#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]
৩৭,,
ছাদটা বেশ সুন্দর করেই সাজানো হয়েছে। গতরাতে কেবল ছাদের একটা বাতি জ্বালানো থাকায় তিলো ভালো করে দেখেনি। তবে আজ যেন ঘোরটাই পাল্টিয়ে গিয়েছে। ছাদটা বেশ বড় এবং ছোট বড় গাছে বাগান করা। পরিবাতিগুলো ডালপালার ফাঁকা থেকে ঢিলা সেলাইয়ের ন্যায় বোনা হয়েছে। ছোট গাছগুলোর উপর সেগুলো পড়ে আছে মাকড়শার জালের মতো। গাছের ডাল থেকে লন্ঠন ঝুলছে যেগুলো লাল রঙের একটা আভা ছড়িয়ে দিয়েছে পুরো ছাদময়, একটা জাপানি আমেজ। পার্টির নামে যেসব উদ্ভট অসংযত কাজকারবার আজকাল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তার তুলনায় এই আয়োজনটা আসলে খুবই ভিন্ন এবং ছিমছাম।
নিজেদের মাঝে আড্ডা, ছোটখাটো গানের আসর আর খাওয়া দাওয়াই মুখ্য এখানে। মিশুক প্রকৃতির সানজিদের সাথে রোৎশীর ভাব জমে উঠেছে, যেটাকে সে যথাসম্ভব লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখার চেষ্টা করছে। তিলো বিষয়টা খেয়াল করে দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেললো। মেয়েটা নিজের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে খুব বেশি সতর্ক। কিন্তু অপরের ক্ষেত্রে একদমই না।
খাওয়ার সময় রোৎশী নিজের প্লেটে একের পর এক চিকেন তুলে নিচ্ছে দেখে ওর প্লেট থেকেই রাফি নিজের প্লেটে তুলতে শুরু করলো। রোৎশী ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
-তোর সমস্যাটা কি বলবি? নিজে নিয়ে খেতে পারিস না?
রাফি আগের মতোই ওর প্লেটে থাকা শেষ পিছটা তুলে নিয়ে বললো,
-মোটা হয়ে যাচ্ছিস তুই মুটি। ডায়েট কর। এরপর বিয়ে দিতে পারবোনা। বরপক্ষ তোর সাইজ দেখে পালাবে হাতি।
-আমার বিয়ে নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। আর আমি মোটেও মোটা নই। আর একবার আমাকে মোটা বললে তোর বাড়িতে খাওয়া বন্ধ করে দেবো। গত দুমাসে দুই কেজি ওজন কমেছে আমার।
বলে আবারও আরেক পিছ তুলতে গেলে রাফি সেটাও তুলে নেয়। রোৎশী মেকি কান্নার ভান ধরে পা দাপিয়ে ওর থেকে সেটা কেড়ে নিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়।
অভ্র এসে রোৎশীর প্লেটে এক পিছ তুলে দিয়ে বললো,
-খাবে তো আজকেই। নাকি? রোজ তো নিয়ম ভাঙার সুযোগ হয়না৷ কাল থেকে ডায়েট করিস।
রাফি এই পিছ আর নিলো না। প্রতিবাদী সুরে বললো,
-খাওয়া। যতো ইচ্ছা খাওয়া এই মুটিকে। এরপর বিয়ে না হলে তো গলায়ও দড়ি দিতে পারবে না। যার সাথে দেবে সেটাই ভাঙবে।
অভ্র ওর পিঠে বেশ জোরে চাপড় মেরে বললো,
-মোটাদেরও বিয়ে হয় রে ছাগল। আর খুব ভালো চিকন ছেলেদের সাথেই হয়।
রোৎশী আরো দুই পিছ তুলে নিয়ে অভ্রের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললো,
-আই লাভ ইউ অভ্র।
অভ্র সরু চোখে ওর দিকে এক মূহুর্ত তাকিয়ে ওর প্লেটের দিকে তাকালো। আরো নিয়েছে দেখে হতাশ নিশ্বাস ফেলে স্বাভাবিক কন্ঠেই বললো,
-অনুগ্রহ পূর্বক আপনি আপনার ভালোবাসা নিয়ে জাহান্নামে যান।
অভ্র আর দাঁড়ালো না ওর সামনে। গটগট করে হেঁটে চলে গেলো। রোৎশী মাংসে কামড় বসিয়ে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে চিন্তা করছে, আদৌও ও কি ভুল বললো!
