#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]
৩৩,,
আজ শুক্রবার। সকাল থেকেই আশাকুঞ্জ-এ মোটামুটি ব্যস্ত একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে। দুপুরে অরিকের পরিবার থেকে হাতেগোনা কয়েকজনই আসবে। বাদ পড়ে যাওয়া অতিথিদের মধ্যে রয়েছে ফাহমিদা বেগম। আকবর সাহেব সরাসরি ওনাকে আসতে নিষেধ করেছেন। সাথে সাথে ফাহমিদা বেগমের বাপের বাড়ির লোকজনকেও ওনি নিমন্ত্রণ করেননি। অরিকের নানাবাড়ির দিক থেকে নানা এবং একজন মামাই আসবেন। তিলোর নানাবাড়ির দিকের প্রায় সকলেই রয়েছে। নানা, নানী, দুই মামা তাদের স্ত্রী সন্তান নিয়ে আর খালা ওনার পরিবার নিয়ে আছে। তিলো নিজের বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেছে। তারা সকলে পরিবার নিয়ে আসলেও অনি আসেনি৷ তবে অনির মা আর আয়াশ এসেছে।
অনিমার মা বেশ লজ্জিত সেদিন অরিকের বাড়িতে প্রস্তাব নিয়ে যাওয়া নিয়ে। অনি তাদের বলেনি তখনও যে ইতিমধ্যে অরিকের সাথে তিলোর বিয়ে ঠিক হয়ে ছিলো। অনি কেবল গিয়ে ওর বাবাকে বলেছিলো যে, ওর কাউকে ভালো লাগে আর ও তাকে বিয়ে করতে চায়। অনির বাবাও ছেলের পরিচয় পেয়ে যখন দেখলেন যে, এবার আর অনি ভুল কোনো মানুষকে বেছে নেয়নি তখন তিনি মেয়ের খুশির জন্য কোনোকিছু চিন্তা না করেই চলে গিয়েছিলেন সেদিন। সে বিষয়ে পরবর্তীতে তাঁকে কেউ আর লজ্জা দেয়নি। অনুষ্ঠানটা একদমই সাদামাটাভাবে হলেও সেটার নূন্যতম প্রাণ ছিলোনা। সকলের মাঝেই এক অদ্ভুত ধরনের বিষন্নতায় ছেঁয়ে ছিলো। হয়তো বিষন্নতা একধরনের ছোঁয়াচে রোগ। তিলো এবং ওর বন্ধুমহলের বিষন্নতাই মুখ্য কারণ ছিলো এসবের পেছনে।
তিলো বেশি সাজেনি। একসময় কল্পনা করতো নিজের বিয়েতে সে কতোটা সাজবে, কিভাবে সাজবে, কতোদিন ধরে অনুষ্ঠান হবে। কিন্তু সেসবের আসলে কিছুই হয়নি। অরিক পছন্দ করে ওকে যে শাড়িটা কিনে দিয়েছে, তিলো সেটাই পড়েছে। বিয়েরদিন হিসাবে তার অবস্থাটা বলা যায় ‘হতশ্রী’, যে শব্দটা ব্যবহার করা যাবে তাকে বর্ণনার জন্য। তার চোখের দিকে তাকালে যার মুখোমুখি পড়তে হয় তা হলো ‘শূন্যতা’। তিলোর মাঝে একটা অবচেতন ভয় আছে, ভালোবাসার পূর্ণতা এবং তাকে ধরে রাখার বিষয়ে। সে নিজের ভেতরে ভয়টা ধারণ করেই এই বিয়েতে এগিয়ে চলেছে।
ইমন এসেছিলো। কিন্তু তুলির সাথে একদমই কথা বলেনি। ব্যাপারটা তুলিকে নতুন করে আরেকবার আঘাত করলো। তিলোকে নিজের বোকামির কথা বললেও তিলো কেবল তাকে বলেছে, সুন্দরীরা আসলে বোকা হয়। তুলি প্রচলিত এসব কথার উর্ধ্বে নয় একেবারে। তুলি সুন্দরী। বিধায় সে যথেষ্ট বোকা। যেসকল সুন্দরী রূপের সাথে বুদ্ধিমত্তাও পায়, তারা আসলে বিশেষ কেউ হয়ে থাকে। বিউটি উইথ ব্রেইন। তুলি তেমন নয়৷ সে তুষারের ভাষ্যমতে ‘গর্ধব’ মস্তিষ্কের অধিকারী। তিলো ওকে আনিস সাহেবকে সবটা খুলে বলতে বলেছে। এতে