#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৩।
‘ভাইয়া, আফসার সাহেব কী বললেন?’
নীহাল মাত্রই রুমে ফিরেছে। প্রিয়তার প্রশ্ন শুনে তার দিকে চেয়ে বলল,
‘তেমন কিছু না, ঐ ওয়াদির ব্যাপারেই।’
‘সিরিয়াস কিছু? আমার সামনে কেন বললেন না?’
‘তোর ওয়াদির কথা শুনে খারাপ লাগবে, তাই হয়তো বলেননি।’
প্রিয়তা পুনরায় প্রশ্ন করার আগেই নীহাল বলল,
‘কালই গিয়ে টিকেট কাটব ভাবছি, এবার দেশে ফেরার দরকার।’
প্রিয়তা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘হ্যাঁ, ভাইয়া। কতদিন মা বাবাকে দেখিনা।’
মা বাবার কথা মনে পড়তেই প্রিয়তার মন খারাপ হলো ভীষণ। বাবার সাথে কথা হলেও মা এখনো অভিমান করে বসে আছেন, এই অভিমান কী করে কমবে কে জানে। প্রিয়তা মিইয়ে যাওয়া সুরে বলল,
‘ভাইয়া, মা আমাকে ক্ষমা করবেন তো?’
নীহাল প্রিয়তার পাশে এসে বসল। বলল,
‘অবশ্যই করবেন। সন্তানদের উপর মা বাবারা রাগ করে থাকতে পারেন না।’
প্রিয়তাও মনে মনে তাই দোয়া করল।
__________
রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে দেয়ে বাসায় ফিরেছে ঘন্টাখানেক হবে হয়তো। এর মধ্যেই জারা এসে হাজির হুট করে। তার এই অযাচিত আগমনে সকলেই বিরক্ত হয়। ফারজাদ অতিরিক্ত। সে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
‘আপনি এইসময়, ম্যাডাম?’
জারা হেসে বলল,
‘এইদিকেই যাচ্ছিলাম; ভাবলাম, একটু আন্টি আর মৌমির সাথে দেখা করে আসি।’
মৌমি নাক মুক কুঁচকে মনে মনে ভাবল, “মহিলাটার মাথায় এসব উল্টাপাল্টা ভাবনা কেন আসে কে জানে, উফফ!”
দিলরুবা বেগম সৌজন্যতার খাতিরে বললেন,
‘এসো মা, ভেতরে এসো।’
জারা ভেতরে গিয়ে সোফায় বসল। দিলরুবা বেগম মৌমিকে বললেন, চা বানিয়ে আনার জন্য।
জারা বলল,
‘ঐ মেয়েটাকে দেখছি না যে?’
দিলরুবা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,
‘কোন মেয়েটা?’
‘ঐ যে হাসপাতালে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল যে?’
‘ওর একটা নাম আছে, ম্যাডাম। আর নামটা আপনার অজানা নয়। উনাকে উনার নাম ধরেই সম্বোধন করুন।’
ফারজাদের কথা শুনে মুখ কালো করল জারা। মেয়েটার কথা উঠতেই ফারজাদ কেমন গর্জে উঠল যেন। ব্যাপারটা মোটেও তার পছন্দ হলো না। তাও সে হেসে বলল,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, প্রিয়তা ছিল বোধ হয় নামটা। তা, প্রিয়তা কোথায়?’
‘হঠাৎ প্রিয়তার খোঁজ? কোনো প্রয়োজন?’
‘না না, এমনিতেই জিজ্ঞেস করছিলাম।’
ফারজাদ আর এই ব্যাপারে কথা বলার আগ্রহ দেখাল না। দিলরুবা বেগম ভদ্রতার খাতিরে জারার কাছ থেকে তার বাবার খোঁজ নিলেন। আরো প্রাসঙ্গিক কথাবার্তাও বললেন। এইদিকে জারার অস্থির চিত্ত। সে যেই কাছে এসেছে সেটা তো করতে পারছে না। ফারজাদের শরীরের অংশ লাগবে, সেটা কী করে জোগাড় করবে সে?
