#সুখের_ঠিকানা
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব১০
আচমকা কারো স্পর্শে লিয়া ঘাবড়ে যায়।কারো গরম নিঃশ্বাস ঘাড়ে আছড়ে পড়তেই লিয়ার গলা শুকিয়ে আসে। কোমড় জড়িয়ে রাখা মানবের দুইহাতের উপর লিয়া ফট করে হাত রাখে। রা’গে লিয়ার সারা শরীর ঘিনঘিন করে উঠে।হাউ পসিবেল ? এনাবুল জান্নাত খাঁন লিয়ার কোমড় জড়িয়ে ধরেছে।কতবড় স্পর্ধা হলে এটা সম্ভব।এটা ভাবতেই লিয়া আশ্চর্যান্বিত হয়।রাগে লিয়ার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।লিয়া রাগান্বিত স্বরে দাঁত কটমট করে ঠোঁট মেলে কিছু বলবে। সেই মূহূর্তে কর্ণদ্বয় ভেদ করে মস্তিষ্কে সাড়া জাগাতেই মনে শীতলতা বয়ে যায় লিয়ার।জারিফ লিয়ার কাঁধে থুতনি রেখে সফট ভয়েজে বলে,,
“সরি।সরি তোমার সাথে মিসবিহেভ করার জন্য। প্লিজ প্রাডোন মি?”
এই কন্ঠের এই ছোঁয়ার মালিক যে জারিফ তা সেকেন্ডেই লিয়ার বুঝে আসে।জারিফের গলার স্বর শুনেই লিয়ার হৃদস্পন্দন যেনো এক মূহুর্তের জন্য স্থির হয়ে যায়।লিয়ার বুকের ভেতর ধক করে উঠে। মনস্তাত্বিকে শুরু হয় কাল বৈশাখীর তান্ডব।তবে লিয়ার বুঝে আসছে না।জারিফ সত্যি কি লিয়ার কাছে ক্ষমা চাচ্ছে?জারিফের ভুল ভেঙ্গেছে কি?
গোধূলি লগ্ন এখন।তবে রেস্টুরেন্টের ভেতর বোঝাদায় রাত কি দিন।কারন বিভিন্ন রঙের আলোকসজ্জায় সজ্জিত রেস্টুরেন্টটা ঝলমল করছে হরেক রঙের কৃত্রিম আলোয়।হালকা মিউজিক চলছে। সুন্দর একটা পরিবেশ বিরাজ করছে।এমন সময় জারিফের স্পর্শে লিয়া চমকে যায়।আরো চমকে যায়। হঠাৎ করেই উপর থেকে লাল গোলাপের পাপড়ি পড়ায়।লিয়া জারিফ দুইজনের গায়ের উপর ফুলের পাপড়ি পড়ে। স্লো ভয়েজে রোমান্টিক গান বাজছে
ইয়ে রাতে ইয়ে মউসাম নাদিকা কিনারা,ইয়ে চাঞ্চল হাওয়া।আ আ…..ইয়ে রাতে ইয়ে মউসাম নাদিকা কিনারা,ইয়ে চাঞ্চল হাওয়া।কাহা দো দিলো নে কে মিলকার কাভি হাম না হোঙগে জুদা।
চমৎকার একটা রোমান্টিক ওয়েদার সৃষ্টি হয়েছে।জারিফের শীতল গলার আওয়াজে লিয়ার সারা শরীরে শিহরণ বয়ে যায়।লিয়া চোখ বন্ধ করে ফেলে।লিয়া যেনো বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।গলা দিয়ে কোনো কথাই বের হচ্ছে না। শ্যাম্পু করা চুলের ঘ্রাণ জারিফের নাকে আসতেই কেমন যেনো মাদকতার সৃষ্টি হয়। জারিফের শ্বাস প্রশ্বাস ঘন হয়ে আসে।জারিফ জোরে শ্বাস টেনে নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখে।