হিয়ার_মাঝে ১৯. #মেঘা_সুবাশ্রী

0
650

#হিয়ার_মাঝে ১৯.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

নুবাহ দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে। জলশূন্য দু’চোখ। নির্লিপ্ত চাউনি জানালা ভেদ করে আকাশে জ্বলজ্বল করা তারার দিকে। নিরবতায় আচ্ছন্ন পুরো রুম জুড়ে। ঘরের আলো নিভানো। ল্যাম্পপোস্ট থেকে আসা টিমটিমে আলোয় ঈষৎ আলোকিত রুম। রুবি হতাশার সুর তুলল।

‘তারপর এমন কি হয়েছিল নুবাহ? যার জন্য দুলাভাই তোদেরকে সেই দিন রাতেই চট্টগ্রাম নিয়ে আসল।’

নুবাহ দু’ঠোঁট কিঞ্চিৎ ফাঁক করে নিশ্বাস ছাড়ল। গলার স্বর আগের মতই করুণ। ভেজানো গলায় বলে উঠল, সেদিন বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম ইমদাদের জন্য। কিন্তু ফিরতি কোন কল বা মেসেজ আসেনি। শেষে না পেরে ভগ্ন হৃদয়ে কোন রকম টলতে টলতে বাড়ি ফিরলাম। বাড়ি ফিরার ঠিক ত্রিশ মিনিট পর আব্বু হুট করে আমার রুমে প্রবেশ করে। আমি হতচকিত হয়ে গেলাম। সেই মূহুর্তে আব্বুকে আমার রুমে একদমই আসা করেনি। তখন বিছানায় শুয়েছি মাত্র। আব্বুর অগ্নি দু’চোখ দেখে ভড়কে যাই। দ্রুত বিছানায় উঠে বসি। কিন্তু আব্বু কিছু না বলেই বিদ্যুৎ বেগে সজোরে আমার গালে থাপ্পড় মারে। হুংকার ছুঁড়ে ক্ষিপ্ত হয়ে,

‘তোকে পড়াশোনা করানোর জন্য স্কুলে পাঠাইছিলাম। আমার মুখে চুলকানি মাখানোর জন্য না।’

আব্বুর হুংকার শুনে আম্মুও ছুটে আসে। আতংকিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, কি হয়ছে তোমার? নিশাত কি করছে, মারও কি জন্য?

আব্বু আম্মুর কথার জবাব দিলেন না। এদিক ওদিক তাকিয়ে অতর্কিত বিছানায় রাখা নারিকেল পাতার তৈরি শলার ঝাটা মুড়ো আম্মুর গায়ে ছুঁড়ে মারলেন। সাথে তুই তোকারি করে গালিগালাজও করল,

‘তুই ঘরে থেকে সারাদিন কি করস। তোর মেয়ে কি করে খোঁজ খবর রাখছিলি। রাখবি কেন? সারাদিন তুই চুলায় গুতা। আমিই রান্না করমু, তুই বাইরে যায় কাজ করবি এবার থেকে।’

আম্মু হতভম্বের মত মার খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিবাদ করার ভাষাও ছিল না তখন। দরজার বাইরে ভয়ে গুটিয়ে আছে নীলাভ নিভান। আব্বুর থাপ্পরে কাঠের কার্নিশে বাড়ি খেয়ে মেঝে পড়ে গেছিলাম। তখনও সেইভাবে পড়ে আছি। এসময় আমাদের সদর দরজায় কারও করাঘাতের শব্দ হল। আব্বু দরজা খুললেন। বাড়িওয়ালা নানা আসলেন। তিনি আগুনে ঘি ঢালার বাকি কাজ’টা করলেন। আব্বুকে তিরিক্ষি গলায় বলে উঠল,

‘গত পনের বছর ছিলা, মোরা কিছু কইছি। কিন্তু অহন তোমার ম্যাইয়ার ল্যাইগা মোগো সম্মানও যাইতাছে। তোমার ম্যাইয়া যে আকাম করছে হোটেলে য্যাইয়া। তওবা, তওবা মুখে আনতেও শরম করতাছে। যত জলদি পারও বাড়ি ছাইড়া দেও। রশিদ, মনু কি কইছি শুনছো।’

রশিদ নিশব্দে বাড়িওয়ালার সব কথা হজম করলেন। ছোট্ট এক বাক্যে বলে উঠলেন, ঠিক আছে, ছাইড়া দিমু।

