#হিয়ার_মাঝে ৫.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️
নিস্তব্ধ নিশুতি রাত। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন পুরো মহল্লাবাসী। কীর্তনখোলা নদীর হিমশীতল বায়ুর প্রভাবে ঠান্ডা পড়ছে বেশ। কম্বল থেকে নিজের মাথা তুলতেই ঠান্ডায় কেঁপে উঠল নুবাহ। দক্ষিণা বারান্দা ঘেঁষে বাগানবিলাসের গাছ। তা থেকে টুপটুপ করে বৃষ্টির ফোঁটার মত শিশির ঝরে পরছে। আবার পাশের ডোবা থেকে ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসছে ডাহুকের ডাক। বেতবন দ্বারা আচ্ছাদিত ডোবার একাংশ। দক্ষিণের বারান্দায় থেকে ডোবার দূরত্ব মাত্র কয়েক গজ। কিন্তু ঝিঁঝিঁ পোকার অনবরত ডাক চলছে সেখানে। থামাথামীর নাম নেই তাদের। নিরব নিভৃত পরিবেশে কিঞ্চিৎ শব্দও ভয়ানক। কেমন গা ছমছমে ভূতুড়ে পরিবেশ। এর মধ্যে এমন ফোনকল। নুবাহ স্থির হতে বেশ সময় নিল। কিয়ৎসময় চুপ থাকল ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তির কথা শুনে। নিজেকে ধাতস্থ করে বলে উঠল,
‘কে আপনি?’
অপর পাশে গলার স্বরের পরিবর্তন হল না। মুখের কোণে হাসির কিঞ্চিৎ শব্দ হল। কথার মধ্যে পূর্বের ন্যায় সেই হেয়ালি সুর।
‘তোমার জামাই।’
‘এত রাতে কোত্থেকে কল দিছেন। কে আপনি?’
‘এক কথা কয়বার কমু। আমি তোমার জামাই। বউয়ের কাছে কল দিতে হয় রাইতের বেলায়। বুঝো না। নয়ত কথা জমব।’
মেজাজ আর ধরে রাখতে পারল না নুবাহ। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল, ‘রাবিশ।’ ধৈর্য্য হল না কলটা ধরে রাখার। রাগে গজগজ করতে করতে কল কাটল। আচমকাই রাগ ঝাড়ল সেই ছেলেটার উপর। কালক্ষেপণ না করেই কল দিল সেই ছেলের নাম্বারে। মুহূর্তে কি হল তার জানা নেই। কিন্তু ওপাশে কল রিসিভ হল না। নিজের রাগ সংবরণ করতে না পেরে শেষে মুঠোফোন বন্ধ করল।
বিছানায় গড়াগড়ি করল বেশ সময় ধরে। তিরিক্ষি মেজাজে ঘুম কখন আসল জানা নেই। সকালে ঘুম ভাঙলো রুকাইয়ার ডাকাডাকিতে। নিভু নিভু চোখে তাকাল। ঘড়ির কাটায় তখন সকাল ছয়টা। ফ্রেশ হয়ে বসল পড়ার টেবিলে। বাসায় আজ রশিদ নেই। তাই নির্ভয়ে রয়েসয়ে চলছে তার পড়াশোনাসহ অন্যান্য কাজকর্ম।
মুঠোফোন বন্ধ হয়ে পড়ে ছিল। অন করার কথা মনে নেই তার। সময় গড়ালো এভাবে। স্কুল থেকে ফিরার পর তার মনে পড়ল নিজের মুঠোফোন বন্ধ করার কথা। তাই ফিরে এসে সবার আগে নিজের মুঠোফোন খুলল। দুপুরের খাবার খেয়ে গা এলিয়ে বিছানায় শুয়েছে মাত্র।
কিন্তু কল আসার তীব্র ধ্বনিতে নিজের বন্ধ হওয়া চোখ মূহুর্তেই খুলে গেল। কল দেখে মুখের কোণে তীব্র রাগের বহিঃপ্রকাশ। রিসিভ করেই তেতে উঠল।
‘কেন কল দিয়েছেন?
