#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]
৪০,,
রাতে খাওয়ার সময় তিলো ওর মাকে তুলির বিষয়ে সবার সামনেই জিজ্ঞাসা করলে নাসীরা পারভীন ইশারায় ওকে বলেন যে পরে বলবেন সব। তুলিকে আসার পর থেকে তিলো একবারও দেখেনি। স্বাভাবিকভাবেই কৌতুহল হয়েছিলো। খাওয়া শেষে তিলোকে সব বললেও ও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। এমনটা হওয়ারই ছিলো, এমন ভঙ্গিতে সে নিজের রুমে চলে গেলো।
দরজা আটকানোর শব্দ পেয়েও অরিক সেদিকে তাকালো না। সে নিজের ফোনে মুখ গুঁজে বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। তিলো ওর পাশে উঠে বসে ওর মাথার সাথে নিজের মাথা মিলিয়ে হেলান দিয়ে ওর ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখছে আর মুখ থেকে শব্দ করছে। অরিক খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললো,
-এটা ব্যাড ম্যানার। শব্দ করো না।
তিলো শব্দ বন্ধ করে বললো,
-তুমি আমাকে ম্যানারের কথা বলছো!
-কেন? বলতে পারি না?
-পারো। ঠিক আছে।
-বাড়ি ফিরে ভার্সিটিতে যাওয়া শুরু করবে।
-হুম। তোমার ফোনের স্ক্রিন ফাটলো কি করে?
তিলোর প্রশ্ন শুনে অরিকের নাসীরা পারভীনের দাবড়ের কথা মনে পড়লো। হঠাৎ করে বলায়, অরিকের কান থেকে ফোনটা পিছলে পড়ে যাচ্ছিলো। অরিক পুনরায় ধরতে গিয়েও হাত ফসকে নিচে পড়ে যায়। অরিক দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,
-তোমার মায়ের দাবড়ে।
তিলো তখন আর কিছু বললো না।
কিছুক্ষণ পর তিলো টের পেলো অরিক ঘন শ্বাস নিচ্ছে। ঘেমে একাকার। তিলো ওর ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়েই বললো,
-শাওয়ার নিয়ে এসো। গরম কম লাগবে।
-সমস্যা হচ্ছে না।
-তোমার ইচ্ছা।
তিলো আর কিছু বললো না। অরিকের কাছে গরমটা সত্যিই অসহনীয় হয়ে এলে সে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার নিতে শুরু করলো। তিলো মনে মনে হাসতে সক্ষম হলো। কিছুক্ষণ পরই অরিক ভেতর থেকে বলে উঠলো,
-বাবাজানা, আমার সাবান শ্যাম্পুগুলো দাও।
তিলোর তৎক্ষনাৎ মনে পড়লো সে আনেনি। তিলোও দরজার সামনে গিয়ে বললো,
-ওগুলো তো আনা হয়নি। তুমি আমার জিনিসগুলো ব্যবহার করো।
অরিক খানিকটা নাখোশ হয়ে বললো,
-তোমার এই লেডিস জিনিসগুলো!
-সরি। তাড়াহুড়ায় ভুল হয়ে গিয়েছে। কাল কিনে এনো। এখন প্রয়োজন না হলে ব্যবহার করো না।
অরিক আর কিছু বললো না। তিলোর জিনিসগুলোই ব্যবহার করলো। সাথে দাঁতও ব্রাশ করলো, অবশ্যই তিলোর ব্রাশ দিয়ে। ব্রাশটা রাখতে রাখতে অরিক আপন মনে হেসে দিলো, এটা ভেবে যে, তিলো বিষয়টা জানতে পারলে কি করবে!
অবশেষে অসামান্য দীর্ঘ সময়ব্যাপী শাওয়ার সেরে অরিক বের হলো কেবল কোমড়ে একটা সাদা তোয়ালে পেঁচিয়ে। তিলো একমুহূর্ত ওর দিকে স্থির মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। অরিক বেরিয়ে আসার পর তিলো ফ্রেশ হতে ঢুকলো। ততক্ষণে অরিক কাপড় পাল্টে ফেলেছে। বিছানায় বসে সবে ফোনটা হাতে নিয়েছে, তিলো বেরিয়ে এসে ওর পাশে বসে জিজ্ঞাসা করলো,
-ঘুমাবে না?
