ভয়_আছে_পথ_হারাবার ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম] ৩১,,

0
392

#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

৩১,,

এদিকের ঝুল বারান্দাটা থেকে পাশের বারান্দাসমেত ঘরটাকে যতোটুকু দেখা যাচ্ছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে কোনোকিছুর উদযাপন চলছে সেখানে। আসলে চলছিল। এতক্ষণে থেমে গিয়েছে। জানালার গ্রীলের সাথে বাঁধা বেলুনগুলো একে অন্যের সাথে বারি খাচ্ছে এলোমেলোভাবে উত্তাল বাতাসে। সেগুলো নীল, লাল, সবুজ, গোলাপি, সাদা, বেগুনি, কমলাসহ রঙবেরঙের, নরম এবং খানিকটা কুঁচকে গিয়েছে। ঘর্ষণে স্থির বিদ্যুৎ উৎপন্ন করছে হয়তো। ফলে একে অন্যের সাথে লেপ্টে আছে তো দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।

তিলো জানতে পেরেছে সেখানে দশবছরের একটা ক্যান্সার আক্রান্ত ছেলে ভর্তি আছে। কিছু চিকিৎসার জন্য তাকে কয়েকদিন এখানে থাকতে হবে। আজ, ওহ! এখন গতকাল হয়ে গিয়েছে কারণ রাত বাজে দেড়টা, তার জন্মদিন ছিলো। তারই ছোটখাটো উদযাপন করা হয়েছে এখানে। বারান্দার মেঝেতে এখনো সোনালী ফয়েলে মোড়ানো কেকের নিচের কার্ডবোর্ডটা পড়ে আছে। অন্ধকারে দেখা না গেলেও তিলো জানে, পিঁপড়াদের একটা বিশাল দল এখন ব্যস্ত ভঙ্গিতে নিজেদের তুলনায় আকারে বড় কেকের গুঁড়া নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। আহ! এটা তাদের অধিকার। কালো কালো পিঁপড়া, খয়েরী খয়েরী কেকের গুঁড়া।

দরজার সাথে লেগে থাকা ছোট্ট গোল কাঁচের জানালা দিয়ে দৃশ্যমান হয়ে থাকা নিরাবরণ বিছানাটি এবং বিছানার উপরের উদ্ভুত দেহটি, যেটি সাদা বর্ণের অসংখ্য ছিদ্রবিশিষ্ট বিশেষ কাপড়ে মস্তকসহ সর্বাঙ্গ আবৃত হয়ে আছে এবং মুখে পরিহিত বিশেষ যন্ত্র আর আশেপাশে দানবাকৃতির যন্ত্রসমেত দৃশ্যমান হয়ে রয়েছে, একজোড়া অশ্রুসজল চোখ ছিলো তার উপর নিবদ্ধ। সে অনিরুদ্ধ দর্শনে চেয়ে আছে।
আহানের শারীরিক অবস্থা একদমই স্থিতিশীল নয়। কাউকে আইসিইউতে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। রিয়া সেই কখন থেকে ছোট্ট জানালাটা দিয়ে তাকিয়ে দেখছে ওকে। বারবার চোখে পানি জমে ঝাপসা হয়ে আসছে তার দৃষ্টি। পরক্ষণে সেটা মুছে ফেলে পলক ফেলে নিজের দৃষ্টি পরিষ্কার করে নিচ্ছে। এখানে ওদের বন্ধুরা সকলে রয়েছে। আহানের বাবা-মা আর বোনও এসেছে। অবাক করা বিষয় হলো, রিয়ার বাবা-মাও এসেছে। তারা সমব্যথী এই মূহুর্তে। ডাক্তার অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে যখন জানালেন, তিনি দুঃখিত এবং মাত্র কিছুক্ষণই রয়েছে এখন আহানের হাতে। আহানের মায়ের হৃদয়বিদারক চিৎকারে পরিবেশটা মূহুর্তেই অসহনীয় হয়ে উঠেছিলো।