এত সুন্দর নিরিবিলি পরিবেশে স্বপ্নের পুরুষটাকে এতো কাছে পেয়ে লিয়ার সময় যেনো থমকে যায়।তবে মূহূর্তেই মস্তিষ্ক স্মরণ করায়,মানুষটা আমার স্বপ্নের হলেও।উনি তো অন্যকারো।আমার বড় বোনের হবু বর। মস্তিষ্ক এটা স্মরণ করে দিতেই লিয়া সেকেন্ডের মধ্যে নিজেকে কঠোর করে নেয়।লিয়া নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য মোচড়ামুচড়ি করতে করতে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো,,
“হো হোয়াট?স সরি ফর হোয়াট?আর ছাড়ুন। প্লিজ ছাড়ুন।”
কন্ঠ শুনে জারিফের কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ে। লিয়া দুইহাতে জারিফের হাত এমনভাবে ধরেছে যে লিয়ার নখ জারিফের হাতে বিঁধে যায়।জারিফ মৃদু আহ্ শব্দ উচ্চারণ করে।লিয়ার কোমড় ছেড়ে দিয়ে একহাত দিয়ে লিয়ার বাহু ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিতে নিতে বলে,,
“সামান্য কোমড় জড়িয়ে ধরাতে বিয়ের আগেই আমাকে আহত করে ছাড়লে।বিয়ের পর কি হবে
এতটুকু বলেই জারিফের মুখের ভাষা উড়ে যায়। তাসনিমের যায়গায় এখানে লিয়াকে দেখে জারিফ তাজ্জব বনে যায়।দুইজনই চরম আশ্চর্যান্বিত হয়ে একে অপরের দিকে চেয়ে থাকে।জারিফ এখনো লিয়ার একবাহু ধরে আছে।জারিফের ধরে রাখা হাতের দিকে তাকিয়ে লিয়ার অস্বস্তি হয়।লিয়া সেদিকে তাকাতেই জারিফের হুঁশ হয়।জারিফ দ্রুত লিয়ার হাত ছেড়ে দিয়ে সাথে সাথেই একটু দ্রুত বজায় রেখে দাঁড়ায়। লজ্জিত মুখশ্রীতে তাকিয়ে জড়তা নিয়ে ঠোঁট আওড়ালো,,
“সরি। মিস্টেক হয়েছে।আসলে ”
জারিফের ফর্সা হাতে র’ক্ত জমাট বেঁধে লালচে হয়ে আছে।এটা দেখেই লিয়ার মুখটা মলিন হয়ে আসে।নিজের মধ্যে অপরাধ বোধ জাগ্রত হয়।লিয়া জারিফের হাতের দিকে তাকিয়ে করুণ সুরে বলে,,”আ’ম রিয়েলি সরি।”
জারিফ ছোট করে শ্বাস ফেলে।লিয়ার কথাতে জারিফের ভ্রুক্ষেপ নেই।জারিফের মস্তিষ্কে এখন শুধু একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে লিয়া এখানে কিকরে?জারিফ গম্ভীর মুখাবয়ব করে প্রশ্ন করেই উঠলো,,”তুমি এখানে?না মানে এখানে তো তাসনিমের থাকার কথা। তাসনিম কোথায়?”
এতক্ষণে সবটা ক্লিয়ার হয় লিয়ার কাছে।জারিফ ইন্টেনশনালি লিয়াকে জড়িয়ে ধরেনি। এটা নিতান্তই একটা মিস্টেক ছিলো।লিয়া কিছু বলতে যাবে তার আগেই একটানে পুল মি ডোরটা খুলে হুরমুর করে নীল ঢুকে পড়ে। চিন্তিত হয়ে চঞ্চল কন্ঠে বলে উঠলো,,
“ব্রো তুই ঠিক আছিস?”
