চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা #ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া #পর্ব-৫৫

0
221

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৫৫
১৪৯.
ডাক্তার রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই অর্পন ছুটে আসে।ডাক্তারের কথা অনুযায়ী পুতুলের অপারেশন করতে হবে এবং সেটা খুব শীঘ্রই।অর্পন ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলে বলল,

অপারেশন কখন শুরু করবেন।

আগামীকাল রাতে অপারেশন শুরু হবে।আজ রেস্টে থাকবে।

আচ্ছা ডাক্তার আপনি আপনার কাজ করুন।আমি যদি না ওহ থাকতে পারি।আমার পরিবার থাকবে।ইনফেক্ট আজকে তাদের লন্ডনে আসার কথা।কোনো সমস্যা হলে আপনি তাদের জানাবেন।ডক্টর চলে যেতেই অর্পন মা’কে ফোন করে।

রাবেয়া জানান তারা এই মাত্র লন্ডন এয়ারপোর্টে আছে।অর্পন হাসপাতালের ঠিকানা।আর এই মুহূর্তের অবস্থানের কথা জানালো।তারা ড্রাইভার দিয়ে জিনিস পত্র অর্পনের ফ্ল্যাটে পাঠাতে ব’লে নিজেরা অন্য গাড়িতে করে হাসপাতালে রওনা হলো।

দরজা খুলে অর্পণ ভীরু পায়ে রুমে প্রবেশ করে।নিজের এত কাছে কারো নিশ্বাসের উপস্থিত পেতেই পুতুল চোখ মেলে তাকায়।হাত বাড়িয়ে স্বামী গাল ছুয়ে দিয়ে জানতে চায় সে ঠিক আছে কি না।অর্পন নিজের গাল থেকে পুতুলের হাতটা নামিয়ে শক্ত করে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

আমি ঠিক আছি।তুমি আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না।আব্বু,আম্মু আসছে।এখন থেকে তোমার পাশে তারা থাকবে সবসময়।অর্পনের কথায় পুতুল চুপচাপ সবটা শুনতে লাগল।কোনো প্রত্তিউত্তর করে নিই।

চোখ বুঝে ঘুমাও।আমি তোমার পাশেই আছি।অর্পণের কথায় পুতুল চোখ মেলে রাখতে চাইলেও পারিনি।ঘুমের ইনজেকশন ডক্টর আরো আগেই পুশ করে দিয়েছিল।তাই না চাইতে ঘুমে তলিয়ে যায়।পুতুল ঘুমিয়ে গেলে।অর্পণ তার কপালে চুমু বসিয়ে আস্তে আস্তে হাত হালকা করে নেয়।

রুম ছেড়ে বাহিরে বের হতেই মায়ের মুখোমুখি হয়।মা’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।রাবেয়া ছেলের শুকনো মুখটা দেখে ভীতু হয়ে পড়েন।ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,

আমার আব্বুটার কি হয়েছে?

অর্পন মায়ের কথার উত্তর দেয়নি।বরং মায়ের কপালে দ্বিতীয় চুমু বসিয়ে বলল,

আমি বাড়িতে যাচ্ছি।কিছু প্রয়োজনী জিনিসপত্ত আনতে।তোমরা ওর পাশে বসো।

তাহলে আমিও যাই তোর সাথে।

না বাবা।তুমি মায়ের সঙ্গে থাকো।তোমার পুতুল আর মায়ের সঙ্গে থাকাটা বেশি প্রয়োজন।আমি যাব আর আসব।অসীম তালুকদারকে জড়িয়ে ধরে।কয়েক মিনিট পর ছেড়ে দিয়ে নিজেই হাঁটতে হাঁটতে আরাভ খান এর বর্ডিগাডদের বলল,

-চলুন!অর্পন চলে যাওয়ার পর একবার পিছন ফিরে তাকায় নিই।

ছেলের এমন কাজে রাবেয়া চিন্তিত হয়ে পড়ে।মনে মনে আল্লাহকে ডাকেন।তার সন্তানের কোনো ক্ষতি না হোক।

আরাভ এর ডেরায় অর্পণ দাঁড়িয়ে আছে।আরাভ খান পায়ের ওপর পা তুলে অর্পণকে পরক্ষ করছে।ছেলেটা তার কথা রেখেছে।

মিস্টার আরাভ খান আমি প্রস্তুত।শুট হিম।

আর ইউ শিয়র।ভেবে বলছো?

