প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল
পর্ব- ২৪
নাবিলা ইষ্ক
_____________________
আজকাল তন্ময় খাচ্ছে না, ঠিকঠাক ঘুমোচ্ছে না। ঠিক সময় বাড়ি ফিরছে না। এসব আলোচনা শাহজাহান বাড়ির কোণায় কোণায় হচ্ছে। অরু যেখানে যায় সেখানেই এগুলো শুনছে। যেমন
ভোর সকালে উঠে এসেছে রান্নাঘরে। পেটে কিছু ঢুকিয়ে পড়তে বসবে বলে। এখানেও শুনছে জবেদা বেগমের অভিমানী স্বর,
-‘ আমার ছেলেটার কি হয়েছে হঠাৎ করে! কার নজর পড়লো! কিছুই খেতে চায়না। কয়েকদিনে শুঁকিয়ে বাজান আমার কাঠকাঠ হয়ে গেছে। ‘
পানি খেতে নিয়ে অরু কেশে উঠলো। আলগোছে বেরিয়ে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে চলে এসেছে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই দেখল তন্ময় দাঁড়িয়ে। তাকে দেখতেই অরু পায়ের গতি বাড়াল৷ তন্ময় সামনে এসে দাঁড়ালো। ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রশ্ন করলো,
-‘ কী সমস্যা তোর? ‘
অরু পাশ দিয়ে নিজের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে দরজা ঘেঁষে বসে পড়লো মেঝেতে। মাথাটা এলিয়ে রেখেছে পেছনে। কীভাবে বলবে তন্ময়কে সমস্যা কোথায়! সমস্যা তো অরুর মধ্যে। সে না জেনেশুনে প্রেমে পড়েছে। এই প্রেম নিয়ে তন্ময়ের সামনাসামনি হবার দুঃসাহস আর তার মাঝে নেই। একদম নেই! ন’টায় বোর্ড এক্সাম দিতে বেরোবে। তাই সকাল সকাল উঠে রিভিশন দিতে শুরু করেছে। এক ফাঁকে সুমিতা বেগম চা দিয়ে গেছেন। অরু চায়ে চুমুক বসিয়ে পড়াশোনায় বিভোর। ঘড়ির কাঁটা আটটায় যেতেই তৈরি হয়ে নিলো। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুঁছিয়ে নিচে নেমে এসেছে। সে আজ যাবে আনোয়ার সাহেবের সাথে। সাধারণত বোর্ড এক্সাম দিতে সবসময় তন্ময় নিয়ে যায়৷ তবে গতকাল রাতে অরু পরিষ্কার করে আনোয়ার সাহেবকে বলেছে, তাকে নিয়ে যেতে। নাহলে পরিক্ষা দেবেনা। অগ্যত আনোয়ার সাহেব তৈরি হয়ে মেয়ের জন্য সোফায় বসে। ব্রেকফাস্ট করে বেড়িয়ে পড়বেন৷ মোস্তফা সাহেব হাতের নিউজপেপার সরিয়ে বললেন,
-‘ প্রিপ্রারেশন কেমন? ‘
-‘ ভালো চাচ্চু। ‘
-‘ ঠান্ডা মাথায় পরিক্ষা দিবে। ‘
-‘ জি। ‘
ব্রেকফাস্ট করে বের হতেই তাদের সামনে তন্ময়ের গাড়ি থামলো। কাঁচ নামিয়ে তন্ময় আনোয়ার সাহেবের উদ্দেশ্যে বলল,
-‘ চাচ্চু! তোমার না ইম্পর্ট্যান্ট কাজ ছিলো? ‘
-‘ ছিলো। কিন্তু মেয়েটা জেদ ধরেছে আমার সাথে যাবে। তাই থাক কাজ। পড়ে করে নিব।’
