#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]
১৪,,
তিলো শাওয়ার সেরে মাত্র বেরিয়েছে। যদিও ওর শাওয়ার নিতেই ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছে। বেডরুমের ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো মুছতে মুছতে নিজের গালের দাগটা খেয়াল করতেই দেখতে পেলো। যদিও ওর গায়ের রঙের জন্য খুব বেশি স্পষ্ট না, তবুও গভীরভাবে খেয়াল করলে বোঝা যাচ্ছে। তিলোর মনে মনে অভিমানের পাহাড় জমে যাচ্ছে ওর মায়ের বিরুদ্ধে। টাওয়েলটা বারান্দায় মেলে দিয়ে এসে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতেই কলিং বেল বাজতে শুনলো। তিলো একপ্রকার নিশ্চিত এটা তুলি। কারণ এখন আনিস সাহেব আসবেন না আর তুষার কখনো একটা বাজিয়ে ভদ্র হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোক না। পরপর তিনটা কমপক্ষে বাজাবে। ওর নাকি শব্দটা শুনতে ভালো লাগে। নাসীরা পারভীন বকেও ঠিক করাতে পারেনি ওকে। প্রতিবেশীদের কেউ আসলে আলাদা কথা।
তবে তিলোর ধারণাকে সঠিক প্রমাণ করে দরজায় তুলিই ছিলো। নাসীরা পারভীন দরজাটা খুলতেই তুলি মিষ্টি একটা হাসি তাকে উপহার দিলো। ঘরে ঢুকে ওড়নার মাথা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে সোফায় বসে পড়লো। হাতের ব্যাগগুলো সেন্টার টেবিলের উপর রেখে নাসীরা পারভীনকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-ইশান, কি ঘুমিয়ে গিয়েছে? রাস্তায় এতো জ্যাম! দেরি হয়ে গেলো একদম। এই রোদে রাস্তায় থাকা যে কি!
নাসীরা পারভীন দরজাটা বন্ধ করে এগিয়ে এসে ওর কথার প্রত্যুত্তর না করে বরং গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
-তুমি আজকে আবার ওই ছেলের সাথে দেখা করে এসেছো তুলি? আমার কোনো কথা তোমার গায়ে লাগে না? তোমার বাপের মুখে চুনকালি না মাখানো পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছো না?
তুলি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে ওনার কথা শুনে। চোখে মুখে আতঙ্ক ফুটে উঠেছে ওর। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে। তুলি শুকনো একটা ঢোক গিলে ওনার দিকে তাকিয়েই বললো,
-আ…আ…আমি তো শুধু মার্কেটে…
তুলির কথার মাঝেই নাসীরা পারভীন খানিকটা চিৎকার করে উঠলেন,
-চুপ কর অসভ্য মেয়ে কোথাকার! একদম মিথ্যা বলবি না। তোকে আমি নিষেধ করিনি ওর সাথে মিশতে? উত্তর দে। এরপরও কেন গেলি? তোর বাপ জানতে পারলে না, একেবারে খুন করে ফেলবে তোকে। নিজের সংসার ভেঙেছিস। এখন আমার সংসারে কোনো অশান্তি চাই না আমি।
তুলি ওনার কথাগুলো শুনে আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলোনা। ডুকরে কেঁদে উঠলো। এতে নাসীরা পারভীন আরো বিরক্ত হয়ে তুলির চুলের মুঠি ধরে বললেন,
-ছিঃ ছিঃ ছিঃ। নিজেকে ঘেন্না হচ্ছে আমার। এই মেয়ে আমি পেটে ধরেছি! বিয়ের পর পরকীয়া করে বেড়ায়। থুহ্। একদম ন্যাকা কান্না কাঁদবি না। এই খা** নাকি আমার পেটে হয়েছে। তুই জন্মানোর পর মরলি না কেন!