হুম।আমি আপনার কথার খেলাফ করিনি।জীবনে সব পাওয়ার আশা আকাঙ্ক্ষা হাতে মুঠোয় নিয়ে মরতে এসেছি।আমি জানি।আমি কারো সাথে কোনো অন্যায় করিনি।সব সময় চেষ্টা করেছি সবাইকে ভালো রাখার।সবাইকে নিয়ে বাঁচার।জীবনের প্রাপ্তির খাতায় কি পেয়েছি?সেইসব মনে করতে চাই না।তবে আমার লক্ষ্য আমার পরিবার কিংবা আমার ভালোবাসা মানুষটির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইনি।দশের ভালো করতে এবং ভালো রাখার প্রচেষ্টায় রাজনীতির মাঠে নামি।
রাজনীতি আমার রক্তে মিশে গেছে।তাই চাইলেও ছুড়ে ফেলতে পারিনি।আজকে আমি যতটুকু করেছি।আমার জনগনের কথা চিন্তা করেই সাফল্যের প্রথম কয়েকধাপ পার করার পর পরই সবার রংচঙ দেখতে পাই।আমাকে সরাতে যেখানে আমার আপন মামা জড়িত।আমার রাজনীতি মাঠের লোকেরা যেখানে বিশ্বাসঘাতকতা করছে।সেখানে আপনাকে কি বলব?মরতে আমি ভয় পাই না।রাজনীতি মাঠে নামার সময় শপথ নিয়ে মাঠে নেমেছি।দেশে এবং দশের ভালো করতে গিয়ে যদি আমার প্রাণ যায় তো যাক।তবে আপসোস আমি আমার দেশকে একটি সুন্দর এবং উন্নয়ন অধ্যায় দিয়ে যেতে পারব না।

যদি তোমাকে সে সুযোগ দেওয়া হয়।তাহলে দেশের মাটিতে পাপী দের ধ্বংস করে ফেলতে পারবে।দেশের মাটিতে সাধারণ মানুষের এক মুঠো সুখ ফিরিয়ে দিতে পারবে।বর্তমান বাজারে যে যাকে পারছে লুটপাট করে খাচ্ছে।এই দেশে জোর যার মুলুক তার।ধনীদের পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে মরছে গরিব।গরিবের কষ্ট দেখার কেউ নেই।পারবে দেশ শাসন করে সৈরাচারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে।পারবে বাঙালির মুখে এক মুঠো হাসি ফিরাতে।

যদি বলি পারব!

এতটা কনফিডেন্স ভালো নয়।বুঝে শুনে কথা বলো।

অর্পণ তালুকদার পারবে।তার মায়ের দোয়া তার মাথার ওপর সব সময় রয়েছে।বাবা-র ছায়া তার পিছু।বাবা নামক বটগাছের আবরণে তার শরীর ঢাকা।আর তার বউয়ের চোখে তার জন্য তৃষ্ণা।যা এ জম্মে মিটবে না।বউটা তার একটু ভালোবাসা পেতেই ভীষণ খুশি।মেয়েটি তাকে বড্ড ভালোবাসে।

অর্পণের কথা শেষ হতেই তার কাঁধে আরাভ খান হাত রাখে।মুচকি হাসি ফুটিয়ে বলল,

যা-ও দেশের মাটিতে ফিরে।শেষ কর আসো পাপী দের।তাদের বিনাশ করায় তুমি মুক্ত।তোমাকে শুট কিংবা প্রানে মারলাম না।একজন বেঁচে যদি দেশ টাকে অমানুষগুলোর হাত থেকে বাঁচাতে পারে তবে ক্ষতি কি?কোনো ক্ষতি নেই।