এর কিছুসময় পর আব্বু তমাকে কল দিলেন। তমা কি বলল সেটা শোনা যাইনি। তবে আব্বুর কথাগুলো স্পষ্টত কানে ভেসে এল। ‘তোমাকে ভালো মেয়ে ভাবছিলাম। পড়াশোনায় ভালো বলে আমার মেয়েকে মিশতে দিছিলাম। কিন্তু তোমার কাছে গিয়ে যে বদচরিত্রের হবে তা কখনও ভাবিনি। তবে কান খুইলা শুইনা রাখও, ভুলেও আর কোনদিন আমার মেয়ের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করবা না। তোমার মত বান্ধবী থাকার চেয়ে না থাকায় অনেক ভালো।’

এরপর কল কেটে দিলেন। আবার আমার রুমে ফিরে এলেন। আমার মোবাইল খুঁজতে লাগলেন। আর সাথে সাথে পেয়েও গেলেন। মোবাইল নিয়ে আব্বু আচমকাই মোবাইল থেকে সিম বের করে নিয়ে গেলেন। সাথে আমার মোবাইলও। আর শেষ হুঁশিয়ারি হিসেবে বললেন, আমি যেন আজকের পর থেকে কোন মোবাইল ফোন না ধরি। যদি ধরি, তাহলে আমার হাত কেটে রাস্তার কুকুরকে খাওয়াবে।

আমি নিশ্চুপ শুনলাম। তখনও মেঝেতে বসে আছি। কারো মুখে কোনো রা’ নেই। রাত দশটায় আমরা বাসা থেকে বের হই চট্রগ্রামের উদ্দেশ্য। সেই বিভীষিকাময় রাতের কথা ভাবলে আজও শরীর থরথর করে কেঁপে উঠে। আব্বু মেরেছে বলে আমি সেদিন কাঁদে নি, কেঁদেছি আব্বুর করা মিথ্যে অপবাদে। পুরো মহল্লা জুড়ে রটে গেল নিশাতকে হোটেলে এক ছেলের সাথে নষ্টামি করতে হাতে নাতে ধরছে। আজও ভাবলে নিজেকে অসহায় লাগে। বিনা দোষে আমি নষ্ট মেয়ে হয়ে গেলাম।
সেই রাত থেকে আম্মুও দীর্ঘ দিন আমার সাথে কথা বলেনি। চট্রগ্রাম যেন আমার জন্য জেলখানায় পরিণত হল। সারাদিন রুমবন্দি জীবন-যাপন, অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু নিরবে নিভৃতে ইমদাদের জন্য আমার দোয়া করা বন্ধ হল না। সারারাত জায়নামাজে বসে অঝোরে কাঁদতাম। যত রকম ইবাদত ছিল তার জন্য করতাম। কত রাত এভাবে কাটিয়েছি জানা নেই। কিন্তু একদিন হুট করে আব্বু আমার বিয়ে ঠিক করে। ছেলে বন্দরে চাকরী করে। রাতেই বিয়ে হবে। সেদিন আর চুপ থাকতে পারলাম না। দ্রুতই তোমাকে কল দিলাম। খালামনি আমাকে বাঁচাও। অন্তত দু’ইটা বছর আমাকে বাঁচতে দাও। তুমিও সেদিন আমার কথা ফেলতে পারও নি। তাই তো ছুটে এলে, আমাকে বাঁচালে। তাহলে আজকেও কেনো বাঁচালে না খালামনি?’

দীর্ঘ সময়ের জমিয়ে রাখা কান্না চেপে রাখতে পারল না। হু হু করে কেঁদে উঠল নুবাহ। মুখশ্রী চোখের জলস্রোতে ভিজে চুপসে গেছে। আচকমাই রুবি হেসে উঠল। নুবাহ খালার এমন আচরণে অবাক হল। তার এত কষ্টের মাঝে তার খালামনি হাসছে। রুবির মুখ বেশ উচ্ছ্বসিত।

‘তোকে একটা গুড নিউজ দিতে সেই কখন থেকেই মনটা আকুপাকু করছে। কিন্তু আমার মনে হয়, তোর শোনার ইচ্ছে নেই। ঠিক আছে, আমি যাই। রাত অনেক হয়ে গেছে। ঘুমাবো।’

ঘুমের ভান করে রুবি হাই তুলল। চলে যেতেই উদ্বত হল মাত্রই। নুবাহ চেঁচিয়ে উঠল।

‘কি বলতে এসেছো, বল না।’

রুবি আবারও হাসল।
‘সেই কথা বলব বলেই তো, এতক্ষণ তোর না হওয়া প্রেমের গল্প শুনলাম।’

‘কিন্তু গুড নিউজ’টা কি খালামনি?’