আজ সন্ধ্যার কিছু আগে আহান একটা টিউশনি করে বেরিয়েছিলো। বাইকটা নিয়ে বড় রাস্তায় উঠতেই পেছন থেকে একটা মালবাহী একটা ট্রাক ধাক্কা দেয় তার বাইকটাকে। আহান ছিটকে গিয়ে সামনে পড়ে। ট্রাকটা নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ আনার আগেই আহানকে আরেকবার আঘাত করে। এখানে কেউ কাউকে দোষারোপ করার না থাকলেও আহানের বাবার মাঝে অনুতাপ বোধটা কেউ খেয়াল করতে না চাইতেও সকলের সামনেই বারবার উপস্থাপিত হচ্ছে। রিয়ার চেহারায়ও মাত্র কয়েক ঘন্টার দুশ্চিন্তা এবং দুঃখটা খুব বেশিই দৃশ্যমান। আহানের মা ইতিমধ্যে দুবার জ্ঞান হারিয়েছেন। এখন নিজেই পাশের কেবিনে ভর্তি হয়েছেন।

তিলো ডাক্তারের মুখে তাদের দুঃখিত হওয়ার খবরটা শোনার পর থেকেই এই পাঁচতলার শেষ মাথার বারান্দাটায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখানে দুপাশে, দুই কেবিনের আরো দুটো ছোট ছোট বারান্দা আছে। তিলোর হাতের ডানপাশের বারান্দাটা যে কেবিনের, সেই কেবিনের ছেলেটির জন্মদিন ছিলো। বাচ্চাটি হয়তো ঘুমে অচেতন, যার জন্মদিন সফলভাবে সমাপ্ত হয়েছে। বারবার তিলোর ভেতরটা মুচড়ে উঠছে। ও কারো মৃত্যু নিয়ে খুব গভীরভাবে ভাবতে পারে না। ভয়ংকর রকমের একটা অনুভূতি ওকে গ্রাস করে ফেলে, বিশেষ করে কম বয়সী কারো মৃত্যুতে। তিলো এজন্য প্রকৃতির এই মৃত্যু নামক নিয়মটার উপর ভীষণ নারাজ। ওর মনে হয়, কম বয়সী কারো মৃত্যু আসলে তার পূর্ণ অধিকার কেড়ে নেওয়া। জীবন তো সে একটাই পাবে। তবে কেউ কেন বেশি সময় এই সুন্দর পৃথিবীতে থাকতে পারবে আর কেউ কম সময়? এটা কি ধরনের বৈষম্য! তার কি এমন দোষ যে তার থেকে বেঁচে থাকার অধিকার বা ধীরে ধীরে বয়োবৃদ্ধ হওয়ার অভিজ্ঞতা কেড়ে নেওয়া হবে!

তিলোর মনে হয়, এমনকি ওর বিশ্বাস, আহানের হাতে বেশি সময় নেই। তিলো জীবনে এই প্রথমবার নিজের বিশ্বাস সঠিক হওয়ার অসফলতা কামনা করছে। সে হয়তো এবার ব্যর্থ হতেই বেশি খুশি হবে।

তিলো বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাতের নিস্তব্ধ শহরটাকে স্থির নয়নে দেখে চলেছে। এই মূহুর্তে নিজেকে দার্শনিক মনে হচ্ছে তার। সে পর্যবেক্ষণ করছে শহরটাকে। আনিস সাহেব চলে গিয়েছেন। তিলো নিজেই ওনাকে জোর করে বাড়ি ফিরিয়ে দিয়েছেন। তিলো এখানে চুপিচুপি এসেছে, কারণ সে একা থাকতে চায়। ওদের কথাগুলো কানে যতোই যাচ্ছে, ওদের হাহুতাশ, ততই তিলোর নিজের মাঝে বুকের বোঝাটা ভারী হচ্ছে।

বাতিলকৃত পুরাতন নক্ষত্রপুঞ্জ, পতন ঘটেছে যাদের আসমান থেকে, পুনরায় সজ্জিত হয়েছে পৃথিবীতে নকশায় নকশায় আর রাস্তায় রাস্তায় আর টাওয়ারে টাওয়ারে আর বাড়িগুলোতে। হানা দিয়েছে সেখানে পোকারা। তারা আকৃষ্ট হয়েছে রঙবেরঙের বাতিতে।