কথাটা বলেই নীলের দৃষ্টি যায় লিয়ার দিকে। নীলের পিছু পিছু তাসনিম ঢুকে।লিয়া আর জারিফ সামনাসামনি দাঁড়িয়ে দুজনের গায়ের উপর গোলাপের লাল পাপড়ি।লিয়ার চুলের মাঝে মাঝেই পাপড়ি গুলো দৃশ্যমান।ইভেন জারিফের মাথার উপরও।এসব দেখে তাসনিম অবাক চাহনিতে চেয়ে থাকে।আবার নীলের এমন প্রশ্নে তাসনিম কৌতুহলি দৃষ্টিতে তাকায় জারিফের দিকে।নীলের এমন প্রশ্নে বিব্রত লিয়া জারিফ।আর তাসনিম ভাবতে থাকে এমন প্রশ্নের মানে কি?লিয়া আর জারিফকে এমন লুকে দেখে তাসনিমের মনে কিছু প্রশ্নের সৃষ্টি হয়।তবে আপাতত সেসব প্রশ্নকে চেপে রেখে নির্বিকার থাকে।নীল নখ কামড়ে ধরে জারিফের মুখের দিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে।জারিফের ফেস দেখে নীল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। মনেমনে আওড়ায়,যাক গে ব্রো এর গালটা ঠিকই আছে।কোনো আঙ্গুলের ছাপটাপ নেই। উফ্! বাঁচা গেলো।আর মিস লিয়া এখানে কিকরে?ধ্যাত একটা জিনিস বাজে হলো।এই ভুলটা ব্রো এর সাথে নাহয়ে আমার সাথে হলে আমি তো নিজেকে লাকী মনে করতাম।আর এখন হবু ভাবীকে ম্যানেজ করতে হবে ভুলভাল কিছু ভাবেনি তো।
লিয়া মাথা নুইয়ে রেখেছে। লজ্জায় অস্বস্তিতে মুখটা বারবার লুকাতে চাইছে।এরমধ্যে নীল লিয়াকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে উঠলো,,”মিস লিয়া আপনি?”
লিয়া কিছু বলার আগেই তাসনিম বলতে থাকে। রেস্টুরেন্টের পাশেই একটা কাস্টমার কেয়ার আছে।লিয়ার ফোনে কিছু প্রবলেম হওয়ায় কাস্টমার কেয়ারে আসে।সেখান থেকে বের হয়ে রাস্তায় রিকশার জন্য দাঁড়াতেই কাকতালীয়ভাবে তাসনিমের সাথে দেখা হয়। তাসনিম রিকশা থেকে নেমে লিয়ার কাছে এগিয়ে আসে। একপ্রকার জোর করেই তাসনিম লিয়াকে সাথে আনে। লিয়া জিগ্গেস করেছিলো এখানে আসার কারন কি? তাসনিম উত্তরে বলেছিলো,ওয়েট কর সময় হলেই দেখা যাবে।জারিফের সাথে দেখা করতে আসছে এটা জানলে লিয়া কজ দেখিয়ে চলে যেতো।এখন লিয়ার নিজের উপর মেজাজটা চরম ক্ষিপ্ত।লিয়া নিজের উপর নিজেই আফসোস করছে। উফ্!কি যন্ত্রনা!কেনো যে তখন আপুর থেকে জোর করে হলেও শুনিনি।যদি জানতাম মিস্টার আয়মান জারিফ এর সাথে দেখা করতে আসছে।তাহলে আমি কোনোভাবে ম্যানেজ করে বাসায় চলে যেতাম। উফ্!এমন একটা বিশ্রী পরিস্থিতিও ক্রিয়েট হতো না। রেস্টুরেন্টে ঢুকে তাসনিম চেয়ার টেনে বসে ফোন বের করে।ফোনে নেটওয়ার্কে সমস্যা হওয়ায়। লিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,লিয়া তুই থাক আমি একটা কল করে আসছি। আম্মু ফোন দিয়েছিলো দেখছি।ব্যাক না করলে টেনশন করবে।লিয়া ঘাড় নাড়িয়ে হ্যা সূচক উত্তর দিতেই তাসনিম বাইরে যায়। তাসনিম কথা বলতে বলতে রেস্টুরেন্টের ছাদে উঠে যায়।এমন সময় নীল আর জারিফ আসে।আর কো-ইন্সিডেন্সলি এমন একটা সিচুয়েশন ক্রিয়েট হয়।