-হুম।
তিলো শুয়ে পড়ে বললো,
-ব্রাশ করেছো?
অরিক ওর দিকে না ফিরেই স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
-হুম।
-আচ্ছা।
বলে পাশ ফিরে শুতে নিতেই ওর মনে পড়লো অরিকের ব্রাশ তো আনা হয়নি। ও কি দিয়ে ব্রাশ করলো? তিলো চকিতে পাশ ফিরে অরিককে জিজ্ঞাসা করলো,
-কি দিয়ে ব্রাশ করেছো তুমি?
-তোমার ব্রাশ দিয়ে।
কথাটা শুনে তিলোর যেন পুরো শরীর ঘিনঘিন করে উঠলো। ও আবার সেই ব্রাশ দিয়েই ব্রাশ করেছে! তিলো অরিককে একটা ধাক্কা দিয়ে চোখ মুখ খিঁচে বলে উঠলো,
-দূর হ নোংরা নর্দমার পোলা কোথাকার!
বিদ্যুৎ গতিতে উঠে বসে জোরে জোরে পা নাড়িয়ে প্রায় বমি করে দেওয়ার উপক্রম ওর। অরিক ওর ধাক্কার ঝোঁক সামলিয়ে ওর ভঙ্গিমা দেখে হেসে দিলো। তিলোর রাগ আরো বেড়ে গেলো তাতে। ও বিছানা ছেড়ে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে কয়েকবার কুলি করে ছলছল চোখে বেরিয়ে চোখ মুখ লাল করে অরিকের পাশে বসলো। অরিক মিটমিট করে হেসে বললো,
-আমি জানতাম না, আমার টিকটিকি ফিডার বউ এতোটা সূচিবাই!
তিলো চোখজোড়া বড় বড় করে ওর দিকে তাকালো। অরিক ওর প্রশ্ন বুঝতে পেরে বললো,
-আমার বেডরুমের টিকটিকিটাকে খাওয়ানোর জন্য পোকা মেরে দেওয়ালে টানিয়ে যে রেখেছে, আমি আসলে তাকে চিনি। আফসোস এটা আসলে কোনো চাকরি নয়।
তিলো ধপ করে অরিকের দিকে পিঠ দেখিয়ে শুয়ে পড়লো। অরিক নিজেও ওর পাশে শুয়ে ওর দিকে এগিয়ে এসে ওর শরীরে হাত রাখলে তিলো ঝটকা মেরে সরিয়ে দেয়। অরিক এতে দমে না গিয়ে ওর উদর জড়িয়ে ধরে কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
-সরি। আমি শুধু মজা করেছি। এভাবে একটা ফালতু বিষয় নিয়ে রাগারাগি করো না। বাজে লাগে ব্যাপারটা। এটা হয়েই থাকে।
তিলো চুপ করে ওর স্পর্শগুলো অনুভব করছে কেবল। কেউই কোনো কথা বলছে না। কিছুক্ষণ নিরবতার পর তিলো বললো,
-তোমার শরীর থেকে বেলি ফুলের ঘ্রাণ আসছে। মেয়েদের মতো।
কথাটা বলে তিলো ফিচ করে হেসে দিলো। অরিক ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে ওর মেরুদণ্ডের পাশের উঁচু পেশির উপর হাত রেখে বললো,
-আমার নিজেকে দোষী দোষী লাগছে। জিনিসগুলো ব্যবহার না করলেই পারতাম।
তিলো মৃদু হেসে বললো,
-তোমাকে দেখাচ্ছেও সেরকম জান।
-আমি কেবল নিজের শরীরের ঘামের দূর্গন্ধ দূর করতে আর জেঁকে বসা ক্লান্তিবোধকে দীর্ঘক্ষণের আতিথেয়তা শেষে বিদায় করেছি।
-এটা ঠিক আছে। ওগুলো খুব বেশি দামী নয় যে, সকাল হতে হতে গন্ধ ছাড়াবে না। বরং আমারই এই গন্ধটা ভালো লাগে।
অরিক আর কিছু বললো না। স্থিরদৃষ্টিতে কয়েক মূহুর্ত তিলোকে পর্যবেক্ষণ করে ওর উন্মুক্ত গলায় মুখ গুঁজে দিলো। তিলো আবেশে চোখ বুজে হঠাৎই বললো,
-তোমার কি কোনোদিনও আফসোস হবে আমাকে বেছে নেওয়ার জন্য?