-‘ আচ্ছা উঠে এসো। আমি ড্রপ করে দেই। ‘
আনোয়ার সাহেব মেয়ের দিক তাকালেন। অরু মুখমণ্ডল অন্ধকার করে রেখেছে। যেমন এই গাড়িতে করে যাবেনা। গাড়িতে সে উঠবে না। আনোয়ার সাহেব ধীর স্বরে শুধালেন,
-‘ কি হইছে মা? উঠো! ‘
অরু কিছুক্ষণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। সময় নিয়ে পেছনে উঠে বসলো। চুপচাপ বসে সে। গাড়ি চলছে। এখন শুধু আনোয়ার সাহেব আর তন্ময়ের আলোচনা শোনা যাচ্ছে।
ইদানীং অয়ন খুব ব্যস্ত। সামনে তার অনার্সের ফাইনাল। তারউপর নতুন প্রজেক্ট শুরু করেছে সে। শাবিহাকে দেখতে যাবার সময় নেই। সপ্তাহ খানেক হয়ে গিয়েছে শাবিহাকে একপলক দেখতে পারেনি। তাই আজ খুব হন্তদন্ত ভঙ্গিতে বাস স্ট্যান্ডের সামনে এসে পৌঁছেছে। কর্নারে বাইক পার্ক করে দাঁড়িয়েছে। ঘড়ির কাঁটা ছয়টা পঁয়তাল্লিশে। শাবিহা বেরোবে সাতটায়। দাঁড়িয়ে থেকে অয়ন হাতে হাত ঘষছে। শীত নেমেছে। প্রচুর শীত। ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে, জ্যাকেট পরেও শীতে থরথর করে কাঁপতে হচ্ছে। মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে একরাশ ধুয়া। শাবিহা বেরোতে বেরোতে সাতটা বিশ। তাকে দেখেই অয়ন ছুটে গেল। অথচ তাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছে শাবিহা। ভাব এমন যে সে অয়নকে চেনে না। অয়ন হেসে পিছু ছুটেছে। ধীর স্বরে শুধালো,
-‘ রেগে? ‘
-‘………’
-‘ এইযে শাবিহা! আল্লাহ ওদিকে যায়না। আমার বাইক এখানে! ‘
শাবিহা কথাই শুনছে না৷ শুনবে কেন? একটা সপ্তাহে একবার কলও করেনি। দেখাসাক্ষাৎ তো দূরের বিষয়। শাবিহা কল করেছে ধরে শুধু ‘ হু, হা ‘ বলে কেটে দিয়েছে। এতটাই ব্যস্ত? এখন শাবিহা ও ব্যস্ত। অয়ন হেসে দৌড়ে ফিরে গেল স্ট্যান্ডের সামনে। হেলমেট পরে, বাইকে চাবি ঢুকিয়ে, বাইক স্টার্ট করলো। একটানে শাবিহার সামনে চলে এলো।
আজ শাবিহা বাসও নেয়নি। কার জন্য নেয়নি তা তো অজানা নয় অয়নের। সে খুশি মনে প্রিয়তমার রাগ ভাঙাতে প্রস্তুত৷ অয়ন একটানে সামনে চলে গেল। ব্রীজের একপাশে বাইক পার্ক করে, শাবিহার কাছে ফিরে এলো৷ পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো দুজন। শাবিহা বুকের কাছটায় দুহাত পেঁচিয়ে রেখেছে। মুখে গম্ভীর ভাব। অয়নের হাসি পাচ্ছে কিন্তু সে না হাসার চেষ্টা করে চলেছে। একপর্যায়ে মাথা ঝুকিয়ে বলল,
-‘ ব্যস্ত ছিলাম সত্যি। এরপর থেকে এমন ভুল আর হবেনা। তুমি ফার্স্ট বাকিসব লাস্ট ওকে?’
