#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]
২৩,,
তিলোর ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে অরিক যেন কথা হারিয়ে ফেলেছে। সে কখনোই ওকে প্রত্যাশা করেনি এই অবস্থায় কোনো খবর না দিয়ে ও আসবে। যেভাবে অরিকের ভেতর অনুভূতিটা এসেছিলো কোনোপ্রকার পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই। কোনো সতর্ক সংকেতের বালাই নেই। একেবারে হঠাৎ আক্রমণ রূপে। অরিক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন তার চোখজোড়া বেইমানি করছে৷
তিলো ওকে একদৃষ্টিতে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। কি করবে ভাবতে ভাবতেই বললো,
-আমি কি ভেতরে আসতে পারি?
অরিক হুসে ফিরলো। বুঝতে পারলো, তিলো আসলে ওর ভ্রম না। ও নিজেও ব্যস্ত ভঙ্গিতে দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়িয়ে বললো,
-হ্যাঁ। নিশ্চয়ই।
তিলো এই প্রথমবার অরিকের ফ্ল্যাটে পা রেখে খানিকটা অবাক হলো। ব্যাচেলর কেউ এতো বড় ফ্ল্যাট নিয়ে থাকে! তার উপর বেশ পরিপাটি। তিলো তো বোধহয় নিজের রুমও ঠিকমতো গুছিয়ে রাখে না।
তিলো এগিয়ে গিয়ে কর্ণার সোফাটায় বসলো। অরিকের যেন এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে ও এসেছে! অরিক দরজাটা চেপে দিয়ে ওর দিকে ফিরে বললো,
-একটু বোস। আমি আসছি।
বলেই অরিক আর দাঁড়ালো না। তিলো ওকে নিজের বেডরুমে ঢুকতে দেখলো। তিলো চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখছে। ও বুঝতে পেরেছিলো, গতকালকের ঘটনার পর অরিক নিজের বাড়ি আর থাকবে না। ওই সময়ই ফিরে আসবে৷ অরিকের এটা অভ্যাস। কারো সাথে মনোমালিন্য হলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
সামনের সেন্টার টেবিলের উপর কিছু ম্যাগাজিন রাখা। তিলো সেখান থেকে একটা ম্যাগাজিন তুলে পাতা উল্টে দেখছে।
অরিক ওকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করায়নি। দ্রুতই ফ্রেশ হয়ে ফিরে এসে ওর পাশের সোফাটায় বসতে বসতে বললো,
-হঠাৎ না বলে আসলি যে? ফোন করতে পারতিস।
তিলো ম্যাগাজিনেই চোখ নিবদ্ধ রেখে বললো,
-ফোন করবো না বলেই এতবার ওঠা নামা করে গাঁধার খাটুনি খাটা লেগেছে।
অরিক বিষয়টা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকে বললো,
-মানে?
-মানে কিছু না।
তিলো ম্যাগাজিন থেকে চোখ তুলে অরিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
-একা থাকো, এতো বড় ফ্ল্যাট দিয়ে করো কি?
-মাঝে মাঝেই আম্মা এসে থাকেন। তাছাড়া ছোট জায়গায় দমবন্ধ লাগে।
তিলো ওর কথার প্রত্যুত্তরে কিছুই বললো না। আবারও ম্যাগাজিনে চোখ রাখলো। অরিকও কিছু বলছে না। আসলে কি বলবে ও ঠিক খুঁজে পাচ্ছে না শব্দ। দুজনের মাঝেই নিরবতা বিরাজ করছে। অরিক অবশেষে বললো,
-আজকে ভার্সিটি যাসনি?
-দেখতেই তো পাচ্ছো।
তিলোর জবাব দেওয়ার ধরণটা অরিকের পছন্দ হলোনা। অরিকও শক্ত গলায় বললো,
-তা তো পাচ্ছি। কেন যাসনি সেটা বল।
-ইচ্ছা হয়নি তাই।
-ব্রেকফাস্ট করেছিস?
-হুম।
আবারও সবকিছু চুপচাপ। বড় ড্রইং রুমটায় সুনশান নিরবতা। হঠাৎই তিলো হাত বাড়িয়ে ম্যাগাজিনটা রেখে অরিকের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-গতকাল রাতে তুমি যা বলেছো, তা কি সত্যিই সত্যি অরিক ভাই?
-কোন কথা?
অরিক মনে করার নূন্যতম চেষ্টা না করেই বললো। তিলো চুপ করেই অরিকের দিকে তাকিয়ে আছে। ও মূলত কথাগুলো বলার সময় অরিকের ফিনোটাইপ পর্যবেক্ষণ করতে চায়। তবে অরিকের প্রথমেই ভুলে যাওয়ার বিষয়টায় তিলোর মনোবাসনা খানিকটা নড়ে উঠলো।
অরিক ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বুঝতে পারলো, ও হয়তো আঘাত পেয়েছে এই সংবেদনশীল বিষয়টায়। অরিক নিজের মস্তিষ্কের নির্দেশে কথাগুলো মনে করে বললো,
-হ্যাঁ সত্যি। সবটা সত্যি।
তিলো ভগ্ন কন্ঠে বললো,
-আমিই কেন?
