#আমার_বাহুডোরে_আবদ্ধ_তুমি
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব ৩
প্রিয় বড় বোনের বিয়ে উপলক্ষে চারিদিকে আয়োজনের ছড়াছড়ি। সবাই যে যার মতো ব্যস্ত হাতে নিজেদের কাজ সামলাচ্ছে। জন সমাগমে যেন গিজগিজ করছে চারপাশ।
ম্যাজেন্ডা কালারের লেহাঙ্গা পরে সিড়ি বেয়ে নামে মেহরুন। লেহাঙ্গাতে ভারী কারুকার্য করা। মুখে হালকা মেকআপ। এতেই যেন মিষ্টি লাগছে মেহরুনকে। সিড়ি দিয়ে গটগট করে নেমে এসেই ফারজানাকে জড়িয়ে ধরে মেহরুন। আজ ফারজানার-ই বিয়ে। মেহরুনের দুষ্সম্পর্কের এক কাজিন হয় ফারজানা। তার বিয়ের জন্যই তো এতো আয়োজন।
দূর হতে মেহরুনকে দেখে মুগ্ধ নয়নে। মেয়েটা আসলেই মন মুগ্ধকর! মেহরুনের হাস্যজ্জ্বল চেহারার কয়েকটা ছবি ক্যামেরা বন্দি করে নেয়।
বিয়ের কার্যক্রম শেষ হতে হতে প্রায় বেশ রাত হয়ে যায়। পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ে আঁধার। কিন্তু রঙ-বেরঙের লাইটিং এর কারণে আলোয় মুখরিত হয়েছে চারপাশ। ফারজানা বিদায় নিল খানিকক্ষণ আগেই। বিদায়বেলায় মেয়েটা কি কান্নাকাটিটা-ই না করল! মেহরুনের দেখে বড্ড খারাপ লাগে। তার চোখেও অশ্রু টলমল করে।মনে মনে বলে ‘আমি কখনো বিয়েই করবো না’।
বিয়ে সম্পন্ন হতে অনেকটা রাত হয়ে যাওয়ায় মেহরুনরা সিদ্ধান্ত নেয় ফারজানাদের বাড়িতে আজ রাতটা থেকে পরদিনই চলে যাবে। সবাই গোছ-গাছে ব্যস্ত বলে মেহরুন একা হয়ে পড়ে। মেহরুনের মন খারাপ থাকায় সে ছাদের দিকে পা বাড়ায়।
রাতের পরিবেশটা নিছকই মন্দ নয়, মেহরুনের ভালোই লাগছে আকাশের ঝিলিমিলি তারাগুলো দেখতে। পাশে কারও উপস্থিতি টের পেতেই ধরফড়িয়ে উঠে সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মেহরুন।
আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেই মেহরুনের উদ্দেশ্যে আদ্রিশ বলে ওঠে
-‘ আমি রীতিমতো রক্ত মাংসে গড়া একজন সাধারণ মানুষ। আমাকে দেখে ভয় পাওয়ার আদৌও কোনো কারণ আছে বলে আমি মনে করছি না।
মেহরুন হাফ ছেড়ে বাঁচে। সত্যিই ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে। কণ্ঠ কিছুটা খাদে নামিয়ে বলল
-‘ আপনি যে রক্তে মাংসে গড়া মানুষ, সেটাতো দেখতেই পাচ্ছি, এটা আবার বলে বেড়ানোর কি আছে? আমি তো ভেবেছিলাম আমার পাশে কোনো প্যাঁচা ট্যাচা এসে বসেছে হয়তো।
শেষোক্ত কথাটা মেহরুন ব্যাঙ্গাত্মকভাবে বলে। আদ্রিশ এবার ভ্রু কুচকে তাকায় মেহরুনের দিকে। বলে ওঠে
-‘ মানে আমাকে দেখলে কি তোমার প্যাঁচা মনে হয়, মেহরুন?
-‘ আমি কিন্তু আপনাকে মিন করে বলিনি, এখন যদি নিজের গায়ে কথা মাখান তো আমি কি বলতে পারি বলুন।
মেহরুন শব্দ করে হেসে ওঠে। মেহরুনের হাসির ঝংকারে মুখরিত হয় চারপাশ। প্রতিধ্বনিত হয় হাসির শব্দ বারবার। হাসির শব্দে তব্দা খেয়ে যায় আদ্রিশ। আদ্রিশকে মেহরুনের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসি থামায় মেহরুন। হাত নাড়িয়ে প্রশ্ন করে
-‘ কি দেখছেন এভাবে?
