#তোমাতেই_নৈঃশব্দ্য_প্রহরে
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্বসংখ্যা_৩
” এই শুনছো! ”
স্ত্রী নিশাত বড় কোমল স্বরে ডেকে উঠলো স্বামী মানুষটিকে। জাওয়াদ তখন বিছানায় বসে। ল্যাপটপে অফিসিয়াল কাজকর্ম করতে ব্যস্ত। মিহি স্বরে প্রত্যুত্তর করলো,
” হুঁ। ”
নিশাত আলতো করে ওষ্ঠাধর ভিজিয়ে নিলো জিভের স্পর্শে। মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকা বর্ণগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে পরিপূর্ণ বাক্যে রূপান্তর করলো। থেমে থেমে বললো,
” বলছি যে উক্তি’র বিয়েটা তো হয়ে গেছে। ফিরতি নাইওরে ওদের আনাও হলো না। এই শুক্রবার… আসতে বলি? ”
জাওয়াদ ডান পাশে দণ্ডায়মান স্ত্রীর দিকে এমনভাবে তাকালো, যে চাহনি নিশাতের বুকের ভেতরটা রীতিমতো ফালাফালা করে দিলো। ত্বরিত দৃষ্টি সরিয়ে নিলো নিশাত। আমতা আমতা করে বললো,
” অমন করে তাকাচ্ছো কেন? আমি ভুল কিছু বলেছি কি? ”
জাওয়াদ ল্যাপটপে মনোনিবেশ করে গাঢ় কণ্ঠে বললো,
” যা বলেছো দ্বিতীয়বার যেন না শুনি। যে গেছে তো, গেছে। কাহিনী খতম। এ বাড়িতে ওর আর কোনো জায়গা হবে না।”
এমন নির্দয় বাক্যে দুঃখ পেল নিশাত। করুণ স্বরে বলে উঠলো,
” ও তোমার আপন ছোট বোন হয়, জাওয়াদ। ”
উচ্চ স্বরে থামিয়ে দিলো জাওয়াদ,
” নিশাত! ”
দমে গেল নিশাত। মলিন হলো মুখশ্রী। তাতে ভ্রূক্ষেপ না করে জাওয়াদ অভিব্যক্তিতে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ততা প্রকাশ করে বললো,
” আমি অফিসের কাজ করছি। মেজাজ খারাপ করো না। যাও। নিজের কাজ করো গিয়ে। ”
আশাহত নিশাত আর দিরুক্তি করলো না। নিঃশব্দে সেথা হতে প্রস্থান করলো। জাওয়াদ চক্ষু বন্ধ করে ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়লো। মেজাজ এখনো ফুটন্ত জলের ন্যায় টগবগ করছে। কোনোমতে শান্ত হলো সে। অতঃপর করতে লাগলো নিজ কর্ম।
•
তমস্র রজনী। নিদ্রায় তলিয়ে উক্তি। ডান পাশেই আধশোয়া হয়ে বালিশে হেলান দিয়ে মুয়ীয। হাতে স্মার্টফোন। তাতে ‘ Into The Dead 2 ‘ গেমস খেলতে মগ্ন সে। রাতের আঁধারে জ°ম্বি গেমস খেলার অনুভূতিই অন্যরকম। মুয়ীয পুরো মনোযোগ দিয়ে খেলে চলেছে। একটু পরপর পরিবর্তিত হচ্ছে মুখভঙ্গি। উঠছে ঈষৎ নড়েচড়ে। ওর এমনতর কাণ্ডে উক্তি মেয়েটার ঘুমে ব্যঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। তাই তো ঘুমের ঘোরে হালকা নড়ে উঠলো