সারাদিনে তিলোর মাত্র একবারই ওর মায়ের সাথে কথা হয়েছে। নাসীরা পারভীন যতোটা না অসন্তুষ্ট ওর বিয়েটা নিয়ে এখন তার থেকে বেশি অভিমান জমেছে মেয়ের উপর। ওনি খেয়াল করেছেন তিলোকে ওনি তুলির থেকে বেশি ভালোবাসেন আসলে। বিষয়টা আবার সেরকম না হলেও তিনি একটু বেশি ভাবেন ওকে নিয়ে। আর আশাও করেন বেশি। হয়তো কেউ কেউ ওকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে বা অবজ্ঞা করে বিধায় ওনার বেশি মায়া হয় নিজের মেয়েটার প্রতি। তুলির বিয়ের পর তুলি ওনাকে কতোটা গুরুত্ব দিলো সেটা নিয়ে ওনি ভাবতেন না। কিন্তু তিলোর বিষয়ে সংবেদনশীল। ওনি এটাও লক্ষ্য করেছেন, আসলে ওনি অরিককে হিংসা করেন৷ হয়তো তিলোর আর কোথাও বিয়ে হলে সেই জামাইকেও হিংসা করতেন। মেয়েটা তাঁর কথা মনেও করে না সারাদিনে? সংসারে এতো ব্যস্ত!! হিংসার সাথে সাথে অরিকের উপর রাগও হচ্ছে, তাঁর মেয়েকে নিয়ে গিয়েছে বিধায়। ওনি নিজেও জানেন ওনার এই অনুভূতিটা নিতান্তই অমূলক। কিন্তু ওনি আটকাতে পারছেন না এই অনুভূতিকে। মেয়েটা তো তাঁর আদরের। আবেগ এবং বাস্তবতা এক নয়। আবেগের বশে মনে হয়, মেয়ের বিয়ে না হয়ে সারাজীবন কাছে থাকলেই ভালো হতো। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তাকেও তো জীবনে এগিয়ে যেতে হবে। আবেগের বশে তার জীবন থামিয়ে রাখার কোনো মানে হয়না৷
সাইকোলজি বলে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অন্য কোনো ভাষায় চিন্তা করলে আরো সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ মাতৃভাষায় চিন্তা করলে অবচেতনভাবে মস্তিষ্কে একটা আবেগ কাজ করে। কিন্তু অন্য ভাষায় চিন্তা করলে, মস্তিষ্কে লজিকের অংশটা অধিক সক্রিয় হয়। ফলে যুক্তি দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সুবিধাজনক।
অভিমানে নিজেও ফোন দেননা তিলোকে। আবার তিলোর সাথে ওনার কথা বলতেও ইচ্ছা করে। ভালো হতো যদি তিলোকে কখনোই কেউ না ভালোবাসতো। কখনোই কারো পছন্দ না হতো। কখনোই ওর বিয়ে না হলে। তাহলে সবসময় তিলো ওনার কাছেই থাকতো। সেটাই ভালো হতো।
আনিস সাহেব ওনার উপর রেগে কথা বলছেন না। তুলির ওপর ওনি রেগে আছেন। ফলে ইশানকেও কোলে নিচ্ছেন না৷ তুষারও বাড়িতে নেই। ওনার কেউ নেই। ভেবে এখন ওনার নিজেরই কান্না পাচ্ছে। ওনি একজন মানুষ। এই সংসারের কর্ত্রী। এতোবছর সংসারটার প্রতিনিধিত্ব করে গিয়েছেন। কিন্তু আজ কেউ ওনাকে পাত্তাই দিচ্ছে না!! কেউ ভাবে না ওনার কথা।
সন্ধ্যা থেকে বিছানায় শুয়ে আছেন নাসীরা পারভীন। দুপুরে ঠিকমতো খাননি আনিস সাহেবের সাথে ছোটখাটো একটা প্রলয়কাণ্ড ঘটানোর পর। ক্ষুধায় নাড়ী জ্বলে যাচ্ছে। তিলো যে কেন ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না, সেটা ওনার আজ আবারও মনে পড়লো। ওনার থেকেই অভ্যাসটা পেয়েছে তিলো।
এরপরও রাগে দুঃখে অভিমানে উঠলেন না বিছানা ছেড়ে। কি দরকার! যে যার মতো আছে। তাঁর প্রয়োজন তো ফুরিয়েছে সংসারে। একরাশ অভিমান নিয়ে অবশেষে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি।
ওদের আড্ডা শেষ হতে হতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। তিলো শেষেরদিকে কে কি বলেছে কিছুই শোনেনি৷ বসে বসে ঝিমুচ্ছিলো। অরিক অবাক হয়েছে তিলোর ঘুমকাতুরতা দেখে। এতোগুলো মানুষের এতো কথার মাঝেও তিলোর বারবার চোখ লেগে আসছিলো। অবশেষে অরিক বলেই ওদের আসর ভেঙেছে। না হলে বোধহয় সারারাত চালানোর পরিকল্পনা করেছিলো অভ্র।
অদ্ভুতভাবে ঘরে ফিরে তিলোর ঘুম কেটে গিয়েছে। এখন সে আবারও সতেজ একটা ভাব নিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় বসে বসে ফোন টিপছে। অরিক আড়চোখে একবার ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
-তুমি না এতক্ষণ ঘুমে পড়েই যাচ্ছিলে?