নীল বেশ বুঝতে পারে যা প্লান করা হয়েছিলো।সব তো ভেস্তে গেলো।কিছুক্ষণ আগের কথা স্মরণ হতেই জারিফের অস্বস্তি বোধ ক্রমশ বেড়েই চলছে।এদিকে লিয়ার পক্ষেও এখানে থাকাটা অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে।লিয়ার মনে হচ্ছে এখনও মানুষটার স্পর্শ গায়ে লেগে আছে।নীল লিয়া আর জারিফের মুখায়ব দেখে খানিকটা আন্দাজ করতে পারে।দুজনেই বেশ বিব্রতকর অবস্থায় আছে।তাই পরিস্থিতিটা নরমাল করার জন্য বলতে থাকে,,
“এই তোমরা সবাই এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি।চলো বসা যাক।আমার তো ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে।”
নীল চেয়ার টেনে বসে পড়ে। তাসনিমও স্মিত হেসে বসে। তাসনিম হঠাৎ বলে উঠলো,,”কি ব্যাপার তোমরা দুজনে বসছো না যে।তোমরা কি এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি?”
জারিফ একনজর লিয়ার দিকে তাকিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়ে।লিয়াও মাথা নুইয়ে রেখে অপর পাশের ফাঁকা চেয়ারে বসে পড়ে।নীল মেনু কার্ড হাতে নিয়ে অর্ডার দিতে থাকে। বার্গার, স্যান্ডউইচ সাথে কফি।নীল এটাসেটা বকবক করছে আর খাচ্ছে। তাসনিমও সাথে এটাসেটা বলছে।জারিফ মাঝেমাঝে হ্যা হু করছে।আর লিয়া একদম নিশ্চুপ রয়েছে।সাদা গোলাপ গুচ্ছ টেবিলের একপাশে পড়ে রয়েছে।নীল বেচারা সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
খাওয়া দাওয়া পর্ব শেষে এমনি স্বাভাবিক কথাবার্তা বলে তাসনিম জারিফ নীলের থেকে বিদায় নিয়ে লিয়ার সাথে লিয়াদের বাসায় আসে। ওদিকে জারিফ ড্রাইভ করছে।নীল ফন্ট সিটে বসে আফসোস করে বললো,,ইশ!কি থেকে কি হলো?ভাবীকে তো প্রোপোজ করা হলোই না।মাঝখানে একটা এক্সিডেন্ট হলো।”
একটু থেমে জারিফের দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে কৌতুহলি স্বরে ফের বললো,,”বুঝলাম না। ব্রো তোর মতিগতি আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। ভাবীর সাথে রোমান্টিক কথা বলতেই যেখানে তোর হাজারো হেজিটেশন।আর সেখানে কিনা ফট করে মিস লিয়ার কোমড় জড়িয়ে ধরলি?এখানে কিকরে সম্ভব হলো?বাই দ্যা ওয়ে কিস টিস করিসনি তো আবার।”
নীলের কথা শোনার সাথে সাথেই তড়িৎ গতিতে জারিফ চোখ পাকিয়ে তাকায়।ড্রাইভিং করতে করতেই দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত গলায় বলে,,”তোর কি মনে হচ্ছে?আমি জেনে বুঝেই লিয়াকে জ