ফারজাদ কিছুক্ষণ বাদেই নিজের রুমে চলে যায়। এখানে বসে জারার সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই তার। মৌমি চা বানিয়ে এনেছে। চা হাতে জারা একই চিন্তায় বিভোর, ফারজাদের শরীরের অংশ নিবে কী করে?
অনেকক্ষণ বসে অনেক ভেবেও এই উপায় সে বের করতে পারেনি। শেষে পরাস্ত হয়েই বাসা বের হতে হয় তাকে।
সেখান থেকে বের হয়েই সে যায় আবার সেই আস্তানায়। আস্তানার ভেতর বসে অদ্ভুত ভাবে মাথা ঝাকাচ্ছেন এক পাগল দেখতে লোক। সাথে মুখে যেন কী কী আবার বিড়বিড়ও করছেন তিনি। জারা লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
‘আমি তো ছবি ব্যতিত আর কিছুই জোগাড় করতে পারিনি।’
লোকটি বড়ো বড়ো চোখে তাকালেন। অমন রক্তচক্ষু দেখে ঢোক গিলে জারা। বাজখাঁই স্বরে তিনি বলে উঠলেন,
‘শুধু ছবি দিয়ে হবে না, দ্রুত কাজ হওয়ার জন্য ওর শরীরের অংশ লাগবে।’
‘কিন্তু, ওর শরীরের অংশ আমি কীভাবে জোগাড় করব? আমি তো কোনোভাবেই ওর কাছে যেতে পারব না।’
লোকটা কুৎসিত এক হাসি দিয়ে বলল,
‘ঘটে বুদ্ধি থাকলে সব’ই পারবি। ভাব ভাব, ভাবতে থাক।’
জারা সত্যিই ভাবতে থাকল। আর ভাবতে ভাবতেই একটা উপায়ও পেয়ে গেল সে। খুশি হলো। উচ্ছ্বসিত সুরে বলল,
‘উপায় পেয়ে গিয়েছি, আমি কালই জোগাড় করে এনে দিব।’
_____________
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে ফারজাদ। আকাশের দিকে দৃষ্টি তার। আজ চাঁদ আছে, তবে খন্ডাংশ তার। বাইরে বাতাসও বইছে মৃদুমন্দ। ফারজাদ খেয়াল করল, তার মনটা ভালো নেই। কেন ভালো নেই, সেই কারণটাও তার অবগত নয়। অযথা মন খারাপ হওয়া একটা বিরক্তিকর ব্যাপার। সে অনেকক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে কী ভেবে প্রিয়তাকে কল করল। অদ্ভুত ভাবে এক বার রিং হতেই কলটা আবার কেটে দিল সে। ভাবল, “অযথা এখন আবার প্রিয়তাকে কল করছে কেন?” সে নিজের উপর বীতঃস্পৃহ প্রকাশ করার তেমন সময় পায়নি, তার আগেই প্রিয়তা কল ব্যাক করে বসে। ফারজাদ চিন্তায় পড়ে, এবার প্রিয়তাকে কল ধরে কী বলবে সে? এত রাতে তাকে কল দেওয়ার কারণ তো সে নিজেও জানে না। ফোনটা বাজছে। ফারজাদ ভাবনা চিন্তার মলাট বন্ধ করে কলটা রিসিভ করে। ওপাশ থেকে সালাম দেয় প্রিয়তা। ফারজাদ সালামের জবাব দিয়ে বলে,
‘দুঃখিত, এত রাতে কল করে বিরক্ত করার জন্য।’
‘আমি তো বিরক্ত হয়নি।’
ফারজাদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
‘ঘুমাননি এখনো?’
‘না।’
‘কী করছিলেন?’
