অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৪১।

0
433

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪১।

কলেজ থেকে ফিরছিল মৌমি। আজ রোদ পড়েছে বেশ। সে ঘেমেগেয়ে একাকার যেন। এইদিকে গাড়িও পাচ্ছে না কোনো, হেঁটে যেতেও তাই বেগ পোহাতে হচ্ছে ভীষণ। পথিমধ্যে গিয়ে থামল সে। আশেপাশে দেখল, যদি কোনো গাড়ি পাওয়া যায়। কিন্তু না, আজ এই রাস্তায় গাড়ি পাওয়া দুষ্কর ঠেকেছে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাকি রাস্তা হেঁটে যাওয়া’ই বোধ হয় তার ভবিতব্য।
রাস্তার ঠিক ডানে হাঁটছিল সে। সাঁ করে একটা সি.এন.জি এসে সামনে থামল তার। আচমকা কিছু ঘটে যাওয়ায় সে ঘাবড়াল। পেছন ফিরে সি.এন.জি দেখে রেগে গেল খুব। নাক মুখ কুঁচকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একজন পরিচিত মানুষ। তাকে দেখা মাত্রই মৌমির কুঁচকানো চোখ মুখ তার পূর্বের রূপ ফিরে পেল।
নীহাল তাকে দেখে প্রসন্ন হেসে বলল,

‘বাসায় ফিরছিলেন না-কি?’

মৌমিও কিঞ্চিৎ হাসল। জবাবে বলল,

‘জি।’

‘চলুন তবে, আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসি।’

মৌমি খুশি হলো এই ভেবে যে, তাকে আর হেঁটে যেতে হচ্ছে না। সে গাড়িতে উঠে বসল। পাশে বসল নীহাল। দূরত্ব রাখল বেশ। সি.এন.জি চলছে আপন গতিতে। বাতাসে শান্তি পাচ্ছে মৌমি। চোখ বোজে বসে আছে। নীহাল জিজ্ঞেস করল,

‘কীসে পড়েন?’

‘কলেছে, দ্বিতীয় বর্ষে আছি।’

‘ওহহ।’

তারপর কিছুক্ষণ নীরবতা। মৌমি খানিক পরে নিজ থেকেই জিজ্ঞেস করল,

‘একটা কথা বলি?’

‘বলুন।’

‘আপনি আবার কিছু মনে করবেন না তো?’

‘না না, বলুন।’

মৌমি আমতা আমতা করে বলল,

‘কেইসটা শেষ হয়ে গেলেই কি আপনারা বাংলাদেশে ফিরে যাবেন?’

‘জি।’

‘আর আসবেন না এখানে?’

নীহাল তার দিকে চেয়ে হাসল। বলল,

‘আপনার বিয়েতে আসব না হয়।’

মৌমি ভ্রু কুঁচকাল। বলল,

‘আমার বিয়ের কথা আসছে কোথ থেকে? আমি তো বিয়ে করছি না।’

‘আচ্ছা তবে, ফারজাদের বিয়েতে আসব।’

মৌমি তখন হেসে বলল,

‘তখন আর আপনাকে আসতে হবে না, আমরাই যাব বরং।’

বুঝল না নীহাল। জিজ্ঞেস করল,

‘মানে?’

‘মানে আপনি বুঝবেন না।’

‘বুঝিয়ে বলুন, তাহলেই তো হয়।’

মৌমি আসকারা পেয়ে খানিকটা এগিয়ে এসে বলল,

‘আপনি কি খুব রাগী?’

নীহাল কপাল কুঁচকে বলল,

‘হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?’

‘না, যদি আমার কোনো কথায় আপনি রেগে যান; তাই আগে থেকেই জেনে নিচ্ছি। রাগী হলে বলব না কিছু।’

মেয়েটার কথা বলার ধরণ দেখে নীহালের হাসি পায়। সে বলে,

‘নির্দ্বিধায় বলে ফেলুন।’

মৌমির মন নেচে উঠল। ভাবল, কথাটা একবার তাকে বলা যেতে পারে, যদি দুয়ে দুয়ে চার মিলে যায়।

সে খানিক রয়ে সয়ে বলল,

‘ফারজাদ ভাইয়াকে আপনার কেমন লাগে?’

প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে নীহাল বলল,

‘কেমন লাগবে আবার? ভালো ছেলে ভালোই তো লাগবে।’

‘আহা, ছেলে হিসেবে না তো। বোনজামাই হিসেবে কেমন লাগে?’

