অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৪৪।

0
575

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৪।

লেপটপে খুব জরুরি একটা কাজে মনোনিবেশ ফারজাদের। তখনই তার কেবিনে আসে জারা। হাতে একটা ট্রে। তার হাসি মুখ। ট্রে’টা ফারজাদের সামনে রেখে বলল,

‘নিজ হাতে কফি বানিয়েছি, শুধুমাত্র আপনার জন্য।’

ফারজাদ বিরক্ত বোধ করলেও সেটা চেপে গিয়ে বলল,

‘আপনার বানানোর কী দরকার ছিল? আমার প্রয়োজন হলে আমি নিজেই বানিয়ে নিতাম।’

জারা হেসে বলল,

‘এইটুকু তো আপনার জন্য করতেই পারি। এখন কাজ রেখে খেয়ে বলুন তো কেমন হয়েছে।’

‘এই প্রেজেন্টেশনটা শেষ করে খাচ্ছি।’

জারা হাত বাড়িয়ে ফারজাদের লেপটপটা বন্ধ করে বলল,

‘উঁহু, আগে খাবেন, পরে কাজ।’

অগত্যাই কফিতে চুমুক বসাল ফারজাদ। আহামরি কিছু মনে হলো না, তাও সৌজন্যতার খাতিরে বলল,

‘ভালো হয়েছে।’

‘চিনি ঠিক আছে তো?’

‘জি।’

জারাও অন্য কাপটাতে চুমুক বসাল। চোখে মুখে অন্যরকমের আনন্দ তার। বলল,

‘আব্বু আমার হাতের কফি ভীষণ পছন্দ করেন।’

অনভিপ্রেত কিঞ্চিৎ হাসল ফারজাদ। ছোট্ট করে বলল,

‘ওহহ।’

ফারজাদ এরই মাঝে দ্রুত কফিটা শেষ করল, জারাকে কেবিন থেকে বিদায় করার জন্য। কাপটা রেখে সে বলল,

‘কফি শেষ, এবার আমি আমার বাকি কাজটা করি?’

‘জি, অবশ্যই।’

জারা ট্রে হাতে বের হলো। চোখে মুখে বরাবরের ন্যায় এক উত্তেজনা। ঠিক বিশ মিনিট পর ফের কেবিনে এল সে। ভেতরের দৃশ্য তার খুশির মাত্রাকে বাড়িয়ে দিল দ্বিগুণ। সে কেবিনের দরজাটা লক করে এগিয়ে এল। ফারজাদের ঘুমন্ত মুখটার দিকে চেয়ে রইল নিষ্পলক। আঙ্গুল ছোঁয়ে দিল তার কপাল, নাক আর ঠোঁটে, ফিসফিসিয়ে বলল,

‘আর কিছুদিনের মধ্যেই এই সবকিছু আমার হতে যাচ্ছে, ফারজাদ। আ’ম সো এক্সাইটেড, বেইব।’

সে এবার হাত বুলাল ফারজাদের সুন্দর গোছানো চুলে। খানিকটা এলোমেলো করে দিল। তারপর প্যান্টের পকেট থেকে বের করল একটা কাঁচি। মাথার তালুর উপরের অংশের কাছটা থেকে এক গাছি চুল কেটে নিল। টেরও পেল না ফারজাদ। জারার মুখে বিশ্বজয়ের হাসি। এ যেন চুল না কোনো রত্ন পেয়েছে সে। চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করে দিয়ে দ্রুত কেবিন থেকে বের হয়ে গেল।

___________

‘হঠাৎ আমার সাথে কী জরুরি কথা?’

কফিতে চুমুক বসাল আফসার। স্বাদটা ঠিক জমল না বোধ হয়। নাক মুখ কুঁচকে নিল। প্রিয়তা তার উত্তরের আশায় চেয়ে। আফসার বলল,

‘কফিটা বিদঘুটে।’

প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘কফি নিয়ে গবেষণা শেষ হলে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন দয়া করে।’

আফসার হেসে বলল,

‘আপনার তো দেখছি খুব তাড়া।’

‘এভাবে জরুরি তলপে ডেকেছেন, এখন কারণ না বলে অযথা সময় নষ্ট করলে তাড়া দেখানোটাই স্বাভাবিক।’

আফসার কফিটা সাইডে রেখে সোজা হয়ে বসল। প্রিয়তার দিকে তাকাল পূর্ণ মনোযোগে। বলল,

‘আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই, প্রিয়তা।’

প্রিয়তা কপালে ভাঁজ ফেলল। শোনা কথাটা ঠিক তার বোধগম্য হলো না বোধ হয়, মুখ দেখে তাই মনে হচ্ছে। সে বলল,

‘কী?’