হাসপাতাল, অদ্ভুত একটা জায়গা! কারো জীবনের সূচনা এখানে হয় তো কারো জীবনের সমাপ্তি। একটা জীবনে এমন অনেকের যাতায়াতই চোখে পড়ে। আচ্ছা, যে চলে যায়, তার অনুভূতি কেমন? কেমন লাগে, এই মায়াবী পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে? কেমন লাগে সব ছেড়ে যেতে যদি সে মূহুর্তে সে সবকিছু অনুভব করতে পারে? হিংসা হয় কি যারা বেঁচে থাকে তখনও তাদের প্রতি? তিলো ছোটবেলায় হিংসা করতো ওর ছোটদের। ওর ধারণা ছিলো কেবল বৃদ্ধ হয়েই মানুষ একই সময়ে মারা যায়। তিলো যখন মারা যাবে তখনও ওর ছোটরা বেঁচে থাকবে!! খুবই হিংসাত্মক একটা বিষয়!
এখন বোঝে, সেগুলো কেবলই বোকামি। বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় এটা করতো কেননা তখনও বাস্তবতা না চিনে ও বাবা মায়ের তৈরি সুরক্ষা বলয়ের ভেতর অবস্থিত নরম গদিতে রাজকন্যার মতো শুয়ে থাকতো। বাবা-মা যেন, আলাদীনের জিনি। তবে তার থেকে ভালো। আলাদীনের জিনিটা কেবল তিনটা ইচ্ছাই পূরণ করতে পারে। কিন্তু এই দুটো জিনি সব ইচ্ছা পূরণ করতে পারে। জীবনটা কতো সহজ ছিলো!!

স্ট্রীটলাইটের উপরে সাদার উপর ফোঁটা ফোঁটা দাগে চিত্রিত পেঁচার বাচ্চাটা কুর্নিশে নিচু হয়েই আবার উঠে পড়লো একজন জাপানিজ ব্যবসায়ীর মতো অতি শিষ্ট আর অনবদ্য ঢঙে। তিলো একদৃষ্টিতে সেটার দিকে চেয়ে আছে। অনেকক্ষণ হয়েছে সে দাঁড়িয়ে আছে। জীবনের কিছু হিসাব কষে নিয়েছে ইতিমধ্যে। ভালোবাসাগুলো কি অসমাপ্ত থেকে যায়? শেক্সপিয়ার বলেছিলেন, ‘ভালোবাসা হলো অসংখ্য দীর্ঘশ্বাসের সমন্বয়ে সৃষ্ট ধোঁয়াশা’। তবে তিলোর দার্শনিক মন আজ বলছে, ‘সত্যিকারের ভালোবাসাগুলো কখনো না কখনো অনির্ণেয় পরিমাণ নোনা পানিতে ডুবতে থাকা হাবুডুবু খেতে থাকা বাঁচার আকুতি নিয়ে ডুবন্ত অবস্থায় মুখ বাড়িয়ে শ্বাস নেওয়ার আকুলতা প্রকাশক মূমুর্ষু জীব।’
শেক্সপিয়ার আরো বলেছিলেন, ‘সত্যিকারের ভালোবাসার পথ কখনো মসৃণ হয়না।’ ইহা একটি সত্য কথা বলে তিলো বিশ্বাস করে। আরো মনে করে, সে পথের শেষে খাদটাও সবসময় দৃশ্যমান থাকে না। পা পিছলে যেতে সময়ও লাগে না।

তিলো দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে, পেঁচার বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে তার ভঙ্গিমাটি ফেরত দিয়ে তাকে বললো, ‘ওইয়াসুমিনাসাই (শুভ রাত্রি)।’

পরক্ষণেই মনে হলো, এটা ঠিক না৷ আসলে ও আর কখনো এখানে আসবে না। আর না ও আশা করে এই পেঁচাটির সাথে ওর আবার দেখা হবে। হয়তো এটাই শেষ বিদায়। তিলো নিজেকে সংশোধন করে বললো, ‘সাইয়োনারা (বিদায়)।’ যেটা ছিলো বাংলা এবং ইংরেজি বহির্ভুত আর কোনো ভাষা, আসলে জাপানিজ সম্ভাষণ যতোটুকু ও জানতো।

