#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]
৩২,,
“চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভিধানের সাথে সাধারণ অভিধানের একটা অমিল হলো, চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভিধানে ‘নিশ্চিত’ শব্দটার কোনো স্থান এখনো নেই। কোনো চিকিৎসক বলতে পারে না যে, তার রুগী নিশ্চিত সেই সময়ই মারা যাবে বা বেঁচে থাকবে। তারা ধারণা দিতে পারেন যে, এই কয়েকমাস বাঁচবেন। তবে সুনির্দিষ্ট দিনটা কোনোদিনই বলতে পারেন না। যখন একজন রুগী মারা যাবে বলে তারা বুঝতে পারেন, তারা সরাসরি বলেন না যে মারা যাবেন। তারা বলেন, তাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে ওনার যা মন চায় খাওয়ান। দুটো গল্প বলি, সত্য ঘটনা একদম।
একজন হার্টের রুগী একদম শেষ মূহুর্তে চিকিৎসা করাতে গিয়েছেন। চিকিৎসক ওনার রিপোর্ট দেখে বুঝতে পেরেছিলেন যে, ওনি মাত্র কয়েকমাসই বাঁচবেন। কোনো চিকিৎসা নেই ওনাকে সুস্থ করার। ওনি তাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বললেন। রুগী সেটা বুঝতে পেরে হতাশ হলেও ওনি আরেকজন চিকিৎসককে দেখানোর কথা চিন্তা করলেন। দুদিন পর গেলেন আরেকজন চিকিৎসকের কাছে। সেই চিকিৎসকও ওনার রিপোর্ট দেখে মুখ গোমড়া করে ফেললেন, তবে রুগীর অগোচরে। এরপর রুগীর দিকে চওড়া হাসি নিয়ে তাকিয়ে প্রফুল্ল কন্ঠে ওনার পিঠে চাপড় মেরে বললেন, ‘আরেহ্, আপনার তো কিচ্ছু হয়নি। আপনি এখনো পাঁচ বছর বাঁচবেন। এটুকু অসুখে কারো কিছু হয় নাকি?’
রুগী সেটা বিশ্বাস করেই খুশি ছিলো। এবং অদ্ভুত বিষয় হলো, ওনি ঠিক পাঁচ বছরই বেঁচে ছিলেন তারপর। রুগীর আত্মীয় স্বজনরা বলতে লাগলো, ডাক্তার বোধহয় দশবছর বললে ওনি দশবছরই বাঁচতেন।”
কথাগুলো অরিক বলছিলো তিলোকে ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে। দুমাস হয়ে গিয়েছে আহান চলে গিয়েছে। তিলো নিজের বিয়েটা স্থগিত করে রেখেছে। মানসিকভাবে নিজেও দূর্বল হয়ে পড়েছে সে। অপূর্ণতার একটা ভয় জেঁকে বসেছে ওর মাঝে।
তিলোর বন্ধুমহলও হঠাৎই ছন্দ হারিয়ে ফেলেছে আহানকে হারিয়ে। আসলে তারা আহানের সাথে সাথে রিয়াকেও হারিয়ে ফেলেছে। রিয়াকে আহানের মৃত্যুর পর থেকে আর ভার্সিটিতে দেখা যায়নি। এখন সে নিজের বাবা-মায়ের সাথে থাকে। একবার আত্মহত্যা করার প্রস্তুতি নিয়েও সফল হয়নি। ঘর থেকে একদমই বের হয়না। কারো সাথে সে কোনো যোগাযোগও রাখেনি৷ ওর বাড়িতে গেলেও ও কারো সাথে দেখা করে না। নিজেকে একেবারে গুটিয়ে ফেলেছে। আহানের মায়ের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। এখন সেই এলাকায় গিয়ে ওদের কথা জিজ্ঞাসা করলেই শোনা যায়, ওই যে পোলাডার মরণের পর মাথা খারাপ হইয়া গেছে যে মহিলাডার।
