#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫১ (১ম ভাগ)||
১০৪।
বাসায় ফিরে পদ্মকে আশেপাশে কোথাও না দেখে রান্নাঘরে গেলো আফিফ। আফিফকে রান্নাঘরের দিকে যেতে দেখেই আফিফা বেগম বললেন,
“তোর বউ আজকাল বড্ড বেড়ে গেছে দেখছি। আমার অনুমতি না নিয়ে সে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে।”
আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কোথায় গেছে?”
“তুই জানিস না? তার মানে তোকেও বলে যায় নি? মেয়েটার মতিগতি ঠিক বুঝতে পারছি না আমি। শোন, তুই ওকে নিয়ে এতো মাথা ঘামাস না তো!”
আফিফা বেগম এবার ছেলের কাছে এসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“একটা মেয়ে দেখেছি আমি। বেশ পছন্দ হয়েছে আমার।”
আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“মা, প্লিজ। আমি তোমাকে আগেও বলেছি, এখনো বলছি, আমি আরেকটা বিয়ে করতে পারবো না।”
“তোর কি বাবা হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই?”
“বাবা হওয়ার জন্য আমাকে আরেকটা বিয়ে করতে হবে?”
“পদ্ম কি তোকে সন্তান দিতে পেরেছে?”
“না পারুক। ও আমার স্ত্রী। আমার দায়িত্ব। যদি আমার কোনো অপারগতা থাকতো পদ্ম কখনোই আমাকে ছেড়ে যেতো না। আমিও আমার দায়িত্ব ফেলে দিতে পারবো না।”
“কে বলেছে পদ্মকে ছেড়ে দিতে? দ্বিতীয় বিয়ে করলে প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিতে হয় না।”
“মা, আমার সমান অধিকার দেওয়ার মতো ক্ষমতা নেই। তাই আমি পদ্মের বর্তমানে দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবো না।”
আফিফ কথাটি বলেই নিজের ঘরে চলে এলো। আজ সন্ধ্যায় উজ্জ্বলকে তাজওয়ারের বিরুদ্ধে বাকী প্রমাণগুলো দিতে হবে। এজন্যই সে বাসায় এসেছে সেই ফাইলটি নিতে, যেটিতে তাজওয়ারের বিরুদ্ধে সব প্রমাণ আছে। কিন্তু বাসায় এসে পদ্মকে না দেখে বেশ অবাক হলো আফিফ। পদ্ম সম্পর্কে সব সত্য জেনে যাওয়ার পর থেকেই আফিফ পদ্মের কাছ থেকে দূরত্ব রাখছে। কিন্তু পাঁচ বছরের এই সংসারটা মিথ্যে দিয়ে শুরু হলেও একটা দায়িত্ববোধ আর মায়া তো সৃষ্টি হয়েছেই। আফিফ যেই ড্রয়ারে ফাইলটি রেখেছিল, সেটা খুলতে খুলতেই পদ্মের নম্বরে ডায়াল করলো। পদ্মের ফোনে রিং হচ্ছে। কিন্তু আফিফের মনোযোগ আঁটকে গেলো শূন্য ড্রয়ারে। আফিফ ব্যস্ত হয়ে ড্রয়ার ঘেঁটে দেখলো কোথাও সেই ফাইলটি নেই। বেশ অবাক হলো সে। আজ সকালেই ফাইলটি সে ড্রয়ারে রেখে বাসা থেকে বের হয়েছিল। কয়েক ঘন্টার মধ্যে কি ফাইলটি অদৃশ্য হয়ে যাওয়া সম্ভব? আফিফ তার ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো পদ্ম কল ধরে নি। রিং হয়ে কেটে গেছে। আফিফ আবার কল করলো পদ্মের নম্বরে। এবার সাথে সাথেই কলটা রিসিভ হলো। আফিফ কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে পদ্মের চাপা আর্তনাদ ভেসে এলো। পদ্ম কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“আমাকে বাঁচান, আফিফ। আমি মরে যাবো।”
আফিফ ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “কি হয়েছে? কোথায় তুমি!”
