অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৩৮।

0
433

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৮।

কদর্য কিছু মুহূর্তের আদ্যোপান্ত বিবরণ শুনেও মানুষটার মাঝে হাহামরি কোনো বিবর্তন এল না। সে উল্টো প্রসন্ন সুরে বলল,

‘আপনি তো বেশ সুন্দর উর্দূ বলতে পারেন।’

প্রিয়তার পছন্দ হলো না একটুও। সে মানুষটার সামনে এত এত দুঃখের বিবরণ দেওয়ার পর মানুষটা সব রেখে তার ভাষার প্রশংসায় মেতেছে? আশ্চর্য! পরক্ষণেই আবার আফসার বলল,

‘তাহলে ফারজাদ আপনার কেউ নন? আপনারা সম্পূর্ণ অপরিচিত দুজন মানুষ?’

‘জি।’

ছোট্ট করে জবাব দিল প্রিয়তা। লোকটার ভ্রু জোড়া কুঁচকাল খানিকটা বোধ হয়। নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরল। কিছুক্ষণ পর আবার জিজ্ঞেস করল,

‘তবে উনি আপনাকে এত সাহায্য করছেন কেন?’

এই প্রশ্নের কী উত্তর হতে পারে। প্রিয়তা এক পল ভেবে বলল,

‘উনি ভালো মানুষ তাই। ভালো মানুষেরা বিপদে পড়া মানুষদের এভাবেই সাহায্য করেন।’

আফসার ঠোঁট উল্টাল। যেন প্রিয়তার কথায় রাজ্যের অবাক হয়েছে সে। অতঃপর বিদ্রুপের সুরে জিজ্ঞেস করল,

‘আজকাল এত ভালো মানুষ আছে?’

‘অবশ্যই আছে। শুধু আমাদের চোখে পড়ে না।’

আফসার হাসল তার কথা শুনে। বলল,

‘যাক, আপনার চোখে যে পড়েছে সেটাই অনেক।’

‘আপনি কি আমাকে নিয়ে মজা করছেন?’

আফসার তার ফাইলে কলম দিয়ে কিছু একটা লিখে প্রিয়তার দিকে সেটা এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘আমার কাছে সময়ের অনেক দাম। আপনার মতো নিত্যান্তই এক ক্ষুদ্র মেয়েকে নিয়ে মজা করার মতো সময় আমার নেই। এখানে একটা সই করুন।’

লোকটার এসব ত্যাড়া ত্যাড়া কথা প্রিয়তার মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। তাও নিজের বিপদের কথা ভেবে আপাতত এসবই হজম করতে হবে তাকে। সে কাগজটাতে চোখ বুলিয়ে বলল,

‘এখানে কিছু মিথ্যে কথাও লেখা আছে, আমাকে ওয়াদি রেপ করার চেষ্টা করেনি।’

আফসার রাশভারী গলায় উত্তর দিল,

‘কেইস জিততে এমন দু একটা মিথ্যে কথা লিখতে হয়। আপনার সাথে করেনি, হয়তো অন্য কারোর সাথে করেছে। আপনাকে এখন যেটা বলা হয়েছে আপনি আপাতত সেটাই করুন।’

প্রিয়তা পুরো লেখা পড়ে দেখল, এখানে আরো অনেক অবাঞ্ছিত কথা লেখা। যেগুলো হয়তো ওয়াদি করেওনি। প্রিয়তার প্রেমিকা মন লেখাগুলো পড়ে খানিকটা কষ্ট পেলেও বিদ্রোহী মনের শাস্তির দাবিকে ছাড়িয়ে যেতে পারল না। সে কাগজে সই করে আফসারের দিকে এগিয়ে দিল। আফসার কাগজে আরো একবার চোখ বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করল,

‘প্রেমিকের নামে মিথ্যে অপবাদ দেখলে কষ্ট হয়? এখনো এতো মায়া!’

