অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৩৪।

0
452

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৪।

ফারজাদের গু লি লাগার কথা শুনে প্রিয়তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল যেন। নির্দ্বিধায়, নিঃসংকোচে ভেবে নিল, তার জন্যই হয়েছে এমনটা। হয়তো ওয়াদি শত্রুতা মেটাতেই এই কাজটা করেছে। চরম অপরাধবোধ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে তাকে। সে নীহালকে নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছে। ফারজাদের কেবিনে যায়। অসুস্থ, জখমপ্রাপ্ত মানুষটাকে দেখে আনমনেই চোখের কার্ণিশে জল জমে তার। এই জল তার দোষের, তার অপারাধ বোধের। তার জন্যই এই নিষ্পাপ, ভালো মানুষটা এভাবে হাসপাতালের বেডে পড়ে আছেন।
নীহাল এগিয়ে যায় ফারজাদের দিকে। তাকে চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করল,

‘এটা কী করে হলো, ফারজাদ? আপনি তো আমাদের দিয়েই ফিরছিলেন। এর মধ্যেই এসব কিছু কী করে হয়ে গেল?’

‘গাড়িটা মাঝ রাস্তায় খারাপ হয়ে যায়। নেমে দাঁড়িয়ে ড্রাইভারকে কল দিই, গাড়ি এসে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ফোন রাখার সাথে সাথেই একটা বিকট শব্দ হয়। তারপরেই হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি এই অবস্থা। সেই ব্যক্তি গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যায়। আমার যতটুকু ধারণা, কাজটা ওয়াদির লোকেই করতে পারে। তাছাড়া আমার আর কোনো শত্রু নেই।’

প্রিয়তার অপরাধবোধের পরিসীমা প্রশ্বস্থ হলো এবার। মানুষটার কোনো শত্রু নেই, তার জন্য এখন অযথাই একজন শত্রু তৈরি হলো। প্রিয়তার কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। সে কেঁদে ফেলবে এখনই। চট করে ওড়নায় চোখ মুছে। ফারজাদের কাছে এসে দাঁড়ায়। সে কিছু বলার জন্য উদ্যত হবে তার আগেই সেখানে এসে হাজির হয় জারা এবং জারার বাবা। জারা এসেই অস্থির ভাবে ছুটে যায় ফারজাদের দিকে। বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করে,

‘এসব কী করে হলো, ফারজাদ? কারা আপনার এত বড়ো ক্ষতি করতে চেয়েছে? আপনার সাথে কার কী এমন শত্রুতা, যে আপনাকে প্রাণে মারার চেষ্টা করল?’

জারার এত অস্থিরতা, উত্তেজনা দেখে বীতঃস্পৃহ বোধ করল ফারজাদ। বিরক্তির নিশ্বাস ছাড়ল। বলল,

‘আমি জানি না, ম্যাডাম। পুলিশ তদন্ত করছেন, আশা করছি অপরাধী ধরা পড়বে।’

‘ড্রাইভারের মুখে তোমার এই অবস্থা শুনে জারা তো পুরো পাগল হয়ে উঠেছিল। সেকি কান্নাকাটি। কোনোভাবেই বোঝাতে পারছিলাম না। অবশেষে তোমাকে দেখে এখন একটু শান্ত হয়েছে।’

বসের কথা শুনে ফারজাদের ভালো তো লাগল’ই না, উল্টো বিরক্তির মিটার তরতর করে বাড়ল। জারা সেই সুযোগে চট করে বসল ফারজাদের হাত ধরে। ফারজাদ চমকে তাকায়। মৌমি আর দিলরুবা বেগম হতভম্ব। প্রিয়তার দৃষ্টিও বিস্ময়াবিষ্ট। ফারজাদের আঘাত পাওয়া হাতের উপর জারার হাত। ফারজাদ অপর হাতে জারার হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলে,

‘মা আর বোন ব্যতিত অযথা কোনো নারীর স্পর্শ আমার পছন্দ না।’