পদ্ম কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমার সব শেষ হয়ে গেছে। তাজ….”
কথাটা শেষ করার আগেই পদ্ম চেঁচিয়ে উঠলো। ওপাশ থেকে ভেসে এলো পুরুষের কন্ঠ স্বর। আফিফ কন্ঠ শুনেই চিনে ফেলেছে ওপাশের কণ্ঠটি কার। আফিফ চেঁচিয়ে বলল,
“সজিব ওখানে কি করছে পদ্ম? কোথায় তুমি? হ্যালো। হ্যালো।”
আফিফ এক সেকেন্ডও অপেক্ষা করলো না। দৌঁড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। আফিফা বেগম ছেলেকে দৌঁড়ে বেরিয়ে যেতে দেখে থমকে দাঁড়ালেন। কি যে হচ্ছে তার ঘরে, কিছুই বুঝতে পারছেন না তিনি।
(***)
আহি ছাদে দাঁড়িয়ে হালকা হাওয়ায় দোলায়মান ডায়ান্থাস ফুলগুলো ছুঁয়ে দিচ্ছে। তখনই তার পাশে দু’কাপ চা নিয়ে এসে দাঁড়ালো রাদ। আহি রাদের দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি ফেরত দিলো। রাদ চায়ের কাপ দু’টি ছাদের কার্নিশে রেখে আহির পাশে এসে দাঁড়ালো। আহি রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কিছু বলবি?”
রাদ আহির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে তার উড়ন্ত চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিতে দিতে বলল,
“আমাকে আর তুই করে ডাকিস না। আমি এখন এই ইনফরমাল সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চাই।”
আহির গলা কাঁপছে। মায়ের কথা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
“অন্তত একা থাকো, তবুও এমন কাউকে তোমার জীবনে রেখো না, যাকে ভালোবাসো না।”
আহি রাদের দিকে তাকালো। এতো ভালোবাসে কেন ছেলেটা তাকে? এই ভালোবাসা উপেক্ষা করলে তো পাপ হবে তার। সৃষ্টিকর্তা কেন যে তাকে মন ভাঙার ক্ষমতা দেয় নি!
রাদ আহির আরেকটু কাছে ঘেঁষে দাঁড়ালো। আহি কিছুটা দূরে সরে যেতেই রাদ আহির হাতটা ধরে তাকে আটকালো। আহি বলল,
“রাদ, আমি তোকে…”
রাদ আহির ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে বলল,
“আমি জানি তুই আমাকে ভালোবাসিস না। কিন্তু আমি তো বাসি। আমাকে একটু ভালোবাসতে দে। আই প্রমিজ, তুই একদিন আমার প্রেমে পড়বি।”
আহির চোখ ছলছল করে উঠলো। গলায় কথা আটকে গেছে তার। এদিকে রাদ আহির দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। রাদের নিঃশ্বাসের ধাক্কা আহির বুক কাঁপিয়ে দিয়েছে। না, এমন অন্যায় সে করতে পারে না। যেখানে তার মন-মস্তিষ্ক সাড়া দিচ্ছে না, সেখানে সে কীভাবে নিজেকে ঠেলে দিবে? হোক কষ্ট, কিন্তু সারাজীবনের অপরাধবোধ নিয়ে সে বেঁচে থাকতে পারবে না। আহি রাদকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি তোকে ভালোবাসি। কিন্তু বন্ধুর মতো। এমন না যে আমি অন্য একজনকে ভালোবাসতাম দেখে তোকে ভালোবাসতে পারছি না। যাকে ভালোবাসতাম, তাকে পাওয়ার কোনো আশা নেই আমার। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি একটু নিজেকে ভালোবাসতে চাই। তুই তো আমাকে গত কয়েক বছর ধরে দেখেছিস। আমার উন্মাদনা দেখেছিস। আমার এক তরফা পাগলামো দেখেছিস। বল না রাদ, তোর কি মনে হয় নি, আফিফকে ভালোবাসতে বাসতে আমি নিজেকে ভালোবাসতে ভুলে গেছি?”
