#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]
১৩,,
দুপুরের এই সময়টায় সাধারণত আশেপাশে মানুষের চলাচল তুলনামূলক কমে যায়। খুব ভিড় না হওয়ায় তিলো স্পষ্টভাবেই তুলিকে দেখতে পেয়েছে, যেটাকে সে চোখের ভুল বলতে পারেনা৷ রিকশাটা চলে যাওয়ার পর অনিও আসলো সেখানে। তিলোকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে একদিকে চেয়ে থাকতে দেখে সেও সেদিকে তাকালো তবে তার চোখে কিছুই পড়লোনা। রিকশাটার হুড ততক্ষণে উঠে গিয়েছে। অনি তিলোর কাঁধে হাত রেখে বললো,
-কিরে, ওভাবে ছুটে আসলি কেন? কাউকে দেখেছিস?
তিলো ছোট করে ‘হুম’ বলে ফোনে ওর মাকে ডায়াল করলো। প্রথমবারেই নাসীরা পারভীন ফোনটা রিসিভ করলেন। আনুষ্ঠানিক কথাটুকু সেরেই তিলো জিজ্ঞাসা করলো,
-আপু কোথায় আম্মা?
-কে? তুলি? ও তো আজকে একটু বাইরে গিয়েছে। একটা ফোন কিনবে। তোর বাবার কাছে থেকে টাকা নিলো তো। আর ইশানের জন্য ফর্মূলা মিল্ক কিনবে। কেন রে?
তিলোর নিজের মস্তিষ্কে পুরো বিষয়টাকে একবার সাজিয়ে বললো,
-নাহ্। কিছু নাহ্। এমনিই। আচ্ছা রাখছি আমি। বাড়ি ফিরছি।
কথাটা বলে তিলো কল কেটে দিলো। নাসীরা পারভীন ওর কথায় খুব বেশি মাথা ঘামালেন না।
তিলো ফোনটা রাখতেই অনি একেবারে ছেঁকে ধরলো ওকে।
-কি সমস্যা তোর? আমাকে একবার একটু বলতে কি হয়? এদিকে কৌতুহলে আমার কেঁদে ফেলার যোগাড়। কি দেখেছিস তুই?
তিলো দোকানটার ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
-একটা মেয়েকে দেখে তুলি আপু মনে হলো। তাই।
-সত্যি তুলি আপু এখানে?
তিলো পূর্বের চেয়ারটায় বসে বললো,
-জানি না। মেয়েটা একটা ছেলের হাত ধরে ছিলো। আপু কি করে হবে?
অনি গলতে শুরু করা আইসক্রিমের এক চামচ গালে দিয়ে বললো,
-সেটাই। তারজন্য পুরো আইসক্রিমের মজা তুই নষ্ট করলি। এখন খাওয়া শুরু কর।
তিলো চিন্তিত ভঙ্গিতে খাচ্ছে আর মনে মনে ভেবে চলেছে। অনেকটা ভাবার পর অনির দিকে না তাকিয়েই বললো,
-অনিমা, একটা কথা বলতো। হুট করে যে আপুর ডিভোর্স হয়ে গেলো। এই যে তার উপর এমন একটা ব্লেইম দিয়ে। আপু এতো চুপচাপ আছে কেন? আই মিন, একবারও সেটা মিথ্যা বলে দাবি নিয়ে গেলোনা ভাইয়ার বাড়িতে? আর ভাইয়ার বাড়ির লোকজনও সেদিন কিছুই বললো না? কেন?
এবার অনিরও ভাবান্তর হলো। ও হাতের ফোনটা টেবিলের উপর রেখে সেটার পাওয়ার বাটন টিপে স্ক্রিন অফ করে দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,
-জানি না। বুঝতে পারছি না। হয়তো সে ঝামেলা করতে চাচ্ছে না।
তিলো হুস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,
-এটা খোঁড়া যুক্তি। ইশানের কথা ভেবেও কি একবারও সে বলবে না ইমন ভাইয়াকে। আমি তো এই কয়েকদিনে ওকে একবারও ভাইয়ার সাথে যোগাযোগ করার নূন্যতম চেষ্টা করতেও দেখিনি। আম্মাও চুপচাপ। স্ট্রেঞ্জ!