অয়ন আবারো বলল,
-‘ আচ্ছা গেইস করো ত, আমি বাড়িতে কী পরে ছিলাম? ‘
শাবিহা মনে মনে অয়নকে ভেঙাল। সে কীভাবে জানবে অয়ন বাড়িতে কি পরেছিল? অবশ্য বাড়িতে ছেলেরা ট্রাউজার পরে। নাহলে শর্ট প্যান্ট? এগুলোই তো। কিন্তু জবাব দিলে সে রাগ দেখাবে কীভাবে? তাই শাবিহা জবাব দিলো না। অয়ন নিজেই বলল,
-‘ লুঙ্গি! লুঙ্গি পরে ছিলাম। একটানে খুলে আরেক টানে প্যান্ট পরে চলে এসেছি। ‘
শাবিহা চমকে তাকাল। তার চাহনিতে বিষ্ময় অনিবার্য। অয়ন শব্দ করে হাসছে। হাসতে হাসতে চোখের কোণে জল জমেছে। শাবিহা বিরক্ত সুরে বলল,
-‘ মিথ্যে বলার যায়গা পাওনা। ‘
-‘ তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না? আমি বাবার দেখাদেখি মাঝেসাঝে পরি। কী যে আরাম! আরাম আর আরাম। কোন দিক দিয়ে বাতাস যায় আর বেরোয় টেরই পাওয়া যায়না। ভেতরের সবকিছু আমার উড়ন্ত পাখির মতো ফ্রি। আহা! ‘
শাবিহা ‘ ছিঃ ‘ বলে আগে পা বাড়ালো। অয়ন আবারো উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো। তার হাসি আজ ফ্রি বিতরণ হচ্ছে। দেখা গেল শাবিহার ঠোঁট জুড়েও হাসি। কোনোভাবেই হাসি মুছতে পারছেনা। বাইকের সামনে আসতেই বাইকে উঠে বসলো অয়ন। শাবিহা পেছনে উঠে বসলো। বাইক স্টার্ট করতে নিয়ে অয়ন বলল,
-‘ শক্ত করে ধরো৷ ‘
শাবিহা ধরলো। শক্ত করে দু’কাধ চেপে ধরলো। কয়েকটি চিমটি ও কাটলো। অয়ন হাসছে। যেমন শাবিহার এতটুকু শক্তি, চিমটি তার কিছুই করতে পারছেনা।
___________
ড্রয়িংরুমে সকলেই উপস্থিত। সাধারণত এসময় মোস্তফা সাহেব, আনোয়ার সাহেব বা ওহী সাহেব তারা থাকেন না। কাজ থেকে বাড়ি ফিরতে তাদের আটটা, ন’টা বেজে যায়। কিন্তু আজ তারা অসময়ে বাড়িতে কেন? শাবিহা চিন্তিত চেহারায় বাড়িতে ঢুকে দাঁড়িয়ে পড়লো। মোস্তফা সাহেব মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
-‘ ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এসো। কথা আছে। ‘
শাবিহা ‘ জি বাবা ‘ বলে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে নিজের রুমের দিক এগোল। মনের মধ্যে সন্দেহ জাগছে। সে যা ভাবছে তা নয়তো? শাবিহা দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এলো। মোস্তফা সাহেবের ইশারায় পাশের সোফায় বসলো। তার চিন্তাভাবনা সত্যি’তে রুপান্তরিত হয়েছে। যা ভেবেছে তাই শুনছে। তারজন্য বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। উচ্চবিত্ত পরিবার। ছেলে ভালো। একজন নামকরা ডাক্তার। বিয়ের