#হৃদয়ে_লিখেছি_তোমারি_নাম
#Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_২১
আহান পা টিপেটিপে হেঁটে জারার রুমের সামনে আসে। নীল রঙের পর্দার ফাঁক দিয়ে বোনকে দেখে নেয় বোন কি করছে? আহান পড়ায় মনযোগী জারাকে দেখে দুষ্টু হেসে হাতে থাকা ছিঁড়া চকলেটের প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে মুখমন্ডল স্বাভাবিক করে নিয়ে আপু আপু বলতে বলতে রুমের ভেতরে ঢুকে। জারা লেখা থামিয়ে বলে।
“কি হয়েছে এভাবে চিৎকার করচ্ছিস কেন?”
আহান জারার পড়ার টেবিলের কাছে এগিয়ে এসে বলে, “এই অর্ধেকটা চকলেট তোমার।”
জারা আহানের মুখে এমন কথা শুনে হতবাক হয়ে যায়। যেই ছেলে তাকে কিছু দিতে চায় না সেই ছেলে কিনা আজকে নিজ থেকে তাকে চকলেট দিতে এসেছে। জারা সন্দিহান গলায় বলে, “হঠাৎ আমাকে চকলেট দিতে চাইচ্ছিস কেন?”
আহান ঠোঁট ফুলিয়ে বলে, “বড়ো ভাইয়া বলেছে তোমাকে এই চকলেট থেকে অর্ধেকটা চকলেট দেওয়ার জন্য তাই দিচ্ছি না হলে দিতাম না।”
জারা ঠাট্টা করে বলে, “আহা গো বড়ো ভাইয়ার ভক্ত ভাই আমার। কবে থেকে তুমি এত বাধ্য ছেলে হলে ভাই আমার?”
আহান মন খারাপ করে বলে, “ঠিক আছে তোমাকে চকলেট খেতে হবে না। ভালোর জন্য দিতে চেয়েছিলাম তোমাকে চকলেট কিন্তু তুমি উল্টে আমাকে কথা শোনাচ্ছো।”
আহান চলে যেতে নিলে জারা বলে, “দাঁড়া এত কষ্ট করে যখন এনেছিস চকলেট টা তখন তো খেতেই হয়। আমি আবার কারোর কষ্ট বিফলে যেতে দেই না।”
আহানের চোখ মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল আর বলল, “সত্যি তুমি খাবে। ঠিক আছে নাও তুমি খাও।”
জারার কেমন জানি সন্দেহ হচ্ছে। তাকে এভাবে চকলেট খাওয়ানোর জন্য এত সাধছে কেন আহান? কিছু তো একটা গন্ডগোল আছেই এর মাঝে। জারা আহানের কাছ থেকে চকলেটের প্যাকেটটা নিতে নিতে বলে।
“কিছু মিশাস নি তো এর মাঝে।”
আহান গলা টেনে টেনে বলে, “আমি কি মিশাব আবার এতে?”
জারা দাঁত দিয়ে কিয়ৎক্ষণ ঠোঁট কামড়ে রেখে আহানের দিকে চকলেটের প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে বলে, “তাহলে তুই আগে খা।”
আহান ভয়ে ভয়ে বলে, “না না তুমি খাও আমি খেয়েছি তো।”
জারাও সরল গলায় বলে, “তো কি হয়েছে? আরেকটু খেলে কোনো ক্ষতি হবে না। নে খা।”
আহান চকলেটের প্যাকেটটা নিয়ে কিছুক্ষণ তব্দা মেরে দাঁড়িয়ে রইল। বোনের দিকে তাকাতেই জারা ইশারা করল খাওয়ার জন্য। আহান চকলেটের প্যাকেটটা সম্পূর্ণ ভাবে খুলে চকলেট সহ জারার দিকে ছুঁড়ে মেরে চেঁচিয়ে বলে।
“দেখো তোমার উপরে তেলাপোকা।”
জারা এমন কথা শুনে ভয়ে লাফিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে লাফালাফি আর চিৎকার করা শুরু করে দেয়। ওদিকে আহান হাসতে হাসতে বলে।
“বেশ হয়েছে আরো খাবে চকলেট। সামান্য একটা প্লাস্টিকের তেলাপোকা দেখে ভয় পায় কি ভীতু গো তুমি আপু।”