প্রিয়তা এই কথার জবাব দিল না কোনো। আফসার চাইল তার দিকে। বলল,

‘আপনার কাজ শেষ। বাইরে থেকে আপনার ভাই আর আপনার সাহায্যকারীকে ডাকুন।’

“সাহায্যকারী” এমন সম্বোধন শুনে প্রিয়তা ক্ষিপ্ত হলো এবার। বলল,

‘উনার একটা সুন্দর নাম আছে, আপনি বোধ হয় সেটা ভুলে গিয়েছেন, মি. আফসার খান।’

আফসার চকিতে তাকাল। কী জেদ মেয়েটার কন্ঠে। এই প্রথম কোনো মেয়ে এত কঠিন গলায় তার নাম বলেছে। নয়তো সব মেয়েদের সুরেলা কন্ঠেই সে নিজের নাম শুনে এসেছে আজীবন। প্রিয়তা বেরিয়ে গেল। আফসার চেয়ে রইল নিষ্পলক। যেন একটা অগ্নি স্ফুলিঙ্গ।

কিছুক্ষণ পর আফসারের কেবিনে এল ফারজাদ আর নীহাল। তাদের সাথেও জরুরি কথা সারল আফসার। বলল, জামিন হলেও কেইসটা অবশ্যই কোর্টে উঠবে। এই ব্যবস্থা সে’ই করবে। নীহাল খুশি হলো। আফসারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে আসল তারা।

প্রিয়তার চোখে মুখে তখন অন্তরীক্ষের কালো মেঘ যেন। আফসার লোকটাকে তার একটুও পছন্দ হয়নি। ঠেকাই পড়ে এখন তাকেই সহ্য করতে হবে। অথচ নীহাল বেরিয়ে এসে বলল আরেক কথা। আফসারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ সে। প্রিয়তা অবাক হয়। ভাইয়ের সাথে এমন কী কথা বলেছে যে, তাকে তার এত পছন্দ হয়ে গিয়েছে?

সেখান থেকে বেরিয়ে তারা তিনজন গেল থানার উদ্দেশ্যে। পৌঁছাতে সময় লাগল আধঘন্টা। প্রিয়তা আজ আর ভেতরে গেল না। দূরে এক কোণে দাঁড়িয়ে রইল সে। ফারজাদ আর নীহাল’ই ভেতরে গিয়েছে। অফিসারের সাথে কথা বলেছে দুজন। অফিসার জানান, ওয়াদির বাবা বাইরেই আছেন। তিনি তাঁর যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ছেলেকে এখান থেকে বের করার জন্য। যেহেতু কেইসটা একদম উপর মহল অবধি চলে গিয়েছে, তাই একটু কষ্ট হচ্ছে উনার। নয়তো এতক্ষণে ছেলেকে বের করে ফেলতেন। নীহাল কথাটা শুনে ক্ষেপল বেশ। ফারজাদের দিকে চেয়ে বলল,

‘চলুন তো, ফারজাদ। ঐ অভদ্র লোকটার সাথে একটু দেখা করে আসি।’

অফিসার বললেন,

‘দেখা করুন, তবে কোনোপ্রকার ঝামেলা করবেন না। যেহেতু থানা এরিয়া পরে কেইস কিন্তু ঘুরে যেতে পারে।’

‘না না, অফিসার, তেমন কিছুই হবে না।’

ফারজাদকে নিয়ে নীহাল গাড়ি পার্কিং এর দিকটাই গেল। অফিসার বলেছেন, ঐদিকেই নাকি ওয়াদির বাবা আছেন। কিছুটা সামনে যেতেই একটা বিশাল খয়েরি রঙের গাড়ি নজরে এল তাদের। তার সামনে দাঁড়িয়েই একজন মধ্যবয়স্ক লোক ফোনে কথা বলে যাচ্ছেন। নীহাল বলল,

‘উনিই হয়তো সেই অভদ্র লোক।’

ফারজাদ বলল,

‘আমারও তাই মনে হচ্ছে।’

‘চলুন।’

তারা দুকদম এগুতেই ফারজাদের ফোনটা বেজে উঠে। হাতে নিয়ে দেখে জারার নাম্বার। বিরক্ত হয়ে কেটে দেয় সে। কাটার সঙ্গে সঙ্গেই ফের কল। নীহাল বলল,

‘জরুরি হলে রিসিভ করুন না।’

ফারজাদ চোখে মুখে মাত্রাধিক বিরক্ত ফুটিয়ে কলটা রিসিভ করল। ওপাশ থেকে জারা উদ্বিগ্ন সুরে জিজ্ঞেস করল,

‘কেমন আছেন, ফারজাদ?’

‘জি, ভালো।’

‘হাতের ব্যথা কমেছে আপনার?’