তিলো ফিরে এলো ভেতরে। পরিবেশটা থমথমে। একেকজন একেকরকম হতাশাপূর্ণ ভঙ্গিতে বসে আছে সেখানে। তিলো নিজে গিয়েও ওদের মাঝে বসলো। কিছুক্ষণ পরই সেখানে অরিকের আগমন ঘটলো। সে আহানকে দেখতে আসার পাশাপাশি তিলোর দ্বায়িত্বে এসেছে। অনি এখানে থাকলেও এই পরিবেশে কোনো দর্শনীয় দৃশ্যের উপস্থাপন ওর মাথায়ও আসছে না। সে একবার আড়চোখে অরিককে দেখে নিজের দৃষ্টি সংযত করে ফেললো।

রাত আড়াইটা থেকে আহানের অবস্থা আরো খারাপ হতে শুরু করে। এদিকে কান্নার রোল পড়ে গিয়েছে। তিলো মূর্তির ন্যায় বসে আছে। তার চোখের সামনে এই প্রথম কারো মৃত্যু হতে চলেছে। এর আগে সে মৃত্যু পরবর্তী মৃতদেহ দেখেছে। কিন্তু মৃত্যুর মূহুর্তে উপস্থিত ছিলোনা। অরিক ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেও সে রাজি হয়নি৷

রাত তিনটার দিকে আহান তার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো। মাল্টিপ্যারা মনিটরে তার ইসিজির হৃৎস্পন্দনের বন্ধুর সারিটা সোজা হয়ে গেলো। ক্ষীণ তীক্ষ্ণ আওয়াজটা এখন যেন বুক ছিদ্র করে দেওয়ার মতো যন্ত্রণাদায়ক। অক্সিজেনের বুদবুদ আর নেই। তার বুকটা আর ওঠানামা করছে না। মৃত্যুর কিছু মূহুর্ত আগে থেকে তার ডানহাতটা রিয়ার দুই হাতের মাঝে স্যান্ডউইচের মতো ধরা ছিলো।
আহানের মৃত্যু সংবাদটা বদ্ধ ঘরটা থেকে বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়লো প্লেগের ন্যায় দ্রুত। তিলোর কানে যখন সংবাদটা পৌছালো তিলো তখন পাশে একটা কাঁধ পেয়েছে যেখানে সে আশ্রয় পেতে পারে। যে জায়গাটার আশা সে করেছিলো আহান আর রিয়ার বিয়েরদিন তাদের জুটিটা দেখে। তিলো ভাবতেও পারেনি, যতদিনে সে সেটা খুঁজে পাবে, ততদিনে ওদের ভেতরকার ভাঙন দেখতে হবে। তিলো খবরটা নিতে পারছিলো না, পড়ে যেতে নিতেই অরিক ওকে নিজের বুকে আঁকড়ে ধরলো। তিলো ঘুরে দাঁড়ালো। অশ্রুসিক্ত নয়নে অরিকের মুখের দিকে একবার তাকালো। এরপর ওর প্রশস্ত বুকে মুখ গুঁজে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। শব্দটা অরিকের বুকেই আবদ্ধ থেকে গিয়েছে। অরিকও এবার তিলোকে শক্ত করে নিজের বুকে মিশিয়ে নিলো। এতোটা কাছে এই প্রথমবার তারা। কিন্তু সেই অনুভূতি অনুভব করার কোনো তাড়া তাদের ভেতর নেই।

রিয়া একদম চুপ করে বসে আছে আহানের ক্ষতবিক্ষত স্থির মুখটার দিকে তাকিয়ে। ওর শরীরের যেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটা কেটে ফেলা হয়েছে। তার মস্তিষ্ক এবং হৃদয়। অনুভূতিহীন একটা পুতুল যেন সে।
আহানের মা এখনো জানেন না যে, তাঁর ছেলে ইতিমধ্যে পরলোকগমন করেছে। রিয়ার বাবা-মাও আজ ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। ওদের বন্ধুরা কারো চোখই শুকনো নেই। অনিকেত নিজের অজান্তেই রেগে সেখান থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। আর বাকিদের অবস্থাও একই।

#চলবে

ওপস! আরেক পর্ব টাইপ করে ফেললাম 🤭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here