#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]
৩৪,,
(এলার্ট! বাচ্চারা দূরে থাকো☠️☠️)
আটতলার ছাদের উপর রেলিঙে হাত ঠেকিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে অরিক। পাশে তিলোও প্রায় একই ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়েছে। পূর্ণ চাঁদ আকাশে নেই। যতটুকু আছে, সে আলো অরিকের চুলগুলোতে যেন প্রতিফলিত হচ্ছে কিছুটা। সে নির্মেদ, সুঠাম, মানানসই উচ্চতার, যদিওবা বলতে পারি সেরকমটা, বিধ্বংসী সুন্দর একটা যুবক সে না হলেও যথেষ্ট যোগ্যতা রাখে সেরকম একটা তকমা পাওয়ার। তার চোখগুলো যেন অবাস্তব কোনো জগতের রাস্তা দেখিয়ে টেনে নিয়ে চলে সেখানে।
মৃদুমন্দ বাতাসে গরমটা কমই লাগছে। মাঝে মধ্যে বাঁদর উড়ে গেলো মাথার ওপর থেকে। এখানে দৃশ্যমানভাবে উপস্থিত দুটি জীব ছিলো এতক্ষণ একদম নির্বাক। দুটি ম্যানিকুইন, যারা শপিংমলে দোকানের সামনে একটা দাম্ভিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে।
তিলো দূরের রাস্তার আলো থেকে চোখ সরিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। তাচ্ছিল্য ভরে হেসে উঠলো এরপরই। অরিক মুখ ঘুরিয়ে ওর হাসির দৃশ্যটা নিজের চোখ দিয়ে লুফে নিলো। তিলো ওর দিকে ফিরে তাকাতেই অরিক চোখের ইশারায় ওকে হাসির কারণ জিজ্ঞাসা করলো। তিলো দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,
-আমাদের মাথার ওপরের আকাশটা একটা ভ্রম। তাই না?
অরিক ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘কেন?’
-যতগুলো নক্ষত্র দেখছি ইতিমধ্যে তাদের মাঝে কতোগুলো মারা গিয়েছে। কিন্তু এখনো দেখছি। অনেক শহরগুলোর সার্বিক অবস্থার মতো তাদের যাত্রা। অনন্ত অসীম। কিন্তু নিজের শেকড় ভোলা।
অরিকও এবার একবার তাকালো তারাভরা আকাশটার দিকে। আবারও মুখ নামিয়ে নিলো।
বহুদিন আগে খোদ নক্ষত্রগুলোর মৃত্যুর পরেও তাদের দ্যুতি এখনো যাত্রা করে চলেছে ব্রহ্মন্ডের মধ্যে দিয়ে। শহরগুলোর মতোই। তারা বেখেয়ালি, বেপরোয়া। কল্পিত জীবনের ঐন্দ্রজালকে প্রতিনিয়ত বাস্তবিক রূপ দিচ্ছে বা নকল করে চলেছে। অস্থির, উৎফুল্ল চিত্তে তারা কেবল নিজেদেরটুকুই ভেবে চলেছে, যখন তাদেরই আশেপাশে মারা যাচ্ছে ধীরে ধীরে ধুঁকে ধুঁকে, তাদের লুটতরাজ চালানো গ্রহটা। কে ভাবে তার কথা? থাকছি সেখানে। কিন্তু সেটাই নষ্ট করে চলেছি। কয়েকদিন আন্দোলন হয় ‘সেভ দ্য আর্থ’। যে আন্দোলন করে সে একটা প্রাইজ পাবে। নতুন কোনো খবর আসার আগে এই ধাক্কা সামলাতে সময় নেবে। তাকে কিছুদিন টিভিতে দেখা যাবে, সংবাদপত্রে পরিচিত মুখ হয়ে উঠবে। যেটা তাকে পরিণত করবে যাকে ম্যাগাজিন আর সংবাদপত্ররা বলে থাকে ‘সেলিব্রেটি’, যেটাকে লোকজন মনে করতো সেটা নিজেই একটা আলাদা পেশা। কিছুদিন দৃঢ়কণ্ঠে ভাষণ দেবে। পারসন অব দ্য ইয়ার হয়ে নিজের আখেরি গুছিয়ে নেবে। কয়েকদিন আমজনতা তাকে কদর করার পাশাপাশি তাকে অনুকরণ করার একটা ঘোর লাগিয়ে দেবে। এরপর সে সেই সুযোগগুলো পেতে থাকবে যেগুলো আসলে তার যোগ্যতায় যায়না কখনোই। সে নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। আর তারপর? তারপর সে একটা পর্যায়ে পৌঁছে বাকিসব শান্ত। তাকে তার ব্যক্তিগত জীবনের বাইরে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। পরিবেশ আবার পূর্বের ন্যায়।
