখন কিন্তু দুপুর দেড়’টা বাজে। তাহলে এখনও আসছে না কেনো?’

নুবাহ জবাবে কিছুই বলতে পারল না। অস্থির লাগছে তার, মনের মধ্যে অজানা ভয় চেপে ধরল। দুপুরের খাবার খাওয়ার কথা ছিল এক সাথে। উদ্বিগ্ন দু’ অক্ষিযুগল সড়ক পানে। না চাইতেও বার বার হৃদ কম্পন বেড়ে যাচ্ছে। কম্পিত বাম হাতের আঙ্গুলের নখ দিয়ে দাঁত খোঁচাতে লাগল। কারণ ইমদাদের মোবাইলে যতবারই কল দিচ্ছে, শুধু বন্ধ বলে যাচ্ছে।

‘কীরে তোদের পরীক্ষা শেষ হয়েছে ত্রিশ মিনিট আগে। তোরা এখানে কি করছিস?’

দৈবাৎ আসা তমালের কথা শুনে চকিতে মুখ ঘুরাল নুবাহ। তমা নিজেও অবাক। তমাল ভাইয়া এসময় কোত্থেকে উদয় হল? নুবাহর দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি দিল। ইশারায় বলতে চাইল, সর‍্যিই দোস্ত, আমি জানতাম না ভাইয়া আসবে?

দু’জনের নিরাবতা দেখে তমাল আবারও বলে উঠল, ‘কীরে তোরা বাড়ি না গিয়ে এখানে কি করছিস?’

নুবাহ হুট করে বলল, ‘আসলে ভাইয়া আজকে পরীক্ষার শেষ দিন। তাই একটু ঘোরাঘুরি করছি আর কি?’ তমাল কিঞ্চিৎ হাসল। বলে উঠল, ‘দুপুরে খাবার খেয়েছিস। না’কি খালি পেটে ঘুরছিস?’ তমালের কথায় নুবাহর কলিজা ধ্বক করে উঠল। এখন যদি ইমদাদ আসে। তাহলে কি হবে? ভাবতেই আৎকে উঠল। এদিকে তমাল জোরাজোরি করছে বেশ। তমা ইশারায় বলল, চল। তোর হাফ জামাই আসলে তখন অন্য ব্যবস্থা নেবো।

অগত্যা তমার কথায় দু’জনে তমালের পিছু পিছু এক রেষ্টুরেন্টে গিয়ে বসল। তমাল খাবার অর্ডার দিল। অসহায় প্রাণীর মত তমার দিকে তাকিয়ে আছে নুবাহ। তমা ফের ইশারায় বলল, বোন এখন খেয়ে নেয়। অবশ্য তখন ঘড়িতে ২:৪০ বেজে গিয়েছে। খিদেও পেয়েছে তার। কিন্তু অস্থিরতায় খাবার গিলতেও পারছে না। তমা খাবার খেয়ে হাত ধোয়ার জন্য বেসিনে গেল। নুবাহ খুব ধীরে ধীরে হাত নাড়িয়ে যাচ্ছে। মন’টা ভীষণ অস্থির। তমাল তার সামনে বসে থাকায় নিজের মোবাইলটাও বের করতে পারছে না। ইমদাদের মোবাইল অন হয়েছে কি’না জানতেও পারছে না। সে চিন্তায় নিমজ্জিত। তমাল তাকে বার কয়েক ডাকল। কিন্তু তার কথা কানেও যাচ্ছে না নুবাহর। আচমকা টেবিলের মধ্যে হাত দিয়ে শব্দ করল তমাল। নুবাহ মাথা তুলে তাকাল তার দিকে। তমাল মাথা নাড়িয়ে বলল,

‘নিশাত, তোমার কি হয়েছে? খাচ্ছো না কেন? কোন কিছু নিয়ে আফসেট?’

নুবাহ তথমত খেলো। তড়িৎ বলল, ‘নাহ! ভাইয়া তেমন কিছু না। পরীক্ষা শেষ, স্কুল জীবনের ছুটি, তার জন্য একটু মন খারাপ আর কি?’

