অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ২৯।

0
483

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৯।

ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গেল প্রিয়তা। গেস্ট রুম থেকে ড্রয়িং রুমটা বেশি দূরে নয়, কয়েক কদমের ব্যবধান। তাও সেই কয়েক কদম যেন আজ শেষই হচ্ছে না। প্রিয়তার হৃদকম্পন বেড়েছে। সে শুনতে পাচ্ছে সেই শব্দ। অবশেষে ড্রয়িং রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পা থামে তার। অনেকদিন পর প্রিয় মানুষ, প্রিয় মুখটা দেখে সে যেন জমে যায়। গলার স্বর বসে যায়। সে কথা বলতে চাইছে, “ভাইয়া” বলে ডাকতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। ভীষণ কষ্টে ঠোঁট নাড়াল অতঃপর, গলার স্বর বের করল। ডাকল,

‘ভাইয়া!’

দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সেই গলার স্বর কানে যেতেই অন্তঃস্থল শীতল হয় নীহালের। বোনের দিকে তাকায়। ঢোক গিলে। এতদিন বোনকে না দেখে মনে যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, সেই ক্ষত আজ সেরে উঠেছে ততক্ষণাৎ। চিত্ত জুড়ে বইছে প্রশান্তির স্রোত। প্রিয়তা তার জায়গা থেকে নড়তে পারছে না। পাগুলো যেন মেঝের সাথে আঠার মতো লেগে আছে। তবে নীহাল বিলম্ব করে না আর এক মুহুর্তও; ছুটে এসে বোনকে জড়িয়ে ধরে। যতটা শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরলে বোন আর পালাতে পারবে না ঠিক ততটাই শক্তভাবে আগলে নেয় তাকে। প্রিয়তা কেঁদে ফেলে। জল জমে নীহালের চোখেও। দু ভাই বোন নীরবে কাঁদে অনেকক্ষণ। বাড়ির বাকি সদস্যরা অপলক চোখে চেয়ে কেবল দেখে ভাই বোনের নির্মল ভালোবাসা। তাদের এই নিখুঁত সম্পর্ক আর মায়া দেখে মৌমিও কাঁদে খুব। মনে মনে ভাবে, তার ভাইও নিশ্চয় তাকে এতটাই ভালোবাসে।

অনেকক্ষণ নীরবে নিভৃতে কান্নার পর্ব চুকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় প্রিয়তা। ভাইয়ের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে চট করে নিচে বসে পড়ে। দু হাতে আগলে ধরে ভাইয়ের পা যুগল। তার ব্যবহারে সকলে হতভম্ব। নীহাল হকচকিয়ে উঠে বলে,

‘কী করছিস, প্রিয়? পা ছাড়।’

প্রিয়তা মাথা ঠেকায় ভাইয়ের হাঁটুতে। বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে বলে,

‘আমি ক্ষমা চাইব কোন মুখে, ভাইয়া? কোন মুখে মা বাবার সামনে দাঁড়াব? আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, বিশ্বাস করো। নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে খুব। আমি এত বড়ো বোকামিটা কী করে করতে পারলাম, কীভাবে পারলাম তোমাদের সাথে এত বড়ো অন্যায় করতে? আর আজ দেখো, আমার এই অন্যায় শাস্তি তোমরাও পাচ্ছো, সাথে এই পরিবারটাও পাচ্ছে। ভুল করেছি আমি, অথচ শাস্তি পাচ্ছে সবাই। আমার যে এখন ক্ষমা চাইতেও বিবেকে বাঁধছে, ভাইয়া। কী করব আমি, বলো! বলে দাও কী করলে ক্ষমা পাব?’