মুঠোফোনের ওপাশ থেকে তাচ্ছিল্যের সুর ভেসে এল। ‘বাহ! উল্টো চোর কোতোয়ালকে ডাটে। আমি কল দেয়নি জনাবা। আপনিই আমাকে কল দিয়েছেন। তাও গভীর রাতে। কি সাংঘাতিক ব্যাপার স্যাপার! তা, আমায় বুঝি খুব মিস করছিলেন। আফসোস, আমি আপনার কল রিসিভ করতে পারেনি। যদি জানতাম আপনি আমায় কল দেবেন। তাহলে ফোন কখনই সাইলেন্ট করতাম না। এখন তো বড্ড আফসোস হচ্ছে।’
নুবাহ এক মূহুর্তের জন্য ভুলেই গিয়েছিল। পরক্ষণেই মনে পড়ল রাতের সেই অপরিচিত কলের কথা। হুট করে গর্জে উঠল,
‘আপনাকে মিস করব, আমার তো আর খেয়ে দেয়ে কাজ নাই। কাল মধ্যরাতে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসছে। সত্যি করে বলুন তো, নাম্বার টা আপনার কি’না।’
‘আচ্ছা, তোমার খেয়ে দেয়ে কাজ নাই। আর আমি তো তোমার জন্য না খেয়ে বসে আছি। কি মনে হয়? শোনো, আমি একজন ছা-পোষা পরিবারের ছেলে। এসব মজা আমাকে বানায় না। পকেট খরচ নিজেকে বহন করতে হয়। তার মধ্যে কিছু বাঁচলে নিজের ছোটো বোনদের জন্য পাঠায়।’
কথাগুলোর শেষে ওপাশে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ হল। ফের বলে উঠল,
‘আমি শুধু তোমাকে বোকা মেয়ে ভেবেছিলাম। এখন তো দেখছি তোমার মাথায় সব কাদামাটিতে ঠাসা। ইডিয়ট।’
মুঠোফোনের ওপাশে কথার মাঝে আচমকাই কিছু হাসির শব্দ হল। একসাথে অনেকগুলো যুবকের হাসি। কেউ একজন মজার ছড়া কাটছে।
‘কে তুমি বৎস
বানাইয়া নিঃস্ব,
জাগাইয়া শিহরণ,
করিয়াছো বারণ।’
তাকে থামিয়ে অন্য একজন গেয়ে উঠল,
‘কে তুমি নন্দিনী
আগে তো আসোনি।
অদেখার সঙ্গীনি
করেছো বন্দিনী।’
নুবাহর সন্দেহের তীর তাদের কথা শুনে আরও তীব্র হল। নিজের দু’চোয়াল শক্ত করল। ক্ষেপা বাঘিনীর মত ফের গর্জে বলল, ‘আচ্ছা, তাহলে এসবই করে বেড়ান। আপনি অন্য কোন এক ছেলেকে নাম্বার দিয়েছেন। যাতে আমাকে বিরক্ত করে।’
তীব্র বেগে হুংকার ছাড়ল মুঠোফোনের ওপাশে। ‘এই মেয়ে, তোমার মাথা ঠিক আছে। সেই কখন থেকে যা’তা বলে যাচ্ছো। পিচ্চি বলে তোমাকে কিছু বলছি না দেখে লাই পেয়ে বসেছো।’
‘আপনার পাশে বসে শব্দ করে হাসছে, কথা বলছে কতগুলো পোলাপান, এরা কারা?’
‘এরা আমার বন্ধু। কেন?’
‘তাদের মধ্যে হয়তো কেউ করেছে। কললিষ্টে আপনি ছাড়া আমার অপরিচিত কেউ নেই।’
আচমকাই মুঠোফোনের ওপাশে কিছু ধমকের শব্দ শোনা গেল। কান থেকে মুঠোফোন সরিয়ে নিয়েছে। তাই কথাগুলো কিঞ্চিৎ ক্ষীণশব্দে ভেসে আসল।
‘এই সানলাইটের বাচ্চা, এখান থেকে যাবি। তোদের জন্য শান্তিতে কথাও বলা যায় না।’
আবারও একসাথে অনেকের হাসির শব্দ ভেসে এল। কেউ কেউ শীষ বাজিয়ে যাচ্ছে। আবার কেউ টিপ্পনী মারছে।
কিছুসময় অতিক্রম হল এভাবে। নুবাহ চুপ হয়ে আছে। আচমকাই ওপাশ থেকে মৃদুস্বর ভেসে এল।
‘সর্যিই, তোমাকে অপেক্ষা করানোর জন্য।’
নুবাহ জবাব দিল না। নিশ্চুপ থাকল।
‘কি রাগ করে আছো না’কি। তবে সত্যিই বলছি। আমি কল দেইনি, নাহ আমার কোনো ফেন্ড। তবে বিশ্বাস না হলে তোমার ঐ নাম্বার আমাকে দাও। আমি তার বায়োডাটাসহ তার চৌদ্দগুষ্টির বায়োডাটাও নিয়ে আসব।’
‘থাক লাগবে না। বিশ্বাস করলাম আপনাকে। আপনি কল দেননি। এবার ঠিক আছে।’
‘মন খারাপ নাকি?’