যদিও তিলোর গাত্রবর্ণ তার পরিবারের বাকি সদস্যদের থেকে নাটকীয়ভাবে ভিন্ন রকমের ছিলো, তার সাথে তার বাবা-মায়ের চেহারার বৈশিষ্ট্যগুলো ছিলো লক্ষণীয়ভাবে একইরকম। এবং কাকতালীয় কিনা জানা নেই। অরিকের সাথে তার চেহারায় কিছুটা মিল ছিলো। বিশেষ করে তাদের ভ্রুযুগল। তারা ছিলো যেন চারজোড়া জমজ। প্ল্যাগ না করেও তেমনি চিকন এবং একটা রেখায়। এলোমেলোভাবটা ছিলোনা। আর তাদের আচরণের ক্ষেত্রে একটা বৈশিষ্ট্য। তারা মাঝে মাঝেই নিজেদের নিরবতা দিয়ে পরিবেশটা গম্ভীর করে তোলার চমৎকার একটা গুণের অধিকারী। ফলে সে মূহুর্তে কৌতুকগুলোকেও মনে হতো বিশেষ অর্থবহ৷
-তুমি কি এখনো তাকে ভালোবাসো?
নিস্তব্ধ পরিবেশে হঠাৎ অরিকের প্রশ্নটায় তিলো চমকে উঠলো। ওর বুঝতে সময় লাগেনি অরিক কার কথা বলছে। তিলো একপেশে হেসে বললো,
-আমি থামাতে পারবোনা আমাকে। কিন্তু তোমায় ঠকাবো না।
অরিক নিজের কপালের উপর পড়া চুলগুলো ডানহাতের আঙুল দিয়ে ঠিক করতে করতে বললো,
-তার চুলগুলো নাকি আমার মতো? আমি জানি না। সবাই বলে আরকি।
-আমি খেয়াল করিনি।
-কার টা? আমাকে দেখেছো কখনো ঠিক করে?
-অস্বীকার করবো না। এখনো সেভাবে নয়। এটা তুমি বলতে পারো, লজ্জা।
অরিক মৃদু হাসলো। কিন্তু কিছু বললো না। তিলো একদৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে এই মূহুর্তে। অরিক এখন চশমা পড়ে নেই। ওর ছোট ছোট চোখগুলো চেহারার সাথে মানানসই। বরং চোখ বড় হলে খারাপ লাগতো। অরিক এখন তিলোর স্বামী না হলে, তিলো উপমা দিতো গরুর মতো।
অরিক ওর দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছে যে, ও এখন অরিকের দিকেই তাকিয়ে আছে। অরিক একটু লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে ডা. এজাজুল ইসলামের মতো করে বললো,
-আমার লইজ্জা লাগে।
তিলো হঠাৎ করে শব্দ করে হেসে দিলো। গম্ভীর ভারী বাতাস কেটে সেখানে ফুরফুরে একটা পরিবেশ তৈরি হলো। বাক্যটা পরিস্থিতির গাম্ভীর্যতা দূর করার একটা হাতিয়ার ছিলো মাত্র। হাসি এক অদ্ভুত ক্রিয়া। যার প্রতিক্রিয়া বরাবরই একটা মিষ্টি পরিবেশ। তিলোর হাসিতে অরিক ইন্ধন যোগাড় করে নিলো। রেলিঙের উপর রাখা তিলোর হাতের উপর সে হাত রাখলো। তিলো তাতে কিছুই বললো না। অরিক ওর না বলাটাকেই অনুমতি ধরে নিয়ে তিলোর পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলো। সজ্ঞানে অরিকের ছোঁয়া পেয়ে তিলো শিউরে উঠছে বারবার। অরিক নিজের মুখটা গুঁজে দিলো সেই পাখির নীড়ে, যাকে জগৎ জানে তার স্ত্রীর বন্য চুল হিসাবে। চুলের শ্যাম্পুর ঘ্রাণটা যেন আজ ফিকে। সেই গন্ধ নির্লজ্জভাবে তিলোর মতোই। তিলো অরিককে বাঁধা দিলো না৷ আবেশের বহিঃপ্রকাশ ঘটালো নিজের হাতের আঙুলগুলোর সামান্য বর্ধিত নখগুলোর দাগ অরিকের হাতের উপরিভাগে বসিয়ে দিয়ে। কেবল নিজের অস্বস্তি প্রকাশ করে বললো,
-কেউ এসে পড়লে?