‘তোমার পাঁচ দিন পর কাবিন হচ্ছে না। আপাতত অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত।’

নুবাহর মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি।
‘কি লাভ, আজ হোক আর কাল। আব্বু আমাকে ওখানে বিয়ে দিয়েই ছাড়বে।’

‘কিন্তু নুবাহ, তুই ভুলে গিয়েছিস তোর কাছে এখনো অপশন আছে।’

‘কিভাবে?’

‘তিতুমীর কলেজ।’

‘মানে?’

‘মানে হচ্ছে, তোর তিতুমীর কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় নাম এসেছে কেমেস্ট্রিতে।’

নুবাহর মুখ এখনও ফ্যাকাসে। সে ম্যাথের জন্য পরীক্ষা দিয়েছিল। অথচ নাম আসল কেমিস্ট্রিতে। এটা কি হল। ইমদাদ ম্যাথ ডিপার্টমেন্টে আর সে কেমেস্ট্রিতে। আবারও মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। রুবি বিরক্ত হল নুবাহর এহেন আচরণে। কঠিন গলায় বলল,

‘তুই খুশি হোস নি। এটাই সুযোগ কিন্তু। তুই ইমদাদকে খুঁজে দেখ। অন্তত শেষ একবার চেষ্টা কর। যদি ইমদাদকে পেয়ে যাস, তাহলে ইয়াফীর বাবাকে বললে তিনি অবশ্যই মানবেন। এই বিয়ে বন্ধ করে দিবেন।’

‘ইয়াফী কে?’

‘তোর হবু বর।’

নুবাহর মুখ মুহুর্তে আঁধারে চেয়ে গেল। নিশব্দে নিশ্বাস ছাড়ল। সত্যি খুঁজে পাবে তো তার ইমদাদকে। ঘড়ির কাটায় মধ্যরাত দুইটা। রুবি নুবাহকে ঘুমাতে বললেন। নিজেও পাশে শুয়ে পড়লেন। কিন্তু নুবাহর চোখ নিদ্রাহীন।
________

‘২ বছর ৭ মাস ৫ দিন ১৯ ঘন্টা’

অশ্রুসিক্ত দু’আঁখি নুবাহর। লাল ফটকের মাঝে খোদাই করা ‘সরকারি তিতুমীর কলেজ’। তার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নিজহাতে থাকা ঘড়িতে সময় দেখল ৮ টা ৪৫ মিনিট। আনমনে মুখ নিঃসৃত এক বাক্যই উচ্চারিত হল। ২ বছর ৭ মাস ৫ দিন ১৯ ঘন্টা ৪৫ মিনিট ১৭ সেকেন্ড। কত সময় পেরিয়ে গেছে। দিন গড়িয়ে মাসে ঠেকেছে। মাস গড়িয়ে বছর। কিন্তু আপনাকে আমি ভুলিনি ইমদাদ। এভাবে হারিয়ে গেলেন? আপনার সেই আদুরে মিষ্টিস্বর শোনা হয়নি কত বছর। জানেন কত রাত আমি ঘুমাইনি। মনে হয় এই বুঝি আমার দুঃস্বপ্ন ভেঙে যাবে। আপনি আমায় কল দিবেন। বলবেন, বোকা পাখি কেমন আছো? আমি আসব তো তোমার সাথে দেখা করতে। এই তো আমি আছি, কোথাও হারাইনি। আমার বক্ষকুঠিরে তোমার বসবাস, সেখানে যে আর কাউকে ঠাঁই দেয়নি। কিন্তু জানেন, আমার সেই দুঃস্বপ্ন আজও ভাঙেনি। আপনি আর আসেন নি। দেখুন, আজ আমি আপনার শহরে। আমাকে স্বাগতম জানাবেন না। আপনার বোকা পাখিকে বলবেন না, অভিবাদন হে প্রিয়।আপনি না বললেও নিজ দায়িত্বে আপনার অভিনন্দন নিয়ে নিয়েছি।

বক্ষস্থলে অতি সূক্ষ্ম চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হল তার। কলেজ ফটকে হাত রাখল। মুখের মাঝে কিঞ্চিৎ খুশির ঝলক। দু’চোখ বন্ধ করে শ্বাস টানল। এই বাতাসেই আমি আপনাকে অনুভব করছি ইমদাদ। কলেজের বাতাসেও আপনার শরীরের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। ঠিক একদিন এভাবে আপনাকেও খুঁজে নেব। সামনে পেলে প্রথমে ইচ্ছেমতো বকব। এতদিন কেন আমায় কাঁদিয়েছেন?

