ভয়_আছে_পথ_হারাবার ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম] ৩৯,,

0
321

#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

৩৯,,

দুপুরে খেতে বসে আনিস সাহেব গম্ভীর কন্ঠে খাবার টেবিলে উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে বললেন,

-গতকাল সন্ধ্যায় ইমনের বাড়িতে গিয়েছিলাম আমি।

ওনার কথাটা শুনে উপস্থিত সকলের মাঝেই নিরবতা। এর আগে একসাথে কাউকে ওনি পাননি৷ গতকাল রাতে এবং আজ সকালেও ওনি একা একাই ছিলেন। নাসীরা পারভীন রান্না করে রেখে চলে যেতেন। রাগে কাউকে তুলে খাওয়াননি। তুলিও নিজের মতো খেয়ে চলে যায়। তুষারও তাই। এই মূহুর্তে সকলকে একসাথে পেয়ে ওনি বলেই ফেললেন কথাটা। নাসীরা পারভীন আর অভিমান টেনে রাখলেন না। কৌতুহলী কন্ঠে বললেন,
-তুমি কেন দেখা করতে গেলে?

আনিস সাহেব গাল নাড়িয়ে গালে থাকা খাবারটুকু গিলে নিয়ে বললেন,
-সবকিছু পরিষ্কার হতে একবার তো অন্তত দেখা করা লাগতো।

তুলি ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
-কী বললো ও?

আনিস সাহেব হঠাৎই কন্ঠ পাল্টে রুক্ষ গলায় বললেন,
-ওই হারা** সাথে আর তোর ফিরতে হবে না। এখন নিজের ক্যারিয়ার তৈরি কর।

তুলি কিছু বলার আগে নাসীরা পারভীন তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললেন,
-কেন? কি হয়েছে?

-ও তুলিকে ইচ্ছা করেই তালাক দিয়েছে। একবারও কি নিজের ছেলেকে সত্যিই মনে হয়নি নিজের? এতো মিল বাপ ছেলের মধ্যে! ডিএনএ টেস্ট করতে পারতো না হলে। ছেলে নিজের না, এটা হলো অযুহাত। নিজের চরিত্রও তো ঠিক ছিলোনা। আমার মেয়ে অন্যায় করেছে সুযোগ দিতে পারতো। আমাদের, ওর মাকে বলে একটা বোঝাপড়া করতে পারতো। কিছু করেনি। ওই বদমাশটা আসলে আরেকটা বিয়ে করবে বলেই এসব করেছে। ওই অফিসের কলিগ মেয়েটাকেই বিয়ে করবে। তুলিকে আর ঘরে তুলবে না। ইশানকে ফেরত চেয়েছে। আমি একদম মানা করে দিয়েছি। যে ছেলের জন্ম নিয়ে ওর মনে সন্দেহ, ছেলে ফেরত নিয়ে কি যত্ন করবে নাকি? নতুন বউ নিয়ে থাকবে আর আমার নাতিটার কপাল পুড়বে।

কথাগুলো শুনে তুলির চোখজোড়া ছলছল করছে। তুলি সেখানে বসলো না আর। ছুটে চলে এলো নিজের রুমে। তবে এখানে এসেও শান্তি নেই। ইশান ঘুমাচ্ছে। ও জোরে কাঁদতেও পারবে না। আনিস সাহেব ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নাসীরা পারভীনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-ওকে বোঝাও। পড়াশোনা শেষ করুক, তারপর দেখা যাবে। ওই নোংরা ছেলেটার পায়ে ধরতে পারবোনা আমি আমার মেয়েকে নেওয়ার জন্য। আর আমার মেয়েকেও দেবোনা।

নাসীরা পারভীন কিছু বললেন না। চুপচাপ খাওয়ায় মনোযোগ দিলেন।

বিকালে তিলো এবং অরিক আশাকুঞ্জ এ আসে বিবাহ পরবর্তী মেয়ের বাড়ি ফেরার নিয়মে। নাসীরা পারভীন মুখে একটা হাসি নিয়ে সবদিক দেখলেও তিলোর সাথে ঠিকমতো কথা বলছেন না।
নাসীরা পারভীন রান্নাঘরে ঢুকলে তিলো পেছন থেকে গিয়ে ওনাকে জড়িয়ে ধরে। নাসীরা পারভীন বিরক্তি নিয়ে ওকে ছাড়তে বললেও ও বরং আরো শক্ত করে ওনাকে জড়িয়ে ধরে। তিলো আদুরে কন্ঠে বললো,
-রেগে আছো? কত্তোগুলো দিন পর আসলাম। আর তুমি আমার সাথে কথাও বলছো না?

-কতোদিন পর কোথায়? দুদিন হলো এবাড়ি ছেড়ে গেলি।

-ওই হলো। আমার কাছে সেটাই অনেক বছর! জানো, আমার কতো কষ্ট হয়েছে তোমাদের ছেড়ে থাকতে?