অরিক থমকে গেলো তিলোর কথায়। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,
-এমন মনে হওয়ার কারণ?
-তোমার মায়ের সাথে তুমি যোগাযোগ কি পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছো?
অরিক দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,
-আপাতত। কিন্তু বাবাজানা, আমি আমার নেওয়া কোনো পদক্ষেপের জন্য কখনো আফসোস করবোনা। তোমার – আমার এগিয়ে চলতে আরো যা করতে হবে তাতেও কখনো আফসোস হবে না। আর আমরা এগিয়ে যাবো। আর এজন্য তোমাকে হুকুম করছি আমি, আমার সঙ্গ ছেড়ো না কখনো যাই ঘটে যাক।
তিলো স্তব্ধ চোখে অরিকের মুখের দিকে তাকিয়ে ওর চাপদাড়ির ফাঁকে ফাঁকে নিজের আঙুলগুলো ভরে দিলো। ঠোঁট কামড়ে ওকে সম্মতি জানালো। অরিক ওর সম্মতি পেয়ে হেসে দিলো। তিলো এরপর বললো,
-কোনোভাবে তোমার দূর্বলতা হয়ে চলেছি কি আমি? নাকি অপূর্ণতার পূর্ণতা?
অরিক উত্তর না দিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো ওর দিকে। তিলো একপেশে হেসে বললো,
-মানুষ নিজের দূর্বলতাকে বারবার শক্তি হিসাবে জাহির করতে চায়। এটা মনুষ্য প্রকৃতি। সে চেনে তাকে বা চেনে না। কিন্তু কোনো না কোনোভাবে সবচেয়ে বেশি সেটা নিয়ে ভেবেই বা কাজে খাটিয়ে ব্যয় করে। হরর স্টোরি রাইটার স্টিফেন কিং। ওনি হরর লেখার জন্য বিখ্যাত। কিন্তু জানো, ওনি রাতে বাতি নিভিয়ে ঘুমাতে পারেননা। সেটা যে কারণেই হোক, অন্ধকারভীতি (Nyctophobia or Achluophobia) বা অন্যকিছু। কিন্তু ওনি হরর লিখলেও এটা তাঁর দূর্বলতা। তিনি এমনই ছদ্মবেশে আছেন যে সেটা ঢাকা পড়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। আবার হয়তো নিজের জীবনের ব্যর্থতা বা অপূর্ণতা হিসাবে ধরে তিনি তাঁর কাজের মাধ্যমে পূর্ণতা চান। তুমি যতোটা আমাকে নিয়ে সংবেদনশীলতা দেখাও বারবার সেটাই মনে হয় আরকি।
-বলতে পারো অনেকটাই। পড়াশোনার জন্য আর বিশেষ করে মায়ের জন্য বয়স থাকতে প্রেম করতে না পারার অপূর্ণতাই তোমার মধ্যে খোঁজর চেষ্টা করি। অবশেষে পরিপূর্ণভাবে।
তিলো অরিকের কথার প্রত্যুত্তর করলো দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে। ওদের মাঝে এরপর আর মুখে কোনো কথা হলোনা। এরপর কেবলই জুড়ে গেলো একটা এলোমেলো পাজেল প্রথম রাতের ন্যায়। একে অপরের না বলা কথাগুলো নিজেরা বুঝে নেওয়ার ক্ষমতাটাই হয়তো বোঝাপড়া।