অপমানে মুখ থুবড়ে পড়ল জারা। মস্তিষ্কে তার একটা স্মৃতি প্রস্ফুটিত হলো ততক্ষণাৎ। যেদিন এই হাসপাতালে প্রথম এসেছিল, ফারজাদের কাজিনকে দেখতে; সেদিন ফারজাদ সবার সামনে সেই কাজিনকে কোলে তুলে নিয়েছিল। মা আর বোন ব্যতিত যদি অন্য কোনো নারীর স্পর্শ পছন্দ’ই না হবে তবে সেদিন তাকে কেন সে স্পর্শ করেছিল? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই চোখ মুখের ভাবমূর্তি তার নমনীয়তা হারায়। সে আড়চোখে দেখে, ঐ মেয়েটা এখানেই দাঁড়ান। আরো বেশি ক্ষিপ্ত হয় সে। ধরেই নেয়, ফারজাদকে পাওয়ার পথে এই মেয়ে তার সবথেকে বড়ো কাটা হয়ে দাঁড়াবে।

সে ফারজাদের অপমান আদতে গায়ে মাখল না। হাসল বরং। বলল,

‘অন্য কোনো নারী আর আমি এক হলাম নাকি, ফারজাদ?’

‘কেন অন্য কোনো নারীর সাথে আপনার কি কোনো নারী জাতীয় পার্থক্য আছে, ম্যাডাম? আপনি কি পুরোপুরি নারী নন?’

মৌমির কথা শুনে মেজাজ হারাল জারা। কটমট করে চাইল, যেন এক্ষুনি মৌমিকে চিবিয়ে খাবে। ফারজাদ মৌমিকে ধমক দিয়ে উঠল,

‘মৌমি, অভদ্রের মতো কথা বলছিস কেন? স্যরি বল উনাকে।’

জারা ভালো মানুষি দেখিয়ে বলল,

‘না না, থাক, স্যরি বলতে হবে না। বাচ্চা মেয়ে, মজা করে বলেছে। আমিও মজা হিসেবেই নিয়েছি।’

‘না, বলব। আমি আমার ভাইয়ের কথা অমান্য করি না। স্যরি, কিছু মনে করবেন না; আর মনে করলেও আমার কিছু যায় আসে না।’

শেষের কথাটা আস্তেই বলল সে।

রওফিক সাহেব বললেন,

‘পুলিশ কেইস হয়েছে তো?’

‘জি, স্যার।’

‘কোনোপ্রকার সাহায্য লাগলে কিন্তু অবশ্যই আমাকে জানাবে।’

‘জি, অবশ্যই।’

জারা বলল,

‘চিন্তা করবেন না, ফারজাদ, ঐ অপরাধী অবশ্যই ধরা পড়বে। আমি নিজে ওকে খুঁজে বের করব।’

‘কেন, আপনি কি ব্যবসার সাথে সাথে পার্ট টাইম পুলিশের চাকরিও করেন, ম্যাডাম?’

জারা কপাল কুঁচকে চাইল মৌমির দিকে। মৌমি ঠোঁট চেপে হাসছে। ফারজাদ গম্ভীর গলায় বলল,

‘মৌমি।’

ভালো মানুষের মতো মুখ চেপে বসল মৌমি। জারার মেয়েটাকে গিলে খেতে মন চাইলেও মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,

‘ইউ আর সো ফানি, মৌমি। আই লাইক ইট।’

‘জি, ধন্যবাদ।’

জবাব দিয়ে নাক মুখ খিঁচে বসল মৌমি। দিলরুবা বেগম তার পাশেই। জারার যেন আহ্লাদীপনা শেষ’ই হচ্ছে না। সে ডাক্তারকে ডেকে এনে নিজ থেকে বলে দিচ্ছে, কী কী করতে হবে না হবে। যেন ডাক্তারটা সে নিজেই।

ডাক্তার এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বললেন,

‘ম্যাডাম, আমি ডাক্তার, আমি জানি আমার পেশেন্টের জন্য কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ। আমি আমার পেশেন্টকে আমার বেস্টটা দেওয়ার ট্রাই করব। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।’

জারাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ডাক্তার বেরিয়ে গেলেন। জারা ক্ষুব্ধ হয়ে বলল,

‘এই ডাক্তারের আচরণ আমার মোটেও ভালো লাগেনি। ফারজাদ, আপনার অন্য কোথাও শিফট হওয়া প্রয়োজন।’

ফারজাদ তপ্ত শ্বাস ছাড়ল। এমনিতেই হাতের ব্যথায় অবস্থা করুণ, তার উপর এই মেয়েকে তাকে বিরক্ত করে ছাড়ছে। সে কোনোরকমে নিজেকে ধাতস্ত করে বলল,

‘ম্যাডাম, আমি এখানে ঠিক আছি। আমার কোনো আসুবিধা হচ্ছে না। আপনি নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরতে পারেন।’