আরাভ খান এর কথায় অর্পণ চমকে উঠে।পুরো বিষয়টা বুঝতেই মুখে হাসি ফুটে।আরাভ খান তার বক্তব্য জানিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়।আর অর্পন নিজের দায়িত্ব পালন করতে ফিরে যায়।গাড়িতে বসে ভাবতে থাকে।তাঁকে দেশে ফিরতে হবে।এখন সে নিশ্চিতে যেতে পারে।মা এবং বাবা তার বউয়ের পাশে রয়েছে।তারা ওর দেখভাল সুষ্ঠুভাবেই করবে।কিন্তু সে এ-ই মুহূর্তে রওনা না হলে তার মামা এবং রাজনীতির চেনা মাঝে অচেনা শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারবে না।অনেক হয়েছে ছাড় দিতে দিতে মাথায় উঠেছে।এবার তা নামিয়ে ফেলা দরকার।

১৫০.

অর্পন আজ রাতের টিকিট কে*টে কাউকে না জানিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখার জন্য রাত বারোটায় এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেলো।এইদিকে পুতুলের কোনো হুস নেই।সে ঘুমে বিভোর।সকাল হতে এখনো রাতের অর্ধেক প্রহর বাকি।এইদিকে রাবেয়া হাতের ফোনে ছেলের নামে একটা মেসেজ আসে।যেখানে অর্পন এর গুটিকয়েক শব্দ লিখা রয়েছে।

আসসালামু আলাইকুম আম্মু।আমি চলে যাচ্ছি!শেষবার আপনাকে একবার ব’লে না যাওয়া আমি দুঃখিত। আর ব’লে ওহ আপনি আমায় কখনোই যেতে দিবেন না।তাই না জানিয়ে দেশের মাটিতে ফিরছি।কেনো ফিরছি?কি কারণে ফিরছি?হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছেন।যাই হোক। আপনারা ওর পাশে আছেন।আমি এক দিক দিয়ে শান্তি পাচ্ছি।অন্য দিক দিয়ে কষ্ট লাগছে। এটা হয়তো আমার শেষ কথা।বেঁচে থাকলে অবশ্যই আপনার কাছে ফিরে আসব আর যদি কিছু হয়ে যায়।আব্বু,আপনার যত্ন নিবেন।আর আমার আমানতকে হেফাজতে
রাখবেন।তার সব সপ্নগুলো পূর্নতা পাক।তাকে আমার বিষয়ে এই মুহূর্তে কিছু বলবেন না।সে মানসিক চাপের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে আমার কথা ব’লে তার ক্ষত আর বাড়াবেন।সে দেশে ফিরে আজ না হয় কাল জেনে নিবে।এখন জানলে তার ক্যারিয়ার।তার না বলা কথাগুলো বন্ধ পড়ে রবে।সে লন্ডন থাকতে চাইবে না।তাই আপনার কাছে আমার বিশেষ অনুরোধ তাকে এখন সত্যিটা বলবেন না।সময় করে পরে ব’লে দিয়েন।সবাই ভালো থাকবেন।

ইতি আপনার আদরের সন্তান অর্পণ তালুকদার।

পাঁচ বছর পর…

অভিনন্দন পুতুল।তোমার স্বপ্ন আজ অবশেষে সত্যি হলো।ফাইনালি তুমি ডাক্তার হলে গেলে।তোমার জন্য আস্ত ভালোবাসা জানেমান।রুমি কথায় পুতুল চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।রুমি, পুতুলের ক্লাসমেট।একসাথে পড়াশোনা শেষ করলো।

পুতুলের গায়ে ডাক্তারী এপ্রোন।সবাই তাকে নিয়ে কত খুশি।রাবেয়া তালুকদারের বুকটা গর্বের ভরে গেলো চোখের পানিটুকু লুকিয়ে বলল,