নাসীরা পারভীন ওকে আবারও ছাড়িয়ে নিতে গিয়েও পারলেন না। আরো বিরক্ত হয়ে বললেন,
-ঢং যতো! ন্যাকামি বন্ধ কর। আমার কথা তো তোর মনেও পড়েনা। নিজের সংসারে এতো ব্যস্ত! কথা বলিস কতোটুকু আমার সাথে?

-আরেহহ্। কি মিথ্যা কথা! আমি তোমাকে ফোন দিলে তুমি ঠিকমতো কথা বলো? এখন সব দোষ আমার?

-এখন তো বলবিই! একটা রাঙামূলা সামনে থাকলে কি আমার মতো বুড়ির কথা তোর মনে পড়ে?

তিলো মুচকি হেসে দুষ্টুমির সুরে বললো,
-এই মহিলা, তুমি অরিককে হিংসা করো নাকি?

নাসীরা পারভীন কিছু বললেন না। তিলো ওনার কাঁধ থেকে মুখ তুলে ওনার গোলগাল গালে একটা চুম্বন করে বললো,
-বলো বলো। তুমি ওকে হিংসা করো নাকি? এটা তো দারুণ! কেউ আমাকে নিয়ে কাউকে হিংসা করছে!! আমাকে কল্পনা করতে দাও, তোমার আর ওর মাঝে যুদ্ধ লেগেছে। তোমার অস্ত্র তোমার কাঠের খুন্তি আর ওর অস্ত্র বেতের লাঠি। কি দারুণ! আমরা সরাসরি একটা গৃহযুদ্ধ দেখতে পারবো। ডোন্ট ওয়ারি নায়িকা। আমি তোমার পক্ষ নেবো। সবাই নেবে। সত্যি বলছি।

নাসীরা পারভীন তিলোকে ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে বললেন,
-ফাজিল কোথাকার! এখন আমাকে পটাতে এসেছিস সারাদিন কোনো খোঁজ না নিয়ে। যা এখান থেকে। জ্বালাবি না আমাকে একদম। তোর জামাই নিয়ে থাক তুই।

তিলো খানিকটা ব্যথিত হলো ওনার কথায়। আদুরে চোখে ওনার দিকে তাকিয়ে মেকি কেঁদে বললো,
-যাচ্ছি চলে। বাড়ি থেকেই চলে যাচ্ছি। ভুলে যেও না, এখন আমার যাওয়ার জায়গা আছে। আগের মতো বলে কয়ে বাড়িতেই থাকবো না। অরিকের সাথে সারাদিন থাকি বলে তোমার হিংসা হয় তো। আরো হিংসা করো। হিংসায় জ্বলে যাও৷ পটকা মাছের মতো ফুলতে ফুলতে ফেটে যাও৷ আমি আর আসবো না। ওখেই বাই।

তিলো সত্যি সত্যি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে লিভিং রুমে এসে অরিকের হাত ধরে বললো,
-চলো এখান থেকে। আমি আর আসবো না।

তিলোর কথায় আনিস সাহেব ছোটখাটো একটা হার্ট অ্যাটাক করলেন বলে বোধ হলো। বিয়ের পরপর মেয়ের এতোটা পরিবর্তন!! আনিস সাহেব ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলেন,
-কি হয়েছে ছোটমা? এখনি চলে যাচ্ছিস কেন?

তিলো নাক টেনে বললো,
-তোমার বউকে জিজ্ঞাসা করো কেন? অরিক চলো।

নাসীরা পারভীনও ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছেন।

অরিক উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,
-বাবাজানা, কি হয়েছে বলবে তো?

কথাটা বলেই অরিক নিজের জিহ্বা কামড়ে ধরলো। তিলো চোখ রাঙিয়ে তাকালো ওর দিকে। আনিস সাহেব আর নাসীরা পারভীন বেশ বিব্রতবোধ করলেন। সবার সামনে এভাবে ডাকাটা একটু অস্বস্তিকর। তিলো কোনো কথা না বলে গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে যাওয়ার আগে নাসীরা পারভীন পেছন থেকে বললেন,
-যাও। চলে যাও। এখন তো এখানে তোমার মনই টিকবে না। আবার ন্যাকা ন্যাকা কথা। নতুন বাড়ি, নতুন মানুষ পেয়ে সব ভুলে যাচ্ছে। আসবে তো নাই। আসলেও সাথে সাথেই চলে যাবে।
আনিস সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-এখন এ বাড়ি থেকে কেউ বেরিয়ে গেলে কিন্তু সে যেন আর ফিরে না আসে। আসলেও আমি আর রান্না করে খাওয়াবো না। যত্তসব, একটু সুস্থ হয়ে বসতেও পারে না।

নাসীরা পারভীন আর কিছু না বলে রান্নাঘরে চলে গেলেন। তিলো পেছনে ফিরে আনিস সাহেবকে বললো,
-তুমি কি বাইরে থেকে খাবার আনতে পারবে না?