আনিস সাহেব রেগে গেলেও কোনো উপায় বের করতে পারবেন। ওই যে, আলাদীনের চেরাগের জিনি। হুকুমের অপেক্ষা। এরপর যেভাবেই হোক, সকল সমস্যা দূর হয়ে যায়। বাবা-মা এভাবে বলে না যে, ‘হুকুম করুন মালিক’। বরং তারা আদুরে স্বরে কিছুক্ষণ পর পর জিজ্ঞাসা করতে থাকে, ‘কিছু খাবি? মন খারাপ? কেন খারাপ? আমাকে বল। কি হয়েছে? খারাপ লাগছে? ডাক্তার ডাকবো? ইত্যাদি ইত্যাদি।’ আরো মধুর কন্ঠে। বলার ভঙ্গিমায় আনুগত্য থাকে না বরং সেটা অপেক্ষা অনেক বেশি কিছু থাকে। থাকে স্নেহ এবং মমতা, যাকে বলা যেতে পারে জীবনে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ কিছু।
তুলির আসলে তাঁকে জানানো প্রয়োজন। এভাবে কতোদিন থাকবে? এখন তো তিলোর ভার্সিটিতেও ভর্তি হয়েছে। ক্লাস করে। আনিস সাহেব যদিও বলেছেন, তিলোর বিয়ের ঝামেলা মিটে গেলে ওকে নিয়ে নতুন কিছু ভাববেন। তুলি চাইলে পড়াশোনা শেষ করতে পারে। এরপর কোনো কাজে ভিড়তে পারে। আবার চাইলে আরেকবার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করার পরিকল্পনা করতে পারে। এটা এখন সম্পূর্ণ তুলির ইচ্ছাধীন।
তবে তুলির সবেতে ভয়। ভীষণ ভয়।
আশাকুঞ্জের ছাদে এবং সামনের ছোট বাগানটায় খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আতিথেয়তায় কোনোপ্রকার ত্রুটি আনিস সাহেব রাখেননি। নাসীরা পারভীন খানিকটা অসন্তোষ হলেও সেটা প্রকাশ করেননি। নিজেকে বুঝিয়েছেন, নিজের মেয়ে যেখানে ভালো থাকবে, সেখানে ওনার অসন্তুষ্টিতে কিই বা যায় আসে?
সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠান শেষে বিকালের বিদায়বেলায় তিলো নিজের আপনজনদের জন্য কেঁদেছে ঠিকই। তবে হয়তো সে ক্লান্ত এই কয়েকদিনের জীবনধারার সাথে। সে হাঁপিয়ে উঠেছে নিজের আবেগের সাথে। কারণ ইতিমধ্যেই সে নিজের আবেগগুলোর সাথে স্বঘোষিত যুদ্ধে কয়েকবার পরাজিত হয়ে মারা গিয়েছে। এখন সে অপেক্ষায় রয়েছে নিজের মৃত্যু অপেক্ষা গুরুতর কোনো নাটকের অপেক্ষায়।
তার বিদায় প্রক্রিয়াটা একদমই যেন তার ঘোরের মাঝে ছিলো। সে আসলে বিশ্বাস করতে পারছিলো না যে সত্যিই সে তার জন্মস্থান, তার শৈশব কাটানো বাড়িটা, তার আপনজনদের ছেড়ে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছিলো, আশেপাশের পৃথিবী ঘুরছে। সে স্বপ্ন দেখছে না হলে অন্য জগতে রয়েছে। পুরো প্রকল্পের বাস্তবায়নটা হয়তো খুবই দ্রুত ঘটেছে বা হয়তো খুব ধীরে। তিলো ঠাহর করতে পারলোনা কোনটা। ছবিটা ছিলো একদম পরিষ্কার আর শব্দগুলো ঠিকঠাকই ছিলো। তুষার ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলে তিলো অনুভব করলো সে আসলে বিরক্ত হয়েছে। কেন? তা ওর জানা নেই। হয়তো ওকে ওর বিদায়টা বুঝিয়ে দেওয়াটা ও মেনে নিতে পারছিলো না। পুরো পরিস্থিতিতে মনে হয়েছে সে কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় মানুষগুলোকে সে আসলে মজা দিচ্ছে। যেটা সে চায়না। পুরো চিত্রনাট্য একদম ঠিক থাকলেও, কোথায় জানি একটা দূরত্ব ছিলো। কিছু একটা ছুঁতে গিয়েও ছুঁতে পারা যাচ্ছিলো না। অনেক পেছনে অনুভূতিরা হামাগুড়ি দিয়ে আসতে লাগলো।