রাদ চুপ করে রইলো। আহি রাদের কাছ থেকে দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো আর বলল,
“আমার তোকে বিয়ে করতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু এখন আমি বিয়ে করবো না। আমি কিছু বছর নিজেকে দিতে চাই। একান্ত নিজেকে। এরপর না হয় ভেবে দেখবো।”
“যদি তখন আমি না থাকি?”
আহি রাদের কাছে এসে তার হাত ধরে বলল,
“তুই যদি মুভ অন করিস, আমার কোনো সমস্যা নেই।”
“আমি বেঁচে থাকতে এই মনে তোর জায়গা কাউকে দিতে পারবো না।”
আহি রাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাদ বলল,
“আমি যদি না থাকি! যদি ততোদিন না বাঁচি?”
“কি বাজে কথা বলছিস? আমার লাইফ-লাইন তুই। প্রেমিক পুরুষকে ভালোবাসার চেয়ে অনেক বেশি গভীর আর শক্ত একটা মনের মতো বন্ধুকে ভালোবাসা। তুই জানিস, তুই আমার মেডিসিন। আমার জীবনে যদি তুই আরো আগে আসতি, আমি নিজেকে এতোটা নিঃস্ব ভাবতাম না। তোর মতো প্রেমিক পুরুষ পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু আমার তোর মতো চমৎকার একজন পুরুষের প্রেমিকা হওয়ার জন্য নিজেকে চমৎকার ভাবে সাজাতে হবে। সময় দিস কিন্তু।”
(***)
আহি চায়ের কাপে চুমুক দিতে না দিতেই ফোনে টুংটাং মেসেজ আসতে লাগলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো তাজওয়ারের একাউন্ট থেকে কিছু ছবি আর ভিডিও এসেছে। আহি চায়ের কাপ নামিয়ে স্ক্রিন অন করতেই ভিডিওটা চালু করলো। রাদ পাশেই দাঁড়ানো। ভিডিওতে চলমান শব্দ কানে আসতেই রাদ স্তব্ধ হয়ে গেলো। আহির যেন পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে। তার মাথাটা ভারী ভারী লাগছে। রাদ আহির কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে স্ক্রিন বন্ধ করে দিয়ে বলল,
“মেয়েটা কি পদ্ম?”
আহির চোখে অশ্রু ভীড় করতে লাগলো। রাদ আহির হাত ধরলো। আহির নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। সে জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বলল,
“আমি একটা জলজ্যান্ত অভিশাপ, রাদ। আমার কাছ থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তাজওয়ার পদ্মের এতো বড় ক্ষতি করেছে! আমার খুব অস্থির লাগছে, রাদ। তাজওয়ার ফার্সার সাথে যা করেছে, ঠিক একই কাজ যদি পদ্মের সাথে করে? আমার ওকে থামাতে হবে। ওরা আমার সব প্রিয় মানুষগুলোকে আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নিয়েছে। আমার মানুষগুলো সব আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে শুধু ওই তাজওয়ার খানের জন্য। আই উইল কিল হিম।”
আহি ফোন হাতে নিয়ে ছাদ থেকে নামতে গিয়ে পা ফসকে পড়ে যেতে নিবেই তখন রাদ পেছন থেকে আহিকে ধরে ফেললো আর বলল,
“আহি, শান্ত হো।”
আহি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো আর বলল,
“আমি এই মুখ নিয়ে পদ্মের সামনে কীভাবে দাঁড়াবো? আমি ওর অপরাধী।”
আহি এলোমেলো ভাবে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গাড়িতে উঠে বসলো। রাদও আহির পাশে বসেছে। ড্রাইভারকে তাজওয়ারের ফ্ল্যাটের ঠিকানা দিতেই তারা সেদিকে রওনা হলো। এদিকে আফিফ অস্থির হয়ে আছে। সে তাজওয়ারকে একের পর এক ফোন করে যাচ্ছে, কিন্তু তাজওয়ার কল ধরছে না। সে সোফায় পা তুলে দিয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে বলতে লাগল,
“এক দেশে ছিল এক বাঘ। তার ছিল এক বাঘিনী। বাঘিনী পড়েছে এক শেয়ালের প্রেমে। আর শেয়ালের বউ গাভী ফন্দি করতে এসেছে বাঘের গর্তে। বাঘ ছিল বেশ ক্ষুধার্ত। সে গাভীকে খেয়ে ফেললো। তাই বউকে বাঁচাতে শেয়াল আসছে ছুটে। বাঘিনীও শশব্যস্ত। বাঘের গর্তে শীঘ্রই পড়বে শেয়াল-বাঘিনীর পা। বাহ, চমৎকার এক মিলনায়তন হবে বাঘের বাড়িতে। গাভীর চামড়া গুলো মাটিতে খসে পড়েছে। রক্ত বেয়ে বেয়ে পড়ছে। এবার শেয়ালের সেই শুকনো মুখটা দেখবে বাঘ। আর বাঘিনী আমার ফিরে আসবে বিড়ালের বেশে৷”
সজিব হেসে বলল,
“আহিকে হাতে আনার এতো চমৎকার প্ল্যান!”
