ভয়_আছে_পথ_হারাবার ফারিশতা রাদওয়াহ্ (ছদ্মনাম) ১০,,

0
518

#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ (ছদ্মনাম)

১০,,

ওদের আতিথেয়তায় পরিপূর্ণ একটা অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে বিকাল হয়ে গেলো। তিলোর চাচা আর ফুফু তাদের পরিবার নিয়ে রওনা হলো এখান থেকে খানিক দূরে, তিলোর দাদাবাড়ীর উদ্দেশ্যে। তারা আজ রাতটা সেখানেই থাকবে। তাদের বাড়ি ফেরা সম্ভব হয়ে উঠবে না আজ রাতে। যাওয়ার আগে আগামী শুক্রবার অরিকদের বাড়িতে দাওয়াতটা পড়লো ওদের। সেদিন আবারও একইরকম অনুষ্ঠান হবে শুধু জায়গা ভিন্ন। আর কিছু চরিত্র বদলে যাবে। যেমন সেদিন অতিথি হয়ে যাবে তিলোরা।

ওরা বেরিয়ে যাওয়ার আগে নাসীরা পারভীন কলির হাতে একটা বড়সড় শপিং ব্যাগ ধরিয়ে দিলেন। তিলো আগেই বুঝতে পেরেছিলো নাসীরা পারভীন আর তুলি আগেরদিন মার্কেটে কলির জন্য কিছু কিনতেই গিয়েছিলো আসলে। সাথে ইশানের জন্যও।

অরিক বেরিয়ে যাওয়ার আগে তিলোর কাছে এসে গলার স্বর একেবারে খাদে নামিয়ে বললো,

-আজকে ভালো করলি না তিল। ভুলে যাসনা আমি তোর প্রফেসর।

তিলো কপট রাগ দেখিয়ে গলার স্বর নিচু করেই বললো,

-তোর দম্ভ ভার্সিটিতে দেখাস। এটা আমার বাড়ি। তুই বের হ।

অরিক আজ ওর আচরণে একের পর এক চমক পাচ্ছে। যে তিল কারো সাথে ঠিকমতো কথা বলতো না, বললেও বিড়ালের মতো মিনমিনে স্বরে বলতো, আজ যেন তার সমস্ত সংকোচবোধের দেওয়াল ভেঙে গিয়েছে। ফাহাদের থেকে আঘাত পেয়ে ড্যাম কেয়ার ধরনের একটা মনোভাব তার ভেতর পরিলক্ষিত। অরিক ওর থেকে পাওয়া আচরণটা হজম করতেই সময় লেগে গেলো। কিছু না বলেই চলে গেলো। বাইরে এসে নীল গাড়িটার ড্রাইভিং সীটে বসে একবার আড়চোখে তিলোর দিকে তাকালো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিলো মুখে বিরাট এক হাসি ঝুলিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আনিস সাহেব আর নাসিরা পারভীনের সাথে সবাইকে বিদায় জানাচ্ছে। ভাবটা এমন, পুরো অনুষ্ঠানের ইনচার্জ যেন সেই ছিলো এবং সফলতার সাথে সেটা পালন করতে পেরে সে নিজেকে নিয়ে গর্বিত। অনুষ্ঠানের পুরোটা সময় সে খুশিই ছিলো এবং আঘাত পাওয়ার মতো কিছুই আসলে তার সাথে ঘটেনি।

নাসিরা পারভীন এবং আনিস সাহেব তিলোর এহেন আচরণ লক্ষ্য করে মনে মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি পাচ্ছেন। যেন বড় একটা ভার তাদের উপর থেকে সরে গেলো। অনুষ্ঠানটা সফল হওয়ায় যতোটা না খুশি, তার থেকে এই মূহুর্তে ওনারা বেশি খুশি।