-‘ তোমাকে।
আদ্রিশের সোজা সাপ্টা উত্তর। মেহরুন বিষম খায়, সেইসাথে তার মুখশ্রীতে কিছুটা লাল আভাও ছড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মেহরুন প্রশ্ন করল
-‘ আচ্ছা, আপনি এখানে কেন?
-‘ তুমি যে কারণে এসেছো, আমিও ঠিক সে কারনেই এসেছি।
-‘ ফারজানা আপু কি হয় আপনার?
-‘ আমার বোনের ফ্রেন্ড। আচ্ছা, আলভি কোথায়?
-‘ ভাইয়া নিচেই আছে হয়তো।
মেহরুন আদ্রিশকে ছাদে দাঁড়িয়ে একসাথে কথা বলতে দেখে রাগে গা জ্বলে ওঠে জারার। গটগট পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে আসে জারা। মনে মনে রাগ হলেও মুখে হাসি ফুটিয়ে আদ্রিশের গা ঘেষে দাঁড়িয়ে জারা বলে ওঠে
-‘ আরে, আদ্রিশ ভাইয়া যে। তো দিনকাল কেমন চলে আপনার?
আচমকা জারাকে নিজের গাঁ ঘেষে দাড়াতে দেখে আদ্রিশ কিছুটা ইতস্তত বোধ করে সরে দাড়ায়। তা দেখে মেহরুন অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আদ্রিশের দৃষ্টি এড়ায়না তা। মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে প্রত্যুত্তোরে বলল
-‘ এইতো চলছে চলার মতো।
-‘ এমন বললে কি করে হয়? বিয়ে করবেন কবে? বাই দ্য ওয়ে, আপনি মেহরুন আপির সাথে কি বলছিলেন? প্রেম টেম করছেন নাকি আপনারা?
আদ্রিশ মেহরুন দুজন দুজনের দিকে তাকায়। মেহরুন জারার কথা শুনে রেগে যায়। বলে ওঠে
-‘ কিসব যা তা কথা বলছিস তুই। কথাবার্তা একটু ঠিক করে বলবি। তা না হলে থাপড়িয়ে গাল লাল করে ফেলব।
মেহরুনের কথা শুনে চোখে পানি চলে আসে জারার। ছিছকাদুনি গলায় বলল
-‘ আদ্রিশ ভাইয়ার সামনে তুই আমাকে এভাবে অপমান করতে পারলি, আপি?
বলেই কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে নিচে চলে যায় জারা। চাচাতো বোন হয়েছে তো কি হয়েছে, জারা এর শোধ নিয়েই ছাড়বে। তার জন্য যা করা প্রয়োজন সে তা-ই করবে।
মেহরুনও আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে না থেকে নিজের জন্যে বরাদ্দকৃত রুমে চলে যায়। আদ্রিশ মেহরুনের চলে যাওয়ার পানে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকে নিজের রুমের পথে পা বাড়ায়।
ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল মেহরুন। এমন সময় লাবিবা রহমান রুমে প্রবেশ করে কোনো ভনিতা ছাড়াই বললেন
-‘ আমি যেন তোমায় আর আদ্রিশের সাথে কথা বলতে না দেখি।
মায়ের হঠাৎ এমন কথাতে মেহরুন ভ্রু কুচকে মায়ের দিকে তাকায়। কই এর আগেও তো আদ্রিশের সাথে কথা বলেছে, তখন তো তিনি কিছু বলেননি। আর মেহরুন তো আদ্রিশের সাথে এমন কোনো কথা বলেনি যা সন্দেহ করার মতো। তবুও কিছুটা দ্বিধা নিয়ে বলল
-‘ কেন মা, কি হয়েছে?
-‘ আমি কথা বলতে নিষেধ করেছি, ব্যাস এই পর্যন্তই। আমার কথার যেন কোনো হেরফের না হয়।
বলেই তিনি মেহরুনের রুম থেকে বেরিয়ে যান। মেহরুন স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে মায়ের যাওয়ার পানে। মেহরুন আর এক মুহুর্ত দেরি না করে আদ্রিশের রুমের দিকে পা বাড়ায়। দরজায় নক করার সাথে সাথে আদ্রিশ দরজা খুলে দেয়। মেহরুনের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলে
-‘ কি ব্যপার তুমি আমার রুমের সামনে এতো রাতে কেন? কোনো ইমার্জেন্সি?
-‘ আপনি কি মাকে কিছু বলেছেন?
-‘ আমি? আমি কি বলতে যাব আন্টিকে? কেন কি হয়েছে?