“এবার কাজি এনে বিয়ে পড়ানোর পরই ভিডিও ডিলিট করবো। একবার আহি আমার হোক, তারপর আমি আহিকে বুঝিয়ে দেবো, আমার সাথে বেইমানি করার শাস্তি কি!”
(***)
আহি আর রাদ তাজওয়ারের ফ্ল্যাট বাড়ির কাছে আসতেই দেখলো, আফিফ পুলিশ নিয়ে সেখানেই এসেছে। আফিফকে দেখে থমকে গেলো আহি। আফিফ আহির কাছে দৌঁড়ে এসে বলল,
“তাজওয়ার পদ্মকে এখানে নিয়ে এসেছো। ওর ফোনের লোকেশন এখানে দেখাচ্ছে। আমি পদ্মকে ফোন করেছিলাম। ওর কন্ঠ শুনে মনে হয়েছে, ও বিপদে আছে। আমি তাজওয়ার খানকে মেরে ফেলবো, যদি ও পদ্মের গায়ে হাতও লাগায়।”
আহি নির্বাক তাকিয়ে আছে আফিফের দিকে। পুলিশ কন্সটেবল বাড়িতে ঢুকলো। আফিফও তাদের পিছু পিছু গেলো। আহি আর পা বাড়াতে পারছে না। রাদ আহির হাত ধরে বলল,
“তুই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ওই তাজওয়ার জানোয়ারটাকে জিতিয়ে দিবি? এবার কিছু একটা করতেই হবে।”
আহির শুকনো মুখটা ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে এলো। দাঁতে দাঁত চেপে হাত মুঠো করে তাজওয়ারের ফ্ল্যাটের দিকে পা বাড়ালো আহি।
(***)
ফ্ল্যাটের দরজায় বার-বার ধাক্কা দিচ্ছে পুলিশের লোকেরা। তাজওয়ার পীপহোল দিয়ে তাদের দেখে নিলো। সজিব আর জিলান ভীত কন্ঠে বললো,
“আমরা তো শেষ।”
তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“রিল্যাক্স গাইস, এই সামান্য কন্সটেবল আমার কিচ্ছু করতে পারবে না। এরা বেশি হলে আমাকে থানায় নিয়ে যেতে পারবে। আর ভেতরে ঢোকানোর আগেই আমি মুক্ত। আর আমি মুক্ত হলেই তোরাও মুক্ত। এসব বস্তিবাসীদের মামলায় রাজার সিংহাসন কাঁপে না।”
তাজওয়ার দরজা খুলে দিতেই আফিফের মুখোমুখি হলো। আফিফ তাজওয়ারের নাক বরাবর একটা ঘুষি মেরে বলল,
“পদ্মকে এখানে কেন এনেছিস?”