তমাল সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাল। কিন্তু মুখে কিছুই বলল না।
_____________

রেষ্টুরেন্টের কর্ণারে তমাল নুবাহকে একসাথে বসা দেখলেন। সেই থেকেই রাগে ফুঁসে উঠলেন জাফর মির্জা। আমার পোলা বিয়ার প্রস্তাব দিয়া হাত ধরতে চাইছে দেইক্কা এ ম্যাইয়ার হাতে ফোস্কা পড়ছিলো। হের ল্যাইগ্যা আমার পোলার গায়ে হাত তুলছে। এত কিছুর পরেও আমি পোলার মুখের দিকে চ্যাইয়া এ ম্যাইয়ার জন্য বিয়ার প্রস্তাব দিছিলাম। কিন্তু ম্যাইয়ার বাপ আমি বিয়ার জন্য কইছিলাম বলে আমারে কত কথা কইলো। গাজা ব্যবসায়ী ছেলের সাথে কিসের বিয়ে দিমু। যেই ছেলের বাপের চরিত্রের ঠিক নাই, সেই ছেলের লগে বিয়া। বড়ই হাসির কথা কইছি না’কি আমি।
আর এখন এ ম্যাইয়া ভাতা* নিয়ে রঙ্গ’লীলা করে যে বাপে চোখে দেখে না। রেষ্টুরেন্ট মালিক জমির উদ্দিন কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল জাফর মির্জা।

জমির উদ্দিন ব্যাঙ্গাত্মক হাসি দিলেন। নিশাতের দিকে আঙ্গুল তুলে বললেন, এ ম্যাইয়া’টার কথা বলতেছেন। এর আগেও আইছে মেলাবার এ পোলার লগে আমার রেষ্টুরেন্টে। আজকাল ম্যাইয়া’গো চরিত্র আছে’নি। সবগুলাই এমন। আপনে একটা কাজ করেন, ম্যাইয়ার বাপরে কল দেন।ম্যাইয়ার রঙ্গলীলা দেখান বাপ’রে। তয় বাপ সিদা হইবো।

জাফর মির্জা নিজের ফোন বাহির করে আগে কয়েক’টা ছবি তুললেন। তারপর কল দিলেন। কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো রেসপন্স পেলেন না। রাগে ক্ষুব্ধ হয়ে হাতের ফোনে বাড়ি মারলেন।
_______________

মধ্যাহ্নের দ্বিপ্রহর শেষ হয়েছে অনেক আগে। ঘড়ির কাটায় এখন বিকেল ৪’টা ছুঁই ছুঁই। তমাল আচমকা আসায় তমা বাধ্য হয়ে ফিরে গেছে ভাইয়ের সাথে। নুবাহ অন্য অযুহাত দিয়ে রয়ে গেছে। দুপুর দু’টো থেকে এখন বিকেল চার’টা, বিগত দু’ঘন্টা ধরেই পার্কের এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে আছে।

মোবাইল থেকে অনবরত ইমদাদের নাম্বারে কল দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওপাশ থেকে বার বার একই স্বর ভেসে আসছে। আপনার ডায়ালকৃত নাম্বার’টি এ মূহুর্তে বন্ধ আছে। যতবার এ স্বর শুনতে পাচ্ছে, ততবার তার কলিজা ধ্বক করে উঠছে। প্রায় দু’ঘন্টা হতে চলল। কিন্তু ইমদাদের কোন খবর নেই। কতশত মেসেজ, কল পাঠিয়েছে তার কোন হিসেব নেই। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে তার।

‘ইমদাদ আপনি কোথায়? প্লিজ আসুন না, আপনার বোকাপাখি অপেক্ষা করছে তো। একবার বলুন না আপনি কোথায়? আর কত অপেক্ষা করাবেন। অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়েও কেন শেষ হচ্ছে না। জানেন আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আর সহ্য করতে পারছি না। আপনি তো সেই দুপুর এক’টায় আসার কথা ছিল? কেনো এলেন না।’

চলবে,,,,,

অতীত শেষ হল অবশেষে। শুভমুক্তি আজ থেকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here