রাত প্রায় একটা বেজে গিয়েছে, তিলোর চোখে ঘুম নেই। হঠাৎ পরিহিত মুখোশটা ওকে আরো বেশি পীড়া দিচ্ছে। নিজেকে ঢেকে হাসি মুখে থাকাটা! সময়টা কঠিন ছিলো।
তিলো তার বারান্দায় বসে আছে। তিলোর রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দাটায় সাদা টাইলসের মেঝের উপর একটা দেওয়ালের সাথে লাগিয়ে ছোট একটা তোষক বিছানো। সেখানে কয়েকটা কুশন আছে। তিলো পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখে জায়গাটা। বসার জন্য কেবল এটাই রয়েছে। নিজেকে গুটিয়ে শুয়েও থাকা যায় এখানে। কোনো চেয়ার নেই। একটা এলইডি লাইট জ্বলছে। তিলো দেওয়ালটায় মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে। মাথাটা ভীষণ ধরেছে। এখন ঘুমানো উচিত ও বুঝতে পারছে। কিন্তু ঘুম আসছে না।
তিলো চোখ মেলে আকাশের দিকে তাকালো। তারাভরা আকাশ। তবে কৃত্রিম আলোয় তারাদের বোঝা দ্বায়। তিলো নিজের মনেই হেসে উঠলো। রাতটা তার মতোই কালো।
তিলো আশেপাশে তাকাতেই একসময় একটা কালো টিকটিকির বাচ্চা ওর চোখে পড়লো যেটা সাদা টাইলসের ফ্লোরের উপর থেকে দ্রুত বেগে হেঁটে চলেছে। মাঝ পর্যায়ে সেটা থামলো। শরীরের তুলনায় বড় মাথাটা তুলে কুচকুচে কালো চোখজোড়া তিলোর উপর আবদ্ধ করলো। তিলো মৃদু হেসে পাশে মশার জমিয়ে রাখা লাশগুলো থেকে একটা লাশ তুলে ওর আর বাচ্চা টিকটিকিটার মাঝামাঝি একটা দূরত্বে রাখলো। এতোক্ষণ ওকে মশা কামড়িয়েছে। এখনও কামড়াচ্ছে৷ কিন্তু তিলো সেগুলো তাড়ানোর বিষয়ে কোনোপ্রকার উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ অনুভব করছে না।
টিকটিকিটা প্রথমে কিছু করেনি। তিলো পিছনে সরে গিয়ে সেটার থেকে চোখ সরিয়ে নেওয়ার কিছু সময় পর টিকটিকির বাচ্চাটা সেটা খেয়ে নিলো। তিলো সেটা বুঝতে পেরে টিকটিকিটার দিকে ফিরে বহুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎই আদেশের সুরে বললো,

-লুকিয়ে পড়ো চোর কোথাকার! তুমি রাতের রঙ চুরি করেছো। তুমি রাতের মতোই কালো। তুমি আমার মতোই কালো। লুকিয়ে পড়ো। পুলিশ আসছে। তোমাকে তোমার চুরিকৃত রঙ নিয়ে খুব কথা শোনাবে আর শাস্তি দিবে।

বাচ্চা টিকটিকিটা ওর ভাষা তো আর বুঝতে পারলোনা। তিলো বিরক্ত হলো এতে। এই মূহুর্তে ওর ভেতর বাচ্চামি ভাবটা প্রবলভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ও জানে ওর কাজটা অযৌক্তিক। এরপরও ও নিজেকে সেটা করা থেকে বিরত রাখতে পারছে না।

তিলো উঠে দাঁড়ালো। এতে টিকটিকির বাচ্চাটা সরে গেলো দূরে। তিলো সেদিকে না তাকিয়েই গটগট করে হেঁটে রুমে চলে আসলো।

পরদিন খুব ভোরে অনি ওকে কল করলো। তিলো তখন সবে ঘুমিয়েছিলো সারারাত জেগে থেকে। ফোনটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে অনি নামটা দেখে ওর মেজাজটা মারাত্মক বিগড়ে গেলো। তিলো ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরেই কয়েকটা গালাগাল করলো ওকে। অনি অপেক্ষা করছিলো, ওর গালাগাল শেষ হওয়ার। তিলো থামার পর অনি স্বাভাবিক কন্ঠেই বললো,

-শেষ হয়েছে? নাকি আরো বলবি?

-কূটনি তুই এখন ফোন করলি ক্যান? আমার আর এখন মনে পড়ছে না।

-বুঝলাম। ঘুমের মাঝে গালাগালির ভান্ডারও চুরি হয়ে যায়। যাই হোক, শোন আজ ভার্সিটিতে আসা লাগবে না। রিয়া আর আহান পালাবে। ওদের নিয়ে কাজি অফিস যাবো।

অনির কথা শুনে তিলোর ঘুম ঘুমভাব সম্পূর্ণ কেটে গিয়েছে। ও তড়িৎ বেগে উঠে বসে উত্তেজিত কন্ঠে তুতলিয়ে তুতলিয়ে বললো,

-মা…মা…মানে? মানে ওরা পালা…পালাবে কেন? আর হঠাৎ করে এ…এই সিদ্ধান্ত কেন? আমি কিছু জানি না কেন? তোকে কে বললো?

তিলোর প্রশ্নগুলোতে অনি খুব একটা বিরক্ত না হলেও ওর তোতলানোতে বেশ বিরক্ত। অনি বিরক্ত মিশ্রিত কন্ঠেই বললো,

-ব্যস্ত হচ্ছোস কিল্লাই? ঠিক কইরা কওন যায়না?

তিলো রাগত্ব স্বরে বললো,

-তোর ফাজিল মার্কা ভাষা বাদ দিয়ে বল সবটা।

অনি ক্ষুন্নস্বরে বলতে শুরু করলো,

-আরে আহানের আব্বু আম্মু গিয়েছিলো রিয়াদের বাড়িতে। রিয়ার আব্বুর কাছে সময় চেয়ে নিতে গিয়েছিলো যাতে আহান কিছু করার পর ওদের বিয়েটা দিতে রাজি হন ওনি। গতকালই গিয়েছিলো। কিন্তু রিয়ার আব্বু আহানদের অবস্থা দেখে আরো বিগড়ে গিয়েছেন। ওনি কোনোমতে রাজি তো হলেনই না উল্টো আহানের প্যারেন্টসকে অপমান করেছেন বাজে ভাবে। এতে আহানও খেপে গিয়েছে। আবার রিয়ার আব্বু আজ দুপুরেই রিয়ার বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন ইউএসে চাকরি করা এক ছেলের সাথে। সব মিলিয়ে একটা জগাখিচুরি মার্কা অবস্থা। তাই ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সকাল দশটার ভেতর পালিয়ে বিয়ে করে নেবে। সাক্ষী আমরা। সিম্পল।

