#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ (ছদ্মনাম)
০৮,,
তিলোর পক্ষে সেটা, তার সেই অপমানটুকু, নথিভুক্ত হতে সময় নেয়নি। এখন তার আত্মীয় স্বজনরা সকলেই তিলোকে তেমনি একটা মেয়ে ভাবছে, যেমনটা তারা ভেবে থাকে রাস্তার পতিতা-দের। তিলো ভেবে অবাক হলো, ফাহাদ সকলের সামনে এমন কথা বললো কিভাবে? তার মুখে বা রুচিতে কি বাঁধেনি। নাসিরা পারভীনও তখন নিজেকে আটকাতে পারেননি। আসলে তখন ওনার একমুহূর্তের জন্য ফাহাদের কথাগুলো সত্যি বলে মনে হয়েছিল। ওনি ঘটনাটার পর থেকে অপরাধবোধে ভুগছেন। তিলোর সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতাই যেন তিনি হারিয়ে ফেলেছেন।
রাতে তিলো চোখের পাতা এক করতে পারেনি। কাঁদতে কাঁদতে ওর আর এখন কান্নার শক্তিটুকুও নেই। রাতে খায়নি। আনিস সাহেব বারবার সেঁধেছেন। কিন্তু ওকে কোনোভাবে খাওয়াতে পারেননি।
রাত আড়াইটার দিকে তিলোর ফোন বেজে উঠল। তিলো চমকে উঠলো, হঠাৎ এই যান্ত্রিক আওয়াজটায়। তিলো অতি ধীরে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো স্ক্রিনে ‘ফাহাদ ভাই’ নামটা সগর্বে ভেসে উঠেছে। তিলো এই নাম্বারটা একসময় সেভ করেছিলো ফোনে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কখনোই এর আগে ওর সৌভাগ্য হয়নি নিজের ফোনের স্ক্রিনে এভাবে এটা দেখার। সবসময়ই তার এমন একটি প্রত্যাশা ছিলো। কামনা করতো এই কলটা। আজ তার সেই বাসনা পূরণ হওয়ায় যেখানে তার খুশি হওয়ার কথা ছিলো, সে আসলে হতে পারলোনা। বরং তার বদলে তাকে একরাশ ঘৃণা ঘিরে ধরলো, প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো সে। কট করে কলটা কেটে দিয়ে ফোনটা সাইলেন্ট করে পাশে রেখে দিলো। সে এই কল রিসিভ করবে না। কখনোই না।
তিলোর আবারও কান্না পাচ্ছে। ও আবারও কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে ও ঘুমিয়ে পড়েছিলো। তবে সে ঘুমটা খুব ভালো হয়নি। ভোরবেলাতেই ওর ঘুম ভেঙে যায়। আর বরাবরের অভ্যস্ততার খাতিরে ও হাতড়ে ফোনটা তুলে নেয় হাতে সময়টা দেখার জন্য। ফোন হাতে নিতেই ওর চক্ষু চড়কগাছ! ফাহাদ পুরো আটচল্লিশটা কল করেছে ওকে। ও যখন তখনও ফোন ধরেনি, ফাহাদ ওকে ভয়েস মেইল পাঠিয়েছে। তিলো একবার চিন্তা করলো, ও মেইলটা ওপেন করবে না। পরে আবারও কিছু ভেবে ও মেইলটা ওপেন করলো। ও আসলে লোভ এবং কৌতুহল কোনোটাই সামলিয়ে রাখতে পারেনি। মেইলটা ওপেন করে ও ফাহাদের কন্ঠ শুনতে পেলো। সেখানে স্পষ্ট অনুতাপবোধের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, কাজটা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত ছিলো। ফাহাদের স্বীকারোক্তিটা ছিলো,
‘তিলোত্তমা! আমি জানি তুই আমার উপর রেগে আছিস। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিশ্বাস কর বোন, আমি নিজেও বুঝতে পারিনি বিষয়টা এতোটা গুরুতর হয়ে উঠবে। আমার কথার অর্থ আরো গভীরভাবে সকলে ভাববে। আমি বুঝে কথাগুলো বলিনি। আমি সত্যিই দুঃখিত। হ্যাঁ, আমি তোকে বোন হিসাবে ভালোবাসি। তুই কেন বুঝিস না, তোকে কোনোদিনও আমি বোন ছাড়া আর কোনো নজরে দেখিনি। আর কখনো দেখতেও পারবোনা। জানিস তো তিলোত্তমা, তোর নামটা আমার দেওয়া। তুই জন্মেছিলি, আমি যখন কেবল ছয় বছরের ছিলাম। যে সময়টায়, আসলেই কোনো শিশু তার একটা ভাই বা বোন চায়। বুঝতে শেখে, ভাই বোন থাকার আনন্দটা। তোকে ওটি থেকে বের করে নিয়ে এসে যখন ছোট মামার কোলে দেওয়া হলো, আমি উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম তোর দিকে। সাদা তোয়ালেতে মোড়ানো ঘন কৃষ্ণ বর্ণ আর অনেক ছোট। এতো ছোট যেন কয়লার একটা টুকরা। তুই প্রিম্যাচিউর ছিলি। আমি তখনও ভালো পড়াশোনা জানতাম না, তবুও নাম দিয়েছিলাম কোনো এক দৈব উপায়ে হয়তো, তিলোত্তমা! সংস্কৃতে যার অর্থ ‘তিলের বীজ’। তুই সেসময় থেকে কেবল আমার বোনই ছিলি। এখনো আছিস এবং ভবিষ্যতেও থাকবি। আমি তোর অনুভূতিগুলো বুঝতে পারি। কখনো প্রশ্রয় দিইনি। আজ যখন তুই সীমা লঙ্ঘন করে ফেলেছিলি, তখন আসলে আমি হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছিলাম। মুখে যা এসেছে, বলে ফেলেছি। আমায় ক্ষমা করে দে। আমি সকলের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবো আজকের জন্য। কিন্তু আমার তোর থেকে পাওয়া ক্ষমাটার বেশি প্রয়োজন। এটুকুই বলার ছিলো। বিনিময় হবে না হয়তো। কেবল আমিই বললাম। আমাদের আসলে আর কিছু বলার নেই নিজেদের ভেতর। ভালো থাকিস বোন। দোয়া করি, খুব ভালো একজন, যে তোকে পরিপূর্ণ মর্যাদা দিতে পারবে, তেমন একজন জীবনসঙ্গীকে খুব তাড়াতে খুঁজে পেয়ে যা।’
ভয়েস মেইলটা এখানেই সমাপ্ত। কথাগুলো তিলোকে আরেকবার আঘাত করলো। আসলে কখনোই ফাহাদ ওকে ভিন্নভাবে দেখেনি। তিলোর এটা ভেবেও লজ্জা করছে যে, সে আসলে কতোটা বেহায়া!