প্রিয়তা কাঁদছে। চোখের পানি বাঁধ ভেঙেছে আজ। তার কান্নার শব্দে দিলরুবা বেগম আর মৌমির মায়া হচ্ছে বড্ড। ফারজাদ নিষ্পলক চেয়ে আছে। প্রিয়তার প্রতি মায়া হচ্ছে তারও। মেয়েটার সাথে এমনটা না হলেও পারত বোধ হয়। আর পাঁচটা স্বাভাবিক মেয়ের মতো একটা সুন্দর জীবন যে সেও প্রাপ্য।

নীহাল নিজেকে শক্ত করে। প্রিয়তাকে টেনে দাঁড় করায় সে। তার গালে হাত রেখে কঠিন সুরে বলে,

‘তুই ভালোবেসে ভুল করিসনি, প্রিয়। ভুল করেছিস আমাদের না জানিয়ে এত বড়ো একটা পদক্ষেপ নিয়ে। কিন্তু যার জন্য এতকিছু করলি, সেই তোকে ঠকাল, তোর সাথে জঘন্য অন্যায় করল; তোর এই ভুল ক্ষমার যোগ্য হলেও ঐ অমানুষটার ভুল ক্ষমার যোগ্য না। তুই যেদিন ঐ অমানুষটার কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারবি, ভেবে নিবি সেদিন থেকেই তোর সমস্ত ভুল ক্ষমা হয়ে গিয়েছে; এর আগ অবধি না।’

প্রিয়তা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। ভাইয়ের কথা শুনে পুরনো ক্ষোভ আবার মাথা চারা দিয়ে উঠল তার। ওয়াদির কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি চায় সে। আর সেই শাস্তির ব্যবস্থা করেই এখান থেকে যাবে, এর আগে না।

প্রিয়তা সংযত করল নিজের আবেগ। চোয়াল শক্ত করে বলল,

‘আমি ওর শাস্তির ব্যবস্থা করে তবেই দেশে ফিরব, ভাইয়া।’

দিলরুবা বেগম প্রিয়তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

‘আমরাও তোমার সাথে আছি, মা।’

___________

রাতের খাবার খেতে বসল সবাই একসাথে। প্রিয়তা এখন পুরোপুরি স্বাভাবিক। তার ভাই তাকে এখনো আগের মতোই ভালোবাসেন। বরং মনে হচ্ছে, ভালোবাসা বেড়েছে যেন। অথচ তার মনে হচ্ছিল, তার ভাই বোধ হয় রাগে তার সাথে আর কথাও বলবেন না।

মৌমির খাবার আগেই শেষ। সে বসার ঘরে টি ভি দেখছে বসে। ফারজাদ আর নীহাল প্রিয়তার কেইসের ব্যাপারেই আলাপ করছে। এই কিছু সময়য়ের মাঝেই দুজনের সম্পর্ক জমেছে বেশ। তাদের দেখে এখন পাকিস্তানী আর বাংলাদেশী বলে আলাদা করা দুষ্কর হবে, দুজনকেই বাঙালী লাগছে পুরো তালে।

নীহালের খাবার শেষ। দিলরুবা বেগম ভীষণ যত্ন নিয়ে তাকে খাইয়েছেন। কোনো ত্রুটি তিনি রাখেননি। নিজের দেশের আরেক মানুষকে পেয়ে তিনি এখন বেজায় খুশি।
নীহাল উঠে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল,

‘বেসিনটা কোনদিকে?’

প্রিয়তা খাবার ছেড়ে উঠতে চাইলে, দিলরুবা বেগম বাঁধা দিয়ে বললেন,

‘তুমি বসো, মৌমি দেখিয়ে দিবে। এই মৌমি, নীহালকে একটু বেসিনের কাছে নিয়ে যাও তো।’

মৌমি উঠে এল। নীহালের কাছে এসে মাথা নুইয়ে বলল,

‘চলুন।’

বেসিনে হাত ধুচ্ছে নীহাল। মৌমি পাশেই দাঁড়ান। অস্বস্তিজনক ঠেকল তার ভাবমূর্তি। সে লোকটাকে মিথ্যে বলেছিল, এখন সেটা নিয়েই অস্বস্তি হচ্ছে তার। তবে ইতস্তত বোধ কাটিয়ে এ নিজ থেকেই বলে উঠে,

‘স্যরি!’