অরিক আর তিলো আরোও একদিন আশাকুঞ্জ এ অবস্থান করলো। সপ্তাহ প্রায় শেষ বিধায় তিলো সিদ্ধান্ত নিলো একবারে পরের সপ্তাহ থেকেই ভার্সিটিতে যাবে। অরিক বাঁধা দেয়নি। এরপরের শুক্রবারের রিসেপশনটা একটা কনভেনশন সেন্টারে আয়োজন করা হয়েছিলো আকবর সাহেবের দ্বারা। চমকে দেওয়ার মতো দৃশ্য ছিলো, সেখানে ফাহমিদা বেগমের উপস্থিতি। তিনি একটা মেকি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে পুরো অনুষ্ঠানে একদম স্বাভাবিক ছিলেন। নিজের হাতে তিলোকে দুটো রুলি পড়িয়ে দিয়েছেন। তিলো অবাক চোখে ওনার দিকে তাকাতেই ওনি গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
-ভেবো না মেনে নিয়েছি। আমার ছেলে তোমার জন্য আমার সাথে যোগাযোগ রাখছে না। ওদের দুজনের জন্যই আমার জীবনের সব। নিজের ছেলে মেয়ে হোক। তারপর বুঝতে পারবে তারা মায়ের কাছে কি! তোমার জন্য তো আমার ছেলে হারাতে পারবোনা আমি। তাছাড়া পাড়ার মহিলাদের নিয়মিত চর্চায় খলনায়িকা হওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।
তিলো হতাশ কন্ঠে বললো,
-ছেলে হাতে রাখতে নাটক করছেন?
ফাহমিদা বেগম ওর কথার প্রত্যুত্তর করার প্রয়োজনবোধ করলেন না। তিলো নিজেও বুঝতে পারছে, সমাজের ভয়ে মানুষ কতো কিছুই না করে! শুধু সেখানে শান্তিপূর্ণভাবে থাকার জন্য! না হলে সমাজ আমাদের আসলে কি দেয়? যদি সামাজিক একটা অবস্থান না থাকে, তো এই সমাজের কেউই ফিরেও তাকায় না।
আজকের জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে তুলির পাল্টে ফেলা ঘোরে তিলোই উল্টিয়ে পড়ে যাচ্ছিলো। এই দুতিনদিনে আগের লেশমাত্র নেই। সে সম্পূর্ণ সতেজ একটা ভঙ্গিমায় নবজন্মা তরুণী। তার এই কয়েকদিনের ‘হতশ্রী’ ভাবটা মুছে একজন ভার্সিটি পড়ুয়া সুন্দরী সে। তার কোলে ইশানকে আসলে ছেলে হিসাবে মানাচ্ছে না। তার বয়স হুট করেই কমে গিয়েছে যেন। ইশানের পরিচয় পেয়ে যে এখানে বেশ কিছু অপরিচিত ব্যথিত হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। তুলির আকর্ষণীয় রূপ এবং অঙ্গভঙ্গি বেশ কয়েকজন অভিজাত মহিলার হৃদয় কেড়ে নিতেও সক্ষম, তাদের পরিবারের কোনো অবিবাহিত ছেলে বা পুনরায় বিবাহযোগ্য কেউ আছে কিনা সে হিসাব কষে নিতেও আরেকবার বাধ্য করছে।
তুলির হাসির জোয়ারেও যেন আজ ভাটা পড়ছে না। এই কয়েকদিন যতোটা গুমরে থেকেছে, সে হিসাব করে আজ উসুল করে নিচ্ছে। নাসীরা পারভীন যে কি মন্ত্র পড়িয়েছেন ওকে সেই খোঁজ তিলোর অজানা।