আফসার ফের বলল,

‘আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।’

‘আমাকে?’

‘জি।’

‘কেন?’

আফসার হাসল তার প্রশ্নে। বলল,

‘মানুষ বিয়ে করে কেন?’

‘আমাকেই কেন? মেয়ে কি অভাব পড়েছে?’

‘মেয়ে আছে, তবে সব মেয়ে তো আর প্রিয়তা না।’

‘প্রিয়তাকে কেন প্রয়োজন? অন্য মেয়ের মাঝে কী সমস্যা?’

‘আমার প্রিয়তাকে পছন্দ, অন্য মেয়েকে আমার পছন্দ না।’

প্রিয়তা এবার হাসল। বলল,

‘আপনি কি আমার সাথে মজা করছেন?’

‘আপনার কী মনে হয়?’

‘আমার যা-ই মনে হোক না কেন, আপনি কীসের ভিত্তিতে এসব কথা বলছেন? আমাকে বিয়ে করার চিন্তা আপনার মাথায় এল কেমন করে?’

‘কেন? এতে তো আমি কোনো অন্যায় দেখছি না। আপনার জীবন তো আর ওয়াদির জন্য থেমে থাকবে না; এটা চলমান, চলবেই। সেই চলার পথে নাহয় আমাকেও একটু পথচারী হিসেবে ঠাই দিলেন, সমস্যা কোথায়?’

প্রিয়তা বড়ো বড়ো চোখ করে বলল,

‘আপনি কী স্বাভাবিকভাবে কথাগুলো বলছেন, অথচ আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। আপনি দুদিনের পরিচয়ে একটা মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারেন কী করে, তাও মেয়েটার এহেন পরিস্থিতি জেনেও।’

আফসার মৃদু আওয়াজে বলল,

‘আমার আপনাকে পছন্দ, প্রিয়তা, তাই প্রস্তাব দিয়েছি। আপনি হ্যাঁ বা না তে একটা উত্তর দিয়ে দিন, আমার তাতেই চলবে।’

প্রিয়তা রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল। মাথার ভেতরে ঝট পাকিয়ে গিয়েছে যেন সব। লোকটার কথা শুনে সে রা খুইয়ে বসেছে। আফসার বলল,

‘দয়া করে চুপ থাকবেন না, আমার একটা উত্তর প্রয়োজন।’

প্রিয়তা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল। বলল,

‘না, আমি এই প্রস্তাবে রাজি না।’

আফসার ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলল। সাইডের কফির কাপটা টেনে এনে এবার এক শ্বাসেই পুরোটা শেষ করল সে। তারপর বেশ শব্দ করে কফির কাপটা টেবিলে রেখে বলল,

‘ধন্যবাদ, আমাকে সময় দেওয়ার জন্য। সাবধানে দেশে ফিরবেন। দোয়া করি, আপনার ভবিষ্যত যেন সুখকর হয়। আসছি, ভালো থাকবেন।’

সে উঠে দাঁড়াল। প্রিয়তাকে আর কিছু বলার সুযোগও দিল না। চলে গেল। হতভম্ব, নির্বাক হয়ে বসে রইল প্রিয়তা। ভাবল, লোকটা কি একটু বেশিই কষ্ট পেয়েছেন?

___________

কলিগের ডাকে ঘুম ভাঙে ফারজাদের। ঘুম থেকে উঠে এদিক ওদিক তাকিয়ে চিন্তায় পড়ে খুব। তার এই আচানক ঘুমের কারণ অনুধাবন করতে পারে না। কলিগ একটা ফাইল হাতে তার সামনে দাঁড়ান। জিজ্ঞেস করল,

‘অসুস্থ না-কি? হঠাৎ এভাবে ঘুমিয়ে পড়লেন যে?’