পুলিশের এক কন্সটেবল আফিফ আর তাজওয়ারের হাতাহাতি থামিয়ে দিতেই আহি আর রাদ উপরে উঠে এলো। তাজওয়ার আহিকে দেখে বলল,
“মাই সুইটহার্ট, ওয়েলকাম, ওয়েলকাম।”
আহি তাজওয়ারের কথায় পাত্তা না দিয়ে দৌঁড়ে ভেতরের রুমে চলে গেলো। আফিফও আহির পিছু পিছু ভেতরে গেলো। শুধু রাদ সেখানে দাঁড়িয়ে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তাজওয়ারের দিকে।
১০৫।
আহি আর আফিফ একসাথেই সেই বন্ধ দরজা খুলে রুমের ভেতরে প্রবেশ করে দেখলো মেঝেতে বিবস্ত্র পড়ে আছে পদ্ম। আফিফের পৃথিবীটা যেন সেখানেই থমকে গেলো। সামনে এগুনোর সাহস হলো না তার। সে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে মেঝেতেই বসে পড়লো। আহি ছুটে গেলো পদ্মের কাছে। গায়ের উড়না খুলে পদ্মকে পেঁচিয়ে নিলো। উড়নাটা পদ্মের ত্যক্ত শরীরটা ঢাকতে ব্যর্থ হলো। আহি পাশের বেডশিটটা টেনে নিয়ে পদ্মের গায়ে জড়িয়ে দিলো। পদ্ম কারো স্পর্শ পেয়ে নিভু নিভু দৃষ্টিতে তাকালো। আহির মুখখানা দেখে বুকের ভেতরটা পুড়ে ছাই হয়ে গেলো পদ্মের। আহি শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। দৃঢ় স্বরে বলল,
“আল্লাহর কসম, ওই শয়তানকে আমি খুন করে ফেলবো।”
পদ্মের দৃষ্টি আটকালো আফিফের শুকনো মুখের দিকে। মানুষটা নিস্তেজ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। পদ্মের কষ্ট হলো খুব। এদের ঠকানোর শাস্তি পেয়েছে সে। কান্না করার অধিকার নেই তার। এটা মেনে নিতে বাধ্য পদ্ম। আহি পদ্মকে ছেড়ে তার দুই গালে হাত রেখে বলল,
“তুই আমার স্ট্রং গার্ল। মনকে শক্ত কর। আমরা সবাই তোর পাশে আছি। আফিফও আছে।”
আহি পেছন ফিরে আফিফের দিকে তাকালো। আফিফকে দেখে বুকটা হুঁ হুঁ করে উঠলো তার৷ পদ্মকে শক্ত করে ধরে রাখলো সে। মেয়েটা যদি ভুল কিছু করে ফেলে?
প্রায় মিনিট খানিক পর রুমের দরজায় খট করে শব্দ হলো। পদ্ম আহিকে শক্ত করে চেপে ধরলো। আফিফ উঠে দরজা খুলতেই একজন কন্সটেবল রুমে উঁকিঝুঁকি দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। আফিফ বলল,
“একজন মহিলা কন্সটেবল লাগবে এখানে।”
পুরুষ কন্সটেবলটি ফোন করে একজন মহিলা কন্সটেবলকে তাজওয়ারের বাড়ির ঠিকানা দিলো। সে না আসা অব্ধি পদ্ম ভেতরেই থাকবে। এদিকে আফিফ রুম থেকে বের হয়েই তাজওয়ারকে জোরে একটা লাথি দিলো। পুলিশ কন্সটেবলের লোকগুলো আফিফকে ধরে বলল,
“এই কাজ তো আপনার না।”
রাদ আফিফকে শক্ত করে ধরে রেখে বলল,
“আফিফ, প্লিজ শান্ত হও। ঠান্ডা মাথায় এই জানোয়ারটাকে শাস্তি দিতে হবে। তুমি দেখো ওর মুখের দিকে। বিন্দুমাত্র ভয় নেই। কারণ ওর কাছে পাওয়ার আছে। ও জানে ও বেরিয়ে আসবে।”
আফিফ শক্ত মুখে বলল,
“ও যদি বের হয়, আমি ওকে খুন করে ফাঁসিতে ঝুলবো।”