তিলোর এসবে কখনোই মত থাকে না। আজও নেই। আবার ওদের ভালোবাসার বিচ্ছেদও তিলো একদমই চায়না৷ উভয়সংকটে পড়েছে ও। খুক খুক করে দুবার কেশে গলাটা পরিষ্কার করে বললো,

-এটা কি ঠিক হবে অনি? বাবা মায়ের অমতে কি ওরা সুখী হবে?

অনি বিরক্ত হয়ে বললো,

-মানুষ মাত্রই ভুল হয়। আঙ্কেলের যে ভুল হচ্ছে না, তার কোনো গ্যারান্টি আছে। তাছাড়া ওরা একে অপরকে ছেড়ে সুখী হবে না। এখন একসাথে থেকেই না হয় দেখুক। তুই দয়া করে নীতিকথার ঝুড়ি নিয়ে লেকচার দিতে বসিস না তোর প্রফেসর ভাইয়ের মতো। পিলিজ বুন্ডি। মাইনা নে।

একটু থেমে আবার বললো,

-থাক তোর আসা লাগবে না। আমরা যথেষ্ট ওদের জন্য। তুই বরং ক্লাস করে পরে আমাদের নোটস দিস। কাজটা রিপার ছিলো। এখন তুই নে দ্বায়িত্ব।

তিলো ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,

-এই হেই, রাগ করছিস নাকি? সরি সরি। আর বলছি না। আমি যাবো তোদের সাথে। কখনো এমন বিয়ে দেখিনি। আজ সেই সাধও পূরণ হবে। রাগ করিস না প্লিজ।

অনি অভিমানী সুরে বললো,

-আচ্ছা ঠিক আছে। সকাল আটটার মধ্যে রিয়ার বাড়ির মোড়ের মাথার গ্রোসারি সুপারশপের সামনে গিয়ে দাঁড়াস। আমরাও যাবো।

তিলো সম্মতি দিয়ে ফোন কেটে দিলো। তিলো পুরো বিষয়টা নিয়ে বেশ উত্তেজনা অনুভব করছে। রোমাঞ্চের গন্ধ পাচ্ছে। ওর বেশ ভালোই লাগছে। এর আগে কাউকে ও এই ধরনের বিষয়ে সাহায্য করেনি। আর না নিজে কখনো ভেবে দেখেছে। আজ প্রথম অন্যরকম অভিজ্ঞতা হতে চলেছে। তিলো নিজের অজান্তেই ওদের সুখের জন্য প্রার্থনা করলো। বিছানা ছেড়ে নেমে ওয়াশরুমে ঢুকে জোরে শাওয়ার ছেড়ে তার নিচে দাঁড়ালো। এখন একটু ভালো লাগছে। তীব্র মাথা ধরাটা শাওয়ারের পানির সাথে অনেকটাই চলে যাচ্ছে যেন। লম্বা একটা শাওয়ার সেরে তিলো রেডি হয়ে নিলো বাইরে যাবে বলে।

রুম থেকে বেরিয়ে নাসিরা পারভীনকে দেখলো রান্নাঘরে সকালের নাস্তা তৈরি করতে। ওনি ফজরের নামাজ আদায় করেই কাজটা করেন। আনিস সাহেবের আবার সকাল সাড়ে আটটার ভেতর বের হতে হয়। তিলো বের হতেই নাসিরা পারভীন ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন,

-এতো সকালে যে কুঁড়ে কুমারীর ঘুম ভেঙে গেলো! তা এখন কোথায় যাচ্ছো?

তিলো এক মূহুর্ত ভেবে তারপর বললো,

-দ্রুত যেতে হবে আজকে আম্মা। একটু কাজ আছে। নাস্তা কি রেডি হয়েছে?

নাসিরা পারভীন বললেন,

-হুম। নাস্তা এখনি করবে? ভার্সিটির আগে বাড়ি ফিরবে না?

তিলো টেবিলে বসতে বসতে বললো,

-সময় হবে না। এখনি দাও।

নাসিরা পারভীন তৈরি হওয়া রুটি আর একটা বাটিতে সবজি আর মাংস তুলতে তুলতে বললেন,

-তোরও আবার ব্যস্ততা! বাব বাহ্! মেয়ে আমার বড় হয়েছে।

তিলো ওনার কথার প্রত্যুত্তরে কেবল হাসলো। ওর মাথায় এখন অন্য চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। রিয়া কি ঠিকমতো পালাতে পারবে? ওদের বিয়েটা নির্দ্বিধায় হবে তো? ইত্যাদি ইত্যাদি।
তিলো কোনোরকমে খেয়ে বেরিয়ে গেলো গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

#চলবে

*মন্তব্য করবেন অনুগ্রহপূর্বক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here