-এটা তো আমি ভেবেও দেখিনি ইয়ার। ডিভোর্স হয়ে গেলেও তুলি আপুর মতো মেয়েরা অন্তত একবার তো নিজের উপর আনা মিথ্যা অভিযোগের বিরুদ্ধে ……
তিলো ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
-না, না, না। অভিযোগটা হয়তো মিথ্যা না। ভুল আপুর আছে। তাই সে চুপ করে আছে। বেশি ঘাটালে সেই আবর্জনাস্তুপে নিজে পড়বে।
অনি অবাক দৃষ্টিতে তিলোর দিকে তাকিয়ে বললো,
-তোর এখন নিজের বোনকে সন্দেহ হচ্ছে?
-না করার তো কারণ নেই। প্রকৃত কারণ ও আড়াল করে গিয়েছে। তাছাড়া কেউই পুরোপুরি পবিত্র হয়না। আমরা মানুষ। নিজের বোন বলে তার অপরাধ না দেখার তো কারণ নেই।
-তুলি আপু এটা তিল। ভুলে যাসনা।
-মানবমস্তি্স্ক না অনেক বেশি রহস্যময়। কখন কি ইচ্ছা করে সেটা হয়তো সেই মস্তিষ্ক ধারক মানুষটাও বুঝতে পারে না। তাই বিয়ের আগের তুলি আপু আর এখনকার তুলি আপুর মধ্যে পার্থক্য আসলেও সেটা অস্বাভাবিক কিছু না।
কথাটা শেষ হওয়ার সাথে সাথে তিলোর আইসক্রিমটুকুও শেষ হলো। তিলো উঠে দাঁড়ালো। অনি ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
-উঠে পড়লি কেন? একটু বস। আমারটা শেষ হোক। একসাথে যাই।
তিলো কন্ঠে কোমলতা এনে বললো,
-সরি ইয়ার। বাড়ি যাওয়াটা জরুরি। তোর কচ্ছপ গতিতে খাওয়া শেষ হতে সময় লাগবে। পরে একদিন অপেক্ষা করবো। এখন যাই।
কথাটা বলে তিলো আর দাঁড়ালো না। দোকান থেকে বেরিয়ে গেলো। অনি ওকে দুবার ডেকে থেমে গিয়ে সামনে ফিরে স্বগতোক্তি করলো,
-খাওয়ালাম আমি। আর আমার জন্যই একটু সময় দাঁড়ালো না। লাগবে না আমার তোদের কাউকে।
অনিও দ্রুত শেষ করে বিলটা দিয়ে বেরিয়ে পড়লো নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
তিলো রিকশায় বসা অবস্থাতেই ভাড়াটা বের করে হাতে ধরে রাখলো। যেন এটুকু সময় দিতেও তার বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। নিজের ভেতরকার অস্থিরতা কাটাতে বারবার পা দোলাচ্ছে। বাড়ির সামনে রিকশাটা থামতেই তিলো খুচরা টাকা দিয়ে নেমে পড়লো। তড়িঘড়ি করে বাড়ির সামনের বারান্দাটায় দাঁড়িয়ে কলিং বেল টিপলো। দরজা খুলতে খুলতে একটু দেরি হচ্ছে দেখে তিলো আবারও বিরক্ত হয়ে আবারও বেল টিপলো। এবার নাসীরা পারভীনের গলা শোনা যাচ্ছে।
-আসছি তো। এরকম অভদ্রের মতো বেল বাজাচ্ছিস কেন?
বলতে বলতে ওনি দরজা খুলে দিলেন। ওনি দরজা খুলতেই তিলো ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
-আপু এখনো আসেনি?
-নাহ্। ওর দেরি হবে আসতে, বলে গিয়েছিলো।
তিলো নিজেকে শান্ত করতে জোরে একটা শ্বাস নিয়ে বললো,
-আম্মা, আপুর কি আর কারো সাথে সম্পর্ক আছে?