-‘ না মানে কিছু না।
-‘ কিছু তো একটা হয়েছেই। সত্যি করে বলো।
-‘ মা, আপনার সাথে কথা বলতে নিষেধ করল কেন হঠাৎ?
আদ্রিশ ভাবে কিছু সময়, ভেবে বলল
-‘ তোমার চাচাতো বোন জারা বলেছে হয়তো। আমরা নাকি প্রেম করি?
ব্যাঙ্গত্মকভাবে বলে হেসে ওঠে আদ্রিশ। আদ্রিশ ব্যপারটাকে নিছক মজা হিসেবে নিলেও মেহরুনের সন্দেহ হয় জারাকে। মেহরুন আর কথা না বাড়িয়ে নিজের রুমে চলে যায়। অন্ধকারে প্রগাঢ় কালো ছায়া দুটি সরে আসে। আদ্রিশের দৃষ্টিগোচর হয়না। ছায়ামানবদের সে ঠিকই চিনতে পেরেছে। মুখে তার বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে। দরজা আটকে শিষ বাজাতে বাজতে শুয়ে পড়ে সে।
পরদিন মেহরুনদের গোছগাছ করে বেরোতে বেরোতে বিকেল হয়ে যায়। এর মধ্যে আদ্রিশ মেহরুনের চোখাচোখি হলেও মেহরুন বারবারই চোখ সরিয়ে নিয়েছে, একবারও কথা হয়নি। লাবিবা রহমান চোখে চোখে রেখেছেন। আলভির জোড়াজুড়িতে আদ্রিশ ওদের সাথে এক গাড়িতে যেতে বাধ্য হয়, হাজার হোক বাল্যকালের বন্ধুর কথা ফেলা যায় না।
গাড়ি চলতে চলতে হঠাৎ আলভি গাড়ি থামাতে বলে। ড্রাইভার গাড়ি থামাতেই। আলভি আদ্রিশকে নিয়ে চায়ের দোকানের সামনে হাজির হয়।
-‘ খুব জোর খিদে পেয়েছে রে ভাই। চল কিছু খাই।
আলভির কথা মতো আদ্রিশ সায় দেয়। মেহরুন, জারা ওরা সবাই গাড়ি থেকে নেমে আসে। জারা কালকের পরে আর মেহরুনের সাথে কথা বলেনি। মেহরুনেরও আর ইচ্ছে করল না। মেহরুন আলভির পাশে গিয়ে বসে। আলভি মেহরুনের হাতে একটা বিস্কুট ধরিয়ে দিয়ে বলে
-‘ নে বিস্কুট খা।
মেহরুন কোনো কথা না বলে বিস্কুট খায়। এর মধ্যে প্রায় সন্ধ্যে নেমে পড়ে। আলভির একটা জরুরি ফোন আসায় সে তড়িঘড়ি করে উঠে যায়। মেহরুন আর আদ্রিশ দুজনে বসে থাকে। এটা দেখে মেহরুন উঠতে নিলেই আদ্রিশ পিছন থেকে ডাক দেয় মেহরুনকে। মেহরুন পিছন ফিরে তাকায়। আদ্রিশ কোনো কথা না বলে এগিয়ে আসে মেহরুনের দিকে। মেহরুনের খুব কাছাকাছি আদ্রিশ এসে দাঁড়াতেই মেহরুন ঘাবড়ে যায়। কাপা কণ্ঠে বলে
-‘ কি হয়েছে আপনার? কিছু বলবেন, না বললে আমি যাই। মা দেখলে কিন্তু…
মেহরুনের দিকে আদ্রিশের দৃষ্টি গভীর। মেহরুনের পুরো কথা শেষ করতে না দিয়েই একহাতে মেহরুনকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় আদ্রিশ। ঘটনার আকস্মিকতায় মেহরুন চমকে ওঠে। পেছন থেকে শুনতে পায় মায়ের চিৎকার।
গালে একহাত রেখে মেহরুনের ঘুমন্ত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে এতোক্ষণ যাবত উক্ত ঘটনাগুলোই স্মৃতিচারণ করছিল আদ্রিশ। জোৎসার আলোয় মেহরুনের ঘুমন্ত মুখশ্রী বড্ড নিষ্পাপ আর মায়বী দেখাচ্ছিল যা বরাবরের মতো এবারও আদ্রিশকে মুগ্ধ করেছে। সে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে মেহরুনের নিষ্পাপ মুখখানার দিকে। মনে মনে আদ্রিশ বলল ‘আমি এভাবেই তোমার ঘুমন্ত মায়াবী মুখের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিতে চাই একজনম’।
#চলবে ~