তিলো ফোন থেকে মাথা না তুলে বললো,
-এখন ভেঙে গিয়েছে। আর ঘুম আসছে না।
নিরবতায় কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর অরিক বললো,
-বাবাজানা।
-হুম।
-আমার সাথে যাবে?
-কোথায়?
-ইউএস যাবো। যাবে তো?
তিলো ফোন থেকে মুখ তুলে অরিকের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। অরিক ওর প্রশ্ন বুঝতে পেরে বললো,
-এখনো পড়াশোনা বাকি রয়েছে আমার।
তিলো বালিশটা বিছানায় ঠেকিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে বললো,
-তোমার কি সারাক্ষণ পড়াশোনা ছাড়া মাথায় কিছু থাকে না? আর কতো পড়বে? এখন তো পড়াও। আরও নিজে পড়বে?
অরিক উঠে বসে তিলোর কপালে ওষ্ঠজোড়া স্পর্শ করে বললো,
-যতো বেশি পড়বে ততই তো জ্ঞান বাড়বে, সম্মান বাড়বে। আরো দ্রুত সামনে এগোতে পারবো। জানো, আমার খালু বলেন, লেখাপড়া শিখে অর্জিত কাগজগুলোর ওজন যদি আধাকেজি না হয় তো জীবনে কি করলাম?
তিলো অরিকের দিকে ফিরেই মাথার একপাশ বালিশে ঠেকিয়ে বললো,
-আমার একটা আফসোস আছে জীবনে। কখনো পোস্টার গার্ল হতে পারলাম না।
অরিক ভ্রু কুঁচকে বললো,
-সেটা কী?
-এই যে তুমি যেমন পোস্টার বয়। আমার ম্যাথ টিচার এই নামটা সবসময় ভালো স্টুডেন্টদের জন্য দিতেন, যাদের পরীক্ষা শেষে রাস্তার মাথায় পোস্টারে দেখা যেতো। তোমাকেও কয়েকবার দেখেছি। কোচিং সেন্টারগুলো বোর্ড স্ট্যান্ড স্টুডেন্ট বা দেশের নামকরা ভার্সিটিতে সুযোগ পাওয়া স্টুডেন্টগুলোর ছবিগুলো ছেপে নিজেদের প্রচার করে। তারা তাদের কারখানার ত্রুটিহীন পণ্যগুলো সগর্বে প্রদর্শন করে কাস্টমার যোগাড় করে। তোমার মতো ত্রুটিহীন পণ্য। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আদৌও কি তাদের হাত থাকে পণ্যগুলো নিখাদ হতে? তারা তো সকলের পেছনেই চেষ্টা করে তাহলে একজন দুজন ভালো হয় বাকিরা কেন নয়? তাহলে নিশ্চয়ই এখানে শিক্ষার্থীর চেষ্টাটাই মুখ্য। না হলে তো ওই কারখানার গাফিলতি। তারা ওই একজন দুজনকেই গুরুত্ব দেয়। বাকিদের দেয়না। তাই পোস্টারে একজনকেই দেখা যায়। সবাইকে না। স্টুডেন্টটার পরিশ্রমের কৃতিত্ব কেন তারা নেবে? ওই একজন যে, যে এই প্রচারে মুগ্ধ হয়ে নিজের সন্তানকে সেখানে পাঠাবে তার সন্তানই হবে তার কোনো মানে নেই। সুতরাং, পুরো কার্যক্রমটা হলো একধরনের ভণ্ডামি। লোক ঠকানো এবং একটা খেলা। ‘বোকা বোকা’। বাজে কোচিং বাণিজ্য।