প্রায় ঘন্টাখানেক পর পুলিশ তাজওয়ার, জিলান আর সজিবকে থানায় নিয়ে গেলো। মহিলা কন্সটেবলটি পদ্মকে বিভিন্ন প্রশ্ন করছে। পদ্ম থম মেরে বসে আছে। সে উত্তর দিতে পারছে না। আফিফ বসার ঘরে পায়চারি করছে। হঠাৎ তার চোখ আটকালো মেঝেতে পড়ে থাকা আধপোড়া একটি কাগজের দিকে। আফিফ মেঝে থেকে কাগজটি তুলতে গিয়ে দেখলো এটা তাজওয়ারের বিরুদ্ধে সংগ্রহ করা প্রমাণগুলোর একটি পৃষ্ঠা। আফিফ পাশেই ডাস্টবিন দেখতে পেলো। সেদিকে গিয়ে দেখলো আশেপাশে ছাই। ভেতরে পুড়ে যাওয়া সেই ফাইলটি। আফিফ কাগজটি হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করলো। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক চিরে। তখনই মহিলা কন্সটেবলটি বেরিয়ে এসে আফিফকে বলল,
“আপনার ওয়াইফ কিছুই বলছে না। উনি এখানে কীভাবে এলেন জিজ্ঞেস করেছি, সেটাও বলছে না। আমাদের সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে হবে। বাড়ির গেটে, সিঁড়িতে, লিফটে সবখানে সিসি ক্যামেরা লাগানো। আমার মনে হয়, আপনার স্ত্রী এখনে শকে আছে।”
আফিফ মিনমিনিয়ে বলল,
“আর এই শক থেকে পদ্ম জীবনেও বেরুতে পারবে না।”
(***)
পদ্মকে নিজের বাসায় নিয়ে এসেছে আহি। আফিফা বেগম এসব জানলে আরো ঝামেলা বাড়বে, তাই পদ্মকে ওখানে যেতে দেয় নি সে। পদ্মকে একটা রুমে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে আহি তার পাশে বসে বলল,
“কিচ্ছুই হয় নি তোর। তুই রেস্ট নে। দেখবি, একটু ঘুমালে ভালো লাগবে।”
পদ্ম কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। আফিফ রুমের দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই আহি উঠে বেরিয়ে গেলো। আফিফ দরজাটা আটকে দিয়ে পদ্মের পায়ের কাছে মেঝেতে বসলো। পদ্ম আফিফের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আফিফ হতাশ কণ্ঠে বলল,
“একটু আগেও মনে হচ্ছিল, তোমার সাথে যা হয়েছে তার জন্য হয়তো আমিই দায়ী। কিন্তু এখন কি মনে হচ্ছে জানো? তুমি স্বেচ্ছায় নিজেকে ধ্বংস করতে তাজওয়ারের বাড়িতে গিয়েছিলে।”
পদ্ম আফিফের কথা শুনে চোখ বন্ধ করে নিলো। আফিফের গলা কাঁপছে। চোখ ঘোলাটে হয়ে গেছে। সে পদ্মের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
“অতীত সবার থাকে। আমারও ছিল। তুমি আমাকে ঠকিয়ে বিয়ে করেছো, মানলাম। একদিন হয়তো সব ঠিক হয়ে যেতো। কিন্তু এতো বড় প্রতারণা! এটা তো আগের চেয়েও বেশি সাংঘাতিক। পাগল না-কি তুমি, পদ্ম? কাকে বিশ্বাস করেছো? তোমার ছোটবেলার বান্ধবীকে তুমি বিশ্বাস করতে পারলে না? তোমার কি মনে হয় মেয়েটা তোমার সংসার ভাঙবে? আমাকে বিশ্বাস করতে পারলে না? যার সাথে পাঁচ বছর সংসার করেছো, সেই মানুষটাকে বিশ্বাস করতে পারলে না? কাকে বিশ্বাস করতে গেলে? ওই তাজওয়ার খানকে? কতো মানুষের প্রাক্তন থাকে! আহির সাথে তো আমার কোনো প্রেমের সম্পর্কই ছিল না। শুধু একটা অনুভূতি ছিল, যেটা তুমি আর তাজওয়ার খান মিলে শেষ করে দিয়েছো। আমি তো তোমার সাথে সুখী হতে চেয়েছিলাম। আমার জীবনটা কেন নষ্ট করলে, পদ্ম?”