তুলির চুল ছেড়ে দিয়ে নিজেকে কোনোমতে সামলে বললেন,
-ইমনের বাড়ি ফিরে ওর পা ধরে মাফ চাবি। মাফ করলে ভালো। না হলে তোর কি হবে আল্লাহই ভালো জানেন। ওই নেশাখোর, মাতাল বদমাশের সাথে আর একবার কথা বললে মুখ ভেঙে ফেলে দেবো। ওইটুকু একটা ছেলে রেখে! ওই তোর কি একবিন্দু লজ্জা নেই?
তুলি কেঁদে চলেছে। আর নাসীরা পারভীন এদিকে যা মুখে আসছে তাই বলে চলেছেন। তিলো নিজের রুমে বসে সবই শুনছে। কিন্তু ও সেখানে যাওয়ার কোনো আগ্রহ বা প্রয়োজনীয়তা খুঁজে পাচ্ছে না। তুলি অন্যায় করেছে আর নাসীরা পারভীন পারিপার্শ্বিক বিবেচনায় সম্মান বাঁচাতে সেটা লুকিয়ে নিজে দ্বায়িত্ব নিয়েছিলেন মেয়েকে ঠিক করার। তুলি কথা শোনেনি৷ এটুকু তো অন্তত ওর প্রাপ্য। তাছাড়া নাসীরা পারভীন ওকে নিজে এসবের থেকে দূরে থাকতে বলেছে৷ তিলোর বিছানায় বসে বসে কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলো আর কিছু সময় পরপর একেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চললো। যদিও এভাবে আড়িপাতা ঠিক না। তবুও ওর আজকে কৌতুহল হচ্ছে তুলির বিষয়টা নিয়ে। তাই আর আজ ঠিক ভুলের বিচার করার কোনো ইচ্ছা ওর নেই। তবে ওর খুব ক্ষুধা পেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে যে খাবার জোটার কোনো সম্ভাবনা নেই ও জানে। এখন শুধু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষা তিলোর। মনে মনে দ্রুত সবকিছু ঠিক হয়ে যাওয়ার জন্য প্রার্থনাও করে চলেছে।
পরিস্থিতি মোটামুটি ঠান্ডা হলো তুষারের বাজানো কলিং বেলের শব্দে। নাসীরা পারভীন কথা থামিয়ে তুলির দিক থেকে অগ্নিদৃষ্টি সরিয়ে গটগট করে হেঁটে গেলেন দরজার কাছে। রাগে লাল হয়ে যাওয়া মুখটা তার স্বাভাবিক রঙে তখনো ফেরেনি। দরজা খোলার পরও আগের রেশ ওনার কাটেনি৷ তুষার দরজা খুলতেই ভ্রু কুঁচকে বললো,
-রোদ থেকে ফিরলাম আমি আর তোমার মুখ টমেটোর মতো লাল হয়ে আছে কেন? বাইরে বেরিয়েছিলে নাকি?
তুষারের ঠোঁটে সাধারণ দুষ্টুমির হাসি৷ নাসীরা পারভীনের এটা যেন সহ্য হলোনা। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,
-তোকে এতোবার বেল চাপতে নিষেধ করা হয়েছে না? চাপিস কেন? এর পরদিন থেকে দরজা খোলা হবে না। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবি। কিছু বলি না বলে যার যা ইচ্ছা তাই করে যাচ্ছো! চড়িয়ে তোর গাল লাল করে দেবো।
তুষারের বুঝতে বাকি থাকলো না যে, নাসীরা পারভীন রেগে আছেন। কার উপর বুঝতে পারছে না। তবে ওনি রাগলে সবার উপরই তার প্রভাব পড়ে। আনিস সাহেবও বাদ পড়েননা কখনো। তুষার এনিয়ে কথা না বাড়িয়ে বললো,
-পরে রাগ ঝেড়ো তো আম্মা। এখন ক্ষুধা লেগেছে, খেতে দাও। বাইরে থেকে এসে ভালো লাগছে না।
-হ্যাঁ, তাই তো। কারোরই কিছু ভালো লাগে না। সব যেন আমারই দ্বায়। যা তোর ছোট বোনকে ডেকে আন গিয়ে।
কথাগুলো বলতে বলতে নাসীরা পারভীন রান্নাঘরে ঢুকলেন। তুষার এখনো জানে না ওনার রেগে যাওয়ার কারণ কি। ও কাঁধ ঝাঁকিয়ে ‘ওই হবে কিছু একটা’ ধরনের একটা ভাব নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। তুলি আরো আগেই নিজের রুমে ফিরে এসেছে।
তুষার কাপড় পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে তিলোকে ডেকে নিয়ে গিয়ে একসাথে বসলো ডাইনিং টেবিলে। তুষার চোখের ইশারায় তিলোকে জিজ্ঞাসা করলো, কি ব্যাপার? বাড়ির পরিবেশ বাইরে থেকে গরম কেন?
