অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৪২।

0
443

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪২।

রেস্টুরেন্টে খেতে এসেছে সবাই। ট্রিট’টা আফসারের পক্ষ থেকে। ফারজাদ একা আসেনি, আফসারের অনুরোধে মা আর বোনকেও এনেছে সাথে। সবাই একই টেবিলে বসে আজ আড্ডায় মেতেছে খুব। অনেকদিন পর প্রিয়তার মন আজ ভীষণ হালকা। মনের চাপা কষ্টকে চেপে রেখেই সে আজ হাসছে, আর এভাবেই হাসবে। প্রিয়তার পাশেই মৌমি। আড়চোখে অযথাই বারবার দেখছে নীহালকে।
দিলরুবা বেগম আজ ভীষণ খুশি। ওয়াদি শাস্তি পেয়েছে, প্রিয়তাও অবেশেষে পেয়েছে মুক্তি। সবার মুখে তৃপ্তির হাসি, মনে হলো যেন সবগুলো তাঁর’ই ছেলেমেয়ে।

খাবার এল। আফসার নিজের হাতে বেড়ে দিল সবাইকে। তার আচরণে বরাবরই সবাই খুশি, এত বড়ো একজন উকিল হয়েও অহংকার দেখাচ্ছে না কোনো। প্রিয়তার প্লেটে খাবার বাড়ার ক্ষেত্রে যত্নটা যেন একটু বেশিই দেখা গেল তার। খাবার বেড়ে টিস্যুটাও এগিয়ে দিল তাকে।

সবাই খাচ্ছে, তার মাঝে প্রিয়তার সম্পর্কে সবকিছু জানল সবাই। এতদিন এখানে ছিল, কিন্তু এত ঝামেলার মাঝে নাম আর পরিবারের পরিচয় ব্যতিত আর কিছুই কেউ জানে না। প্রিয়তা তার পড়াশোনার ব্যাপারে বলল। তার পরিবার, বন্ধু বান্ধব সবার গল্প করল। আফসার মুগ্ধ হয়ে শুনল সব।
এর মাঝেই ঘটল আরেক ঘটনা। খাবার নিতে গিয়ে ভুল ক্রমে মৌমির সাথে হাতের ধাক্কা লেগে প্রিয়তার খাবার ফারজাদের শার্টের উপর পড়ে যায়। আচমকা এমন কাজে প্রিয়তা হকচকিয়ে উঠল। ফারজাদ রেগে যাবে সে ভয়ে ঘাবড়াল সে। দ্রুত একটা টিস্যু নিয়ে নিজ থেকে পরিষ্কার করতে উদ্যত হলো। ফারজাদ অস্বস্তিতে পড়ল যেন। বলল,

‘সমস্যা নেই, প্রিয়তা; আমি পরিষ্কার করে ফেলব।’

প্রিয়তা অপরাধবোধের খাতিরে নিজ থেকেই পরিষ্কার করে দিল তাও। সাথে ইতস্তত সুরে ক্ষমা চাইল বার কয়েকবার। আফসারের এই দৃশ্য মোটেও পছন্দ হলো না। সে ভ্রু কুঁচকে বেশ কিছুক্ষণ সময় চেয়ে ছিল প্রিয়তা আর ফারজাদের দিকে।

মৌমির বরাবর চেয়ারে নীহাল বসা। সে এই দৃশ্য দেখে নীহালকে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘দেখেছেন, কত কেয়ার! এইজন্যই বলেছিলাম। আপনি তো আর কিছু জানালেন না।’

নীহাল কোনো উত্তর না দিয়ে চোখের ইশারায় খেতে বলল তাকে।

সবার খাওয়া দাওয়া শেষ হলো। বিল মেটাতে গেল আফসার। প্রিয়তা এখনো ফাঁকফোকড়ে ফারজাদের কাছে ক্ষমা চাইল আরো কয়েকবার। ফারজাদ বোঝে না, মেয়েটা অল্পতেই এত ক্ষমা চায় কেন।

কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছেন দিলরুবা বেগম। দূর থেকে দাঁড়িয়ে ফারজাদ আর প্রিয়তাকে দেখছেন। ছেলে মেয়ে দুটোকে দারুণ মানাচ্ছে এক সাথে। তিনি চট চরে সিদ্ধান্ত নিলেন, প্রিয়তা বাংলাদেশে ফিরলেই তিনি তার মা বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবেন। প্রিয়তার চেয়ে যোগ্য মেয়ে আর পাবেন না তিনি।

রেস্টুরেন্ট ঢুকতে নিয়েও থমকে দাঁড়ালেন আহাম্মেদ তাজওয়ার। দরজার সম্মুখে ভীষণ পরিচিত এক মুখ দেখে কিছুক্ষণের জন্য হৃদকম্পন থেমে গেল যেন। তিনি ঢোক গিললেন। চোখে ভুল দেখছেন না তো? না না, এই মুখ ভুল হতেই পারে না। সেই তো পুরোনো চেহারা, ভীষণ মায়ামী দু’চোখ, যেই চোখে হয়তো কোনো একদিন আটকে ছিলেন তিনি। অদ্ভুত ভাবে আজও সেই চোখে মায়া রয়ে গিয়েছে পূর্বের ন্যায়। গালের চামড়া খানিকটা কুঁচকালেও চাকচিক্য তার মোটেও কমেনি। তিনি নিজ জায়গায় স্থির। খেয়াল করলেন একটা মেয়ে এসে কথা বলছে তাঁর সাথে। তাঁকে “আম্মি” বলে সম্বোধন করছে। আহাম্মেদ তাজওয়ার হকচকালেন। তাঁর মেয়ে, মৌমি; কত বড়ো হয়ে গিয়েছে। ব্যাপারটা আরো একটু চমক দিল তাকে যখন একই জায়গায় তিনি তার শত্রুদের সবাইকে একসাথে দেখলেন। চিন্তা এল, এখানে একসাথে কেন সবাই?

ফারজাদ মায়ের কাছে এগিয়ে এসে বলল,

‘এবার আমাদের যেতে হবে, আম্মি।’

ফারজাদের মুখ থেকে “আম্মি” ডাক শুনে এবার যেন আকাশ থেকে পড়লেন আহাম্মেদ তাজওয়ার। হতভম্ব হলেন। নিষ্পলক চেয়ে ভাবলেন, “ফারজাদ তাঁর ছেলে? তাঁর সেই ছোট্ট ফারজাদ? তিনি কি-না আজ নিজের ছেলেকেই খু ন করতে যাচ্ছিলেন?” আহাম্মেদ তাজওয়ারের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। সবকিছু গোলমাল লাগছে তাঁর। তিনি আর ভেতরে প্রবেশ না করেই চলে গেলেন। এক ছেলের কথা রাখতে আরেক ছেলেকে মারতে যাচ্ছিলেন তিনি, এই চিন্তাটা যেন তাঁকে কুরে খাচ্ছে।

নিচে নামল সবাই। যার যার গাড়ি দেখছে। মৌমি তখন চট করে নীহালের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,

‘আমার কিন্তু আজ রাতেই উত্তর চাই।’

নীহাল ভ্রু কুঁচকে তার দিকে চেয়ে বলল,

‘আপনি তো আচ্ছা জ্বালাতন করছেন।’

মৌমি ঠোঁট চেপে হেসে বলল,

‘আমার কথায় রাজি হয়ে যান, আর জ্বালাব না।’

নীহাল পরবর্তীতে কিছু বলার আগেই দিলরুবা বেগম মৌমিকে ডাকলেন। ফারজাদ গাড়ি ডেকে এনেছে।
নীহাল আর প্রিয়তাকে আফসার নামিয়ে দিবে। তারা আফসারের গাড়িতে উঠে বসল। হোটেলে পৌঁছাতে সময় লাগল না বেশিক্ষণ। সবাই নামল একসাথে। আফসার নীহালকে বলল,