তিলোর কন্ঠে আশঙ্কা। অরিক ওর চুলগুলোতে মুখটা গুঁজে রেখেই বললো,
-আসবে না। সানজিদ আছে।
-সানজিদ কে?
-এই বাড়িটার মালিক আঙ্কেলের ছেলে।
তিলো তিক্ত কন্ঠে বললো,
-ওই গায়ে পড়া ছেলেটা।
-উঁহু। ও মোটেই গায়ে পড়া না৷ ও আসলে মিশুক। আর যেমন বলে থাকি, জলি মাইন্ডের মানুষ। সে যদি ট্রেনের টিকিট কাটতে লাইনে দাঁড়ায় তো কিছুক্ষণের মাঝেই সামনে পেছনে নিজের বন্ধু বানিয়ে আড্ডা দিতে শুরু করে দেবে। যদিনা তোমার মতো মানুষ থেকে থাকে তাহলে৷ ও প্রথমদিন থেকেই তোমার কথা জানে।
-তুমি ওর সাথে কথা বলো?
-আমার বন্ধু বলতে পারো।
তিলোকে হুট করে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে ওর শাড়ির ওপর থেকেই তিলোর মেরুদণ্ডের দুপাশের উঁচু উঁচু পেশিগুলোর ওপর নিজের হাত রেখে অরিক ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-জরুরি তো নয় যে নতুন স্বামীদেরকে বেহায়া হতে হবে, নাকি হতে হয়?
তিলো কয়েক সেকেন্ড অরিকের চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওর বুকে একটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললো,
-আমি চিন্তা করছি, আমার সন্তানেরা তোমার চোখ রাঙানি দেখে একদমই ভয় পাবে না। তারা যদি আমার স্বভাব পেয়ে থাকে, তবে তাদের মানুষ করা কতোটা কষ্টসাধ্য একটা ব্যাপার হবে। তোমার চোখ খুব বড় বড় করলেও আমার সমান হবে না।
অরিক ওর কথা শুনে মাথা নিচু করে দুবার ডানে এবং দুবার বামে নাড়িয়ে বললো,
-তোমার সন্তানেরা! কতোজন চাও? বাবাজানা, আমি ভেবেছিলাম, তুমি এখনো অনেক ছোট।
বাবাজানা! আমার প্রিয়! ডাকটা তিলো শুনে সামান্য কেঁপে উঠলো। নতুন নতুন অনুভূতিগুলো একদমই অপরিচিত তিলোর কাছে। তিলো খেয়াল করলো। অরিক করলোনা। ডাকটা তিলোর অস্থির হৃদয় মূহুর্তেই ঠান্ডা করে দেওয়ার মন্ত্র যেন।
তিলো সেটা পাত্তা না দিয়ে বললো,
-আমি অবুঝ নই। একুশ বছর!
অরিক এক ভ্রু উঁচু করে বললো,
-একুশ হয়েছে তোমার?
-দুমাস পর হবে।
-তো এখন থেকেই একুশ একুশ করে চিৎকার করছো কেন?
