ভয়_আছে_পথ_হারাবার ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম] ১৯,,

0
409

#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

১৯,,

নাসীরা পারভীনের জন্মদিনে পারিবারিকভাবে ছোটখাটো সারপ্রাইজ দেওয়ার প্ল্যান করেছে তিলো আর তুষার। তারই অনুষঙ্গ হিসাবে তিলো নিজে হাতে রান্না করেছে। নাসীরা পারভীন ওর অতি আগ্রহে ভেবেছিলেন মেয়ের সংসার হবে তাই নিজে থেকে ঘরকন্না শুরু করেছে। তিলো তার কোনো সাহায্য ছাড়াই সব করেছে। এদিকে তুষারের মাথায় হাত। ও নিশ্চিত তিলোর রান্না খাওয়া যাবে না।

দুপুরে তিলোর অনুরোধে আনিস সাহেব অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এসেছেন। যদিও ওনি নিজেও নাসীরা পারভীনের জন্য সন্ধ্যায় কিছু পরিকল্পনা করেছেন। তবে ছেলেমেয়ের সামনে ভাব ধরেছিলেন যেন জানেনই না। তিলো ওনাকে তাড়াতাড়ি ছুটি নিতে বললে ওনি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন কেন। তিলো তার উত্তর না দিয়ে বরং অধিকার নিয়ে বলেছে, আসতে বলেছে তাই আসতে হবে তাকে।

সবাই টেবিলে বসলে তিলো একে একে সব পরিবেশন করে। খাবারগুলো দেখতে অত্যন্ত লোভনীয় হয়েছে। তিলো নিজেও খেতে বসতে বসতে বললো,
-ভাবতে পারছো? আমি নিজে সবকিছু রান্না করেছি!

নাক টেনে ঘ্রাণ নিয়ে বললো,
-কি দারুণ ঘ্রাণ আসছে! নাও সবাই শুরু করো।

সকলের মনেই একপ্রকার ভয় কাজ করছে, তিলোর রান্না! তবে ধীরে সুস্থে গালে নিয়ে দেখলো মোটামুটি ভালোই হয়েছে। আনিস সাহেব তিলোকে উৎসাহ প্রদানের সুরে বললেন,
-বাহ ছোট মা! খুবই সুন্দর হয়েছে।

তিলো হেসে দিয়ে বললো,
-আমি রেঁধেছি। বুঝতে হবে।

তুষার তো খাচ্ছে না বরং গালে নিয়ে কি কি দিয়ে রান্না করা হয়েছে সেটাই বোঝার চেষ্টা চালাচ্ছে। খেতে খেতে বললো,
-ভালো হয়নি। তোর হাতে রান্না তো। এ কোনোদিন ভালো হবে না।

তুলি ফোঁড়ন কেটে বললো,
-তাহলে খাস না তুই। জোর করছে না তো কেউ তোকে।

-তবুও আমি খাবো। বোন বলে কথা। না খেলে কষ্ট পাবে তো।

নাসীরা পারভীন ওদের খুঁনসুটির মাঝেই বলে উঠলেন,
-এখন তো শিখতে হবে ওকে ধীরে ধীরে সব। কয়দিন পর চলে যাবে নিজের সংসারে।

বলতে বলতে ওনি কেঁদে দিলেন। মেয়ে বিদায় করতে যে ওনার ভীষণভাবে কষ্ট হচ্ছে সেটা সকলে বুঝতে পেরেই কেউ সান্ত্বনা দিলো না। তুষার ভেংচি কেটে বললো,
-বিদায় হবে তো! চুন্নি বিদায় হলে বাঁচা যাবে।