প্রাণোচ্ছলতা হারিয়ে ফেলেছে তারা। অরিকও তিলোকে সময় দিয়েছে নিজেকে সামলে ওঠার জন্য। অনিকেত ইতিমধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় চলে গিয়েছে। ফলে ওরা আরো গুমিয়ে উঠেছে।
অনি খুব বেশি বাড়াবাড়ি করেনি। আহানের মৃত্যুতে ও নিজেও শোকাহত। তবে অরিকের বাড়িতে সেদিন ওর বাবার যাওয়ার পর থেকে ফাহমিদা বেগম অরিককে উত্ত্যক্ত করে চলেছেন। অরিক ওনার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে আকবর সাহেবের পরামর্শে। কিন্তু এখন সেটা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। যতোই হোক, ফাহমিদা বেগম অরিকের মা। অরিক তাকে যথেষ্ট সম্মানও করে। তিলো যত দেরি করছে, পরিস্থিতি অরিকের জন্য জটিল হয়ে পড়ছে।
তিলোর বন্ধুমহলের সকলে সে রাতের স্মৃতি চাইলেই ভুলতে পারবে না। সারাজীবন এটা বিড়ালের লেজে বাঁধা টিনের কৌটার মতো ঝনঝন শব্দে (উপমা স্বরূপ) পিছু করে বেড়াবে।
অরিক এই দুমাসে সরাসরি একবারও ওকে বিয়ের কথা বলেনি। তবে অরিকের প্রতিবাক্যেই পরোক্ষভাবে সেটা প্রকাশ পেয়েছে।
তিলো ওর কথাগুলোতে বিরক্ত কখনোই হতোনা। ও নিজেও বুঝতে পারতো, ঝামেলাটা আসলে ও বাঁধিয়েছে এবং একটা সম্পর্ক স্থায়ীভাবে স্থাপন করাটা আসলে অধিক সুরক্ষিত একটা ব্যাপার। তবুও তিলোর নিরবতা অরিকের জন্য ছিলো বিরক্তির কারণ।
তিলোকে চুপ করে থাকতে দেখে অরিক আবারও বললো,
-তিল, ঠিক আছো তুমি?
-হুম।
কথাগুলো বলতে নিজের ওষ্ঠজোড়া ফাঁকাও করে না তিলো। বর্তমানে তিলো একটু বেশিই চুপচাপ স্বভাবের হয়ে গিয়েছে। ধাক্কাটা সামলে উঠলেও গভীর একটা ক্ষত রেখে গিয়েছে। যেমনটা হয়ে থাকে পোড়া দাগগুলো। ক্ষত শুকিয়ে গেলেও দাগ থেকে যায়।
-তুমি কি কিছু বলবে? (অরিক)
-গল্পটা আসলে আমার ভালো লাগেনি। (তিলো)
-এটা গল্প ছিলোনা। সত্যি ছিলো।
তিলো দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,
-আমার একটা ক্ষুদ্র ধারণা তোমায় দেই? সে আসলে ডিসকাউন্ট অফার পেয়েছে।
অরিক থমকে গেলো ওর কথা শুনে। তিলোর এই হাইপোথিসিস সে আগেও শুনেছে। আহান যেভাবে আঘাত পেয়েছিলো, তাতে আসলে অনেকের ধারণা ওর স্পট ডেড হওয়ার কথা। এরপরও যতোটা সময় ও বেঁচে ছিলো, সেটা ছিলো ওর জন্য ডিসকাউন্ট। যেমনটা আমরা পেয়ে থাকি বড় বড় শপিংমলে বা কোনো পণ্য কিনে আরেকটা ফ্রী পেয়ে। এটা অনেকটা এমন যে, একটা পণ্য সে কিনলো। সে জানতো পণ্যটার দাম এতো হতে পারে। কিন্তু সে বিশ বা ত্রিশ পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট পাওয়ায় তার নির্ধারিত টাকা থেকে কিছু টাকা বেঁচে গেলো। সেই টাকাটা সে বাড়ি ফিরে টিনের বাক্সে জমিয়ে রাখলো বা অন্য কিছু কিনতে পারলো। এভাবে সে জীবন থেকে ছেঁকে ছেঁকে কিছু সময় সঞ্চয় করে রেখেছে, যেটা ও ডিসকাউন্ট পেয়েছে। যেন সেই গানটার মতো, ‘If I could save time in a bottle’.