ফারজাদ চেয়ার টেনে সোজা হয়ে বসে বলল,

‘না না, শরীর ঠিক আছে। ঘুমিয়ে পড়লাম কী করে সেটা বুঝতে পারছি না। আপনি কী ফাইল নিয়ে এসেছেন, দেখি।’

কেবিন খালি এখন। ফারজাদ এখনো তার চিন্তায় বিভোর, সে ঘুমিয়ে পড়ল কী করে। অনেক ভেবে মনে পড়ল, জারার দেওয়া কফিটা খেয়ে লেপটপে কাজ করার মাঝেই হঠাৎ প্রচন্ড ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। আর তারপরেই অদ্ভুত ভাবে ঘুমিয়েও পড়ে সে। এই ব্যাপারটা মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না তার। কফি খাওয়ার পর এমন ঘুম আসবে কেন, আশ্চর্য। ভাবতে ভাবতেই মেঝেতে চোখ যায় তার। সাদা টাইলস্ এর উপর বেশ কয়েকটা ছোট ছোট চুল। সে এই জায়গায় এমন চুল দেখে অবাক হয়। সঙ্গে সঙ্গেই নিজের মাথায় হাত দেয়। ভালো ভাবে বোঝার চেষ্টা করে তার চুল ঠিক আছে কি-না। তালুর উপর বরাবর অংশের চুলগুলো একটু আলাদা ঠেকল বোধ হয়। মনে হলো সেগুলো কাটা হয়েছে। সে এবার দ্রুত ওয়াশরুমে যায়, আয়নায় খেয়াল করে ভালোভাবে। সে চুলের ব্যাপারে সচেতন বেশ, সেলুনে গিয়ে সতর্কতার সাথে চুল কাটে। এই চুল এইদিক থেকে ওদিক হলেও সে টের পায়।তালুর অংশের চুল ছোট, সেটা আপাত দৃষ্টিতে ধরা না গেলেও সে ঠিকই বুঝতে পেরেছে। ব্যাপারটা তার এখন বোধগম্য হচ্ছে না যে, জারা তার চুল কাটবে কীসের জন্য?

_______________

বিকেলের দিকে ফারজাদদের বাসায় আসে প্রিয়তা। নীহাল টিকেট কাটতে গিয়েছে যে এখনো আসেনি। একা রুমে ভালো লাগছিল না বলেই এখানে আসা তার। তারউপর আফসারের বলা কথাগুলোতেও মন খচখচ করছে ভীষণ। প্রিয়তাকে পেয়ে মৌমি খুশি। দিলরুবা বেগমও। বসার ঘরে বসেই তিনজন কথা বলছেন। প্রিয়তা আর তাদেরকে আফসারের প্রস্তাবের কথা জানায়নি। এরই মাঝে ফারজাদের কল, দিলরুবা বেগমের ফোনে। তিনি রিসিভ করেন। ফারজাদের রুষিত স্বর। দিলরুবা বেগম কারণ জানতে চাইলে ফারজাদ সব খুলে বলে। সবশুনে তিনিও হতভম্ব। বলে উঠেন,

‘তোমার চুল দিয়ে জারার কী কাজ? ও তোমার চুল কাটতে গেল কেন?’

‘সেটাই তো আমি বুঝতে পারছি না, আম্মি। উনি কোনো সাহসে আমার চুল কাটলেন?’

‘আচ্ছা, রেগো না এখন। আগে বাসায় এসো, তারপর এটা নিয়ে কথা বলা যাবে।’

ফোন কাটলেন তিনি। প্রিয়তা চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করল,

‘কী হয়েছে, আন্টি?’

‘আর বলো না, জারা মেয়েটা যা শুরু করেছে না; আজ না-কি ফারজাদকে কফি খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে তার চুল কেটে নিয়েছে। ছেলেটা এখন বেজায় ক্ষিপ্ত, ওর চুলে কারোর হাতের স্পর্শও ও সহ্য করে না।’

প্রিয়তা হকচকিয়ে উঠে বলল,

‘চুল কাটবে কেন?’

মৌমি রেগে বলল,

‘মেয়েটা বোধ হয় পাগল, নয়তো এসব করে কে?’

প্রিয়তা ভাবল গভীর ভাবে। এভাবে কফি খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে চুল কেটে নেওয়াটা মোটেও স্বাভাবিক বিষয় না। সে অনেক আর্টিকেলে পড়েছিল, আজকাল ভালোবাসা পেতে না-কি মানুষ সব জঘন্য প্রন্থাও অবলম্বন করছে। আর তারই মধ্যে একটা হলো, কালো জাদু। হঠাৎই অদ্ভুত ভয়ে বুকে মোচড় দিল তার। জারা মেয়েটাকে ফারজাদের প্রতি যে পরিমাণ উন্মত্ত দেখেছে, মেয়েটা আবার এমন কিছু করার কথা ভাবছে না তো?

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here