তিলোর গন্তব্য ছিলো অরিকের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনটা পর্যন্ত। তাকে সাদরে গ্রহণ করতে উপস্থিত ছিলো অরিকের খালা (ফাহমিদা বেগমের স্থান দখল করে) এবং মামীরা। তিলো তাদের কানাঘুঁষাও শুনতে পেলো। তবে কেউই ওকে সরাসরি আক্রমণ করলোনা। কারণ তারা সেটা করার ক্ষমতা রাখেনা। তিলো অরিকের ছোট্ট মামাতো বোনটার মুখে ওকে ‘নিগ্রো’ বলতে শুনলো, যাকে কিনা দ্রুত তার মা কোলে নিয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। এবং পরবর্তীতে তিনি ছিলেন লজ্জায় মর্মাহত, সকলের দিকে ফিরলেন একটা সাহসী হাসি নিয়ে এবং তার কোলে থাকা পরিবারের সবচেয়ে নতুনতম সদস্যটিকে নিয়ে বললেন,
‘আমাদের অরিকের বউ তো দেখি অতি শান্তশিষ্ট।’
তিলোর কোনো অনুভূতি কাজ করলোনা তার সম্পূর্ণ কাজটার প্রতি। তার কোনো ক্ষোভ ছিলোনা বাচ্চাটার প্রতি আর না শিশুটির প্রাপ্ত শিক্ষাটার প্রতি। অতি সাধারণভাবেই তাকে ঘরে তোলা হলো। অরিকের অন্যান্য টিনএজ, প্রাপ্ত বয়স্ক কাজিনরা হয়তো আরো কিছুক্ষণ তাদের বিরক্ত করতো। কিন্তু এখানেও হয়তো অরিকের নিষেধাজ্ঞা ছিলো।
তিলোর এখন নিজেকেই দোষী মনে হচ্ছে। সে যতোটা ব্যথিত, তার থেকে অনেক বেশিই সকলের সামনে প্রকাশ করেছে। যেহেতু অরিক ওর প্রতিটা বিষয়েই সংবেদনশীল। তাই সেই অতিরঞ্জিত বিষয়টাকেও একইরকম গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। ফলাফল, এখন হয়তো অনেকের অনেকদিনের পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দেওয়া। তারা হয়তো অরিকের বিয়েটা নিয়ে কিছু না কিছু ভেবে রেখেছিলো। সেসবই অধরা থেকে গেলো।
বাসরঘরটাও সাদামাটাভাবেই সাজানো হয়েছে। তবে সেটা তিলোত্তমার পছন্দের হলুদ গোলাপে। তিলোর জানে না এই সময় একটা মেয়ের আসলে অনুভূতি কেমন হওয়া উচিত। তবে সে একদমই অনুভূতিশূন্য ছিলো তা নয়। সে অনুভব করছে ঠিক না। সে গবেষণা করছে। চিন্তা করছে। অরিক ওর পরিচিত বিধায় একধরনের অনুভূতি হচ্ছে। যখন একটা মেয়ে তার নবস্বামীকে একদমই চেনে না তখন তার আরেক ধরনের অনুভূতি হয়। যখন কেউ কয়েকবছর প্রেম করে বিয়ে করে তখন তার আরেক ধরনের অনুভূতি হয়। তিলো নিজেকে সেই প্রতিটা অবস্থানে কল্পনা করে মনে মনে দুটো ব্যক্তি সেজে কথা বলছে, কারণ তার হাতে আর কোনো কাজ নেই কল্পনা ব্যতীত। সবচেয়ে মজা পেয়েছে একদম অপরিচিত কারো বউ হিসাবে নিজেকে কল্পনা করে। সে জানে না তার স্বামী কেমন? সে কি রাগী নাকি শান্ত হবে? তার সিদ্ধান্তের গুরুত্ব দেবে? কি রোমাঞ্চকর!!