তিলো দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে ঠোঁট উল্টে মৃদুস্বরে বললো, ‘কি জানি?’
নাসীরা পারভীন ওদের দুজনকে খেতে দিয়ে তুষারকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-তোমার বড় বোন কি খাবে না? নাকি? আমি কারো জন্য পরে করতে পারবোনা।
তুষার সরু চোখে একবার ওনার দিকে তাকিয়ে বললো,
-তুমি তো শুধু তিলাপুকে ডাকতে বললে। তুলিপু খায়নি?
নাসীরা পারভীন কোনো একটা কারণে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। সে ভঙ্গিতেই বললেন,
-যার ইচ্ছা হবে সে খাবে। না হলে আমার কি? আমি আর কাউকে দিতে পারবোনা। নিজে নিয়ে খাবে।
কথাটুকু শেষ করে ওনি চলে গেলেন সেখান থেকে। তুলি সবকিছু শুনলেও আসলোনা। তিলো আর তুষারের কি? ওদের ক্ষুধা লেগেছে, তাই খেয়ে নিলো। তুষার বুঝতে পারলো, ওর মা আসলে তুলির উপর রেগে আছেন।
খাওয়া শেষে নাসীরা পারভীন একটা প্লেটে খাবার গুছিয়ে তুষারের হাতে দিয়ে বললেন তুলির রুমে রেখে আসতে। সাঁধতে নিষেধ করলেন। ইচ্ছা হলে খাবে না হলে নাই। তুষারের হাতে প্লেটটা দিতে দিতে স্বগতোক্তি করলেন,
-যাবি আর কই? সেই ডাবের চারির ধারে তো আসতেই হবে। বাপের তা ছাড়া খাবি কি?
তুষার মুখ টিপে হেসে দিলো। ওর মায়ের স্বভাব ও জানে। ছেলেমেয়ের উপর ভীষণ রেগে থাকলেও তারা সময়মতো না খাওয়া পর্যন্ত ওনি শান্তি পাননা৷
তুষার খাবারটা তুলির রুমে থাকা স্টাডি টেবিলটার উপর রেখে ওকে খেতে বলে চলে আসলো। ওকে আবারও বের হতে হবে টিউশনে।
সন্ধ্যায় আজকে আর প্রতিদিনের মতো হালকা নাস্তার সাথে আড্ডাটা হলোনা। বাড়ির পরিবেশ থমথমে। তিলো বিকালে ছাদে গিয়েছিলো। তবে সেখানে গিয়ে দেখতে পায়, ওর মা আগে থেকেই সেখানে আছে। ওনি সাধারণত ছাদে ওঠেন না৷ বিকালে বসে বসে টিভিতে সিরিয়াল দেখেন, নইলে পাড়া বেড়াতে বের হন৷ এই ভাবির বাড়ি, ওই ভাবির বাড়ি।
আজকে ছাদে দেখেও তিলো অবাক হয়নি। আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করেও হয়নি৷ ওনি কাঁদছিলেন। তিলো ওনাকে সামলাতে যায়নি৷ কেঁদে হালকা হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। তাছাড়া ও সামলাতে গেলে হয়তো হিতে বিপরীত হতো। ওনার সহানুভূতি পছন্দ না। আবার তিলো তো অভিমান করে আছে তাঁর উপর।
তিলো নিঃশব্দে নিচে চলে এসেছে।