আজকে ফাহাদ আর কলিকে একসাথে দেখে অদ্ভুতভাবে তিলো নিজের ভেতর হিংসা অনুভব করেনি। তিলো বরং অরিকের পাশে নিজেকে দেখিয়ে অহংকার প্রকাশ করছিলো কিছুটা গোপনেই। ফাহাদ তার স্ত্রীসমেত তিলোর পাশে বসে কয়েকটা ছবি উঠিয়ে গিয়েছে সেই হাসি মুখে নিয়ে, যে হাসি তিলো আসলে ভালোবাসতো একসময়। হয়তো এখনো ভালো লাগে হাসিটা দেখলে। তিলোকে অভিনন্দন জানাতে ভোলেনি সে।
আজকের পুরো অনুষ্ঠানে প্রশংসার দাবিদার হয়ে উঠেছেন ফাহমিদা বেগম। তিলোকে মন থেকে মেনে নেওয়ার নাটক মঞ্চস্থ করতেই ওনি নায়িকা হিসাবে পদার্পন করেছেন। অরিকের যোগ্যতা, সামাজিক মর্যাদা, তার পরিবারের অবস্থান (অবশ্য তিলোও সেই অবস্থানেই রয়েছে), তার ব্যক্তিত্ব, তার সুদর্শন হয়ে ওঠা, বিশেষত ‘সফল’ হিসাবে বিবেচিত হওয়ার কারণে অরিকের সুযোগ ছিলো একাধিক নারীর মধ্যে সবার সেরাকে বাছাই করে নেওয়ার যাদের কেউ কেউ হতে পারতো তিলোর থেকে অনেক বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন, কেউ কেউ আরো ভালো অভিজাত পরিবারের, কেউ কেউ আরো অনেক বেশি সুন্দরী। কিন্তু অরিক সেটা না করে তিলোকে বেছে নিয়েছে এবং এখানে অধিকাংশ মানুষ জানে, সে কারো দ্বারা বাতিলকৃত। এটা অবশ্যই ফাহমিদা বেগম এবং মরিয়ম রহমান সগর্বে উপস্থাপন করেছেন এখানকার সবচেয়ে বড় বড় বাঘা বাঘা অতিথি, পাড়ার বিবিসি, রয়টার্স এর সাংবাদিক মহিলাদের কাছে। চৌধুরী বাড়ির কর্ত্রী তার বউমাকে নিয়ে এই আলোচনায় সামিল হয়েছেন একটা আমদানিকৃত দামী গাড়ি থেকে নেমেই। শিকদার বাড়ির বউয়েরও একই অবস্থা। তিলো ভেবে অবাক না হলেও হতাশ হয়েছে এটা ভেবে যে, মানুষের সামাজিক অবস্থান যতো উঁচুতেই হোকনা কেন, এই সমস্ত অতি তুচ্ছ বিষয়ে নিজেকে জড়িয়ে হীন প্রমাণ করতে বাঁধে না। বিবেকের দংশন তাদের বরং ছুঁতেও পারে না। তারা হয়তো ভুলে যাবে একসময়। কিন্তু যাকে নিয়ে এতোকিছু বলছে, সে কি কখনো ভুলতে পারবে বা কখনো তাদের মন থেকে সম্মান করতে পারবে, এটা ভেবেও দেখেনি কখনো।
ফাহমিদা বেগম বাহবা পেয়েছেন এজন্য বেশ।
অরিক তিলোর পাশে এসে দাঁড়াতেই তিলো অরিকের দিকে না ফিরে দূরে ফাহমিদা বেগমকে হেসে লুটোপুটি খেতে দেখে মৃদু হেসে বললো,
-এই গল্পের নায়িকা কে অরিক?
অরিক ওর প্রশ্ন বুঝতে না পেরে ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে নিজেও হাসলো। তারপর বললো,
-তাতে কিছু যায় আসে?
-নাহ্। এমনিই বলছিলাম আরকি।
-তো, যা বলছিলাম, তোমার বন্ধুরা?
-রিয়া আর অনি ছাড়া সবাই এসেছে। হয়তো খেতে গিয়েছে। তোমার সাথে দেখা হয়নি?