পর শাবিহাকে ইতালি নিয়ে যাবে। সেখানেই স্যাটেল হবে নাকি। পাঁচ মাসের মধ্যেই বিয়েটা শেষ করতে চায়। মোস্তফা সাহেব খুব করে বলেছেন, তাকে ভেবে দেখতে। দেখে বোঝা যাচ্ছে তার বাবা এই বিয়ের সম্বন্ধে সন্তুষ্ট! শাবিহার পৃথিবী ঘুরছে। ঝামেলা কী শেষ হবার নয়? এই বিয়ে নামের দাগ জীবনে কেন থাকে? অতিষ্ঠ লাগছে তার সবকিছু।
রাতে খেতে বসে সম্বন্ধের বিষয়টি আবার উঠেছে। মুলত তন্ময়কে বলার জন্য। তন্ময় ইদানীং বাড়িতেই থাকেনা। ভোর সকালে বেরোয়, গভীর রাতে ফিরে। আজ দ্রুত ফিরেছে মোস্তফা সাহেবের আদেশে। বিয়ের বিষয় উঠতেই তন্ময় খাওয়া বন্ধ করল। মোস্তফা সাহেবের উদ্দেশ্যে বলল,
-‘ শাবিহাকে জিজ্ঞেস করেছ ও বিয়ে করতে চাচ্ছে নাকি? ‘
-‘ বিয়ে তো করতে হবে। আর কতো? মাস্টার্স শেষ হয়ে যাবার পথে প্রায়। তারপর? তোমার বোনের বয়স হচ্ছে! ছোট নেই আর। বাসায় আরও মেয়ে আছে। তাদের ও বিয়ে-শাদির ব্যাপার আছে। ওর জন্য অন্যদের আটকে রাখা হয়েছে।’
-‘ ও এখন বিয়ে করবে না! জোড়াজুড়ি করো না।’
-‘ বোনের প্রতি দায়িত্ব বলতে কিছু আছে তোমার মাঝে? ‘
-‘ আমার মধ্যে নেই! ‘
-‘ সেটা থাকবে কীভাবে? তবে শুনে রাখো! পরিবার ভালো। ছেলে ভালো। আমার ইচ্ছে… ‘
-‘ বিয়ে কী তোমরা করবে নাকি? তোমাদের ইচ্ছে দিয়ে কিছু আসবে যাবে না। বিয়ে যে করবে সে এসে যেদিন বলবে সেদিন বিয়ে হবে। ‘
-‘ শাবিহা রাজি। ‘
-‘ শাবিহা বলেছে? ‘
-‘ অবশ্যই। আমি যা বলবো আমার মেয়ে তাই করবে। ‘
বাবা-ছেলের তর্কের মধ্যে বাকিরা নিশ্চুপ। সকলেই কান পেতে শুনছে। তবে কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। অরু মাথা নিচু করে খেয়ে চলেছে। তর্কাতর্কি যেমন সে শুনছে না। আনোয়ার সাহেব বেশ কিছুক্ষণ পর বলল,
-‘ ভাইয়া… ‘
মোস্তফা সাহেব আগেই তাকে থামিয়ে দিলেন,
-‘ তুই যদি এই ছেলের সাপোর্ট করার জন্য মুখ খুলিস, তাহলে এখানেই চুপ করে যা। ‘
আনোয়ার সাহেব চুপসে গেলেন। তন্ময় খেতে নিয়ে বলল,
-‘ সামনে ইব্রাহিমের বড়ো ভাইয়ের বিয়ে। কার্ড পাঠিয়েছে। দেখে নিও। ‘
চুপচাপ খেতে থাকা রুবি খানিক নড়ে বসলো। আঁড়চোখে তন্ময়ের দিক তাকাল। মোস্তফা সাহেব ও গম্ভীরমুখে ছেলের দিক তাকিয়ে। কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। সেসময় বিনা আমন্ত্রিত মেহমান চলে এসেছে। অরুর মামা বাড়ির লোকজন। দলবেঁধে এসেছে। অরু আঁড়চোখে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। মোস্তফা সাহেব সাহেব গম্ভীরমুখে