#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]
০৯,,
তিলোর কপালটা খুব একটা ভালো না হয়তো। কিছু সময় পরই ওর ডাক পড়লো। ওকে ডেকেছে ওর ফুফু। তাই ডাকতে এসেছে তুষার ওর মায়ের আদেশে। তিলোর দুইকানেই ইয়ারফোন থাকায় প্রথমে কিছু শুনতে পেলো না। একটা গান শেষ হয়ে অপর গান শুরু হওয়ার মাঝখানে তুষারের ডাক কানে এলো ওর।
তিলো বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে দিলে তুষার ফিচেল হেসে বললো,
-আম্মা তোকে ডাকছে।
তিলো তুষারের ধৈর্য্য দেখে মাঝে মাঝেই অবাক হয়ে যায়। বিশেষ করে ওর ধৈর্য্যের পরিচয় পাওয়া যায়, বাড়িতে আত্মীয় স্বজনের আগমনে। তিলোকে এতক্ষণ সাড়া না দেওয়ার জন্য কিছুই না বলে তুষার চলে গেলো।
তিলোর সংকোচবোধ হচ্ছে সবার সামনে যেতে। তবুও না যাওয়াটা অভদ্রতা বিধায় রুমের দরজা আটকে ভালো একটা জামা পড়ে নিলো। ওয়াশরুম থেকে ভালো করে মুখ ধুয়ে ক্রিম মেখে বেরিয়ে এলো।
লিভিং এ ঢুকে সবার উদ্দেশ্যে তিলো ছোট করে একটা সালাম দিলো। কারো কারো মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে তো কারো কারো হয়নি। তিলোকে দেখে ওর ফুফু মরিয়ম রহমান ওকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
-এই তো তিল এসে গিয়েছে। এদিকে আয় তো। তোর ভাবির সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।
মরিয়ম রহমান কলির দিকে তাকিয়ে বললেন,
-কলি মা, এই হলো তিলোত্তমা। তোমার আরেক ননদ।
কলি তিলোর দিকে তাকিয়ে হাসি মুখেই সালাম দিলো। তিলোও মেকি হেসে তার উত্তর দিলো। সে তিলোকে সবার সাথেই বসতে বললো। তিলো খেয়াল করে দেখলো সোফায় একমাত্র অরিকের পাশের জায়গাটাই ফাঁকা আছে। তিলো একবার সেদিকে তাকিয়ে ডাইনিং থেকে চেয়ার টেনে এনে বসলো। অরিক তিলোর আচরণে কোনো এক অজানা কারণেই খানিকটা অপমানবোধ করলো যদিও তার কোনো ধারণা নেই, কেউ বিষয়টা লক্ষ্য করেছে কিনা। তবে অরিকের আরেকপাশে বসে থাকা ওর ছোট ভাই অভ্র বিষয়টা ঠিকই খেয়াল করেছে। তবুও সে কিছু বললো না।
ফাহাদ বসেছে কলির ঠিক পাশেই আর সে অরিকের বাবা আকবর সাহেবের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত। মাঝে মাঝে পাশে কলির দিকে ফিরে নিচুস্বরে কথা বলছে। নিশ্চয়ই সে খুব মজার কিছু বলছে হয়তো। কলি মুখ টিপে হেসে দিচ্ছে কথাগুলো শুনে। ফাহাদ একবারও তিলোর দিকে তাকাচ্ছে না। এটা তিলো খেয়াল করে দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেললো কেবল। ভুলটা তো ওর। কি অসম্ভব একটা চাহিদা সেটা! তিলো নিজেকে সামলে নিলো। এখন এসমস্ত কথা ভাবাও পাপ। ফাহাদ, ওর পাশে বসে থাকা বেগুনি রঙের ঢাকাই শাড়ি পড়া সুন্দরী মেয়েটার স্বামী এখন। মেয়েটার কি উজ্জ্বল গায়ের রং! হাসলে কি সুন্দর দেখায় তাকে! চোখে একটা চশমা পড়ে। এতে আরো মানিয়েছে যেন মেয়েটাকে।
