ভয়_আছে_পথ_হারাবার ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম] ২৪,,

0
431

#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

২৪,,

তিলোর ঘোষণার পর খুব বেশি সময় লাগেনি ওদের বিয়ের কথাবার্তা এগিয়ে যেতে। ফাহমিদা বেগমের আপত্তি সত্ত্বেও সেটা এগিয়ে চলেছে। তিলোর বন্ধুদের খবরটা জানানোয় সকলেই খুশি হলেও মনে হলো না অনি খুব বেশি খুশি হয়েছে বলে। কিন্তু সেটা সে প্রকাশ করতে নারাজ।

ইতিমধ্যে আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত দেওয়াও শুরু হয়ে গিয়েছে। একটা মর্যাদাপূর্ণ গতিতে তিলো এবং অরিকের সম্পর্কটারও উন্নতি ঘটছে। তুলির সাথে সম্পর্কটাও কিছুটা সহজ হয়ে উঠেছে তিলোর।

তুলি ফোনে একটা নাম্বার ডায়াল করে হাতে নিয়ে বসে আছে। কলটা করবে কি করবে না ভেবে উভয়সংকটে পড়েছে। খুব ইচ্ছা করছে মানুষটার সাথে কথা বলতে। আবার দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে বিষয়টা আদৌও ঠিক হবে কিনা ভেবে। পাশে ঘুমিয়ে থাকা ইশানের মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে খুব তাড়াতাড়িই নিজের দ্বিধাদ্বন্দ কাটিয়ে উঠলো সে। কল করলো নাম্বারটায়। কানে ধরে ‘টুউউ’ ‘টুউউ’ শব্দটা যতোবারই ওর কানে যাচ্ছে ততবারই শরীরের ভেতর একটা শিহরণ খেলে চলেছে। একটা আতঙ্ক। এই বুঝি ফোনটা তুলে সেই চিরচেনা কন্ঠটা ‘হ্যালো’ বলে উঠবে। তখন সে কিভাবে কথা বলবে? আনিস সাহেব বলেছিলেন, তিনি কথা বলে তিলোর বিয়েতে নিমন্ত্রণ করবেন। তুলিই আগ বাড়িয়ে সেই দ্বায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। এছাড়া কি করতো সে? খুব বেশিই ইচ্ছা করছিলো একটা অযুহাত পেতে তার সাথে কথা বলার। তাকে কি সবকিছু বলে দেওয়া উচিত নয়? যে কারণে সব গোপন করেছিলো, একটা ভুল করে হাজারবার মিথ্যা বলে সেটা ঢাকতে চেয়েছিলো, সেই কারণটাই তো নেই। সংসারটা তো টিকলো না। অন্যায় করেছে সে। ঘোরতর পাপ। একবার করেছিলো। এরপর বারবার। সইতে না পারলেও সইতে হচ্ছে তাকে।

তুলির ভাবনার মাঝেই ওপাশ থেকে কাঙ্ক্ষিত কন্ঠটা বলে উঠলো,

-আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?

তুলির কন্ঠ আটকে গিয়েছে। কথা বলতে গিয়েও বলতে পারছে না। ভাষা হারিয়ে ফেলেছে যেন। এটা কি সম্ভব ভাষার বাইরে বসবাস করা? ও হয়তো করছে। ওর গবেট মাথা (তুষারের দেওয়া উপমা) পুরোপুরি শূন্য হয়ে গিয়েছে, ও অনুভব করলো। যেন সে ইশানের মতোই কথা বলতে জানে না।
তিলোর তুলির সাথে কথা বলতে ওর রুমেই তখন আসছিলো। এটা অনেকটাই কাকতালীয় একটা ঘটনা, যেমনটা প্রায়শই হয়ে থাকে। তুলিকে ফোনটা কানে ধরে বসে থাকতে দেখে তিলো নিজেও ওর রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে গেলো। আড়িপাতা খারাপ অভ্যাস ও জানে। তারপরও মাঝে মাঝে ও নিজের কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারে না।

তুলিকে কিছু বলতে না দেখে অপর পাশ থেকে আবারও বলে উঠলো,
-হ্যালো! কে বলছেন? কথা বলুন।