-নাহ্।
-থাক লাগবে না। লজ্জা পাবে তুমি। যতোই হোক, তুমি তাদের শিক্ষক সম্পর্কে পাশাপাশি আবার দুলাভাই।
বলেই তিলো মুচকি হাসলো। অরিক সেখানে আর না দাঁড়িয়ে আবারও অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
রাতের অনুষ্ঠানটা শেষ হলো বেশ রাত করেই, আর শেষ হলে অরিক আর তিলো বেরিয়ে যাওয়ার আগে ফাহমিদা বেগম অরিকের কাছে এসে আবদার মাখা কন্ঠে ওনাদের সাথে যেতে বললেন। অরিক এতোগুলো দিন মায়ের থেকে দূরে থেকে নিজেও আলাদা মমত্ববোধ অনুভব করছে ওনার প্রতি। অগত্যা ওনাদের সাথেই গেলো। তিলো এই প্রথম শ্বশুরবাড়ি হিসাবে ‘মায়ানীড়’ এ পা রাখলো। ফাহমিদা বেগম ছেলেকে ধরে রাখতে হোক বা সমাজের ভয়ে, তিলোকে বাড়িতে প্রবেশের ক্ষেত্রে ত্রুটি কোনো রাখেননি। তিলোর তো সত্যিই কয়েকবার মনে হয়েছে, ও ফাহমিদা বেগমের অরিককে হারানোর ভয়ের ইশকাপনের টেক্কা নয় বরং ওনি সত্যিই মেনে নিয়েছেন। ওনার মাঝে কোনোকিছু মেকি ছিলোনা হয়তো।
রাতে তিলো ফ্রেশ না হয়েই নিজের শরীরটাকে ছুঁড়ে ফেললো বিছানায়। অনেক বেশি ক্লান্ত লাগছে। চিৎ হয়ে শুয়ে দুহাত দুদিকে মেলে দিয়ে চোখ বুজে ফেললো। অরিক রুমে এসে দরজা বন্ধ করে বললো,
-কেমন কাটলো আজকের দিনটা?
তিলো চোখ মেলে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে বললো,
-এলোমেলো।
অরিক ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তিলো সেটা না দেখেই ওর নিরবতায় বুঝতে পেরেছে। কিন্তু কোনো উত্তর দিলো না। অরিক ওকে তাড়া দিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে বললো। তিলো অলস ভঙ্গিমায় উঠে বসে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। আদুরে কন্ঠে বললো,
-এভাবেই শুয়ে পড়ি। ইচ্ছা করছে না কিছু করতে।
অরিক নাক শিটকে বললো,
-কেউ একজন আমাকে খুব বেশি সূচিবাইগিরি শেখায় হয়তো। রাতে ব্রাশ না করে মুখের ব্যাকটেরিয়াদের খাবারের ব্যবস্থা করা কোন ধরনের পরিচ্ছন্নতা?
তিলো বিরক্ত হয়ে দপাদপ পা ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকলো। অরিক ওর যাওয়ার ভঙ্গি দেখে হেসে লুটোপুটি খাওয়ার উপক্রম।
রাতের শেষ প্রহর। কিছুক্ষণ পরই ফজরের আযান দিবে। রাতের নিরবতার মনোযোগ ভঙ্গ হয়ে তিলোর ফোনটা একটা অভদ্র বিড়ালের মতো কথা না শুনে বেজে উঠলো। তিলো ঘুমিয়েছে বেশিক্ষণ হয়নি। কাঁচা ঘুমটা নষ্ট হওয়াতে তিলো ভ্রু কুঁচকে ফেললো সাথে সাথে। পাশাপাশি অরিকও। তিলোর হঠাৎ খেয়াল হলো ওর পাশে অরিক ঘুমিয়ে আছে। এই শব্দ বেশিক্ষণ বাজলে ওর ঘুম ভেঙে যাবে। তিলো হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে ফোনটা রিসিভ করার আগে স্ক্রিনের উপর নামটা দেখে দারুণ চমকে উঠলো।
#চলবে