এবার একটু বেশিই ভ্রু কুঁচকাল নীহাল। মৌমির কথার উপযুক্ত অর্থ মেলানোর চেষ্টা করল। কয়েক পল ভেবে বলল,

‘কীসব বলছেন আপনি?’

‘বলছি যে, আমার প্রিয়তা আপুকে ভাবিজান হিসেবে ভীষণ পছন্দ। এখন আপনার ভাইয়াকে বোনজামাই হিসেবে পছন্দ হলেই হয়ে যাবে।’

নীহাল হতবাক হয়ে চেয়ে আছে। কী বলবে বুঝতে পারছে না। এই মেয়ের মাথায় এসব ঢুকল কী করে। সে নিজের মাথা চাপড়ে বলল,

‘আপনার মাথায় এমন অদ্ভুত চিন্তা কোথ থেকে এল? আপনি ফারজাদ আর প্রিয়তার বিয়ের কথা ভাবছেন?’

মৌমি উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল,

‘জি জি।’

নীহাল ডানে বামে মাথা নাড়াল। ততক্ষণে মৌমিদের বাসার সামনে চলে এসেছে তারা। গাড়ি থামল, নেমে দাঁড়াল মৌমি। বলল,

‘আমাকে ভেবে জানাবেন কিন্তু।’

নীহাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ঘুম দিন, ম্যাডাম; আপনার মাথা ঠান্ডা হওয়া প্রয়োজন।’

সে ড্রাইভারকে গাড়ি ঘুরাতে বলল তারপর। মৌমি চেয়ে রইল। অদ্ভুত ভাবে, নীহালের মুখে “ম্যাডাম” ডাকটা তার পছন্দ হলো বেশ।

___________

পরদিন সকালেই কোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিল নীহাল আর প্রিয়তা। যাওয়ার আগে ফারজাদকেও জানিয়ে গেল। ফারজাদও তৈরি। দিলরুবা বেগম জানালেন, তিনিও যেতে চান সাথে। কিন্তু ফারজাদ নেবে না। কেন নেবে না, সেই কারণ একমাত্র সে’ই জানে। দিলরুবা বেগম জোর করেও ফারজাদকে রাজি করাতে পারলেন না আর।

ফারজাদও বেরিয়ে পড়ল কোর্টের উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়েই নীহাল আর প্রিয়তার সাথে দেখা করল। প্রিয়তার বিষন্ন, উদ্বিগ্ন চোখ মুখ। কেমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে তাকে। নীহাল তাকে সাহস দিচ্ছে ক্রমাগত। এখন এসে যোগ হয়েছে ফারজাদও। সেও আসার পর থেকে প্রিয়তাকে আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই সেখানে এসে হাজির হয় আফসার খান। গাড়ি থেকে নেমে চশমাটা খুলে তার সহকারীর হাতে দেয়। এগিয়ে এসে যুক্ত হয় নীহালদের সাথে। মাঝেই একবার গভীর মনোযোগে প্রিয়তাকেও পর্যবেক্ষণ করে নেয়। প্রিয়তার চঞ্চল চোখ জানান দেয়, তার মনটা অস্থির ভীষণ। আফসার এই অস্থিরতার কারণ বোঝে। তাই আর সেসব কথা না তুলে বলল,

‘আপাতত আমার কাছে তিনজন শক্ত স্বাক্ষী রয়েছে। একজন তো ভিকটিম নিজেই, আর দুজন প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ স্বাক্ষী। ফারজাদ, আপনার মা’কে আনেননি কেন? উনি থাকলে তো আমার হাত আরো মজবুত হতো। শুরু থেকে তো প্রিয়তার সাথে তো উনিই ছিলেন।’

ফারজাদ ইতস্তত বোধ করে। এখন তাদের কী করে বোঝাবে, মা’কে এখানে না আনার কারণ। নীহাল বলল,

‘আমার মনে হচ্ছে না আন্টির এখানে প্রয়োজন আছে, আর সব প্রমাণ তো আপনার হাতের মুঠোয়।’

‘তাও ঠিক অবশ্য।’

আফসার আরো একবার ফাইলগুলো চেক করল সব। কিছু একটা দেখে কপাল কুঁচকাল সে। অবাক হলো। ফারজাদের দিকে চেয়ে বলল,

‘একটা জিনিস তো আমাকে বেশ অবাক করেছে, ফারজাদ। আপনার আর ওয়াদির নামের পদবী এক। দুজনেই তাজওয়ার বংশের। অদ্ভুত!’