তিলোর প্রশ্নটায় নাসীরা পারভীন চমকে উঠলেন। হঠাৎ করেই ওনি ঘামতে শুরু করেছেন। তিলোর জেনে যাওয়াটা এবং হাজার বারণ সত্ত্বেও তুলির স্পর্ধাটা ওনাকে একইসাথে কয়েক রকমের অনুভূতি এনে দিচ্ছে। কৌতূহল, তিলো জানলো কিভাবে? রাগ, তুলি ওনার বারণ সত্ত্বেও আবারও ওনার কথার অবাধ্য হওয়ার সাহস পেলো কিভাবে? ভয়, এখন কি সকলেই ধীরে ধীরে জেনে যাবে? বিরক্তি, এইমাত্র বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়িয়ে এসে তিলোর প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার কারণে। সাথে সাহায্য পাওয়ার তাড়না।
এই মিশ্র অনুভূতিটা আরেক ধরনের অনুভূতির অবতারণা করছে। তা হলো, উত্তেজনা। ওনি নিজের কানের পাশ থেকে ঘামের সরু ধারার বয়ে চলা অনুভব করতে পারছেন। চুপ করে হতাশ দৃষ্টি ফেলে রেখেছেন তিলোর উপর।
ওনাকে চুপ করে থাকতে দেখে তিলো বললো,
-কি হলো কি? চুপ করে আছো কেন, তুমি জানো তাই না?
-কি…কি…কি জানবো? কি আজগুবি কথা বলছিস হঠাৎ করে। রাস্তার রোদে কি তোর মাথা গেলো নাকি? তুই বোস,আমি তোর জন্য শরবত আনছি।
কথাটা বলে ওনি পেছনে ফিরে রান্নাঘরের দিকে যেতে নিতেই তিলো শান্ত এবং একইসাথে কম্পিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
-ইশান ইমন ভাইয়ার ছেলে না। তাই না আম্মা?
নাসীরা পারভীন থমকে দাঁড়ালেন তিলোর কথাটা ওনার কর্ণকুহরে প্রবেশমাত্র। ওনি হঠাৎই নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন, যেটা ওনার অজানা থেকেই ঘটে গেলো। ওনি পেছনে ফিরলেন তিলোর দিকে। তিলোর মুখোমুখি হলেন এবং ওর চোখে চোখ রেখে তাকালেন। ওনার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো আর ওনি নিজের ডান হাতটা তুলে তিলোর গালে বসিয়ে দিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় তিলো হতভম্ব হয়ে গেলো। তিলোর মুখটা একদিকে ঘুরে গেলো। ও গালে হাত দিয়ে ছলছল চোখে নাসীরা পারভীনের দিকে তাকালো। চোখে তার কৌতূহল।
নাসীরা পারভীন শক্ত গলায় দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
-তুলির নামে বাজে কথা একদম বলবি না। যা বলেছিস। ব্যাস। এই কথা বাইরে নিবি না। আমাদের তিনজনের বাইরে আর কেউ জানবে না একথা।
তিলো নিজের বুজে আসা গলাটা দুবার কেশে পরিষ্কার করে নিয়ে বললো,
-তাহলে সেটাই সত্যি?
-নাহ্। ইশান ইমনের ছেলে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তুই যে তুলির বিষয়ে আজকে কথাগুলো জেনে গেলি, এটা আর কাউকে বলবি না। তোর বাবাকেও না।
-তুমি আপুকে কিছু বলো না কেন?
-তিল, আর একটা কথাও বাড়াবে না তুমি এই নিয়ে। এখন ঘরে যাও।
-কিন্তু আম্মা আব্বুর থেকে লুকিয়ে ……।
-আমি তোমাকে থামতে বলেছি। বড় হয়েছো, কোথায় থেমে যাওয়া উচিত এটুকু যদি এখনো না শেখো তো কবে শিখবে? ফ্রেশ হয়ে এসো,আমি খেতে দিচ্ছি।
নাসীরা পারভীন তিলোকে আর কিছু বলতে না দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন। তিলো সেখান থেকে নিজের রুমে চলে আসলো। চোখ থেকে এখন পানি পড়ছে ওর। ঠেকিয়ে রাখতে পারলোনা। তিলোর অদ্ভুত লাগছে। পৃথিবীতে ও কাকে বিশ্বাস করতে পারে? নিজের এতোদিনের চেনা বোনটাও আজ বদলে গেলো।
#চলবে
আমার অ্যাসাইনমেন্ট শুরু হয়েছে। তাই গল্প দিতে একটু অনিয়ম হলে, আশা করি বিষয়টা বিবেচনা করে দেখবেন।
গল্পটা ধীরে এগোচ্ছে আমি জানি। কিন্তু কোনো এক কারণে দ্রুত টানতে পারছি না। কারণটা আমি নিজেও জানি না। এখন ধীরে যাচ্ছে, হঠাৎ করে একদিন দেখবেন দ্রুত অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিনা৷ এটা আমার ব্যর্থতা। দুঃখিত এজন্য।