এতটুকু বলে জারিফ কথাটা গিলে নেয়।কথাটা শেষ করে না। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে স্পষ্টভাবে ফের আওড়ালো,,”বাদদে এসব।আর তোর বুদ্ধি শুনে এই অবস্থা।মাফ চাই আর কখনো আমাকে কোনো আইডিয়া দিতে আসিস না।”
নীল হো হো করে হেসে উঠলো।হাসিটা থামিয়ে বলতে থাকে,,”তবুও আমি বলবো তোর কিছু একটা বোঝা উচিত ছিলো।আমার সিক্স সেন্স বলছে, কাকতালীয়ভাবে এটা হলেও কোনো না কোনো যোগসূত্র রয়েছে।তুই হয়তো বুঝতে পারছিস না।অদৃশ্য কোনো ব্যাপার স্যাপার আছে।কোনো অদৃশ্য টান মহব্বতের ব্যাপার আছে।সেই টান মহব্বত থেকেই হয়তো তুই মিস লিয়ার
জারিফ ধমক দিয়ে নীলকে থামিয়ে দেয়।জারিফ কন্ঠে কঠোরতা নিয়ে বললো,,”এমনিতেই আমার মন মেজাজ ভালো নেই।তাই এখন আপাতত আলতু ফালতু ননস্টপ বকবক বন্ধ রাখ।”
নীলকে চুপ করিয়ে দিলেও নীলের কথাগুলো জারিফকে বেশ ভাবাচ্ছে।সত্যি কি কোনো অদৃশ্য টান মহব্বত আছে?আর বারবার কেনো সব কিছুতেই এই মেয়েটা জড়িয়ে যাচ্ছে? অদ্ভুত! পরক্ষনেই জারিফের মস্তিষ্ক বলে উঠলো,এটা নিছকই একটা ভুলবোঝাবুঝি।আর লিয়া কেনো।অন্যকেউ থাকলেও হয়তো আজ এরকমটা হতে পারতো।তাই এসব বোকাবোকা কথা নিয়ে ভাবা একদম উচিত নয়।এসব ভেবে মনেমনেই মাথা ঝাড়ল জারিফ।
.
হসপিটালে ডক্টরদের সাথে রাউন্ডে আছে তাসনিম। ডক্টর আলিফ পেশেন্টকে দেখে মেডিসিনের নাম বলছে।আর ফাইল হাতে দাঁড়িয়ে তাসনিম নোট করছে।না চাওয়া সত্বেও বারংবার আলিফের দৃষ্টি সবার আড়ালে শ্যামবর্ণ মুখশ্রীতে যাচ্ছে। তাসনিমকে নিয়ে আলিফের বুকের ভেতর অনুভূতির তোলপাড় শুরু হয়েছে।তবুও বাইরে তার ছিটেফোঁটা প্রকাশ করছে না।বেশ গাম্ভীর্য বজায় রেখে যথারীতি কর্তব্য পালন করছে।ওদিকে তাসনিমেরও বেশ অস্বস্তি হচ্ছে।নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেও ভেতরে ভেতরে বিব্রত বোধ হচ্ছে।স্যারের সাথে আগের মতো নরমাল কথা বলতেও আনইজি লাগছে। তাসনিম চোরাচোখে আলিফের দিকে একপলক তাকায়।আড়ালে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে। মনেমনে আওড়ায়,সরি স্যার। আপনার প্রস্তাবটা এক্সসেপট করতে না পারায়।বড্ড লেইট করে ফেলেছেন। উফ্!এখন সব কিছুই আমার হাতের বাইরে।আমি চাইলেও সম্ভব নয়।
এরমধ্যে আলিফ ইন্টার্ন এর একটা মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলে,,”ইউ বলো, নেফ্রোটিক সিনড্রোম এর সিমটম কি?”
মেয়েটি সাথে সাথেই গলা ঝেড়ে বলতে থাকে,,”চোখের পাতা ফোলা,শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে পেটে,পায়ের গিরায় পানি জমা,সাথে এলার্জি , শ্বাসকষ্ট।”
আলিফ সাদা এপ্রোন এর পকেটে দুইহাত গুঁজে ফের শুধালো,,”এই রোগটা যে হয়েছে তা শিয়র হওয়ার জন্য একটা টেস্টই এনাফ।টেস্টের নামটা কি বলুন?”