ডাইনিং থেকে উঠে দাঁড়ালেন। অতিথিদের ড্রয়িংরুমে বসতে ইশারা করলেন। আনোয়ার সাহেব ও ভাইয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সুমিতা বেগম হাত মুছে এগিয়ে এসেছেন। আজ শুধু অরুর বড়ো মামামামী আসেনি। সাথে তার মেজো মামামামী এবং তাদের ছেলে এসেছে। হানিফ! এই হানিফের জন্যই অরুর হাত চেয়েছে। হ্যাংলা পাতলা এবং কালো দেখতে। একদম অরুর মেজো মামার মতো। মোস্তফা সাহেব ওপর পাশের সোফায় বসেছেন। নাস্তা তৈরি করছেন জয়া বেগম। ফটফট কিছু খাবার ট্রে করে এনে সামনে দিয়েছেন। অরুর বড়ো মামা প্রশ্ন করলেন ,
-‘ অরু কোথায়? ‘
সুমিতা বেগম বললেন,
-‘ খাচ্ছে! ‘
-‘ আসতে বল। ‘
আনোয়ার সাহেবের গম্ভীরমুখে বললেন,
-‘ ওর পরিক্ষা আছে৷ এখানে আসতে পারবেনা। ‘
-‘ দু মিনিটের বিষয়! ‘
মোস্তফা সাহেব ডাকলেন,
-‘ অরু! ‘
অরুকে বিরক্ত মুখে উঠে দাঁড়ালো। তার সামনেই তন্ময় দাঁড়িয়ে। মুলত এই লোক তার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে এতক্ষণে যেতে পারেনি৷ নাহলে কখন নিজের রুমে চলে যেতো। ধীর পায়ে ড্রয়িংরুমে এলো। অরুকে দেখেই ইশারা করলেন তাদের মধ্যে বসতে। অরু এবার মহা বিরক্ত হলো বটে। দুজনের মধ্যে গিয়ে বসতে হবে কেন? অরু গিয়ে বসলো। অরুর মাথায় হাত বোলাচ্ছেন তার মেজো মামী। তার বড়ো মামা হাসিমুখে মোস্তফা সাহেবকে বললেন,
-‘ সুমিতা বলেছে নিশ্চয়ই? ‘
-‘ বলেছে। আমিও জবাব দিয়ে দিয়েছিলাম সেটা বলেনি? ‘
-‘ বলেছে! তাই আমরা সামনাসামনি কথাবার্তা বলতে এলাম৷ ‘
উপস্থিত সকলের কাহিনি বুঝতে সময় লাগলো না। অরুও সবকিছু বুঝে অবাকের চুড়ান্তে। তাকে আরও অবাক করতে হুট করে তন্ময় সামনে চলে এলো। চোখমুখ তার লালচে হয়ে আছে। মোস্তফা সাহেব আঁড়চোখে ছেলেকে চোখ রাঙালেন। তন্ময় সেদিকে তাকায়নি অবদি। গম্ভীরতম স্বরে সে অরুকে আদেশ দিল,
-‘ অরু! তোর রুমে যা! ‘
অরুর হাতের পশম দাঁড়িয়ে গিয়েছে। সে হুড়মুড়িয়ে উঠে চলে যাচ্ছে। এতটা ভয়ংকর সুরে বলেছে যে, অরুর শ্বাস গলায় আটকে গিয়েছে প্রায়। তন্ময়ও পরপরই চলে গিয়েছে। মোস্তফা সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হেসে বললেন,
-‘ অরুর পরিক্ষা তো! তাই আরকি! ‘
কিন্তু তন্ময়ের ধমকের পর পরিবেশ থমথমে রয়ে গেল।