‘নাহ।’
‘তাহলে। এত নিশ্চুপ কেন? কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমার জন্য না’কি ব্যক্তিগত কিছু?’
নুবাহ নিশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। একহাত থুতনিতে তখন। ‘নাহ, তেমন কিছু না।’
আচমকাই কলটা কেটে গেল। নুবাহ অবাক হল। তবে তা নিয়ে মাথা ঘামাল না। চুপচাপ আবার শুয়ে পড়ল। তন্দ্রাচ্ছন্ন দু’চোখ। কিছু সময় পেরুতেই ফের মুঠোফোন কর্কশ ধ্বনি তুলল। বিরক্ত হলেও ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলালো। যা দেখল তাতে বেশ অবাক হল। ছেলেটা আবার কল দিয়েছে। নেহাৎ ভদ্রতার খাতিরে কল রিসিভ করল। নরম গলায় সালাম দিতেই ওপাশ থেকে এক মিষ্টি স্বর ভেসে এল।
‘সর্যিই, কল কেটে যাওয়ায়। আসলে আমার টিউশন থেকে ফোন এসেছিল। এসএসসির দু’টো স্টুডেন্ট আছে আমার। তার আম্মু কল করেছে। আজকে তাদের বাসায় না যাওয়ার জন্য।’
নুবাহ বিস্মিত হল। ব্যগ্রকন্ঠে বলল,
‘এসএসসির স্টুডেন্ট টিউশন পড়ান আপনি।’
কিঞ্চিৎ মৃদু হাসির শব্দ হল। ছোট্ট এক বাক্যে ভেসে এল। ‘হুমম। কেন, পড়াতে পারি না ভেবেছো? দু’বছর ধরে তাদেরকে পড়ায় নবম শ্রেণি থেকে। তাদের জন্য সাজেশন, পড়ার কৌশল, নোটস সব আমিই তৈরি করছি নিজের হাতে। কি বিশ্বাস হচ্ছে না।’
‘বিশ্বাস হবে না কেন? আপনার স্টুডেন্ট কোন বিভাগে পড়ে?’
‘বিজ্ঞান বিভাগে। আচ্ছা, তুমি কোন বিভাগে পড়।’
‘আমিও বিজ্ঞান বিভাগে।’
‘তোমার স্কুলের নাম কি?’
‘জেবুন্নাহার গার্লস স্কুল।’
‘গার্লস স্কুলে পড়।’
‘হুম।’
‘পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন তোমার?’
‘ভালো না।’
‘কেন।’
‘আসলে আমি ম্যাথে খুব ভালো না। তার উপর থিউরি মনে থাকে না। এত জটিল শব্দ যাই পড়ি সব ভুলে যাই।’
কিছু সময় নিরাবতা ঘটল তাদের মাঝে। হুট করে ওপাশ থেকে বলে উঠল,
‘আমি যদি সাহায্য করি। তাহলে তুমি আমার সাহায্য নেবে।’
‘কিভাবে সাহায্য করবেন?’
‘আচ্ছা নুহা, তোমার ঠিকানা দাও তো।’
‘কিন্তু কেন? আপনি আমার ঠিকানা দিয়ে কি করবেন?’
‘তোমার জন্য সর্ট সাজেশন আর হাতের তৈরি নোটস পাঠাব। সময় যে কয়দিন আছে তাতেও পারবে। আর না পারলে আমি তো আছি।’
‘কিন্তু, আপনি আমায় কেন সাহায্য করবেন?’
‘মনে কর, আমি তোমার টিচার। যেভাবে বলব সেভাবে করবে। দেখবে তোমার রেজাল্ট ভালো আসবে।’
‘আপনি আমার জন্য এত কিছু কেন করবেন। আমাকে চেনেন না, জানেন না।’
‘তুমি না প্রচুর কথা বল। জলদি ঠিকানা দাও তো।’
‘কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনি না। আপনার নামও জানি না। কিভাবে বিশ্বাস করি বলেন তো।’
‘তোমার সমস্যা কোথায়? আমার সাহায্য নিতে না’কি আমি অপরিচিত বলে। বল কোনটা?