অরিক আগের মতোই ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-এর উত্তর আমার জানা নেই। হয়তো জানা নেই বিধায়ই। আমি ব্যাখ্যা করতে পারিনা বিধায়ই।
অরিকের কন্ঠে আবেগ মিশে আছে। কন্ঠটা তিলোর কর্ণকুহর হতে প্রবেশ করে মস্তিষ্কে পৌঁছাতেই মস্তিষ্ক হয়তো তার প্রতিধ্বনি হৃদয়ে পৌঁছে দিচ্ছে। আজ যেন অন্যরকম স্বরে কথা বলছে অরিক। তিলোর হৃদয় শীতল করে দেওয়া একটা সুর! তিলো চোখ বুজে সুরটুকু অনুভব করে আবারও চোখ মেলে বললো,
-আমি আর কাউকে ভালোবাসি জানার পরও?
অরিক সোফার ব্যাকরেস্টে শরীরটা ঠেকিয়ে দিয়ে সামনে তাকিয়ে বললো,
-এটা একটা অনুভূতি। যে কারো উপর যখন তখন আসতে পারে। তোর আগে কারো উপর এমন অনুভূতি এসেছে। এটা নিয়ন্ত্রণহীন। আমি আমার দিক থেকে তোকে ভালোবেসেছি। আর তুই আর কাউকে। এতে কার দোষ আছে? তুই আমার থেকে ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য বিধায় আমি ভালোবেসেছি। আর কেউ তোর চোখে মনে হয়েছে তোর ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য, যদিও সে নয়।
-যদি বলি তোমাকে আর কেউ ভালোবাসে?
-সেটাও তার বিষয়। আমি তার থেকে পাওয়ার যোগ্য বিধায়।
তিলো আরও কিছু সময় চুপ করে থেকে তারপর বললো,
-আমি যদি তোমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করি?
অরিক চকিতে ওর দিকে ফিরে তাকালো। ওর চোখে মুখে একরাশ হতাশা গ্রাস করে ফেললো মূহুর্তেই। কোনোমতে বললো,
-তুই সেটাই করবি?
-যদি করি? হ্যাঁ করবো।
-এটা তোর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তোর জীবন, তোরও মতামত রয়েছে। পরিশেষে সংসারটা তুই করবি। জোর করে আর কাউকে খুশি করতে নিজেকে বলি দেওয়াটা বোকামি। জীবন একটাই। আর এর দৈর্ঘ্যটাও বেশি না। নিজের জীবনকে গুরুত্ব দিতে শিখতে হয়।
-তোমার মায়ের কথা কি তুমি একবারও ভাববে না? কোন বুদ্ধিতে তুমি তার সামনে গতকাল অতোগুলো কথা বললে?
-তিল, আমি এইমাত্র কি বললাম? নিজের জীবনে গুরুত্ব দিতে শিখতে হয়। একটা জীবনে তার মুখ চেয়ে আমি আমার নিজের কথা একবারও ভাববো না? এখন সবকিছু যে আমার ভাগ্যে থাকবে তার তো নয়। তবে তার দাবি করতে দোষ কোথায়? সংসার আমি করবো। সে তো নয়।
-তুমি সত্যিই বলেছিলে কালকে?
তিলো অবিশ্বাসের সুরে কথাটা আবারও জিজ্ঞাসা করলো। অরিক একই প্রশ্নে বিরক্ত না হয়ে বরং মুখে প্রশান্তি মূলক একটা হাসি ফুটিয়ে বললো,
-একদম সত্যি।
তিলো যেন স্বস্তি পেলো। ও আর বসলো না সেখানে। তড়িৎ বেগে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। অরিক ওর আকস্মাৎ আচরণে হকচকিয়ে গিয়েছে। বুঝে উঠতেই তিলোর নাম ধরে ডাকলো কয়েকবার। তিলো যেতে যেতেই বললো,
-আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি আসছি।
অরিক নিশ্চিত ও এখন পরিস্থিতি থেকে পালাতেই কথাটা বললো। তিলো চলে গেলো। অরিক জানতেও পারলোনা আসলে তিলো কি সিদ্ধান্ত দেবে।
তিলো অরিকের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। গতকালকের পর থেকেই অরিকের সামনে দাঁড়াতে ওর কেমন অস্বস্তিবোধ হয়। এটা কি অরিকের গতকালকের কথাগুলোর জন্যই? তিলোর সেটাই মনে হয়। ও দ্রুত একটা রিকশা ঠিক করে বাড়ি ফিরে এলো। দরজায় কলিং বেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটাও যেন ওর কাছে অনন্তকালের অপেক্ষা মনে হচ্ছে। তুলি দরজা খুলে দিলে তিলো খুব দ্রুতই ঘরে ঢুকলো। আনিস সাহেব অফিসে মনে পড়তেই তিলোর মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ও নাসীরা পারভীনের কাছে গিয়েই জানালো যে ও অরিককে বিয়ে করতে রাজি। নাসীরা পারভীন তিলোর এই হুটহাট সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টা সম্পর্কে অবগত হলেও আজ বেশ বিরক্ত এতে তিনি। তিলো বরাবরই হুটহাট সিদ্ধান্ত নেওয়া মেয়ে। সকলে তাই মনে করে। তবে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তিলো কতোটা চিন্তা করে নেয় সেটা কেবল ওই জানে। সিদ্ধান্ত ভুল হলেও এরপর আর ও বদলাতে চায়না।
#চলবে