মেয়েটা কিছুক্ষণ ধরে মনে করার চেষ্টা করতে থাকে। কিয়ৎক্ষন মনে করার চেষ্টা করেও যখন বলতে পারছে না।সেই মুহূর্তে তাসনিম বলে উঠলো,,”আ্যলবুমিন।আ্যলবুমিন টেস্ট করলেই শিয়র হওয়া যায়।আ্যলবুমিন নীল হলে ভালো।ওয়ান প্লাস হলে সমস্যা আছে।আর টু বা থ্রি প্লাস হলে সেটা নেফ্রোটিক সিনড্রোম।”
আলিফ মনেমনে হাসে।তবে মুখে সেটা প্রকাশ করে না।মেয়েটা যথেষ্ট ব্রেনি তা বলার অপেক্ষা রাখে না।আলিফ পাশে থাকা মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে ফের বললো,,”ইউ লিসেন।এই পেশেন্টের গার্ডিয়ানকে সবটা ভালো করে বুঝিয়ে দিবে।আর ইউরিন হিট এর বিষয়টা দরকার পড়লে সাথে থেকে দেখিয়ে দিবে।যেহেতু নতুন।তাই প্রথমে বুঝবে না।”
তাসনিমকে ইগনোর করে অন্যকাউকে দায়িত্ব দিলো। এটা তাসনিমের মনটা মেনে নিতে পারছিলো না।আর এযাবত কালে আলিফ বেশিরভাগ সময়েই তাসনিমকেই বলে এসেছে।তাই হয়তো তাসনিমের কাছে বিষয়টা স্বাভাবিক লাগছে না।যদিও সবকিছু স্বাভাবিক।তবুও তাসনিমকে ভাবাচ্ছে বিষয়টা।আলিফ বেদনাময় ভগ্ন হৃদয় নিয়েই রাউন্ড শেষ করে।বুকের ভেতরের ব্যাথাটা ভেতরেই চেপে রাখে।কাউকে একফোঁটাও বুঝতে দেয়না।আর তাসনিমের কাছেও চায়না নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করতে।কি আছে যে তার হবে না। শুধু শুধু নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করে তাকে বিব্রত করা।আলিফ রাউন্ড শেষে নিজের কেবিনে যেতে থাকে। আলিফের যাওয়ার দিকে ফাইল হাতে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে তাসনিম।স্যার আগের মতো অতোটা কথা বলছে না। ইচ্ছে করেই এড়িয়ে চলছে।যেটা তাসনিমের কাছে মোটেও ভালো লাগছে না।ডিউটিরত ডক্টরস রুমে বসে তাসনিম ফাইল রিফ্রেশ করছিলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বারংবার আলিফের কথা মনস্তাত্ত্বিকে ভেসে আসছে। আলিফের গভীর চোখের চাহনি যা তাসনিমকে জানান দিচ্ছে অনেক কিছুই।মন আলিফের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেও মস্তিষ্ক চলছে তার উল্টো পথে। মস্তিষ্ক বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে আমি কমিটেড।তাই অন্যকারো কথা এই সময় মনে আসা মানেও সেটা পাপ। তাসনিম মস্তিষ্কের সিদ্ধান্তকে প্রায়োরিটি দেয়।আর মাথা থেকে আলিফের চিন্তা দূর করার চেষ্টা চালিয়ে যায়।নিজের কাজে কনসেনট্রেট করার আপ্রাণ চেষ্টা করে।
.
.