‘আমার আপনার সাথে একটু কথা আছে, নীহাল।’

নীহাল বলল,

‘জি, বলুন।’

আফসার প্রিয়তার দিকে চাইল। প্রিয়তাও প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চেয়ে আছে তার দিকে। আফসার বলল,

‘প্রিয়তা আপনি রুমে যান, আমি আপনার ভাইয়ের সাথে একটু একা কথা বলতে চাই।’

একগাদা প্রশ্ন আর দুশ্চিন্তার ভান্ডার সাথে নিয়ে প্রিয়তা একাই ফিরল তাদের রুমে। আফসারকে নিয়ে নীহাল গিয়ে বসল লবিতে। বলল,

‘এবার বলুন, আফসার।’

আফসার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব না দেখিয়ে সরাসরি বলল,

‘আমি আপনার বোনকে বিয়ে করতে চাই, নীহাল।’

নীহালের মুখের চোয়াল ঝুলল। আফসারের কথা শুনে সে আকাশ থেকে পড়েছে যেন। কাল একবার মৌমির কথা শুনে এমন অনুভূত হয়েছিল তার। বোনকে নিয়ে তো বিবাহ বিড়ম্বনায় পড়ল বেচারা। আফসার উত্তর না পেয়ে বলল,

‘কিছু বলছেন না কেন, নীহাল?’

নীহাল ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলল। কী বলবে বুঝতে পারছে না। ঐদিকে মৌমিও অধীর আগ্রহে তার উত্তরের অপেক্ষায়। আর এখন আবার যুক্ত হলো নতুন একজন। সে ক্ষীণ সুরে বলল,

‘এখানে আর কী বলার আছে, আফসার? প্রিয়তা এখনো এই ট্রমা থেকে বের হতে পারেনি, আমার মনে হচ্ছে না ও এখনই বিয়ের ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক চোখে দেখবে।’

‘আমি এখনই বলছি না। আমি এখন কেবল একটা অঙ্গীকার চাই যে, আপনি আপনার বোনকে আমার আমানত হিসেবে আপনাদের কাছে রাখবেন, যতদিন পর্যন্ত না ও স্বাভাবিক হচ্ছে। প্রিয়তা পুরোপুরি স্বাভাবিক হবার পরই আমাদের বিয়ে হবে, তার আগ পর্যন্ত আমি ব্যতিত যেন অন্য কোনো পুরুষ ওর জীবনে না আসে, আমাকে এইটুকু আশ্বাস দিলেই হবে।’

নীহাল পড়ল মহা ফ্যাসাদে। সে ভ্রু চুলকে বলল,

‘এই নিশ্চয়তা আমি কীভাবে দেই, বলুন? প্রিয়তার জীবন, সেই জীবনে ও কাকে বেছে নিবে সেটা ওর সিদ্ধান্ত, আমি বা আমরা তো ওর উপর কিছু চাপিয়ে দিতে পারব না।’

‘একবার নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে কত বড়ো ভুল করেছে দেখেছেন তো, সেই ভুল আবার হোক, সেটা নিশ্চিয় চাননা? আর সবথেকে বড়ো কথা আমার প্রিয়তাকে ভীষণ পছন্দ, আমি ওকে সুখি রাখার নিশ্চয়তা দিতে পারব।’

নীহাল দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,

‘একটা কাজ করুন, আপনি এই কথাগুলো প্রিয়তাকে গিয়ে সরাসরি বলুন। ও রাজি হলে আমাদেরও কোনো আপত্তি থাকবে না।’

আফসার কিঞ্চিৎ হেসে বলল,

‘ঠিক আছে তবে, কালই আমি ওর সাথে কথা বলব। আজ উঠছি।’

আফসার চলে যেতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল নীহাল।

চলবে….

ছবি: রত্নাবু❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here