তুলির চোখজোড়া ইতিমধ্যে ওর হৃদয় গভীরের আবেগ প্রকাশ করতে যথেষ্ট ছিলো। ভরে উঠেছে নোনাপানিতে। সে পলক ফেলতেই পানির রেখা তার সরু নাকটার দুপাশের হালকা ফোলা ফর্সা গাল দুটোয় গড়িয়ে গেলো। তুলি বহু চেষ্টার পর শব্দ সাজিয়ে মুখ ফুটে বলতে সক্ষম হলো। সালামের উত্তরটা আর ও দিলো না।
-আমি তুলি, ইমন।

তুলি নামটা শুনে ইমনের মেজাজটা ঠিক থাকলো না। তবে এখন সে অফিসে আছে বিধায় ফোনেই চিৎকার করে কিছু বললো না। চোয়াল শক্ত করে ফোনটা কেটে দিতে নিতেই হয়তো তুলি ওর প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারলো। আসলে এখন এটাই ও প্রত্যাশা করে। তুলি ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
-ফোনটা কেটো না। প্লিজ। একটু কথা বলতে দাও আমায়।

ইমন গলার স্বর খাদে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
-তোমার মতো নোংরা মেয়ের সাথে আমার কোনো কথা নেই। তোমার কন্ঠ শুনতেও আমার রুচিতে বাঁধছে। দ্বিতীয়বার আমাকে ফোন করার স্পর্ধা দেখাবে না। ভুলে যেও না আমাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। খুব শীঘ্রই আমি আবারও বিয়ে করছি।

ইমন আবারও বিয়ে করবে শুনে তুলির ভেতরটা একেবারে ভেঙে গেলো। যেন চামড়াটা ঠিক রেখে, তার নিচে ওর শরীরটা কেউ ভেজা কাপড়ের মতো নিঙড়ে দিলো। তুলি নিজেকে সামলে বললো,
-আমি আমার স্বপক্ষে যুক্তি দেখাতে তোমাকে ফোন করিনি ইমন। সামনের মাসে তিলের বিয়ে। তুমি পরিবার নিয়ে এসো। আব্বু যাবে তোমার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতে। প্লিজ তাকে উল্টোপাল্টা কিছু বলে অপমান করো না।

ইমন যেন তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। এরপর বললো,
-কেন? তোমার বাবাকে এখনো তোমার সুকীর্তির কথা বলোনি? আমাদের চেনো না তুমি? আমরা আমাদের চিরশত্রুকেও বাড়িতে আসলে অপমান করি না। কথাটা কি হবে, আমি যা করেছি সেটা বলো না?

তুলি নাক টেনে বললো,
-হ্যাঁ সেটাই।

-নিজের কথা লুকিয়ে তাহলে বোনকে বিয়ে দিয়েই দিচ্ছো! তোমার কথা সবাই জানলে ওর বিয়ে হতো না।

-অতীত চর্চা বন্ধ করো।

-অতীতকে তুমি ডেকে এনেছো। ফোন করলে কেন? আমি রাখছি। আর দয়া করে বিরক্ত করো না।

কথাটা বলেই ইমন ফোন কেটে দিলো। তুলি ফোনটা কানে তারপর বেশ কিছুক্ষণ চেপে ধরে ছিলো। এরপর সেটা কান থেকে নামিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। তবে সাথে সাথেই কান্নার শব্দ থামিয়ে দিতে হলো ইশানের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে সেটা চিন্তা করে।
তিলো কখনোই কাউকে সান্ত্বনা দিতে জানে না। সবচেয়ে বেশি যেটা পারে তা হলো কারো দুঃখে সমব্যথী হয়ে তার সাথে কান্না করা। ওর এখনো মনে পড়ে, ও যখন পঞ্চম শ্রেণিতে ছিলো তখন অনির দাদী মারা যায়। অনিমা ওর দাদী বলতে অজ্ঞান। খুব বেশি ভালোবাসতো তাঁকে। দাদীর হাতেই মানুষ বলতে গেলে। রাতে ঘুমাতোও দাদীর সাথে। যেদিন ওনি মারা গেলেন সেদিন অনির সে কি কান্না! দুবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো। তিলো কেবল তার পাশে বসে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলেছিলো কিন্তু মুখ থেকে একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারেনি।
তুলিকে কাঁদতে দেখে ও আসলে কি বলতে এসেছে সেটাই ভুলে গিয়েছে। আর কিছু না বলেই ও সেখান থেকে চলে গেলো। তুলি দরজার দিকে পিঠ ফিরিয়ে রাখার কারণে সেটা দেখলোও না।