তুলি মৃদু ধমকে উঠলো তুষারকে। তিলোর চোখেও এদিকে পানি ভরে উঠেছে। ওকে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে! ছোট থেকে আজ পর্যন্ত এবাড়ির বাইরে গেলে ওর ঘুম আসতো না। আর কোথাও থাকার কল্পনাও করতো না পরিবার ছেড়ে। তুলির বিয়ের আগের রাতে সারারাত তুলির পাশে শুয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে। তুলি অবশেষে বিরক্ত হয়ে বলেছিলো, ও বিয়েই করছে, মরছে না। এবার অন্তত থেমে যাক। তিলো তাই শুনে ওর পিঠে কিল বসিয়ে আরো জোরে কাঁদতে শুরু করে।
আর আজ কয়েকদিন পর ওকেই ছেড়ে যেতে হবে ভাবতেই মনটা বিষাদে পূর্ণ হয়ে গেলো। তখন তো তুলি গেলেও বাবা মা তুষার ছিলো। এবার তো ও একা হয়ে পড়বে সম্পূর্ণ একা!
তিলো খেতে পারছে না। নিজে এতো কষ্ট করে নিজেই খেতে পারছে না। হাত দুই জায়গায় পুড়ে গিয়েছে। কিছু জায়গায় কেটেও গিয়েছে। সেটা বড় ব্যাপার নয়। আসল কথা হলো খাবার ভালো হয়েছে। সকলের সামনে কোনোমতে খেয়ে নিলো। আনিস সাহেব সবটা খেয়াল করেও তখনই কিছু বললেন না। সবাই খেয়ে উঠে গেলে নাসীরা পারভীন সবকিছু পরিষ্কার করেন।
আনিস সাহেব লিভিং রুমে সোফায় বসে পেপারটা খুলে সামনে ধরেন। তিলো ওনার পাশে বসে কোক খাচ্ছে। তুলি ইশানকে সামলাতে ব্যস্ত। তুষার বন্ধুদের ডাকে বাইরে গিয়েছে।
আনিস সাহেব পেপার থেকে চোখ তুলে তিলোর দিকে তাকিয়ে দেখেন ও ফোন স্ক্রোল করছে। ওনি দুবার কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে আবার পেপারের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-তিল একটা সত্যি কথা বলবি?

-হুম বলো।

-তুই কি সত্যিই মন থেকে রাজি? দেখ মা, তুই যা চাইবি তাই হবে। তোর বিয়েতে অমত থাকলে এই বিয়ে হবে না।

তিলো অবাক চোখে আনিস সাহেবের দিকে তাকালো। ওনি কি এখনো রাজি নন। তিলো অবাক কন্ঠেই বললো,
-তোমার কি রেজা সাহেবকে পছন্দ হয়নি আব্বু?

আনিস সাহেব পেপার থেকে চোখ তুলে বললেন,
-বিষয়টা আসলে তা নয়। তুই ওনার তুলনায় আসলে অনেক ছোট।

-তুমিও?

-এটাই আসলে কথা। তাছাড়া আমি চাই না আমাদের মতো পরিবার থেকে গিয়ে তুমি অতো বড় বাড়িতে অবহেলিত হও।

-ওনি ভালো মানুষ আব্বু। আমাকে সম্মান করেন। অবহেলা করবেন না।

আনিস সাহেব দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে পেপার পড়ায় মনোযোগ দিলেন। ওনার আসলে রেজাকে খুব বেশি পছন্দ হয়নি নিজের মেয়ের জন্য। রেজা মানুষ হিসাবে ভালো। তবে এতোটুকু মেয়ের জামাই হিসাবে মানতে ওনার কষ্ট হচ্ছে।

আজ শুক্রবারে অরিকদের বাড়িতে ওর ফুফু এবং চাচার পরিবারের সকলের দাওয়াত। সাথে নানা বাড়ির দিক থেকে মামা খালারাও আসবে। সকাল থেকেই ফাহমিদা বেগমের মাঝে বিরাট ব্যস্ততা। কোনদিক রেখে কোনদিক সামলাবেন সেটাই যেন বুঝে উঠতে পারছেন না। বাবুর্চি রান্না করছে একদিকে। আরেকদিকে বাড়ির সামনের বাগানে টেবিল পাতা হচ্ছে। ওদের বাড়িতে লোক বেশি আসবে। অরিকের নানাবাড়ির দিক থেকেও লোক আসছে।
সকাল থেকে তিনি অরিকের কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না। বুধবার রাতে অরিক এসেছে এবাড়িতে। গতকাল রাতেও বেশ চিন্তিত ছিলো ও। জিজ্ঞাসা করেও কোনো সদুত্তর পাননি ফাহমিদা বেগম। আজকে সকাল থেকে অরিক নিখোঁজ। ওকে ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না৷ ফাহমিদা বেগম একদিকে চিন্তায় অস্থির হয়ে আজকের পুরো অনুষ্ঠানটা বাতিল করে দিতে চেয়েছিলেন। তবে আকবর সাহেব সেটা হতে দেননি৷ ফাহমিদা বেগমের ধারণা তিনি জানেন অরিক কোথায় গিয়েছে। তবে তার মুখ থেকে সেটা বের করা সম্ভব না যদিনা তিনি নিজে থেকে জানাতে চান।