________
আজ অরুর পরিক্ষা শেষ হয়েছে। মাস খানেক লাগিয়ে পরিক্ষা দিয়েছে। দিন কোনটা রাত কোনটা তফাৎ করতে পারেনি। চোখমুখ বন্ধ করে পড়তে হয়েছে শুধু। তবুও এবারের পরিক্ষায় সে সম্পুর্ন মনোযোগ দিতে পারেনি। মনমেজাজ পরিক্ষা দেবার জন্য তৈরিও ছিলো না। কেমন রেজাল্ট আসবে তাতেও বেশ চিন্তিত অরু! কিন্তু এখন তার ঘুমানো প্রয়োজন। কিছুদিন ধরে ঘুমাতে পারেনি। তাই পরিক্ষা দিয়ে এসেই বিছানায় মরার মতো পড়ে রইল। কিন্তু তাকে ডিস্টার্ব করতে সুমিতা বেগম চলে এলেন। তখন মাগরিবের আজান দিচ্ছে সবে। তিনি উচ্চস্বরে বললেন,
-‘ মাজারে যাবো। তৈরি হয়ে নে। ‘
-‘ আমি যাবো না৷’
-‘ সবাই যাচ্ছি। তুই যাবি না মানে? ‘
-‘ মা আমার ঘুমে মাথা ব্যথা করছে। ঘুমাতে দাও প্লিজ! ‘
-‘ একা থাকবি কীভাবে? ‘
-‘ এভাবেই। ‘
-‘ তোর চাচ্চু বলেছে এক্ষুনি উঠে তৈরি হয়ে নিতে।’
-‘ আমার পায়ে চিনচিন ব্যথা করছে। রেস্ট নিতে হবে। ‘
দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন সুমিতা বেগম। এই মেয়ের সাথে তিনি তর্কে পারবেন না৷ বললেন,
-‘ তোর ছোট চাচী বাসায় আছে। কিছু লাগলে ডেকে নিস। ‘
-‘ হুম.. ‘
সুমিতা বেগম কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মেয়েকে চোখ রাঙিয়ে, চলে গেলেন। অরু পড়ে পিটে ঘুমিয়ে রইলো। এরমধ্যে আবার মারজি ফোন করেছে। অরু ধরলো না৷ মেয়েটা কল দিয়েই যাচ্ছে। অতিষ্ঠ হয়ে অরু ধরলো। ওপাশ থাকে মারজি চেঁচিয়ে উঠলো,
-‘ জানিস কী হইছে? ‘
-‘ জানতে চাই না। ফোন রাখ। ‘
-‘ আরে কাটিস না। শোন। আব্রাহাম ভাইয়ার বিয়ে পরশু জানিস তো? ‘
-‘ হু। ‘
-‘ আজ তারা ব্যাচেলর পার্টি করছে। ‘
-‘ তো? ‘
-‘ কাকে দেখেছি আমি এখানে বলত? ‘
-‘ তোর চাচাকে? ‘
-‘ উঁহু! তোর তন্ময় ভাইয়াকে। আমাদের বিল্ডিং থেকে তাদের বিল্ডিংয়ের ছাঁদ দেখা যায়। ভাইরে ভাই! মদ, ভোটকা খেয়ে যা’তা অবস্থা। তুই যদি দেখতি… ‘
অরু কল কেটে দিলো। মদ খাক, নাহলে তেল খাক। তার কিছুই আসে যায়না। অরু আবারো ঘুমাতে চোখজোড়া বুঝল। কিন্তু এবার ঘুম ধরা দিচ্ছে না। মনে মনে মারজিকে ইচ্ছে রকম ধুয়ে দিলো। এই মেয়েটা ঘুম ভেঙেছে তার। তবে কথায় আছে, চেষ্টায় সফলতা মিলে। কথাটি সত্য! কারণ একপর্যায়ে অরু আবারো ঘুমিয়ে পড়েছে। সন্ধ্যা রাতে পরিনত হয়েছে তবুও তার ঘুম থেকে উঠার নামগন্ধ নেই৷ মুফতি বেগম কয়েকবার দরজায় টোকা মেরে ডেকে গিয়েছেন,
-‘ এই অরু! তোর চাচ্চুদের ফিরতে মধ্যরাত হবে। আমি এখন ঘুমাবো৷ তুই কী কিছু খাবি না?’
-‘ আমি নিজে নিয়ে খাব। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। ‘
-‘ আচ্ছা! খেয়ে নিস। ‘
ঘুমঘুম চোখে সেলফোনে নজরে বুলালো। বারোটা এগারো। এতো রাত হয়েছে?
চলবে