‘চন্দ্রবিলাস।’
কিঞ্চিৎ হাসল ফারজাদ। বলল,
‘না ঘুমিয়ে এসব বিলাসে মেতে থাকলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বেন।’
‘উঁহু, কিছু হবে না।’
‘নীহাল কি ঘুমিয়ে পড়েছেন?’
‘বোধ হয়।’
‘তা, দেশে ফিরছেন কবে?’
‘ভাইয়া কাল টিকেট কাটতে যাবেন।’
ফারজাদ খানিক সময় নীরব থেকে বলল,
‘আবার আসবেন।’
‘আপনি বিরক্ত হবেন না?’
‘আমার আগের ব্যবহারের জন্য আমি দুঃখিত।’
‘সমস্যা নেই, আমি কিছু মনে করিনি। আমি আসব, আপনার বিয়েতে দাওয়াত করতে ভুলবেন না।’
ফারজাদ হাসল এবার। বলল,
‘এসব ঝামেলাতে আমি নেই।’
‘জারা মেয়েটা ভালো। মনে হলো, আপনাকে ভীষণ পছন্দ করেন।’
‘তাতে কী? আমার তো পছন্দ না।’
‘অমন সুন্দর মেয়েকে আপনার পছন্দ না?’
‘সুন্দর? প্রসাধনীর ভিড়ে তো সবাইকেই সুন্দর লাগে। আমার উনার ব্যক্তিত্ব পছন্দ না।’
‘তাহলে যেমন ব্যক্তিত্ব পছন্দ তেমন কাউকেই বিয়ে করুন। আন্টি আর মৌমি আপনার বিয়ের জন্য অধির আগ্রহে বসে আছেন।’
‘ওদের কথা আর কী বলব? আমি ওদের বুঝিয়ে আর পারি না। আমার বিয়ের উপর ভরসা নেই। আমার মনে হয় বিয়ে মানেই একটা বিশাল দায়িত্বের বোঝা একজন মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া। আর তার থেকেও বড়ো কথা, আজকাল এত এত বিচ্ছেদের ভিড়ে বিয়েটাই বা আর টেকসই রইল কই?’
‘চাইলেই সব সম্ভব। ভালোবাসা দিয়ে মানুষ সব পারে।’
‘আপনি পেরেছেন, ওয়াদিকে নিজের করতে?’
প্রিয়তা থমকাল। আচমকা বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করল সে। ফারজাদ বলল,
‘দুঃখিত, আমি জানি আমার কথায় কষ্ট পেয়েছেন। তবে কষ্ট পেলেও এটাই তিক্ত সত্যি যে, ভালোবাসা সব পারে না। আর এইজন্যই এইসব মিথ্যে সম্পর্কে আমি জড়াতে চাই না।’
প্রিয়তা ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলল,
‘ভুল মানুষকে বেছে নিলে তো এমনিই হবে। আপনি তো আর আমার মতো মূর্খ নন, আপনি নিশ্চয় সঠিক মানুষ খুঁজতে ব্যর্থ হবেন না।’
ফারজাদ ম্লান হেসে বলল,
‘যদি কখনো সঠিক মানুষ পাই, তবে ভেবে দেখব অবশ্যই।’
‘আর তখন বিয়ের দাওয়াতটা কিন্তু অবশ্যই দিবেন।’
ফারজাদ হাসল ফের। বলল,
‘আচ্ছা।’
‘এখন রাখি তবে, শুভ রাত্রি।’
‘শুভ রাত্রি।’
কল কাটল ফারজাদ। ঠোঁটের কোণে হাসির রেশটা রয়ে গিয়েছে এখনো। আশ্চর্য, সে খেয়াল করল, একটু আগের মন খারাপটা এখন আর নেই। মনটা এখন হালকা লাগছে ভীষণ। সে ভাবল, মেয়েটা ম্যাজিক জানে না-কি?
চলবে…..
ছবি: রত্নাবু❤️