উক্তি। শুলো মুয়ীযের দিকে ঘুরে। সে মুহূর্তে লেভেল সম্পন্ন করে ফুরফুরে মেজাজে মানুষটা। প্রসন্ন চিত্তে এমনিই নজর পড়লো বামে শায়িত মেয়েটার পানে। আস্তে ধীরে পরিবর্তন এলো তার অভিব্যক্তিতে। কিয়ৎক্ষণ পূর্বের উৎফুল্ল চেহারায় এখন মুগ্ধতার হাতছানি! শাড়ি পরিহিতা উক্তি ঘুমিয়ে। দিনের মতো এখন আর চুল আবৃত নয় শাড়ির আঁচলে। বরং মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় উন্মুক্ত। উন্মুক্ত কেশরাশি নিজ মর্জি মতো ছড়িয়ে বালিশের বুকে যত্রতত্র। ঘুমন্ত কন্যার শাড়ি কিঞ্চিৎ এলোমেলো। ফলস্বরূপ পেট কিছুটা উন্মুক্ত। দৃশ্যমান নাভিকুণ্ড। ক্ষুদ্রাকৃতির সে কেন্দ্রবিন্দুতে নজর আটকাতেই গলবিল শুকিয়ে হলো মরুদ্যান। অদম্য ঝড় উঠলো বক্ষ পিঞ্জিরায়। উচ্চ কলরবে ধুকপুক ধুকপুক করে চলেছে হৃৎপিণ্ডটা। এ কোন অজানা মধুরতম সর্বনা’শ! কেন এমন করে হাহাকার হচ্ছে অন্তরে! কেন পু’ড়ছে সমস্ত স্নায়ু! কিসের অভাবে ছটফটানি হৃদয়ের অলিগলি! জানা নেই মুয়ীযের। সে শুধু অনুভব করতে পারলো এক তড়িৎ প্রবাহিত হলো শিরদাঁড়া বেয়ে। বড় তৃষ্ণা পাচ্ছে তার। অজানা কোনো বাসনা পূরণের আকুল তৃষ্ণা ছেয়ে তনুমনে! এক ছটফটে ব্যগ্ৰতা!
বিমুগ্ধ মুয়ীয কখন যে মোবাইল রেখে স্ত্রীর সন্নিকটে এসেছে নেই জানা। সে এলো। খুব সন্নিকটে এলো। দু’জনের মধ্যকার দূরত্ব অতীব ক্ষীণ। আঁধার মাঝে তখন এক টুকরো আলোর বড় অভাব। ঘন আঁধারে সয়ে এসেছে চক্ষু। সহনীয় সে আঁধারে মুয়ীয করে বসলো এক অভাবনীয় সাহসী কাণ্ড! পুরুষালি কর্মঠ-খসখসে হাতটা বাড়িয়ে দিলো। বৃদ্ধাঙ্গুল আলতো করে ছুঁলো নাভি। দপ করে জ্বলে উঠলো ভেতরকার পৌরুষ চিত্ত। কামনার তটিনীতে তখন ডুবে যাওয়ার উপক্রম। মুয়ীয বৃদ্ধাঙ্গুল সরিয়ে নিলো না। বরং আলতো করে বুলিয়ে গেল আশপাশ। মেপে নিলো সে কেন্দ্রবিন্দুর গভীরতা। প্রতিটি সেকেন্ড, মিনিটে মানুষটার একেক রকম ভিন্নতর অনুভূতি হচ্ছিল। বৃদ্ধি পাচ্ছিল উত্তপ্ত শ্বাস প্রশ্বাসের চলাচল। চক্ষু বন্ধ করে ওষ্ঠাধর গোলাকার করে শ্বাস ছাড়লো মুয়ীয। আস্তে করে অতি সাবধানে সরিয়ে নিলো আঙ্গুল। বড় আদর মেখে নিজ বৃদ্ধাঙ্গুলে এঁকে দিলো এক দীর্ঘস্থায়ী চুম্বন। যেন সে চুম্বন বৃদ্ধাঙ্গুল নয় বরং অর্ধাঙ্গিনীর আবেদনময়ী নাভিকুণ্ড ই ছুঁলো। তবে মোহাচ্ছন্ন মুয়ীয কি জানে রাতের এই ঘন আঁধারে এক জোড়া মায়াবিনী চক্ষু বি°স্ফোরিত নজরে তারই পানে তাকিয়ে!