মরিয়ম রহমান কথাপ্রসঙ্গে তুলির কথা তুলতেই নাসিরা পারভীন আর আনিস সাহেব সেটা সামলে নিলেন কোনোমতে ইমনের ঘাড়ে দোষগুলো চাপিয়ে। তুলি ততক্ষণে খাবার সাজানোর নাম করে সেখান থেকে বিদায় নিয়েছে। এরপরই মরিয়ম রহমান কলির উদ্দেশ্যে কোনো কারণ ছাড়াই বললেন,
-তিলের রং তো দেখি এখন খুলেছে। কলি তোমায় কি বলবো, জন্মের সময় ওকে যেমন দেখাতো না! এখনতো বয়সের সাথে সাথে উজ্জ্বল হচ্ছে।
নাসিরা পারভীন সম্মতির সুরে বললেন,
-তা ঠিক বলেছেন আপা। মেয়ের বিয়ের বয়স হচ্ছে, এখন তো রূপ খোলেই।
তিলোকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– যা তো তিল, তোর বোনকে সাহায্য কর। মেয়েটা একা একা পেরে উঠবে না।
তিলো নিঃশব্দে উঠে গেলো সেখান থেকে। নাসিরা পারভীন যে এই প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতেই তিলোকে পাঠিয়েছেন, তিলো জানে। এখন না হলে, এই কথা চলতে থাকলে ওর দাদীও একসময় আরো অনেক কথাই এর সাথে লাগাবেন।
তিলো রান্নাঘরে এসে দেখে, ওদের কাজের মেয়েটিই সবকিছু করছে। আর তুলি এককোনায় দাঁড়িয়ে ইশানকে কোলে নিয়ে ফিডার খাওয়াচ্ছে আর কাজের মেয়েটাকে নির্দেশ দিচ্ছে। তবে তার কন্ঠ ইতিমধ্যে ভেঙে গিয়েছে। তুলি এতক্ষণ কেঁদেছে। আর এটা তিলোর বুঝতে একদমই সময় লাগলো না। তিলো তুলিকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা জানে না। সংসারের ঝুট ঝামেলা সম্পর্কে ও খুব কমই অবগত। এসবের শুরু কিভাবে, মিটমাট হয় কিভাবে বা আদৌও হয় কিনা ও কখনো ভেবে দেখেনি। ছোট থেকে নিজের পরিবারটাকে আদর্শ পরিবার দেখে এসেছে। আত্মীয় স্বজনসহ ওদের বাড়িতে যেই নিয়মিত আসে, সেই বলে, তিলোর বাবা মায়ের সম্পর্কটা আসলেই শিক্ষণীয়। ওদের মধ্যেকার বোঝাপড়া অত্যন্ত ভালো, যা সংসারটাকে এতোদিন কোনোরকম কোনো সূক্ষ্ম চিড় ছাড়াই সুন্দর রেখেছে। ওনাদের ঝগড়াও খুব কম হয়, যতটা হয়, বেশি সময় টেকেনা। দুজনের কেউ না কেউ সেটা খুব দ্রুতই নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেন। তিলো এমন একটা পরিবার দেখে অভ্যস্ত। ওর তুলির সংসার নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই আসলে।
তিলো ওর দিকে এগিয়ে এসে বললো,
-কি করতে হবে বল তো আপু।
তুলি ইশানের মুখের দিকে তাকিয়েই বললো,
-কিছু করতে চাস?
-হুম।
-তাহলে প্লেটগুলো সাজিয়ে ফেল। গ্লাসগুলো সাজাবি। আর চামচগুলো নিয়ে যা।
তিলো ব্যস্ত ভঙ্গিতে কাজ করতে শুরু করে দিলো। কিছু সময় পর, ওরা খেতে বসলে তিলো প্রস্থান করলো। ওকে আর ওদের মাঝে খুঁজে পাওয়া গেলোনা।
ছাদে দাঁড়িয়ে তিলো নিজেকেই দুষে যাচ্ছে। কেন আজও অবাধ্য চোখজোড়া ফাহাদ ভাইকে দেখে যাচ্ছিলো। সে তো সুখেই আছে। তিলো তো তাকে নিজের সমস্তটা দিয়ে সুখেই রাখতে চেয়েছিলো। সে তো তাই আছে। তবে কেন, তিলোর এখনো কষ্ট হয় ওর জন্য? নিজে মানতে পারছে না এখনো। চোখজোড়া ভিজে উঠেছে আবারও।
-ফাহাদ ভাইয়ের কথা ভাবছিস?
