অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৩৯।

0
533

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৯।

বাইরে থেকে ফিরে এল ফারজাদ। তার ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীরটাকে এলিয়ে দিল সোফায়। শার্টের প্রথম দুই বোতাম খোলা। লোমষ বুকের খানিকটা অংশ দৃশ্যমান তাই। চোখ বোজা। দৃশ্যপটে ভেসে চলছে কিছু বিদঘুটে প্রতিবিম্ব, যেগুলো এত বছর বেশ সন্তর্পনে লুকিয়ে রেখেছিল অন্তঃস্থলের এক কোণে। সেগুলো আজ আবার তাজা হয়ে উঠেছে। রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে পুরোনো ক্ষত থেকে।

দিলরুবা বেগম এক গ্লাস পানি হাতে বসার ঘরে এলেন। পানির গ্লাসটা ফারজাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

‘পানিটাও খেয়ে নাও, ভালো লাগবে।’

ফারজাদ চোখ মেলে চাইল। গ্লাসটা হাতে নিয়ে রেখে দিল সামনের টেবিলে। তারপর মায়ের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘আমার নাম কী, আম্মি?’

এমন অদ্ভুত প্রশ্নে অবাক হলেন দিলরুবা বেগম। বললেন,

‘এটা আবার কেমন প্রশ্ন?’

অধৈর্য গলায় ফারজাদ জবাব দিল,

‘বলুন না।’

দিলরুবা বেগম ফারজাদের ভাবমূর্তি ধরতে পারছেন না। তাই উত্তরে বললেন,

‘ফারজাদ।’

‘পুরো নাম?’

খানিকটা এবার ভ্রু কুঁচকালেন দিলরুবা বেগম। ছেলের মতি গতি ভাবাচ্ছে তাঁকে। বললেন,

‘ফারজাদ তাজওয়ার।’

ব্যস, এইটুকু শুনে ফের সোফায় হেলান দিল সে। চোখ বুজল। দিলরুবা বেগম চিন্তায় পড়লেন। ছেলেটার হলো কী? তিনি প্রশ্ন করলেন,

‘কী হয়েছে তোমার, ফারজাদ?’

ফারজাদ বিধ্বস্ত সুরে বলল,

‘আমি আমার নামের এই পদবীটা না পাল্টে বড্ড বেশি ভুল করে ফেলেছি, আম্মি। আমার আজ আফসোস হচ্ছে খুব।’

দিলরুবা বেগম বুঝতে পারলেন না কিছু। হঠাৎ আজ কেন ছেলেটা এসব কথা বলছে? ফারজাদ ফের নিজ থেকেই বলল,

‘আহাম্মেদ তাজওয়ার, এই মানুষটাকে আমি ভীষণ ঘৃণা করি আম্মি, ভীষণ। দেখুন, আমার জীবনে তার কোনো প্রতিচ্ছবি নেই, কেবল এই একটি পদবী ছাড়া। আমি কেন এই পদবীটা পাল্টালাম না, কেন?’

ফারজাদ রাগে নিজের মাথার চুল খামছে ধরে। দিলরুবা বেগম ভয়ে আঁতকে উঠেন। ছেলের হাত ধরে চুল ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলেন,

‘নামের পদবীতে কিছু যায় আসে না, বাবা। মানুষের ব্যবহার আর চরিত্রটাই আসল।’

ফারজাদ চেঁচিয়ে উঠে বলল,

‘তাও আমার এই পদবীটা চাই না, আম্মি। আমি ঘৃণা করি এই পদবীটাকে, এই পদবীর বাহককে। আমি ঘৃণা করি ঐ মানুষটাকে, আম্মি।’

আজ এতগুলো বছর পর ফারজাদের এই ক্ষিপ্ত, অগ্নিশর্মা রূপে হকচকালেন দিলরুবা বেগম। সিঁড়ির কোণে দাঁড়িয়ে থাকা মৌমিও হতভম্ব, হতবিহ্বল। ভাইকে এতটাও রেগে যেতে কখনো দেখেনি সে। আর এই “আহাম্মেদ তাজওয়ার” এই মানুষটাই বা কে? কেন এই মানুষটার প্রতি ভাইয়ের এত ক্ষোভ? মৌমির ছোট্ট মন জুড়ে এই প্রশ্নগুলোই কিলবিল করে চলছে।

ফারজাদ নিজের ঘরে এসে দোর দেয়। দিলরুবা বেগম অনেক বলেও বোঝাতে পারেননি। পুরোনো জখমে ফের আঘাত পেয়েছে বোধ হয়, তাই ব্যথা এবার হাজার গুণ প্রগাঢ় হয়েছে। মৌমি মায়ের কাছে এসে বসে। জিজ্ঞেস করে,

‘আহাম্মেদ তাজওয়ার কে, আম্মি?’