আহানের এহেন কথা শুনে জারা শান্ত হয়ে নাক ফুলিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ছে আর নিচ্ছে। অধিক ভয় আর রেগে যাওয়ার কারণে জারার চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। আহান বোনের এমন ভয়ংকর রুপ থেকে শুকনো ঢোক গিলে বলে।
“আহান বাঁচতে চাইলে পালা”
আহান দিক বেদিক না দেখে দৌঁড় মারল। আহানকে এভাবে চলে যেতে দেখে জারা চেঁচিয়ে বলে, “আহান দাঁড়া বলছি। আজকে তোর একদিন কি আমার একদিন শ’য়তান ছেলে। খালি শ’য়তানি বুদ্ধি মাথায় গিজগিজ করে তোর না।”
বলেই আহানের পেছনে দৌঁড় দেয় জারা। কিন্তু আহানকে আর ধরতে পারে না জারা। তার আগে আহান নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে নিশ্চিন্তে রুমের ভেতরে লুঙ্গি ডান্স গান গাইতে গাইতে নাচচ্ছে। আহানের দরজা বাইরে দাঁড়ানো জারা এসব শুনে আরো তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে আর বলে।
“আহান দরজা খুল আজকে তোর সব বাদরামি আমি ছুটিয়ে ছাড়বে। সবার আদর পেয়ে বাদর হচ্ছিস দিনকে দিন।”
আহান ভেতর থেকে চেঁচিয়ে বলে, “আরো বাদরামি করব আর সেটাও তোমার সাথে।”
জারা এবার রেগে দরজায় লাথি মেরে বলে, “দরজা খুল বলছি না হলে কিন্তু দরজা ভেঙ্গে দিব আমি।”
আহান গানের স্বরে চিৎকার করে বলতে লাগল, “আমি দরজা খুলব না, খুলব না, খুলব নারে, আমি দরজা খুলব না।”
জারা দ্বিতীয় বারের মতো দরজায় লাথি মেরে বলে, “আহান ভাল হচ্ছে না কিন্তু।”
চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে আজমল শেখ আর আযহার শেখ আহানের রুমের সামনে এসো জড়ো হয়। মা চাচিরা আসে নি তার এই দুই ভাই বোনের এমন ঝগড়া দেখতে দেখতে ক্লান্ত। তাই আর এসব তারা বেশি পাত্তা দেয় না। আজমল শেখ মেয়েকে রেগে বলেন, “জারা কি হচ্ছে এসব এভাবে চিৎকার চেঁচামেচি করছো কেন এই রাতের বেলা?”
জারা রেগে এবার কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে, “বাবা তোমার ভাতিজা সবসময় আমার সাথে এমন করে। আমি পড়চ্ছিলাম তখন ও এসে…. ।”
জারা সবটা খুলে বলল তার বাবাকে। এই দুই ভাই বোন সবসময় কিছু না কিছু নিয়ে লেগেই থাকে। যেন একই ছাদের নিচে সাপ আর নেউল বাস করছে। আহান ভয়ে ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে চাচ্চু আর বাবার ডাকে দরজা সে খুলে নি। আজমল শেখ হতাশার শ্বাস ফেলেন। আজমল শেখ মেয়েকে কিছু বলবেন তার আগেই আযহার শেখ ভাতিজির কাছে এসে ভাতিজির চোখের কোণে নোনা জলটা মুছে বোঝানোর স্বরে বলেন।
“আহান একবার বের হোক রুম থেকে তারপর আমি ওকে এমন কঠিন শাস্তি দিব যেন পরের বার আমার আম্মুটাকে আর যন্ত্রণা না করে। তুমি আর কেঁদো না।”
জারা ছোট বাচ্চাদের মতো বলে, “সত্যি বলছো তো তুমি চাচ্চু।”
আযহার শেখ মুচকি হেসে বলেন, “একদম তিন সত্যি। তুমি গিয়ে এখন পড়তে বসো।”
তারপর ভাইয়ের কাছে এসে চাপা গলায় বলেন, “ভাইজান চলেন বাচ্চারা একটু আধটু ঝগড়া করবেই। একটু পরেই দেখবেন তারাই আবার মিল হয়ে গেছে। এসব নিয়ে চিন্তা করবেন না।”