আম্মু বাসায় চলেন।পুতুল নিজের এপ্রোন খুলতে খুলতে গাল ফুলিয়ে বসে রইলো।

যার মানে সে যাবে না।বাংলাদেশে সবার সাথে তার যোগাযোগ হয়।কিন্তু যে মানুষটা তার জীবনে না আসলে লক্ষ্য অবধি পৌছাতে পারতোনা।সে মানুষটা কথা ব’লেই সবাই চুপ হয়ে যায় কেন?তারা কেন বুঝতে চায় না।পুতুল তার স্বামীকে দেখতে চায়।কথা বলতে চায়।তার দুই চক্ষে অনেক তৃষ্ণা।এই সময় যত গড়িয়ে যাচ্ছে।ততোই পুতুলের তৃষ্ণা বাড়ছে।সে পাগলামি করছে।তাইতো পড়া শেষ হতেই দেশে ফিরে চাওয়ার বন্ধবস্ত কম্পিলিট।বাবাকে টিকিট কে*টে আনতে ব’লেছে।তিনি টিকিট নিয়ে এই আসলো ব’লে।পুতুল অপেক্ষা করছে।তার অপেক্ষা অবসান ঘটিয়ে অসীম তালুকদার গাড়ি থেকে নামতেই পুতুল ছুটে আসে।তার চোখের সামনেই বিডি টিকিট দেখাতেই মুখে চমৎকার হাসি ফুটে।

পুতুলের এই হাসি দেখে রাবেয়া দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে এগিয়ে আসে।পুতুল আজই রওনা হবে।তাই বাসায় পৌঁছে নিজের মতো করে সবকিছু গুছিয়ে নিতে ব্যাস্ত।এয়ারপোর্টে যাওয়ার পর অর্পণ তার এখানে আসার দিনগুলো চোখ বুঝে স্মরণ করতে লাগল।ইশ কি মিষ্টি অনুভূতি ছিল?যা এখনো তার মনে দোলা দেয়।

তিনদিন পর…

বাংলাদেশ নিজ গ্রামে সেই রাঙ্গা মাটির পথ।আঁকাবাকা কাঁচা মাটির রাস্তাগুলো আজ ইট পাথরের তৈরি হয়েছে।ক্ষেত খামারে জায়গায় নতুন নতুন বাড়ি ঘর উঠেছে।কত কিছু পরির্বতন হয়েছে এই পাঁচ বছরে।পুতুল নিজের গ্রামের দৃশ্যগুলো মনে করতে করতে নিজ মামুর বাড়িতে প্রথম পা রাখলো।সবার সাথে কথা শেষ করে,সাজুকে টেনে এক কিনারে নিয়ে গিয়ে তার স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করে।তার স্বামী কোথায়?

আপু,ভাইয়া আর নেই।সাজু কেঁদে দিল।চোখের পানি মুছে বলল,

তোমাকে ওখানে রেখে আশার পর এখানে অনেক কিছু ঘটে গেছে।আমি নিজের চোখে এই গ্রামে লা*শ দেখেছি।র*ক্তের স্রোত বয়েছে।আর ভাইয়াকে ওরা সবাই মিলে মিথ্যে মামলা ফাঁসিয়ে….!

সাজুর বাকি কথাগুলো তার কানে ঢুকে নিই।ভাইয়া আর নেই এই কথাটা বারবার কানে বাজছে।সে ধপ করে মাটিতে পড়ে গেলো।
পুতুলের এমন রিয়াকশনে রাবেয়া তাকে ছুঁতে চাইলে তাকে ছুঁতে দিলো না।পুতুল রাস্তার পথে দৌড় দিলো।পুতুলের এমন আচরণে সবাই ভয় পেয়ে যায়।

আপনি বিহীন আমার কিছু নেই।আমি অপূর্ণ।আমি শূন্য।আপনাকে দেখা’র জন্য আমার দুই চক্ষে যে তৃষ্ণা তা আমি কি দিয়ে মিঠাবো?আপনি এত নিষ্ঠুর প্রিয়তম কেন?কেনো আমায় একা ফেলে চলে গেলেন? একটিবার কি আমার কথা আপনার মনে পড়েনি?কি নিয়ে বাঁচব আমি।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here