তিলো নিজের রুমে ফিরে এসেও শান্তি পাচ্ছে না। তুলি কেন একাধারে তার ভুলটা এখনো জিইয়ে রেখেছে তার কোনো যুক্তি তিলোর মাথায় আসছে না। ইশানের কথা ভেবে অন্তত সংসার টিকিয়ে রাখতে নিজের স্বপক্ষে কিছু বলতে পারতো ইমনকে! তবে ওর অন্যায়টা চাপা পড়ে আছে কিভাবে এতোদিন সেটা তিলো বুঝতে পারছে। নাসীরা পারভীন এখানে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন। তুলির অন্যায়টা তিনিই ধামাচাপা দিয়ে রেখেছেন নিজের স্বামীর থেকে পর্যন্ত। আনিস সাহেব তুলির কথা জানতে পারলে নিশ্চিতভাবেই তুলির এবাড়ির ভাত কপাল থেকে উঠে যাবে। ওনি এসমস্ত অন্যায় একদমই বরদাস্ত করেন না।
তিলোর চিন্তার মাঝেই ওকে অনিমা ফোন করলো। তিলো ফোনের স্ক্রিনে মিস পাটোয়ারী নামটা দেখে মৃদু হেসে রিসিভ করলো। এই মেয়েটার সাথে তিলোর বন্ধুত্ব কোন কালের থেকে!! প্রথম প্রথম কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ওর প্রথম বান্ধবীই এই অনিমা পাটোয়ারী। সেই সময় থেকে এখনও ওদের বন্ধুত্ব টিকে আছে। মাঝখানে যে ভেঙে যায়নি তা নয়। মাঝখানে কয়েকবছর ওর সাথে যোগাযোগটাই ছিলো হালকা পাতলা ধরনের। কোনো ঝগড়া নয়। তবে অনির আরো কিছু বন্ধুবান্ধব জোটায় ও তিলোর সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দেয়। তিলো ওর তুলনায় পড়াশোনায় ভালো। তিলো একটা গতানুগতিক ছাত্রী। আর অনি টিটিপি। মানে টেনেটুনে পাশ করে আরকি। ফলে তিলো একটা ভালো হাইস্কুলে এডমিশন পেয়ে যায়, যেখানে অনিমাকে পড়তে হয় একটা লোকাল স্কুলে। ফোনে যোগাযোগ ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এরপর কলেজে উঠে অনির সাথে আবার দেখা। আবার একসাথে ব্যাচ টিউশন। তবে ওদের কলেজও আলাদা ছিলো। এখন আবার ভার্সিটিতে এক হয়েছে।

অনির ফোনটা ধরার পরই অনি সাধারণ কুশল বিনিময় বাদ দিয়ে বললো,
-তোর কি আজকে বিকালে সময় হবে?

তিলো একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ইতিমধ্যে আছরের আযানের সময় হয়ে গিয়েছে।
-হ্যাঁ হবে।

-হাঁটতে যাবি?

-যাওয়া যায়।

-তাহলে নামায আদায় করে তৈরি হয়ে থাকিস। আমি তোর বাড়ির সামনে দাঁড়াবো। আর হ্যাঁ, মোড়ের মাথার দোকানটায় চা খাবো।

তিলোর উত্তরের অপেক্ষা না করে অনি ফোন কেটে দিলো। তিলো বোকার মতো ফোনটা হাতে ধরে বসে থাকলো কিছু সময়। এরপর দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে উঠে পড়লো বসা থেকে।

নামায আদায় করে তিলো তৈরি হয়ে নিয়েছে অনির দেখা নেই। হঠাৎই আবার ফোন করে বললো,
-শোন না, সরি। আব্বু ফিরেছে আজকে। এখনই৷ যাওয়া হবে না। তবে কাল যাবো। অবশ্যই, অবশ্যই। তোকে কিছু বলার আছে আমার।

-আঙ্কেল কেমন আছেন?