-এটা একটা কথার কথা আসলে। যেমন পৌঁনে চারটা বাজলেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘এই তো চারটা বাজে’ বলে থাকি। তাই আমি আরো তিন চার মাস আগে থেকেই বলছি।
-তাহলে একুশের বুড়ি, আমি যে আপনার অনুমতি না নিয়ে এতো বড় একটা অন্যায় করে ফেললাম। তো এখন এ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?
তিলো মৃদু হেসে বললো,
-অনুমতি কি কেবল মুখেই দিতে হয়। মজা করোনা। আমি জানি যে, তুমি আমার সম্মতি সাপেক্ষেই ছুঁয়েছো। যদি তোমার মনে হতো, আমি অনুমতি দেইনি, তো তুমি সেই মূহুর্তে আমাকে ছেড়ে দিতে। নিচে চলো।
অরিক তিলোর সম্পূর্ণ কথা অগ্রাহ্য করে ওর খুব নিকটে দাঁড়িয়ে কন্ঠে দৃঢ়তা এনে বললো,
-আমি জানি, জীবনে প্রথম ভালোবাসার স্থান ভিন্ন এবং কখনোই সে স্থান কাউকে দেওয়া যায়না। কিন্তু আমি কেবল তোমাকে তোমার শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত সঙ্গ দেওয়ার অনুমতি চাই। বা আমার শেষ পর্যন্ত আমার পাশে থাকবে৷ তোমার গন্তব্য।
তিলো নিশ্চুপ থেকেই সম্মতি প্রদান করলো। অরিক একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। অরিকের ঠোঁটের কোণের হাসিটা ওর জন্য তিলোর প্রেমকে আরও উসকে দিলো।
ওরা সবসময় একে অন্যের সাথে জোড়া লেগেছে একটা অসমাধিত ধাঁধাঁর দুটো টুকরোর মতো। অরিকের ধ্রুম্রময়তাটি গিয়ে জুড়েছে তিলোর দুর্ভেদ্যতার সাথে, তিলোর নির্জনতাটি অরিকের জনবহুলতার সাথে, ওর ঔদাসিন্য ওর সংযমের সাথে। অতঃপর তাদের দুজনের নিরবতা মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছে। একজন অনাহুত অপরিচিতের মতো কক্ষ থেকে পিছলে বেরিয়ে গিয়েছে অস্বস্তি সে বহুক্ষণ আগে।
তারপর আর কিছু ছিলোনা যেগুলো কখনো জুড়বে না। যা ঘটেছে সেরাতে, তা ছিলো প্রণয় চরিতার্থ করার সর্বোচ্চ পন্থা। ক্ষুদ্র একটা সময়ের জন্য তারা অস্বীকার করতে পেরেছিলো সেই পৃথিবীকে যেখানে বাস করতো তারা আর ওটার যায়গায় ডেকে এনেছিলো অন্য আরেকটিকে, যেটি একইভাবে সত্য।
তিলো নিজের শরীর ছড়িয়ে দিয়ে অরিকের উপর শুয়ে পড়লো যেন একটা তোষক অরিক, তার চিবুক রাখা ছিলো নিজের হাতের লম্বাটে আঙুলগুলোর উপর, যেগুলো অভিজাত ভঙ্গিতে পেতে রাখা ছিলো অরিকের অনাবৃত বুকের উপর। চোখজোড়া অরিকের মুখে নিবদ্ধ। নিরবতম কিছু মূহুর্ত কাটিয়ে তিলো অরিকের পাশে শুয়ে পড়লো। অরিক ওকে নিজের বাহুডোরে আঁকড়ে ধরে বললো,
-আমার একটা পরামর্শ শুনবে বাবাজানা?
-হুম।
-নিজের পড়াশোনা শেষ করে নাও৷ তারপর আর কারো কথা ভেবো।
-হুম।
-এখন ঘুমিয়ে পড়ো।
তিলো আর কথা বাড়ালো না। নিজের উদ্ভট চিন্তাগুলোকে অস্বস্তির মতোই মাথা থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়ে নিজের বড় বড় টানা টানা হরিণী চোখজোড়া বুজে ফেললো।
#চলবে
(Just kidding 😜)