অরিক তিলোর কথাগুলো শুনে প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও এখন ওর নিজের কাছে নিজেকে একটা ক্লাউন মনে হচ্ছে। প্রতিবার বোর্ড পরীক্ষার পর ও যে কোচিং সেন্টারে পড়তো সেখানে সেজেগুজে গিয়ে ফুলের তোড়া গ্রহণ করতো আর ক্যাবলা মার্কা একটা হাসি দিয়ে ছবি তুলতো। তখন সেটা খুব ভালো লাগলেও এখন সত্যিই মনে হচ্ছে, সে আসলে একটা মুরগী ছিলো যাকে প্রতি সফলতার পর জবাই দেওয়া হতো নিজেদের ভোজে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও দ্বিতীয় হয়ে সুযোগ পাওয়ার পর যে কোচিং এ পড়তো সেখানে গিয়ে মডেলিং করে এসেছে। এখন সেই অবচেতন উত্তেজনা কেটে বাস্তবতা বুঝতে পেরে, একদিক থেকে ভালো লাগছে যে তাকে এই মাঠে অনেকে চিনেছে। কিন্তু তাকে সমানভাবে ব্যবহারও করা হয়েছে। সে তো নিজের যোগ্যতায় সুযোগ পেয়েছিলো। কিন্তু তার কৃতিত্ব সেই কোচিং সেন্টার নিয়ে শিকার ধরেছে। মাছ ধরার টোপ যেন।
তিলোর এই কথাগুলো শোনা একটা ভুল হয়ে গিয়েছে। বাজে একটা ভুল। ওর ভেতর হীনমন্যতা কাজ করছে। অরিক ঘৃণা করে, ওকে কেউ ব্যবহার করুক। কিন্তু সেটা সে নিজেই সুযোগ দিয়েছে প্রতিবার।
অরিক ওর কথার প্রত্যুত্তর না করে ছোট করে বললো,
-শুয়ে পড়ো। ঘুম চলে আসবে।
তিলো নিজের ভঙ্গিমায় সম্মতি দিলো। অরিক তিলোর দিকে পিঠ দেখিয়ে শুয়ে পড়লো। তিলো বুঝতে পারছে, অরিক অস্থিরতায় ভুগছে কোনো কারণে। ওকে পেছন থেকে আঁকড়ে ধরে তিলো চোখ বুজলো। অরিক ওর স্পর্শ পেয়ে মৃদু হাসলো।
#চলবে
ভাষাগত যে সমস্যাটা রয়েছে, আমি দুঃখিত সেজন্য। এটা শুধু প্রভাবিত হওয়ার সমস্যাটা থেকে উদ্ভুত। আমার পড়া উপন্যাসগুলো থেকে শব্দগুলোর প্রতি যত্নশীল হয়ে পড়েছিলাম। আবার বলা যায়, কিছু শব্দের প্রেমে পড়েছি। রাশভারী শব্দ সমূহ মাঝে মাঝে ব্যবহার করতে হয় বলে আমি মনে করি। না হলে সেটা গল্প বা উপন্যাস হবে কিভাবে? আচ্ছা সেটা না করলাম। আজকের শব্দগুলো সহজ ছিলো আশা করি। আর পরিবেশের বর্ণনা নিয়ে যে সমস্যাটা, তার বিষয়ে বললো, এটা মাধুর্যতা। আশেপাশের আবহ সৃষ্টি না করলে কিভাবে একজন নিজেকে সেখানে কল্পনা করতে পারে? তাছাড়া পরিবেশের বর্ণনা ছাড়া কোনো রোম্যান্সধর্মী গল্প, গল্প হয় কি? থ্রিলারে পরিবেশের বর্ণনার প্রয়োজন পড়ে কম। আমি দুঃখিত, এবিষয়ে নিজের স্বকীয়তা থেকে বের হতে পারবো কিনা জানি না। আর মাত্র কয়েকটা পর্ব দিয়ে বিরক্ত করবো। খুব তাড়াতাড়ি এই ছোট উপন্যাসটা শেষ হবে। যারা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছেন কোনো উপায় না পেয়ে, আরেকটু করুন।
ধন্যবাদ।