এই অবস্থায় ফাহমিদা বেগমের সবটা তদারকি করতে হচ্ছে। অভ্র সবে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা নিয়ে বসলো।

তিলোর বিয়ের তারিখও ঠিক হয়ে গিয়েছে। যখন সবাই রাজি তখন আর ওনারা কেউ দেরি করতে চাননি। আজকে তিলো অরিকদের বাড়িতে যেতে চাচ্ছে না। এরপরও নাসীরা পারভীন খানিকটা জোর করলেন। লোকে কি বলবে? তিলো নিজের বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পরও ফাহাদের শোক ভুলতে পারেনি! তিলোও ভেলা দেখেছে সেটা। আসলেই আজকে ফাহাদের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে সে।
খুব সকালেই ওরা বেরিয়ে পড়লো অরিকদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

প্রায় সবাই এসেছে এখানে। নাসীরা পারভীন তো গর্ব করে সকলের মাঝে নতুন জামাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আনিস সাহেব সেবিষয়ে একটা কথাও বলছেন না। সামনের মাসেই ওনার অপছন্দের পাত্রের হাতে মেয়ে তুলে দেবেন, এটা মানতে পারছেন না ওনি এখনো।

আজকেও কলি আর ফাহাদের জুটিটা নজরকাড়া। তিলো না চাইতেও কয়েকবার আড়চোখে তাকিয়েছে। ফাহাদ ওকে দেখতে পেয়েই হাসি মুখে বলেছে,
-কি রে ছোট! তোরও বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে! ভাবা যায়! কতো বড় হয়ে গেলি!

তিলো কেবল মুচকি হেসে প্রত্যুত্তর করলো। ফাহাদ আজও ছোটই ভাবে ওকে। এরপরও সেদিন অপমানটা কিভাবে করলো ও!

অরিক ফিরলো দুপুরে খাওয়ার ঠিক আগে আগে। ফাহমিদা বেগম ছুটে এসে ওকে কোথায় গিয়েছিলো, কি করছিলো বিভিন্ন কথা জিজ্ঞাসা করলেও অরিক কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে কোনো দর্শনীয় দৃশ্যের অবতারণা হতে দেয়নি।

খাওয়া দাওয়া শেষে যেন দুটো দল আপনাআপনি জেনারেশন অনুযায়ী ভাগ হয়ে গেলো। বড়রা সবাই ভেতরের ড্রইং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আর এদিকে ছোটরা বাগানের মাঝে গোল ছাউনিযুক্ত বসার জায়গাটায় মেঝেতে গাদাগাদি করে বসে আড্ডা দিচ্ছে। ওদের কথাগুলো ঘুরে ফিরে সেই তিলোর বিয়েতেই আটকে যাচ্ছে। তিলোর বর্তমানে এবিষয়ে এতো আলোচনা, এতো লাফালাফি ভালো লাগে না। তবে প্রত্যেকেই কৌতুহলী। বড়রা তো ছেলের পেশার নিয়ে আলোচনায় মত্ত। ছেলের পেশা থেকে ধীরে ধীরে সেটা রাজনীতির আলোচনায় রূপ নিয়ে কয়েক পর্বের কথার ব্যবধানে ছোটখাটো সংসদ বানিয়ে ফেলে। দেশের হালচাল। সরকারের অক্ষমতা, তার সফলতা সামান্য পরিমাণে আলোচনা করা হয়। বিভিন্ন দেশের রাজনীতিও বিষয়।
আর এদিকে ছোটরা! ওদের কৌতুহল ছেলের বয়স আর রূপ। অভ্র আলোচনার মাঝখানে বললো,
-তিল যতোই বল, ছেলে কিন্তু টাক।

তিলো স্বাভাবিক কন্ঠেই বললো,
-তো কি! বড় বড় মানুষেরা টাকই হয়। আমার প্রিয় একশান হিরো ডোয়াইন জনসনও টাক।

তুষার ঘোৎ করে বলে উঠলো,
-কি মিথ্যা! কি মিথ্যা! তোর না টম ক্রুজ পছন্দ। এখন জনসন আসলো কোথা থেকে?