সন্ধ্যার পর বইগুলো নিয়ে বসে ও পড়ায় মন বসাতে পারছে না। কারণ অনুধাবন করলো, আশেপাশের পরিবেশের অস্থিরতা আর ওর পেটের ক্ষুধা নামক ছোট্ট ইঁদুরটা। সন্ধ্যার নাস্তার অভাব ও অনুভব করতে পারছে। তিলো রান্নাঘরে গিয়ে চা বানিয়ে সাথে কয়েকটা বিস্কুট এনে বারান্দায় বসলো।
খেতে খেতে চিন্তাগুলো ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ওর মা আর বোনের মধ্যেকার ঠান্ডা যুদ্ধটা এতোদিন সবার চোখের আড়ালেই ছিলো। আজ যেন তিলো আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে। ঘুমিয়ে থাকা আগ্নেয়গিরি হঠাৎ জেগে উঠেছে ওর ইন্ধনে। আর ও নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে আগেই এলাকা ত্যাগ করেছে। চুপচাপ গর্তে লুকিয়ে আছে। ছোটবেলার কথা মনে পড়লো হঠাৎ ওর৷
ছোট থাকতে তুলির কোনো লুকিয়ে রাখা অন্যায় মাকে জানিয়ে দিয়ে তিলো একদম চুপ হয়ে দেখতো ওর বোনের বকা খাওয়া। তখন সে হতো সবচেয়ে ভদ্র মেয়ে। আজ এতোগুলো বছর পর আবারও ছোটবেলার একটা স্বাদ পাচ্ছে ও৷ যদিও তুলির অন্যায়টা এবার খুবই গুরুতর।
ওর ভাবনার মাঝেই ফোনটা বেজে উঠলো। তিলো ভ্রু কুঁচকে পাশে তাকিয়ে স্ক্রিনে আননোন নাম্বার দেখে বিরক্ত হলেও ফোন রিসিভ করলো। ও হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে বাজখাঁই কন্ঠ শোনা গেলো।
-আমার নাম্বার তুই তোর বান্ধবীকে দিয়েছিস তিল?
কন্ঠটা শুনে তিলো কয়েক মূহুর্ত চিন্তা করলো এটা কে। মনে পড়তেই বললো,
-কে? অরিক ভাইয়া?
-রাখ তোর ভাই। তুই দিয়েছিস আমার নাম্বার?
-হুম।
-কেন তিল? আর দিলেও বলিসনি কেন আমাকে বিরক্ত না করতে? কি উশৃংখল মেয়ে রে বাবা!
তিলোর আজকের মন খারাপের মাঝেও বেশ মজা লাগছে। অনি কাজ সেরে ফেলেছে। তারপরও এখন ওর অরিকের বকা শোনার সাধ নেই। মনে মনে বললো, প্লিজ আল্লাহ, এই মিথ্যার জন্য মাফ করে দাও। আর বলবো না। প্রমিজ।
কথাটা মনে মনে আওড়ে তিলো ফিঙ্গার ক্রস করে নিয়ে বললো,
-সরি ভাইয়া, আসলে ওকে আরেকটা নাম্বার দিতে গিয়ে তোমারটা চলে গিয়েছে। আজকে ভার্সিটিতে গেলে তখন ও বললো। নিষেধ করার সময় পাইনি৷ ওকে বলে দেবো।
অরিক নিজের কন্ঠ শান্ত করে বললো,
-হ্যাঁ বলে দিস। আর আমার এই নাম্বারটা একদম দিবি না৷ বেহায়া মেয়ে! নিষেধ করা সত্ত্বেও ফোন করে যাচ্ছে।
তিলো ছোট করে ‘আচ্ছা’ বলে ফোন কেটে দিলো। অরিক চাইছিলো না তিলো এখনই কেটে দিক। একবার ওরও জিজ্ঞাসা করা হয়নি, যে তিলো কেমন আছে আর না তিলো করলো। এটা কি সম্পর্কের অবচেতন দূরত্ব নাকি জড়তা আর সংকোচবোধ এটা অরিকের বোধগম্য হলোনা।
#চলবে