দিলরুবা বেগম শূণ্য চোখে তাকান। তার এই নিরেট শূণ্য চোখই যেন বলে দিচ্ছে অনেক কিছু। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ছোট্ট করে। মৌমি অধির আগ্রহে চেয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায়। দিলরুবা বেগম শুকনো গলায় ছোট্ট করে বললেন,

‘তোমার বাবা।’

থমকে গেল মৌমি। অবিশ্বাস্য চোখে মায়ের দিকে চাইল। ছোট বেলা থেকেই “বাবা” নামক শব্দটার সাথে খুব একটা পরিচিত নয় সে। পরিচিত নয় বললে ভুল হবে, তাকে কখনো পরিচয় করানোই হয়নি। বোঝ হবার পর থেকেই মা আর ভাই’ই তার সব। তার স্কুল কলেজ সব ফর্ম থেকেই বাবার নামটা উহ্য ছিল তার। একবার বাবার পরিচয় নিয়ে খানিকটা আগ্রহ দেখানোর ফলস্বরূপ ভাইয়ের খুব বকা শুনে। তারপর থেকে আর এই ব্যাপারে কোনো আগ্রহও দেখায়নি। না কোনোদিন এই বাড়িতে তার বাবাকে নিয়ে কোনো কথা উঠেছে। আজ আচানক, অকস্মাৎ বাবার কথা শুনে রা হারাল সে। মিইয়ে যাওয়া সুরে জিজ্ঞেস করল,

‘উনি কি বেঁচে আছেন, আম্মি।’

দিলরুবা বেগম ঢোক গিললেন। বললেন,

‘হয়তো।’

তিনি উঠে চলে গেলেন। কেন যেন শব্দগুলো জড়িয়ে যাচ্ছিল তাঁর। তার উপর মেয়ের সামনে তো আর চোখের জল ফেলা যায় না। মৌমি তার জায়গাতেই স্থির। সে বিড়বিড় করে আওড়াল, “আমার বাবা বেঁচে আছেন? কোথায়? কোথায় আছেন তিনি?”

____________

রাতের খাবার খেয়ে মাত্রই রুমে এসেছে প্রিয়তা আর নীহাল। নীহাল নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়েছে। প্রিয়তা গিয়ে দাঁড়িয়েছে বারান্দায়। বারান্দা থেকে হোটেলের গেইট অবধি স্পষ্ট দেখা যায়। সে বাইরের পথচারী মানুষদের দেখছে। এরই মাঝে কী মনে করে নিজের ফোনটা হাতে নেয়। যেটা আজই থানা থেকে নীহাল এনেছে, সাথে তার পাসপোর্ট ভিসাও ফিরে পেয়েছে সে। এবার কোর্টে ওয়াদির শাস্তির ব্যবস্থা করেই দেশে ফিরবে। আর এই দেশে মন টিকছে না। এই দেশের আবহাওয়ায় শান্তি পাচ্ছে না মোটেও। কেমন একটা পোড়া পোড়া ঘ্রাণ যেন। প্রিয়তা ফোনটা অন করে। আনমনে তার আর ওয়াদির পুরোনো মেসেজগুলো পড়তে থাকে সে। শুকনো মুখে ফুটে তাচ্ছিল্যের হাসি। ওয়াদির কী চমৎকার অভিনয়! কী নিঁখুত পরিকল্পনা! এসব দেখার মাঝেই একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসে হঠাৎ। আচমকা ফোন আসায় খানিকটা ঘাবড়ে যায় প্রিয়তা। কিছুক্ষণ বাদেই আবার স্বাভাবিক হয়ে কলটা রিসিভও করে। ওপাশ থেকে সরাসরি প্রশ্ন আসে,

‘নাম্বারটা খোলা কেন? ফোনটা কি পেয়ে গিয়েছেন তাহলে?’

প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকাল। জিজ্ঞেস করল,

‘কে আপনি?’