-পছন্দ পাল্টায়।

অরিক তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো,
-এখন তো তোর সব পাল্টাবে। লোকটা খাটো। একদম বাটকুলি।

তিলো চোখ ছোট ছোট করে বললো,
-বুদ্ধিমান মানুষেরা খাটোই হয়।

-তোকে বলেছে?

-ওই হলো।

-সে বু্ড়ো।

-তাহলে জ্ঞানী। পিচ্চি পোলাপাইনের মতো বউ সামলাতে মারামারি চুলোচুলি করবে না।

অরিক বিরক্ত হয়ে মুখ শিটকে জোরালো কন্ঠে ‘রিডিকিউলাস’ বলে উঠে গেলো সেখান থেকে।
তিলো কাঁধ ঝাঁকিয়ে বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ওদের সাথে আড্ডায় মনোযোগ দিলো।

বিদায়ের আগে সকলে ওদের গার্ডেনে এসে জড়ো হয়ে একে একে কথা শেষ করছে। মহিলাদের কথাই আসলে শেষ হচ্ছে না। একজনের কথা একটা শেষ হয় তো আরেকজন আরেকটা বলে। এদিকে পুরুষেরা বিরক্ত হয়ে তাগাদা দিচ্ছে যাওয়ার।
অরিক হঠাৎ খুব ভেবেচিন্তে মনস্থির করলো কাজটা এখনি করবে। ও এই কয়েকদিন অনেক ভেবে দেখেছে শেষ পর্যন্ত এটা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ও সকলের মাঝে দাঁড়িয়ে জোরে বলে উঠলো ‘এটেনশান’। সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করতে প্রথমবারেই সফল হলোনা। কয়েকজন ওর দিকে তাকালো। অরিক এবার আরো জোরে বললো। প্রায় সকলেই ওর দিকে তাকিয়েছে। তিলোর মুখোমুখি তুষার দাঁড়ানো। তিলো নিজের ব্যাগ থেকে বোতল বের করে পানি পান করতে শুরু করেছে কেবল।
অরিক চোখ বন্ধ করে জোরে একটা শ্বাস নিয়ে চোখ খুলে একনিশ্বাসে বললো,
-আমি তিলোকে বিয়ে করতে চাই।

কথাটা সকলের কানে পৌঁছাতেই মৃদু গুঞ্জনটাও থেমে গেলো। ছোটখাটো একটা নাটকীয় দৃশ্যের অবতারণা ঘটলো সেখানে। তিলো নিজের নাম শুনে বিষম খেয়ে তুষারের মুখ ভিজিয়ে দিলো মুখের পানিতে। ফাহমিদা বেগমের জ্ঞান হারিয়ে ফেলার উপক্রম। অভ্র ভাইয়ের সাহসের নমুনা পেয়ে মনে মনে বাহবা দিলো। আকবর সাহেব আর আনিস সাহেবের মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠলো। এদিকে নাসীরা পারভীনের চোখে মুখে কেবলই অবিশ্বাস।

#চলবে

আগেরদিন একটা বিষয় হয়তো অস্পষ্ট থেকে গিয়েছে। আসলে অরিকের নানী বোবা কালা নন। ওনার যার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো তিনি নৌকাডুবিতে মারা গিয়েছিলেন। আর এদিকে ওর নানার পাত্রী বদলে যাওয়ায় ওনি সেখানে বিয়ে করেননি।
বিষয়টা পরিষ্কার করে দেওয়াটাও অদ্ভুত। হয়তোবা। একটা সিক্রেট বলি, এই ঘটনাটা কিন্তু সত্যি। আমার মায়ের একজন খালার সাথে এমনটাই ঘটেছিলো। তবে ওনার বিয়ে অন্য কারণে ভেঙে গিয়েছিলো বা বিয়ে হয়নি। আমি এই বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা রাখি না। তবে আম্মুর খালু পাত্রী বদল হওয়ায় বিয়ে না করে চলে আসছিলেন। তখন তাদের বিয়ে দেওয়া হয়। কোনো একটা কারণে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here