‘আসলে,,
‘আসলে কি?’
নুবাহ দোটানায় ভুগল কিছু সময়। পরে ঠিকানা দিল স্কুলের পাশের একটা লাইব্রেরী দোকানের। ঠিক তার পরেরদিন দুপুর বেলায় তার পার্সেল হাজির। নুবাহ ফোনকল পেয়ে ছুটে গেল দোকানে। বাসায় এনে খুলতে গিয়ে বেশ অবাক হল। এতকিছু প্যাকেটের ভিতর।
পার্সেলগুলো এক এক করে খুলল। সাজেশন আর নোটস আগেই খুলেছিল। তবে নোটস দেখে বেশ অবাক হল। এত সুন্দর লিখাও কারো হতে পারে। গোজানো আর বেশ পরিপাটি। দ্বিতীয় প্যাকেট খুলে চক্ষু ছানাবড়া তার। এটাতে পরীক্ষার জন্য যাবতীয় সরঞ্জাম। একটা ফাইল, বলপেন এক প্যাকেট, কালার পেন ছয়টি, বড় মাঝারি দু’টো স্কেল, জ্যামিতি বক্স, সায়েন্টফিক ক্যালকুলেটর আর একটা নরমাল ক্যালকুলেটর। পাশে ডিজিটাল ঘড়িও আছে। এত জিনিস দেখে হতভম্ব সে। কিন্তু এত কিছু কেন দিয়েছে তাকে।
তৃতীয় আরো একটা প্যাকেট আছে। বুঝল না এটাতে কি আছে। প্যাকেট ধরতেই ঝুনঝুন শব্দ হল। চট জলদি খুলে নিল। এটা দেখে অবাকের চরম পর্যায়ে সে। দু’টো হিজাব একটা মেরুন আর অন্যটা কালো রঙের। হিজাবগুলো এত সুন্দর! সাথে ছয়টি কাপড়ের মাস্ক, হিজাব পিন পাথরের বারটি, নরমাল পিন এক প্যাকেট, আলপিন আছে এক প্যাকেট।
সাথে একটা চিরকুটও লিখা।
“কি লিখব বা কিভাবে সম্মোধন করব জানি না। আসলে তোমাকে আমার ভীষণ ভয় লাগে। সত্যিই বলছি!
ব্যাগ খুলে তোমার কেমন রিয়্যাকশন হবে সেটা ভেবেও ভয় লাগছে। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি এগুলো ইচ্ছে করে দিই নাই। লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম নিজের একটা কাজের জন্য।দেখলাম আমার পাশে একজন স্টুডেন্ট নিজের জন্য ফাইল,কলম কিনছিল। তা দেখে তোমার কথা মনে হল। তুমিও তো আমার স্টুডেন্ট হও। তাই না! এরপর শপিংমল দিয়ে আসার সময় আচমকা চোখ পড়ল হিজাবের উপর। কেমন যেনও মনে হল এ হিজাব দু’টো তোমাকে বেশ মানাবে। তাই খুব বেশি না ভেবে দোকানদারকে বললাম হিজাব দু’টো প্যাক করে দেন। সাথে হিজাব বাধার জন্য পিনও নিলাম। নতুন হিজাবের সাথে নতুন পিন। তাই কয়েকটা পিনও দিয়ে দিলাম। আমি গরিব নিরীহ মানুষ তাই বেশি কিছু দিতে পারি নি বলে মন খারাপ কর না। যখন আমার অনেক টাকা হবে তোমাকে অনেক গুলো দামী উপহার কিনে দেব। তবে এখন আমার এই ক্ষুদ্র উপহার সাদরে গ্রহণ কর ‘বোকা মেয়ে’।
ইতি তোমার অধম শিক্ষক।
ইমদাদ।”
চিরকুট পড়ে কিয়ৎক্ষন থম মেরে বসে রইল নুবাহ। এসব কি ছিল? স্বপ্নের মত লাগছে তার কাছে। জিনিস গুলো চটজলদি ড্রয়ারে রেখে দিল। শুধু সাজেশন ছাড়া। বক্ষস্থলে হাত চেপে বসে আছে।
চলবে,,,,,,