তিলোর এই অদ্ভুত ধারণায় অরিক তাজ্জব বনে গিয়েছিলো কিছু সময়ের জন্য। তার হায়াৎ যতোটুকু ততটুকুই তো সে বাঁচবে। কিন্তু তিলো নিজের ধারণাটা মজা করতে বানিয়েছিলো, তাও এতো গুরুতর একটা সময়ে এটাই অরিকের কাছে অদ্ভুত লেগেছে।
অরিক কিছু সময় চুপ থেকে বললো,
-তিলো, আমার মা।
অরিকের আর কিছু বলতে হয়নি। কারণ অরিক জানে যে তিলো জানে যে অরিক জানে যে তিলো জানে।
হয়তো তিলোর আচরণ এতোক্ষণ অতিরিক্ত ছিলো। তিলো আশা করেছিলো, অরিক আরো আগেই ওকে হঠাৎই বলে উঠবে, ‘যেটা তোমার দরকার আসলে, আমি বলতে দুঃখিত হচ্ছি, সেটা হচ্ছে দুটো শক্ত চড়।’ কিন্তু অরিক সেটা বলেনি। সে ধৈর্য্য ধরে ছিলো। তিলোর আচরণ ওর পরিবারের কাছেই বিরক্তিকর ছিলো। অরিক অধিকারপ্রবণ নয় বরং খুব বেশি সহযোগিতাপূর্ণ। অরিক জীবনসঙ্গী হিসাবে যথেষ্ট অপেক্ষা অধিক। সে যত্নশীল এবং অনুগত সম্পর্কটার প্রতি। তিলোত্তমার মতামতকে সমর্থন করার পাশাপাশি তাকে গুরুত্ব দেয়। আহানের মৃত্যুটার প্রভাব ওর উপর যতোটা না পরেছে ও আরো বেশি ভেবে ভেবে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছিলো।
আজ অরিকের কন্ঠের আকুলতা একটু বেশিই। তিলো ভেবেছে কিছুদিন ধরে। জীবন আসলে থেমে থাকে না। ওকে এগিয়ে যেতে হবে। নিজের রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দাটায় দাঁড়িয়ে তিলো দুফোঁটা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললো,
-আর দেরি করার প্রয়োজন নেই অরিক। আমরা এগিয়ে যেতে পারি।
তিলোর বাক্যদুটো ছিলো একদমই অনাকাঙ্ক্ষিত। অরিক যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। কিন্তু এরপরও দ্বিতীয়বার ও জিজ্ঞাসা করলো না। ওকে বিরক্ত করতে চায়না নিজের কথা দিয়ে। তিলোর মেজাজটাও এখন নিয়ন্ত্রণে থাকে খুব কমই। প্রতিটা মানুষই নিজের চারপাশে একটা অদৃশ্য দেওয়াল তুলে নিয়েছে। সম্পর্কগুলো শিথিল হয়ে চলেছে। অরিক উৎফুল্ল কন্ঠে ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন কেটে দেওয়ার আগে তিলো আবারও বললো,
-দয়া করে খুব সাদামাটাভাবে এটা হোক। আমি কোনো জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান চাই না।
অরিক ওকে আশ্বস্ত করলো যে, সে নিজেও চায়না। তিলো বললো,
-তোমার জন্য আনন্দময় রাত্রি কামনা করছি।
অরিক মৃদু হেসে প্রত্যুত্তর করলো,
-তোমার জন্য তার কয়েক গুন।