বেখেয়ালি মন তার এলোমেলো কদমে হেঁটে চলেছে। নিজের অতীত ভাবনায় ডুবন্ত নুবাহ। সহসাই কারও আর্তচিৎকারে তার হুঁশ ফিরে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই আৎকে উঠল। সদ্য কেনা তার নতুন পাদুকায় কারও পা ধাবিয়ে দিয়েছে। সামনে থাকা আগুন্তকঃ নিজের পা খানা ধরে সমানে চেঁচিয়েই যাচ্ছে।

‘আবে কোন হালা’রে পাড়া দিছে। আমার পাটা’রে শেষ কইরা দিল। আহ, ভাইঙা গেছে মনে হয়।’

নুবাহ হতবিহ্বল। নিজের হতবুদ্ধির জন্য কিছুক্ষণ দুষল নিজেকে। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করল,
‘সর‍্যিই, ভাইজান। আমি দেখিনি আপনাকে।’

চিৎকার চেঁচামেচি বাদ দিয়ে নিরব হা’ হয়ে আছে। এই নতুন আইটেম কোত্থেকে টপকালো। সোজা ভাইজান। তাকে দেখতে কি সিনিয়র লাগে নাকি? কপট রাগ দেখাল,
‘চোখ কোথায় রাখো আসমানে, না বাড়িতে রাইখা আইছো।’

‘আসলে ভাইজান, আমি বুঝতে পারি নি।’

নিরবের চোখ কপালে। কিছুসময় নিজেকে গালি ছুঁড়ল নির্বুদ্ধিতার জন্য। ফোৎ করে নিশ্বাস ছাড়ল। নুবাহর আপাদমস্তক ভালো করে লক্ষ্য করল। গায়ে ফিরোজা বর্ণের অবয়া। সাথে কালো হিজাবে মুখ মন্ডল পুরো আবৃত। শুধু কালো ভ্রু জোড়ার সাথে চোখদু’টো কিঞ্চিৎ উন্মুক্ত। পায়ে মেরুন রঙের স্লিপার। এই স্লিপার দিয়েই তাকে পাড়া দিয়েছে। কি সাংঘাতিক ব্যাপার! সন্দিহান দৃষ্টি তার। ‘নতুন না’কি?’

নুবাহ শুকনো ঢোক গিলল ভয়ে। এখন তাকে যদি র‍্যাগ দেয়। কিংবা যদি সবার সামনে অপমান করে। নিজমনে দোয়া পড়ল। আমতা আমতা করে জবাব দিল, ‘জী,,,জ্বী।’

‘নাম কি?’

‘নিশাত নুবাহ।’

‘কোন বিভাগ?’

‘কেমিস্ট্রি ১ম বর্ষ।’

নিরব নিজের গলার স্বর বেশ টেনে বলল, ‘আচ্ছা, ১ম বর্ষ। আমার ইয়ারের। কিন্তু ভাইজান ডাকলা কোন দুঃখে। আহ,,, বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে। ফের বলে উঠল,
‘আজকেই প্রথম আসছো?’

নুবাহ কিঞ্চিৎ মাথা নাড়ালো। ‘হুমম।’

নিরব হেসে উঠল। ফের বলে উঠল, ‘ক্লাস চেনো তো কোনটা আমাদের?’

নুবাহ চুপ করে থাকল কিছু সময়। তারপর বলে উঠল, ভবন এক, বিজ্ঞান ভবন। না চিনলেও চিনে নেব। ধন্যবাদ।

নিরব আরও কিছু বলতে নিতেই নুবাহ তড়িৎ পায়ের কদম বাড়াল সামনের দিকে। নিরব পেছন থেকে বার’কয়েক ডাকল। কিন্তু নুবাহ পেছনে তাকাইনি আর। ক্লাসে প্রবেশ করার পূর্বে আচমকাই থমকে দাঁড়াল। কিঞ্চিৎ দূর থেকে গিটারের শব্দে সুর তুলে কেউ গেয়ে উঠল,

“আমি জানি কোনো একদিন
কোন এক নতুন ভোরে,
দেখা হবে আমাদের আবার
এক স্বপ্নের শহরে”

চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here