-ভালো। রাখছি আমি।

এবারও অনি হুট করে কেটে দিলো ফোনটা। তিলো বর্তমানে খেয়াল করেছে, অনির ওর প্রতি আচরণ বদলে যাচ্ছে। আগের মতো আর খোলামেলা আচরণ সে করে না। ফোন কম দেয়। কথা কম বলে। হুটহাট সিদ্ধান্ত জানিয়ে আবার নিজেই পরিবর্তন করে। নাসীরা পারভীনের সাথে ওর সম্পর্কটাও তিলোর ভালো লাগছে না। ওর মা’ও ওর থেকে যেন দূরে চলে গিয়েছে। আগের মতো আর নেই।
তিলোর এসব ভাবতেই খুব খারাপ লাগে।

মাঝরাতে তিলোর ঘুম ভাঙলো ফোনের আওয়াজে। বিরক্ত মুখে ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে উঠলো,
-বাড়ি থেকে বের হও।

কথাটা কানে যেতেই তিলোর ঘুম ছুটে পালিয়েছে। তিলো কান থেকে ফোনটা সামনে ধরে দেখলো এটা অরিকের কল। তিলো পুনরায় কানে ধরে বললো,
-এতোরাতে বাড়ি থেকে বের হবো মানে কি?

-ঘুরতে যাবো।

-মাথা খারাপ নাকি? আমার ঘুম আসছে। বিরক্ত করো না। রাখছি।

-তিল, আমি ‘আশাকুঞ্জের’ বাইরে দাঁড়িয়ে আছি৷ অপেক্ষা করছি। প্লিজ এসো।

অরিকের মুখে নিজের বাড়ির নাম শুনে তিলো উঠে বসলো। খাট থেকে নেমে বারান্দায় গিয়ে দেখার চেষ্টা করলো, সত্যি বলছে কিনা অরিক। প্রাচীরের জন্য সরাসরি দেখা না গেলেও গেটের বাইরে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে বোঝা যাচ্ছে।
-না বলে কয়ে আসতে কে বলেছে?

-ইচ্ছা হয়েছে এসেছি। তুমি কি আসবে? প্লিজ এসো।

তিলো হঠাৎ ফোন কেটে দিলো। না বলে হঠাৎই এসে বলে ঘুরতে যাবো। এটা যে পরোক্ষভাবে জোর করা সেটা তিলো বুঝতে পারছে। তিলো মানবতার খাতিরে না গিয়েও পারবে না। এতোরাতে কষ্ট করে এসেছে। ও দ্রুত নিজের পোশাক বদলে চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকেই ভেঙচি কাটলো। একটু সাজতেও পারলোনা এখন। ওকে কতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখবে? বলে আসলে না হয় এতোক্ষণে সেজে ফেলতো।
তিলো রুম থেকে বেরিয়ে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। ভেবেছিলো কাউকে জানাবে না। তবে ও জানতো না তুষার আগে থেকে সবটা জানে। তিলো বেরিয়ে যাওয়ার সময় দেখে তুষার সোফায় বসে ঢুলছে। তিলো ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
-এতো রাতে এখানে কি তোর? নিজের ঘর কি ভাড়া দিয়েছিস?

তুষার তেতে উঠলো ওর কথায়। চিৎকার করে বলে উঠলো,
-এতো রাতে!

সাথে সাথে নিজের মুখ চেপে ধরলো ও। ওর চিৎকার না সবাই জেগে যায়! তিলোও হাতের ইশারায় বোঝাচ্ছে আস্তে কথা বলতে। তুষার এবার ফিসফিসিয়ে বললো,
-রাত কয়টা বাজে তা তোদের খেয়াল আছে? প্রেমে পড়লে যে মানুষের মতিভ্রম হয় তা তোদের দেখে বোঝা যায়। এতো কষ্ট করি সারাদিন আমি। আর সেই আমাকেই ঘুম থেকে তুলে দরজা বন্ধ করে দিতে বলা হচ্ছে! তাড়াতাড়ি বিদায় হ। আমি দরজা আটকে শুতে যাবো।

তিলো কিছু বললো না ওকে। এখন কিছু বললেই ও ঝগড়া বাঁধাবে। তিলো চুপচাপ দরজা খুলে বের হয়ে গেলে তুষার দরজাটা বন্ধ করে দিলো।

#চলবে

সুস্থ থাকলে রাতে ইনশাআল্লাহ আরেকটা পর্ব দিবো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here