‘জি।’

‘তাহলে কি কাল থেকে অফিসে আসবেন?’

‘চেষ্টা করব।’

‘আমি অপেক্ষায় থাকব কিন্তু।’

ফারজাদ আরো বেশি কপাল গুটাল এবার। বলল,

‘আমি একটা জরুরি কাজে এসেছি, ম্যাডাম। একটু পরে কল করছি।’

জারাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কলটা কেটে দিল ফারজাদ। ফোনটা পকেটে পুরে নীহালের দিকে চেয়ে বলল,

‘চলুন এবার।’

তারা কদম ফেলল। ঠিক গিয়ে দাঁড়াল লোকটার পেছনে। নীহাল কাঠকাঠ গলায় জিজ্ঞেস করল,

‘এক্সকিউজ মি, আপনি কি ওয়াদির বাবা?’

ফিরে চাইলেন তিনি। ভ্রু কুঁচকালেন। চোখের চশমাটা নামিয়ে বললেন,

‘ইয়েস, বাট হু আর ইউ?’

ফারজাদ থমকাল। এই মুখটা বড্ড পরিচিত মনে হলো তার। আর ঐ চোখগুলো, ঐ চোখগুলো যেন খুব কাছ থেকে দেখেছিল সে। ফারজাদ চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করল। লোকটার মুখভর্তি দাড়ি। এই দাড়ির আঁড়ালে কি অন্য কেউ আছে, যাকে ফারজাদ চেনে। খুব ভালো করে চেনে।
নীহাল বলল,

‘আমি প্রিয়তার ভাই।’

লোকটি এবার ভ্রু সোজা করলেন। কান থেকে ফোনটা সরিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বললেন,

‘ওহহ, তোমরাই তাহলে আমার ছেলের শত্রু? কিন্তু, তোমরা হয়তো এটা জানো না যে, তোমরা কার সাথে লাগতে এসেছো। তোমার পুরো পরিবারকে কিন্তু আমি ধ্বংস করে দিব।’

নীহাল তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

‘আগে নিজের ছেলের ধ্বংস দেখুন, তারপর অন্যকিছু।’

লোকটি রেগে বলল,

‘সময় থাকতে কেইসটা উইথড্র করে নাও।’

‘জীবনেও না। আপনার ছেলের শাস্তির ব্যবস্থা না করা অবধি আমি ক্ষান্ত হব না।’

লোকটি চোয়াল শক্ত করে বলল,

‘যত টাকা লাগবে দিব, কেইসটা শুধু তুলে নাও তোমরা। টাকা দিয়ে মুড়িয়ে দিব একদম।’

নীহাল ব্যঙ্গ করে বলল,

‘গাছ ভালো না তো ফল ভালো হবে কী করে? যার এমন জঘন্য চিন্তা ধারার বাপ আছে তার ছেলে তো কুলাঙ্গার হবেই, এটাই স্বাভাবিক।’

লোকটা রেগে গেল খুব। নীহালের দিকে তেড়ে আসতে নিয়েও ক্ষান্ত করলেন নিজেকে। মনে পড়ল, এটা থানা। এখানে এখন কিছু করা মানেই নিজের বিপদ বাড়ানো। তিনি চশমাটা চোখে লাগালেন ফের। আঙ্গুল নাড়িয়ে বললেন,

‘তোমাদের আমি দেখে নিব।’

হাসল নীহাল। লোকটা গাড়ির দরজা খুলতেই এতক্ষণ নিশ্চুপ নির্বাক থাকা ফারজাদ জিজ্ঞেস করল,

‘নাম কী আপনার?’

প্রশ্ন শুনে কপাল কুঁচকালেন লোকটা। ফারজাদকে আপাদমস্তক পরখ করে বললেন,

‘কেন, আমার নামেও কেইস লেখাবে নাকি? আহাম্মেদ, আহাম্মেদ তাজওয়ার। যাও গিয়ে, পারলে আমার নামেও এখন একটা কেইস লিখিয়ে এসো।’

চলে গেলেন আহাম্মেদ তাজওয়ার। ফারজাদ এক জায়গাতেই স্থির। খালি ঠোঁট দুখানা কাঁপছে তার। কেবল বিরবির করে আওড়াছে, “আহাম্মেদ তাজওয়ার, আহাম্মেদ তাজওয়ার।”

চলবে…

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here