ফাহাদ পরদিন তিলোর বাড়িতে এসে সকলের কাছে ক্ষমা চেয়ে গিয়েছিল। নিজের বাড়ি এমনকি বড় চাচার বাড়িতে পর্যন্ত গিয়ে নিজের ভুল স্বীকার করে নিয়েছিলো। এই সাহসটুকু অর্জন করতে ফাহাদের একদিন সময় লেগেছে, নিজের সাথে যুদ্ধ করে জয়ী হতে হয়েছে। তবে সকলেই তখন জেনে যায়, যারা যারা জানতে বাকি ছিলো আরকি, যে, তিলো ফাহাদকে ভালোবাসে।
ফাহাদের এতো কথাও তিলোর ওর প্রতি অনুভূতিগুলোকে হত্যা করতে পারেনি কখনো। তিলো প্রকাশ করে না কিন্তু মনের কুঠুরিতে আজও ফাহাদের জায়গাটা সংরক্ষণ করে রেখেছে। তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারেনি সেখান থেকে। যা এখনো তিলোকে ক্ষণে ক্ষণে নির্জীবতা অনুভব করাতে যথেষ্ট, যা তাকে জীবনটা অর্থহীন মনে করায় মাঝে মাঝেই।
আজ যে কলিকে ফাহাদের পাশে দেখে তিলোর ভেতরটা একেবারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে, চুরমার হয়ে ভেতরটা তার আকৃতি হারিয়ে কেবল একটা আবর্জনা স্তূপ সদৃশ স্তুপে পরিণত হতে চলেছে, এটা সকলে বুঝতে পারা সত্ত্বেও প্রত্যেকই নির্বিকার। তারা উপায়হীন একদিক থেকে। আনুষ্ঠানিকতা পালনে অলিখিত এবং প্রায় অঘোষিত একটা নির্দেশ তাদের উপর আছে। যা তিলোর জন্য কখনোই পালন না করা হবে না।
দুপুর হতে না হতেই ওরা আসতে শুরু করেছে। তিলোর জীবনের চরম অপমানের দিন অরিক উপস্থিত ছিলোনা। আজ সেও এসেছে। তিলোর একবার মনে হলো, সে অনিকে কল করে ডেকে আনে। কিন্তু সে এমনটা করলোনা। এখানে তিলোই গুরুত্বীন, এরপর ওর বন্ধুদের ডাকা চলে না।
তিলো নিজের রুম থেকে বের হয়নি৷ বাইরে কোলাহল ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফাহাদের মাইকের মতো কন্ঠস্বর তিলোর কানে প্রবেশ করছে বারংবার। এতো কেবল কানে প্রবেশ করছে না, তিলোর মস্তিষ্কে ঢুকে সেখান থেকে হৃদয়ে আঘাত হানার সংকেত যাচ্ছে একের পর এক। তিলো আর নিতে পারছে না৷ ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে ড্রয়ার খুলে ইয়ারফোনটা বের করলো। একমুহূর্ত সেটার দিকে তিলো তাকিয়ে চিন্তা করলো, ফাহাদের জানা উচিত, সেদিন তিলো মুখেই কেবল বলেছিলো যে ও ফাহাদকে ক্ষমা করে দিয়েছে। কিন্তু আসলে সে মন থেকে করতে পারেনি। তিলো দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেললো। এটা ফাহাদের জানা না জানার মধ্যে কোনো পার্থক্য রচনা করে না আসলে। তিলো, ভোডাফোনের পুরান জনপ্রিয় অ্যাডগুলোর ওই সাদা সাদা কার্টুনের মাথার মতো দেখতে ইয়ারফোন দুই কানেই গুঁজে নিলো। সে নিজেকে কড়া শাসনে রেখেছে, আজ কোনো ছ্যাঁকা খাওয়া গান শুনবে না। নিজেকে আনন্দ দেবে সে।
#চলবে
পর্ব ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত।
এটা হয়তোবা একটা উপন্যাস হতে চলেছে। তিলোর নায়ক নিয়ে যারা প্রশ্ন করছিলেন, তাদের কাছে অনুরোধ, একটু ধৈর্য্য ধরুন। সব গল্পেরই কি কেবল নায়ক নায়িকা আর তাদের রোম্যান্স কেন্দ্রীক হওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে?
যাই হোক, রিচেইক করিনি৷ ভুলত্রুটি অনুরোধ করছি, ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
ধন্যবাদ। হ্যাপি রিডিং।
ঈদ মোবারক।