বাড়ি ফেরার কথা শুনে জারা একবার প্রিয়তার দিকে চাইল। মৌমির পাশেই বসা সে। জারা বলল,

‘আমি আজ রাতটা এখানেই থাকব।’

সবাই তাজ্জব বনে তাকায়। ফারজাদের বিরক্তির মাত্রা অতিক্রম করে সে। ফারজাদ বলল,

‘ম্যাডাম, এখানে আমার বাড়ির লোকেরা আছেন, আপনাকে কষ্ট করে থাকতে হবে না।’

‘আমার কোনো কষ্ট হবে না, ফারজাদ।’

‘ম্যাডাম, বোঝার চেষ্টা করুন। একটা হাসপাতালে এত মানুষ থাকা যায় না, ব্যাপারটা চোখে লাগে। আর আমি এখন সুস্থ একদম। আপনাকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না।’

জারা দেখল, কেউই তাকে সাধছে না। উপায়ান্তর না দেখে চলে যেতে হলো তাদের। জারা যেতেই ফারজাদ যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। নীহাল জিজ্ঞেস করল,

‘মেয়েটা কে, ফারজাদ?’

‘আমার অফিসের বসের মেয়ে।’

নীহাল সকালের ঘটনা সম্পর্কে কিছুটা অবগত হওয়ায় দুই এ দুই এ চার মিলিয়ে বুঝে গেল, মেয়েটার ফারজাদের প্রতি দূর্বলতা আছে।

রাত হচ্ছে। দিলরুবা বেগম বললেন,

‘ফারজাদের জন্য খাবার আনা দরকার। ওর খেয়ে আবার ঔষধ খেতে হবে।’

‘এখানে ক্যান্টিন আছে, আম্মি। সেখান থেকেই আনাতে পারবেন ।’

‘আমি যাব আনতে?’

নীহাল জিজ্ঞেস করল। দিলরুবা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,

‘তুমি যেতে পারবে, বাবা।’

‘জি, কেন পারব না আন্টি। কী কী লাগবে, বলে দিন। আমি নিয়ে আসছি।’

দিলরুবা বেগম বলে দিলেন, যা যা লাগবে। বললেন,

‘মৌমিকে সাথে নিয়ে যাও, তোমার যদি আবার উর্দু বুঝতে বা বলতে সমস্যা হয়।’

নীহাল বলল,

‘বেশ। মৌমি, চলুন।’

মৌমি আনন্দ চিত্তে ছুটল নীহালের পেছন। কেবিনে দিলরুবা বেগম আর প্রিয়তা। দিলরুবা বেগম বসা থেকে উঠে ওয়াশরুমে গেলেন। প্রিয়তার একা অস্বস্তি হচ্ছে। বেডে চোখ বুজে শুয়ে আছে ফারজাদ। প্রিয়তা অস্বস্তি কাটিয়ে তার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ায়। অনুনয়ের সুরে বলে,

‘আমাকে ক্ষমা করবেন।’

ফারজাদ চোখ মেলে তাকাল। ভ্রু কুঁচকাল সে। জিজ্ঞেস করল,

‘হঠাৎ ক্ষমা চাইছেন কেন?’

‘আমার জন্যই তো আজ আপনাকে এত বড়ো বিপদের মুখে পড়তে হয়েছে। আমার জন্যই আপনার শত্রু তৈরি হয়েছে, সব দোষ তো আমার। আমাকে ক্ষমা করবেন, প্লিজ।’

ফারজাদ রাশভারী গলায় বলে,

‘এই পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটা ঘটনার পেছনে এক জনের’ই হাত আছে। উনার ইশারাতেই হয় সব। আপনি আমি একটা উছিলা মাত্র। তাই নিজেকে দোষ দিবেন না, ভাগ্যে ছিল হয়ে গিয়েছে। এখানে আপনার কোনো দোষ নেই।’

ফারজাদের কথা শুনে দারুণ ভালো লাগল প্রিয়তার। মানুষটা কী সুন্দর বুঝে সবকিছু, অথচ শুরুর দিকে এই মানুষটাকেই কত কিছু ভেবেছিল সে। প্রিয়তা বলল,

‘তাহলে আরেকটা জিনিসের জন্য ক্ষমা লাগবে।’

‘আরেকটা জিনিস? কী সেটা?’

প্রিয়তা ইতস্তত সুরে বলে,

‘সেটা তো আপনাকে বলা যাবে না।’

চলবে….

ছবি: রত্নাবু❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here