নাসীরা পারভীন রান্নাঘর থেকেই চিৎকার করে বললেন,
-এবাড়িতে বাইরের খাবার ঢুকবে না।

তিলো নিষ্পাপ একটা ভঙ্গিমা করে বললো,
-আব্বু, আমি কি চলে যাবো?

আনিস সাহেব হতাশ দৃষ্টিতে তিলোর দিকে তাকিয়ে বললেন,
-তুই কেন যাবি? যে ঝগড়া বাঁধিয়েছে সে যা…।

কথাটা শেষ করলেন না। নাসীরা পারভীনের কানে গেলে আরেক কান্ড বাঁধবে।
তিলো মুখ ভার করে সোফায় বসলো৷ অরিক আর আনিস সাহেব তা দেখে মুখ টিপে হেসে দিলো।

খাওয়ার সময় তিলোকে ডাকতেই সে উপস্থিত। সে আবার ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না। অরিকের আসতে দেরি হচ্ছে দেখে নাসীরা পারভীন তিলোর ঘরে গিয়ে দেখতে পান সে ফোনে কথা বলছে। নাসীরা পারভীন এমনিতে ওর উপর হিংসায় জর্জরিত। ওনি বাজখাই গলায় বলে উঠলেন,
-এই ছ্যামড়া, তোকে কি আলাদা করে নিমন্ত্রণ করা লাগবে? খেতে আয়।

অরিক ওনার অধিকার নিয়ে এমন ভঙ্গিতে ডাকায় হতভম্ব হয়ে গেলো। তিলোর সেদিনের মন খারাপ নিয়ে ওকে হুমকি দিয়ে ফোন করার পর নাসীরা পারভীন ওর সাথে ঠিকমতো কথা বলেননি। তিনি কি ভুলে গিয়েছেন, যে অরিক এখন কেবল তাঁর ভাসুরের ছেলে না। তাঁর মেয়ের জামাই। অরিকের মনে পড়ে না, নাসীরা পারভীন ওকে শেষ কবে ছ্যামড়া বলে ডেকেছেন। তবে এটুকু মনে আছে, অরিক যখন দশ বছরের ছিলো তখন খুব দূরন্ত ছিলো। কথা শুনতো না একদম। দাদাবাড়ীতে বেড়াতে গেলে, ওকে আর অভ্রকে রেখে ওর মা গিয়েছিলো পাড়া ঘুরতে। ওনার বাবার বাড়িও সেই এলাকায়। অরিকের পুকুরপাড়ে যাওয়া নিষেধ ছিলো। অভ্র আর, তিলো তুলিরও তাই। অরিক তা শোনেনি। বারবার সেখানে গেলে নাসীরা পারভীন কয়েকবার ওকে ধমকেছেন। ওনার রেগে গেলে ডাকের ধরণ, ছ্যামড়া-ছেমড়িতে নেমে যায়। অরিক যখন একদমই শোনেনি, নাসীরা পারভীন ওকে পাঁজা কোলা করে তুলে পানিতে ছুড়ে ফেলার অভিনয় করেন। অরিক আরো হেসে দেয়। নাসীরা পারভীন শেষে ওকে নিয়ে পুকুরে নেমে একসাথে ডুব দেন। বেশ কিছুসময় ডুবে থাকেন। সেটা ছিলো অরিকের প্রথম পুকুরে ডুব। নাকেমুখে পানি ঢুকে ওর অবস্থা খারাপ। পানি থেকে উঠে প্রায় কেঁদে দেয়। নাসীরা পারভীন ওকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আর আসবি এদিকে?’
অরিক মাথা নেড়ে সম্মতি জানালে, ওনি আবারও ওকে ডুব দেওয়ায়। এবার অরিক পুরো কেঁদে দিয়ে মাথা নেড়ে তাকে আশ্বস্ত করে যে, ও আর এদিকে আসবে না।

এরপর আর অরিকের মনে পড়ে না, কখনো নাসীরা পারভীন ওকে এভাবে বকেছেন বলে।

#চলবে

আজকের পর্বটাও বেশি ভালো হয়নি জানি। শুধু বলবো একটু ধৈর্য্য ধরুন।

গতকালকে আরেকটা নব্য প্রেমের সূচনা হয়েছে কেবল। হ্যাঁ, সোহা সানজিদের প্রণয় সম্পর্কের কেউ।

‘বাবাজানা’ শব্দটা ‘আমার প্রিয়’ বোঝাতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আমার খুব পছন্দের একটা উপন্যাসে এই শব্দটা খুঁজে পেয়েছি। আমার আবিষ্কৃত নয়।

আগামী কয়েকদিন ব্যক্তিগত ব্যস্ততার দরুন গল্প দিতে পারবোনা। দুঃখিত এজন্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here