পদ্ম বিছানা ছেড়ে উঠে আফিফের সামনে এসে মেঝেতে বসে বলল,
“শাস্তি হয়ে গেছে আমার। আমাকে তালাক দিয়ে দিন। আমি চলে যাই আপনার জীবন থেকে। এক কাজ করুন, আমাকে বিষ এনে দিন। আমি খেয়ে মরে যাই। আপনাকে ভালোবাসার শাস্তি পেয়েছি আমি। আপনাকে বেঁধে রাখার শাস্তি পেয়েছি আমি। আহি যেমন আপনার ভালোবাসায় ছাই হয়ে গেছে, আমিও হয়ে গেছি। আমার পুরো শরীর থেকে এখন পোড়া গন্ধ বেরুবে। আহির মতো টাকা নেই আমার। বাবার গাড়ি-বাড়ি নেই। আপনি ছেড়ে দিলে আমার ঠিকানা হবে রাস্তায়।”
আফিফের দমবন্ধ হয়ে এলো। সে পদ্মের হাত ধরে বলল,
“আমি তোমাকে ছাড়বো না, পদ্ম। তোমার মতো বিশ্বাসঘাতকতা করবো না আমি।”
(***)
তাজওয়ার নিজেকে এক ঘন্টার মধ্যে ছাড়িয়ে নিয়ে আবার প্রমাণ করে দিলো সে কতো ক্ষমতাবান পুরুষ। আহি ফোন হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। তাজওয়ার ছাড়া পেয়েই আহিকে মেসেজ লিখেছে,
“কবুল বলবে, না-কি ভিডিও ভাইরাল করবো? এখন তো শুধু গুটি কয়েক মানুষ জানে। তখন পুরো পৃথিবী জানবে। আমার কাছে চ্যানেল আছে কিন্তু। লাইভ টেলিকাস্ট করতেও সমস্যা হবে না।”
আহি আফিফকে মেসেজটা পাঠালো। আফিফ সাথে সাথেই আহিকে কল করে বলল,
“এই দেশে ওর শাস্তি হবে না। ওকে মেরে…”
আহি আফিফকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার মাথায় এমন একটা বুদ্ধি এসেছে, যেটা তাজওয়ারকে ফাঁসাবেও, আর তার পাওয়ারটাও আর কাজ দেবে না।”
“কি বুদ্ধি?”
“দেখা করো। উজ্জ্বলও আসবেন। সেখানেই বলি।”
পরদিন আফিফ, উজ্জ্বল আর আহি একসাথে বসলো। আহি তার বুদ্ধিটা আফিফ আর উজ্জ্বলকে শোনালো। আফিফ বলল,
“তুমি এতো বড় রিস্ক নিবে?”
“নিতে হবে। আমি চাই না পদ্মের ব্যাপারে কেউ জানুক। তাই আমি এই কাজটা করবোই।”
আফিফ আহিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি তোমাকে এই কাজ করতে দেবো না। তুমি জানো, এটা কতো বড় ডিসিশান? তোমার ভবিষ্যৎ থেমে যাবে।”
“কিছুই হবে না আমার। আমার ভবিষ্যৎ থেমে গেছে অনেক আগেই। এখন আমি আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি না। যা হওয়ার আজ হবে। আমার জীবনে আগামীকালের কোনো অস্তিত্বই নেই। আর আমি যা করছি পদ্মের জন্য না। আমার নিজের জন্য। তাজওয়ারের ফাঁদে ফেঁসে যাওয়া প্রতিটা মেয়ের জন্য। ভবিষ্যতে ওর হাত থেকে আরো অনেক মেয়েকে বাঁচানোর জন্য।”
চলবে-