আফসারের এই কথা শুনে প্রিয়তা আর নীহাল দুজনেই অবাক হয়। ভাবে, এটা কী নিতান্তই এক কাকতালীয় ব্যাপার, না-কি অন্যকিছু। ফারজাদ চুপ রইল। কী বলবে, কী বোঝাবে, সে বুঝতে পারছে না।

প্রিয়তা বলল,

‘এমন কি হতে পারে না? আমাদের এইদিকে তো একই বংশের নাম একাধিক পরিবার আছে।’

আফসার খানিকটা ভেবে বলল,

‘তবে পাকিস্তানে বাবার নামটাই সন্তানদের পদবী হয়।’

প্রসঙ্গটা আরো একটু ঘোলাটে হওয়ার আগেই ভেতর থেকে ডাক পড়ল তাদের। আফসার দ্রুত পায়ে ছুটল সেদিকে। বাকি তিনজন হাঁটল তার পেছন পেছন। প্রিয়তা তখন অত না ভাবলেও এখন হুট করেই চিন্তায় এল, “আসলেই তো, পদবীতে এত মিল কী করে?”

অনেক হৈ চৈ, অনেক বিচার বিবেচনার পর এবার রায় দেওয়ার পালা। প্রিয়তার হাত পা ঠান্ডা বরফ যেন। তার ঠিক সামনেই কাঠগড়ায় তার প্রিয় মানুষ, যে তাকে ভীষণ অপ্রিয় অসুখে রেখেছে। নীহাল প্রিয়তার হাত চেপে ধরে আছে শক্ত করে।
বেশ কিছুটা সময় নিয়ে জর্জ তাঁর রায় পেশ করলেন। ওয়াদিকে তার অন্যায়ের শাস্তি স্বরূপ পঁচিশ বছরের জেল, আর পঞ্চাশ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
তাতেও মনঃপূত হলো না আফসারের। শাস্তির মাত্রা আরো একটু বাড়াতে পারলে হয়তো শান্তি পেত সে।

ওয়াদিকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো। আহাম্মেদ তাজওয়ার তার সাথেই। ছেলেকে বোঝাচ্ছেন, তিনি তাকে ছাড়িয়ে নিবেন। ওয়াদির চোখ মুখ বিধ্বস্ত। সে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রিয়তা, নীহাল আর ফারজাদকে দেখছে। রাগ যেন আর ধরছে না তার। ফারজাদের গুলি লাগার পরও বেঁচে যাওয়াটা সে মেনে নিতে পারছে না কোনোমতেই। সে বাবার কানে কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

‘আব্বু, তুমি শুধু ঐ ফারজাদকে খু ন করে ফেল, আমার আর কিচ্ছু চাই না।’

আহাম্মেদ তাজওয়ার ফারজাদের দিকে চাইলেন। ফারজাদের প্রতি মনে এমনিতেই তার ক্ষোভ অনেক, আজকের পরে সেটা তো আরো কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে।

ওয়াদিকে পুলিশের গাড়িতে করে আবার থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। আহাম্মেদ তাজওয়ার চোয়াল শক্ত করে আঁড়ালে দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে একটা বন্দুক। সময় করেই এই বন্দুক তাক করবেন তার শত্রুর দিকে। ফারজাদ, নীহাল, প্রিয়তার আর আফসার কথা বলছে। সব কাজ শেষ এবার প্রিয়তা আর নীহাল দেশে ফিরবে। তার আগেই আফসার আজ দুপুরে তার পক্ষ থেকে একটা খাবারের দাওয়াত দিল তাদের। রাজীও হলো তারা। আহাম্মেদ তাজওয়ার অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও নিজের লক্ষ ঠিক রাখতে পারেননি। কেন যেন গুলিটা আর করতে পারেননি তিনি। বন্দুকটা পকেটে পুরে বললেন,

‘হয়তো আজ হায়াতে বেঁচে গেলি, কাল আর বাঁচতে পারবি না।’

চলবে….

(অধৈর্য হবেন না, পাঠকমহল। আর কয়েকপর্ব পরেই কাহিনীর মোড় ঘুরে যাবে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here