‘আফসার খান।’

পরিচিত নাম শুনে এবার আরেকদফা অবাক হলো সে। এই লোক তার এই নাম্বার পেল কই! পরক্ষণেই মনে পড়ল, মামলার কাগজে তার নাম্বার লেখা ছিল। সে জিজ্ঞেস করল,

‘এত রাতে কল দিয়েছেন কেন?’

‘নাম্বারটা খোলা না বন্ধ সেটা যাচাই করার জন্য। পাসপোর্ট ভিসা পেয়েছেন সব?’

‘জি।’

‘ধন্যবাদ দিবেন না?’

‘আপনাকে কেন দিব?’

‘আশ্চর্য! আপনার এত বড়ো একটা উপকার করলাম, আর সামান্য ধন্যবাদ দিতেও এত কার্পণ্য করছেন আপনি। দ্যাটস নট রাইট, প্রিয়তা?’

‘কোন উপকারের কথা বলছেন?’

‘কাল ফারজাদের সাথে কথা বলে সব জানার পরই আমি আমার লোক লাগিয়ে আপনার এই ফোন, পাসপোর্ট আর ভিসা খুঁজে বের করিয়েছে। নয়তো পুলিশেরা যে ঢিলামি করছিল, এক মাসেও খুঁজে পেত না এসব।’

প্রিয়তা অবাক হয়ে বলল,

‘আপনি কী করে পেলেন?’

আফসার কিঞ্চিৎ হেসে বলল,

‘বোকা পুলিশ ওয়াদিকে যে বাড়ি থেকে উদ্ধার করেছে সেই বাড়ি আর সার্চ করেনি, সেখানেই ছিল এগুলো।’

প্রিয়তা খুশি হলো এবার। বলল,

‘ধন্যবাদ।’

‘এখন শুধু ধন্যবাদে চলবে না, ম্যাডাম। আপনার জন্য আমাকে অনেক খাটতে হয়েছে, তার পারিশ্রমিক স্বরূপ আপনার দেশটা আমাকে ঘুরিয়ে দেখাতে হবে।’

‘অবশ্যই, কখনো বাংলাদেশে গেলে যোগাযোগ করবেন। ঘুরিয়ে দেখাব।’

‘মনে থাকে যেন।’

‘অবশ্যই থাকবে।’

‘আচ্ছা, আর রাত না জেগে এবার ঘুমিয়ে পড়ুন। রাত পাহারার জন্য পেঁচারা আছে বাইরে, আপনি তো আর পেঁচা নন, আপনি হলেন গিয়ে পর…’

বাকিটা না বলেই সে ফের বলল,

‘আচ্ছা রাখছি তবে, শুভ রাত্রি।’

‘শুভ রাত্রি।’

আফসার কল কাটল। প্রিয়তা অবাক হলো। লোকটা অদ্ভুত বেশ। তবে এইটুকু ভেবে খুশি হলো যে তার জন্য সে এতকিছু করেছে।

________

পরদিন সকালেই অফিসের জন্য বের হয় ফারজাদ। মন মেজাজ এখনো তার ঠিক নেই। অফিসে প্রবেশ করতেই জারার মুখোমুখি হতে হলো তাকে। বিগড়ানো মেজাজটা আরো বিগড়ে গেল এবার। জারা তাকে দেখেই আহ্লাদে গলে গেল যেন। আদুরে কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘অবশেষে আপনি এলেন, ফারজাদ। আমি এই কয়দিন আপনাকে কত মিস করেছি জানেন?’

আগুনে পানি লাগলে যেমন ছ্যাঁত করে উঠে। ফারজাদেরও এই মুহুর্তে তেমনই অনুভূত হচ্ছে। সে আশেপাশে একবার চোখ বুলাল। মানুষ নেই তেমন। এগিয়ে এল কিছুটা। অতঃপর দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘নিজের সম্মান ধরে রাখুন, ম্যাডাম। অযথা বারবার অপমানিত হবেন না। আমাকে দয়া করে আমার মতো থাকতে দিন, নয়তো এবার রিজাইন করলে পায়ে পড়লেও আর এই অফিসে আসব না।’

সে জারাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। জারা ক্ষিপ্ত হলো খুব। এই একটা ছেলের জন্য আর কত অপমান সহ্য করবে সে? সে দ্রুত গেল তার বাবার কেবিনে, আজই এর একটা বিহিত করতে হবে।

চলবে..

(গল্প রেগুলার দিতে পারছি না বলে কি রেগে আছেন, পাঠকমহল?🥲)

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here