এরপর একে অপরকে বিদায় জানিয়ে ফোন কেটে দিলো তিলো। কতো সময় আমরা কতো ভাবে কাটিয়ে দেই। কিন্তু তাদের মাঝেই লুকিয়ে থাকে এমন কিছু মূহুর্ত যেগুলো ওলটপালট করে দিতে পারে পুরো জীবনের ছন্দ। ছন্দময় গতিটা রুদ্ধ করে দিতে পারে। একটা মানুষের জীবন। কিন্তু ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকার কারণে বহু জীবনের উপর তার প্রভাব পড়তে পারে। কতোটুকু সময় ছিলো সেটা যখন আহান আঘাতটা পেয়েছিলো। এক মিনিট? নাকি তারও কম? কিন্তু নাড়িয়ে দিয়েছে ভীতগুলো। মানসিকভাবে আঘাত করেছে, তিলোর মতো অতি আবেগি ব্যক্তিগুলোকে। মানুষকে বাঁচতেও সমাজে থাকতে হয়। কিন্তু গাছের মতো যে শিকড় এতোটা গভীরে গিয়ে নিজের বেখেয়ালিপনার মাশুল গুনতে হয় সেই গাছের ছায়ায় আশ্রয় নেওয়া প্রতিটা মানুষকে। সেই গাছ থেকে প্রাপ্ত ফলগুলোর আশায় থাকা মানুষগুলোকে। অদ্ভুতভাবে পরিবেশ বদলে দেওয়ার ক্ষমতা থাকে মাত্র কিছু মূহুর্তের। গুমোট পরিবেশটায় শ্বাস নিতেও ভয় হয়। হয়তো নিশ্বাসের বাতাসে তাসের ঘরের ন্যায় চারপাশ ভেঙে গুড়িয়ে যাবে।
জোসনার ছদ্মবেশ নেওয়া নিয়ন কর্কশ আলোকধারা জানালার গ্রীলের ফাঁক গলে বয়ে এসে তিলোর শরীরে পড়ছে। তিলো শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে যতোটুকু দৃষ্টিসীমার মাঝে পড়ে ততটুকু আকাশ। তিলো চিন্তাও করতে পারে না, রিয়ার পরিস্থিতি। ও ঠিক সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারে না। কাছের মানুষগুলোকে আঁকড়ে ধরে থাকাটাও একটা কাঁচের পাত্র হাতে নিয়ে ভাঙাচোরা রাস্তায় হিল জুতায় খটখট শব্দ তুলে হাঁটার মতো। সংবেদনশীল প্রতিটা স্পর্শ। যত্নশীলতা না শিখে কখনোই সেই সম্পর্কে জড়ানো উচিত নয়। সম্পর্কটার পাশাপাশি মানুষটার চারপাশেও গড়ে তুলতে হয় সুরক্ষা দূর্গ। সেটা তার দ্বারাই উদিত হবে সগর্বে। তার সাথে তার পরিখা, কামানের প্রকোষ্ঠ, মাটির তলায় লুকানো বন্দীশালা, সেই দূর্গের অনাবশ্যক অলংকৃত ঘরগুলো। মানুষটাকে কেবল অর্জন করলেই হয়না। তাকে ধরে রাখার কৌশল জানতে হয়।
‘হেথায় শ্বাস নাও খুব ধীরে, কারণ ভঙ্গিরতায় পূর্ণ সব।’
#চলবে
একটা মানুষের জীবনে কি কেবল একটা ধারাবাহিক ঘটনাই অনবরত ঘটতে থাকে? জীবনে উত্থান পতন সবই থাকে। একজন সমাজে কতোগুলো মানুষের সাথে জুড়ে থাকে! এখানে অনেকগুলো চরিত্রেরই মূল্য রয়েছে। এরপরও কেন তিলো এবং অরিকের ঘটনার বাইরে গেলেই আপনাদের মনে হয় বাজে প্যাঁচাল চালিয়ে কোনো ঘটনাই লিখিনি?
দুঃখিত, কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে আমার কথায়। আগামী পর্বে আমার মাথায় অন্য কোনো ভুত না চাপলে ওদের বিয়ের কাজি ডেকে আনবো। যেহেতু কোনো আয়োজন নেই, সেহেতু আপনারাই আয়োজন করুন ওরা দাওয়াত পাক নিজেদের বিয়ের 🙃।
ধন্যবাদ। হ্যাপি রিডিং।