সময় কখনো থেমে থাকে না।কারো জন্য ভালো সময়ই হোক বা খা’রাপ সময়ই।যেমনই হোক না কেনো সময় তার আপন গতিতে চলে যায়।পৃথিবী নামক গ্রহে রাত ও দিনের আবর্তনের মাধ্যমে সময় হুহু করে চলে যায়।দেখতে দেখতে দেড় মাস কে’টে গিয়েছে। তাসনিম জারিফের বিয়ের কার্ড ছাপানো হয়েছে।আজ মঙ্গলবার।আসছে শুক্রবার ওদের বিয়ে।ঋতুতে গ্রীষ্মকাল চলছে।বিয়ের শপিং এর জন্য আজকে তাসনিমকে জারিফের পরিবারের সাথে মলে যেতে হবে।নীল এসেছে তাসনিমকে নিতে।সাথে লিয়া তুলিকেও।জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না।আর থেমে রাখাও ঠিক নয়।লিয়া আগের মতো অতোটা স্বাভাবিক না হলেও বলা চলে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে। এরমধ্যে আর লিয়া বা জারিফের কারো সাথে দেখা বা কথা কোনোটাই হয়নি।লিয়া মনে প্রাণে গেঁথে নিয়েছে,জারিফ ওর বড় বোনের হবু বর।আর কদিন পর হবু শব্দটাও থাকবে না।আর বোনের বরের দিকে ভালোবাসার নজরে তাকানো বড় পা’প।আর একপাক্ষিক ভালোবাসার কথা মনে হতেই লিয়া নিজের উপর নিজেই তাচ্ছিল্য হাসে। সামনে লিয়ার এইচএসসি পরীক্ষা।তাই সবসময় পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে।জারিফের কথা কখনো মনে পড়লেও সাথে সাথেই ঘনকালো মেঘের মতো অন্য চিন্তাভাবনা দিয়ে ঢেকে দেয়। সুপ্ত অনুভূতি গুলোকে আর গ্রো করতে দেয়না। তাসনিম আজকে মেডিকেল থেকে ছুটি নিয়েছে বিয়ের জন্য। তাই আজকে শপিং এর ডেট ঠিক করা হয়েছে।নীল লিয়াদের বাসায় আসছে। এখানে আজ সকালে তুলি আসছে।আর তাসনিম মেডিকেল থেকে একবারে ছুটি নিয়ে আসছে।লিয়া ওদের সাথে শপিং এ যেতে অনীহা প্রকাশ করলেও নীল বারবার বলছে, নিরুপমা বেগম নাকি ওদের সবাইকে যেতে বলেছে।আবার তাসনিমের জোড়াজুড়িতে যেতে হচ্ছে। একটা বড় মলে লিয়া তাসনিম তুলি আর সাথে নীল ঢোকে।ওখানে আগে থেকেই নিরুপমা বেগম জারা সাথে নাতাশা ছিলো।ওরা অপেক্ষা করছিলো।জারিফের আসার কথা আছে। ভার্সিটি থেকে সোজা ওদের সাথে এটেন্ড করবে।
এই শহরে অনেকেরই কষ্ট আছে।কেউ বন্ধ ঘরে চাপা কান্নায় আড়াল করে।কেউবা হাসির মাধ্যমে আড়াল করে।তেমনি লিয়াও নিজের কষ্টটা হাসির মাধ্যমে সবার আড়ালে রাখে।নিজেকে ভালো রাখার বা থাকার অভিনয় করে।লিয়া নিজেও জানে না ঠিক কতটা ভালো আছে।তথাপি সবার সামনে সেই আগের মতো চঞ্চল হাসিখুশি লিয়াকে উপস্থাপন করে যায়।সবার সামনে আগের মতো মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখে।যদিও এখনকার হাসিটা কৃত্রিম।বুকের ভেতর থাকা চাপা বেদনাটা চেপেই থাকনা।কি দরকার ভেতরের কষ্টটা বাইরে প্রকাশ করার।এই বাণী নিয়ে চলছে লিয়ার দিন যাপন।
তাসনিম নিরুপমা বেগমকে সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করে। নিরুপমা বেগম অমায়িক হেসে কুশলাদি বিনিময় করে।সবাই ভালোমন্দ কথাবার্তা শেষে মলে ঢোকে শপিং করতে। প্রথমে শাড়ি চুজ করতে থাকে।এমন সময় নিরুপমা বেগম নীলকে উদ্দেশ্য করে বলেন,,”এই নীল । জারিফ এখনো আসলো না যে। এতক্ষণে তো চলে আসার কথা।”
লিয়া একটা কুশনের উপর বসে ছিলো।পাশে নাতাশা ছিলো।এমন সময় দোকানে থাকা কাঁচের আয়নার মধ্যে দৃষ্টি যেতেই লিয়া কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়।
[চলবে…ইন শা আল্লাহ]