তিলোর ভাবনার মাঝেই কখন ওর পাশে অরিক এসে দাঁড়িয়েছে ও খেয়ালও করেনি। কথাটা ওই জিজ্ঞাসা করলো। তিলো চমকে উঠে পাশে তাকিয়ে অরিককে দেখে বিব্রত হয়ে পড়েছে। দ্রুত হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বললো,
-ভাইয়ার কথা ভাবতে যাবো কেন অরিক ভাইয়া?
অরিক ছাদের রেলিঙের উপর হাত রেখে হেলে দাঁড়িয়ে বললো,
-পাপ করছিস। আবার মিথ্যা বলে আরো পাপ করছিস। কেন? নিজে দোষ করতে লজ্জা লাগে না। কিন্তু স্বীকার করতে লজ্জা লাগে?
তিলো এবার আরো লজ্জা পেলো। মাথা নিচু করে চোখে পুনরায় জমে যাওয়া পানি ছেড়ে দিলো। সেগুলো সোজা মাটিতে পড়লো। অরিক ওর দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারছে ও আবারও কাঁদছে৷ বিরক্ত হয়ে বললো,
-এই ছিচকাদুনে ন্যাকামি বন্ধ কর।
তিলো ওর দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বললো,
-আমার যা খুশি তাই করবো, তাতে তোর কি? তুই এসেছিস কেন, আমার সাথে গায়ে পড়ে কথা বলতে? বড় ভাই, যা না নিজের মতো ওদের সাথে আড্ডা দে। আমাকে বিরক্ত করছিস কেন?
তিলো এবার শব্দ করে কেঁদে দিলো, যা থামানোর উদ্যোগ ওর নিজের মাঝেই নেই। অরিক হতভম্ব হয়ে গিয়েছে ওর আচরণে। ও সাধারণত তিলোর সাথে খুবই কম কথা বলে। এর আগে কতোবার কথা বলেছে, সেটা ও আঙুল গুনে বলে দিতে পারবে। হঠাৎ করে তিলোর থেকে এমন আচরণ ও আশা করেনি। ও অবাক কন্ঠে বললো,
-তিল, আমি অরিক।
তিলো আরো তেতে উঠলো এতে।
-আমি জানি তুই কে। বলার কি আছে?
-তিলো তুই কিন্তু …
অরিকের কথা শেষ হওয়ার আগেই সেখানে অভ্র এসে উপস্থিত হলো। তিলোকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-তিল তোর মা তোকে ডাকে। যা নিচে, যা।
তিলো কটমট চোখে একবার অরিকের দিকে তাকিয়ে অভ্রকে উদ্দেশ্য করে ‘যাচ্ছি’ বলে নিচে নামতে যেতেই অভ্র বলে,
-আমার জন্য কোক পাঠিয়ে দিস তো। তখন খেতে পারিনি।
তিলো আচ্ছা বলে নিচে চলে গেলো। অরিক ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
-দেখেছিস মেয়েটার সাহস? আমাকে এতোগুলো কথা শুনিয়ে গেলো!
অভ্র মুচকি হেসে বললো,
-আরে ভাইয়া, বোন সে আমাদের। ও বলবে না তো কে বলবে? এটুকুও যদি ভাই হিসাবে মেনে না নিতে পারিস, তাহলে চলবে?
অরিক নিজেও জানে না ওর কি হলো। হঠাৎই কন্ঠস্বর ওর অজান্তেই পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। বিষন্ন স্বরে বললো,
-ও আমাদের বোন!
-হুম।
-ফাহাদও তো ওর ভাই। ও কিভাবে তাকে আলাদা নজরে দেখে, আর আমাকে নয়?
কথাটা বলে অরিক নিজেই চমকে উঠলো। ও নিজেকে তিলোর থেকে ফাহাদের জায়গাটায় প্রত্যাশা করে! এটা তো ওর কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত ও!
অভ্র সন্দেহের সুরে বললো,
-ফাহাদ ভাইকে যেভাবে দেখে, তুই কি জেলাস?
অরিক থতমত খেয়ে বললো,
-জেলাস মানে? তুই কি মনে করিস আমাকে?
-কিছুই না। শুধু বলবো মায়ের দিকটাও ভেবে দেখিস।
-মায়ের দিক মানে? অভ্র তুই …
এবারও অরিকের কথা শেষ হতে না হতেই অভ্র উধাও। নিচে চলে যাচ্ছে সে অরিককে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে।
#চলবে