নীহাল কল বন্ধ করে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মেয়েটা হয়তো তার বোনেরও ছোট। কেমন জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখো, যেন কোনো বিরাট চুরি করে চোর ধরা পড়েছে। সে জিজ্ঞেস করে,

‘স্যরি কেন?’

মৌমি চোখ পিটপিট করে চাইল নীহালের দিকে। নীহালের কুঁচকান ভ্রু আর এক গাল দাঁড়ি হরণ করল তার পূর্ণ মনোযোগ। হঠাৎ তাল হারাল সে। কী জন্য যে স্যরি বলেছে ভুলে গিয়েছে বেমালুম। নীহাল ভ্রু সোজা করে, কিঞ্চিৎ হাসে মৌমির বিভ্রান্ত মুখখানা দেখে। বলে,

‘ইট’স ওকে, মিস মিমি অর মৌমি? হুইচ ওয়ান ইস রিয়েল?’

নীহালের কথায় আরো বেশি আড়ষ্ট হলো মৌমি। লোকটা জেনে বুঝে ব্রীড়ায় ফেলছে তাকে। সে কিছু বলার আগেই নীহাল আবার বলে উঠে,

‘ধন্যবাদ, আমার বোনের বন্ধু হয়ে উঠার জন্য। আপনাদের সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’

মৌমি স্মিত হেসে বলল,

‘এভাবে বলবেন না, প্রিয়তা আপুকে সাহায্য করতে পেরে আমরা নিজেরাও ভীষণ খুশি। আমরা চাই, প্রিয়তা আপু যেন আবার স্বাভাবিক একটা জীবনে ফিরে যেতে পারে। আর যেন কোনো দুঃখ কষ্ট আপুকে কখনো না ছুঁতে পারে।’

নীহাল হাসল। বলল,

‘অন্যের ভালো চাওয়া মানুষটা নিজেও নিঃসন্দেহে ভীষণ ভালো মনের মানুষ। আপনারাও তাই।’

মৌমি ক্ষীণ আওয়াজে বলল,

‘ধন্যবাদ।’

‘ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। চলুন, এবার ভেতরে যাওয়া যাক।’

‘জি জি, চলুন।’

______________

খাওয়া দাওয়া শেষ করে বসার ঘরে বসেছে সবাই। নীহাল বসেছে ফোন নিয়ে। দেশে ফোন করে বাবা মা’র সাথে প্রিয়তাকে কথা বলিয়ে দিবে। ঐ মানুষগুলোও ঐখান থেকে ব্যাকুল হয়ে বসে আছেন তার অপেক্ষায়। নীহাল ভিডিয়ো কল দেয় বাবার ফোনে। বাবা রিসিভ করেন সঙ্গে সঙ্গেই। কল ধরেই উতলা হয়ে উঠেন তিনি। শ’খানেক প্রশ্ন করে বসেন। নীহাল কোনোকিছুর জবাব না দিয়েই ফোনটা প্রিয়তার হাতে ধরিয়ে দেয়। ফোনের স্ক্রিনে এতদিন পর মেয়ের মুখখানা দেখে বাবার হৃদয়ে যেন রক্ত ক্ষরণ শুরু হয়। এই এক মেয়েকে কতই না ভালোবাসা, আদর, মায়া-মমতা দিয়ে বড়ো করেছেন। অথচ মেয়ে তাদের তেইশ বছরের ভালোবাসাকে ভুলে দুই বছরের ভালোবাসার টানে সব ছেড়ে কী নিদারুণ ভাবে চলে গেল। একবারও ভাবল না তাদের কথা। এই বয়সে এতটা কষ্ট নিতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। আজ এতদিন পরে মেয়েকে দেখে যেন চিত্তে কিছুটা শান্তি ফিরেছে।

প্রিয়তা কম্পিত সুরে ডেকে উঠে,

‘বাবা।’

তার বাবা অলিউল জামান চোখের জল মুছলেন। নাক টেনে বললেন,

‘দেশ ছাড়ার আগে কি এই বুড়ো বাবা মা’র মুখটা একবারও চোখের সামনে ভেসে উঠেনি, মা?’

চলবে….

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here