চাচ্চু আর বাবা চলে যেতেই জারা চোখের জল মুছে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে নিতেই নজর যায় নুহাশের দিকে। নুহাশ হা হয়ে জারার দিকে তাকিয়ে আছে। নুহাশের চাওনি দেখে মনে হচ্ছে যেন জারাকে আজকে সে নতুন দেখছে। জারা এমনিতে রেগে আছে মনে মনে আর নুহাশকে দেখে রাগটা যেন আরো চওড়া হয়ে গেল আর নুহাশকে উদ্দেশ্য করে বলল।
“কি হয়েছে এভাবে তাকিয়ে কি দেখো জীবনে কোনো দিন মেয়ে দেখো নি যে এভাবে হুতুম পেঁচার মত তাকিয়ে আছে আমার দিকে? অসহ্যকর দুনিয়া।”
নুহাশ থতমত খেয়ে যায় জারার এমন ঝারি শুনে। বুঝতে পারল আহানের উপরে পুষে রাখা রাগটা তার উপর ঝেড়েছে। জারা ধপধপ পায়ে নিজের রুমে ঢুকে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দেয়। নুহাশ আনমনে হেসে ফেলে জারার ব্যবহার দেখে। আজ এক অন্য জারাকে দেখেছে সে যে জারা রেগে গিয়েও বাচ্চাদের মতো কান্না করে। এই কান্নারত জারাকে দেখে খুব ইচ্ছে করছিল জারার ওই লাল নাকটা ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু মনের ইচ্ছেটা মনেতেই মেরে দিল নুহাশ। এই ইচ্ছেটা তার কোনো দিনও পূরণ হবে না সে জানে। নুহাশ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজের ঘরের ভেতরে চলে যায়।
_______
জাহিন বাইরের চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে কোনো মতে শাওয়ার নিয়ে বের হল। ভেবেছিল শাওয়ার নিবে না কিন্তু পরে আবার মত পরিবর্তন করল। জাহিন এতটুকু বুঝতে পারছে আহান নিশ্চয়ই জারার সাথে আবারো কিছু একটা করেছে। ছেলেটা দিন দিন যত বড় হচ্ছে তত যেন অবাধ্য হচ্ছে। বাড়ির কারোর সাথে কিছু না করলেও জারার সাথে ও কিছু না কিছু একটা করবেই করবে। এটা যেন ওর প্রতিদিনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাহিন রুম থেকে দ্রুত পায়ে বের হতে নিবে তখনই অয়ন্তি রুমের ভেতরে এসে ঢুকে। জাহিন অয়ন্তিকে দেখে নি অয়ন্তি জাহিনকে দেখে নি। যার ফলে দুজন দুজনের সাথে ধাক্কা লাগে। অয়ন্তি জাহিনের মতো লম্বা আর শক্ত পোক্ত শরীরের সাথে আকস্মিক এভাবে ধাক্কা লাগাতে নিজের টাল সমলাতে না পেরে অয়ন্তি ভয়ে চিৎকার করে নিজেকে বাঁচানোর জন্য সামনে যা পেয়েছে তাই আকঁড়ে ধরেছে প্রাণপনে। মনে মনে অয়ন্তি ভেবেই নিয়েছে আজকে হয়ত ওর সুন্দর কোমরটা গেল। কিন্তু নিজের উন্মুক্ত কোমরে কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে অয়ন্তি ভয়ে ভয়ে চোখ মেলে তাকাতেই দেখতে পায় জাহিন তার মুখের সামনে। জাহিনের গলায় ঝুলে থাকা সাদা টাওয়ালটা অয়ন্তি দু হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে রেখেছে যার ফলে জাহিন আর অয়ন্তি অনেকটা ঝুকে আছে। সদ্য স্নান করে আসা জাহিনের চুলের কয়েকটা পানির ফোঁটা টুপ করে গড়িয়ে পড়ে অয়ন্তির বা গালে। অয়ন্তি তাতে চোখ বন্ধ করে নিয়ে