তিলো সেই রোমাঞ্চ অনুভব করে পুলকিত। অরিক হয়তো অপরিচিত হলে বেশি ভালো হতো।
ওর ভাবনার মাঝেই অরিকের সেই কক্ষে আগমনে তিলোর ভাবনার ঘুড়িটা ভোকাট্টা হলো। এতক্ষণ একধরনের অনুভূতি হলেও অরিকের আগমনে পুরো পরিস্থিতি যেন পাল্টে গেলো। দরজাটা বন্ধ করার শব্দে তিলো মৃদু কেঁপে উঠলো। এতক্ষণ একরকম ভাবলেও তিলো এখন বুঝতে পারছে, সেগুলো নিতান্তই অমূলক ছিলো। তিলো অনুভব করলো, ওর শ্বাসপ্রশ্বাসের উপরে অরিকের পরোক্ষ হস্তক্ষেপ রয়েছে। অরিকের প্রতি পদক্ষেপে তিলোর নিশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে। গভীরভাবে সে নিশ্বাস ফেলছে। তিলো উঠে দাঁড়িয়ে অরিককে সালাম দিলো। অরিক গম্ভীর কন্ঠে তার উত্তর দিয়ে এমন একটা অপ্রত্যাশিত আবদার করলো যেটা তিলোর জন্য একদমই অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো। অরিক ওকে ছাদে যাওয়ার প্রস্তাব দিলো। তিলো নিজের ঘোর কাটিয়ে সম্মতি দিতেই রুমের বিছানার তলা এবং কাবার্টের নিচে থেকে তিনটা ছেলেমেয়ে বেরিয়ে এসে প্রায় চিৎকার করে নিজেদের ব্যর্থতা প্রকাশ করে বললো,
-ভাই এটা কি হলো? সব ভেস্তে দিলি!
অরিক যুবতী মেয়েটার (যে আলমারি থেকে বেরিয়েছে) কান টেনে দিয়ে বললো,
-তোরা যে আমার বাসর ভেস্তে দিতিস, তার বেলায়?
মেয়েটা কান ছাড়িয়ে নিতে নিতে বললো,
-লাগছে তো। ছাড়। কিছুই তো করতে দিলি না। বাজে লোক একটা! এতেও সমস্যা। না হলে তোদের প্রেম করা দেখতাম রাত জেগে।
অরিক তখনও ছাড়েনি ওর কান। এবার আরেকটা ছেলে (যে খাটের তলা থেকে বেরিয়েছে) মেয়েটার কান ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
-ভালো হয়ে যাও মাসুদ। ভালো হতে টাকা লাগে না।
অরিক ভ্রু কুঁচকে বললো,
-কথাটা আমার তোদের বলা উচিত। বোকারদল কোথাকার!
তিলোর হাত ধরে বললো,
-চলো তিল। এই চিরিয়াখানার জীবগুলো দেখে শান্তি নেই। তোমাকে মিরপুর চিরিয়াখানায় নিয়ে যাবো।
তিলো এতক্ষণ ওদের কাহিনি দেখে মুখ টিপে হাসছিলো। আফসোস হচ্ছে, তুষারটা ওর ছোট। নাহলে ও নিজেও এই কাজটা করতো। ইতিমধ্যে তিলো ঠিক করে ফেলেছে অভ্রের বাসরে সে এমন কিছু করবেই করবে। অরিক ওর হাত ধরে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মূহুর্তে পেছন থেকে আরেকটা ছেলে (সেও আলমারি থেকে বেরিয়েছে) বলে উঠলো,
-এখন তো ভাবিকে পেয়ে আমাদের চিনিসই না। যাও, যাও। সময় আমাদেরও আসবে।
অরিক ওদের দিকে না ফিরেই বললো,
-সে সময়গুলোও এখনের মতো দুঃসময় হয়ে যাবে। টা টা।
তিলো পুরো বিষয়টা বেশ উপভোগ করেছে। আসলে সে এইধরনের মজাগুলো আগে কখনো করেনি। প্রথমবার এমনটা হওয়ায় ও আনন্দই পেয়েছে।
#চলবে