পুনরায় জাহিনের দিকে তাকায়। জাহিন ধীরে ধীরে অয়ন্তিকে সোজা করে দাঁড় করায়। অয়ন্তিও সাথে সাথে টাওয়ালটা ছেড়ে দিয়ে এলোমেলা দৃষ্টিতে চারপাশটা নজর বুলিয়ে জাহিনের দিকে তাকায়। জাহিনের গভীর চোখের চাওনি দেখে অয়ন্তির বুকটা ধ্বক করে উঠে। মাঝে মাঝে এভাবে তাকায় কেন লোকটা তার দিকে? এদিকে জাহিন অয়ন্তির গালের উপরে পড়ে থাকা পানির ফোঁটা গুলার দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে। জাহিন যেন একটা ঘোরের মাঝে চলে গেছে। বা পাশে থাকা হৃদয়টাও যেন একটু বেশিই লাফালাফি করছে ইদানিং। জাহিন ঢোক গিলে নিজের অজান্তেই ডান হাতটা বাড়িয়ে নিয়ে যায় অয়ন্তির মুখের দিকে। অয়ন্তি তা দেখে ধম আটকে রেখে চোখ বন্ধ করে নেয়। অপেক্ষায় আছে জাহিনের শীতল স্পর্শ অনুভব করার। অয়ন্তির অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে জাহিনের শক্ত, শীতল হাতের ছোঁয়া পেল নিজের বা কপোলে। জাহিন অয়ন্তির কপোলে হাত রেখে থামে নি সে সযত্নে অয়ন্তির কপোলে পড়ে থাকা পানির ফোঁটা গুলা আলতো হাতে মুছে দিল। তাতে যেন অয়ন্তির তল পেটটা অদ্ভুত ভাবে মোচরে উঠল। দিন দিন যেন নানান রকমের অনুভূতির সাথে সাক্ষাৎ হচ্ছে অয়ন্তির। জাহিনের ঠান্ডা গলার স্বর শুনে অয়ন্তি চোখ মেলে তাকায়।
“দেখে শুনে চলাফেরা করবেন অয়ন্তি কারণ কোমর ভাঙ্গা বউ কিন্তু আমি বইতে পারব না।”
অয়ন্তির ঠোঁট দুটো আপনাআপনি ফাঁক হয়ে যায় জাহিনের কথা শুনে। বলে কি এই লোক? কোমর ভাঙ্গা বউ! জাহিন অয়ন্তি বিস্ময়কর চেহারা দেখে ঠোঁট টিপে হেসে বলে।
“কি হয়েছিল বাইরে?”
অয়ন্তি গম্ভীর গলায় বলে, “জারা আর আহান ঝগড়া করছিল।”
“ঝগড়া থেমেছে ওদের।”
“হুম।”
জাহিন কৌতুকের স্বরে বলে, “তো এখন কি আপনি আমার সাথে ঝগড়া করতে চাইছেন?”
অয়ন্তি ভ্রু কুঁচকে বলে, “মানে আমি কেন আপনার সাথে ঝগড়া করতে যাব?”
“এই যে একটু আগে আপনাকে কোমর ভাঙ্গা বউ বললাম। আর আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে ঝগড়া করতে চাইছেন আমার সাথে।”
অয়ন্তি নিজের জায়গা পরিবর্তন করে বলে, “আমি কারো সাথে ঝগড়া করতে পারি না।”
জাহিন অয়ন্তির দিকে ফিরে মৃদু হেসে বলে, “মাঝে মাঝে আমার সাথে ঝগড়া করবেন অয়ন্তি।”
অয়ন্তি অবাক হয়ে বলে, “কেন?”
“দেখব কে ঝগড়ায় জিতে আমি নাকি আপনি।”
অয়ন্তি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল জাহিনে পানে। জাহিন টাওয়াল দিয়ে ভেজা চুল মুছতে মুছতে বলে, “আজ তো ঝগড়া করা হল না। ভবিষ্যতে কিন্তু আমি আর আপনি একদিন ঝগড়া করব কেমন!”
কথাটা বলে জাহিন ড্রেসিং টেবিলের কাছে চলে যায়। যত দিন যাচ্ছে অয়ন্তি যেন নতুন ভাবে জাহিনের সাথে পরিচিত হচ্ছে। কেমন যেন একটা গোলক ধাঁধার মত জাহিন নামক পুরুষ মানুষটি।
#চলবে_____
প্রকাশিত আগের পর্ব গুলা
https://www.facebook.com/100063894182680/posts/830411019098697/?app=fbl