•
দিনমণি তখন প্রতাপশালী রাজার ন্যায় দখল নিয়েছে বিস্তর গগণের। উত্তপ্ত রৌদ্রে জনজীবন ঝলসে যাবার উপক্রম। ঘনবসতিপূর্ণ এ এরিয়ায় এক নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থিত পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ওয়াশরুম। গণ ওয়াশরুম হিসেবে তা ব্যবহৃত হয়। এ এরিয়ায় বসবাসকারী মানুষগুলো ক্রমান্বয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে এই ওয়াশরুম ব্যবহার করে থাকে। তাদের বাড়িতে আলাদা করে কোনো ওয়াশরুমের ব্যবস্থা নেই। গোসলের সময় মূলত এই বিশাল লাইন সৃষ্টি হয়। কখনো কখনো লাইনে দাঁড়িয়েই পেরিয়ে যায় কয়েক ঘণ্টা। তখন অসহ্য-অস্থির হয়ে শুরু হয় অশান্তি, অরাজকতা। গালমন্দ। যেমনটা চলছে ঠিক এই মুহূর্তে।
উক্তি অনেকক্ষণ ধরে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম হাতে লাইনে দাঁড়িয়ে। একজন গোসল করতে ঢুকেছে বহুক্ষণ আগে। এখন অবধি বের হবার নামগন্ধ নেই। এক মাঝবয়সী মহিলা দরজা ধাক্কা দিয়ে বারবার বের হতে বলছে। ভেতরে থাকা নারী তা শুনলে তো! এতেই লেগে গেল অশান্তি। হাউকাউ অবস্থা।
” ওই বেডির ঘরে বেডি! গোসল করতে গিয়া ম^রছোছ নি! বাইর হ কইতাছি। ”
” তুই একলাই গোসল করতি? আর মাইনষে করতো না? এক্ষুনি বাইর হ। ”
সেথায় উপস্থিত নারীরা বেশ ক্ষে’পেছে। উচ্চ স্বরে মনের ক্ষোভ প্রকাশ করে চলেছে। শুরু হয়েছে নিজেদের মধ্যে তর্ক বিতর্ক। উক্তি সজল নয়নে তাকিয়ে। এ কোথায় এসে পড়লো সে! সামান্য গোসল করা নিয়েও অশান্তি হচ্ছে। এসব যে সে কষ্মিনকালেও দেখেনি। এমনিতেই তেজস্বী রৌদ্রের উত্তাপে প্রাণ ওষ্ঠাগত। এর ওপর ওয়াশরুমের অবস্থা ভালো না। বেশ নোংরা পরিবেশ। গোসল করতে গেলে ঘৃণায় নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসতে চায়। কোনোমতে ঢুকে যথাসম্ভব দ্রুত গোসল করে আসে সে। এখন গোসল করতে এসেও অশান্তি সহ্য করতে হবে! সে যে লোকের কটূ বাক্যে বড় ভয় পায়! উক্তি না পারছিল কিছু বলতে। না পারছিল সহ্য করতে। অপারগ মেয়েটি একটিবারের জন্যও বলতে পারলো না,
‘ তোমরা থামো। শুধু শুধু ঝগড়া করো না। ‘
বোবা মেয়েটি কিচ্ছু বলতে পারলো না। নিজের মতো করে হাত নাড়িয়ে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে ওদের থামতে অনুরোধ করছিল। তবে তা কেউ লক্ষ্য করলে তো। সবাই তো নিজেদের মতো ঝামেলা করতে ব্যস্ত। ঠিক সে মুহূর্তে ওয়াশরুমে থাকা মহিলাটি গোসল সেরে বেরিয়ে এলো। এতে এক মুহুর্তের জন্য থামলো চলমান ঝগড়াঝাঁটি। উক্তি বড় করে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। শুকরিয়া আদায় করলো মহান রবের। তবে আফশোস! আরেক দফা ঝামেলা তৎক্ষণাৎ আরম্ভ হয়ে গেল। জোরদার এ ঝামেলার সূত্রপাত করলেন ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসা সে মহিলা। ব্যাস। লেগে গেল তুমুল ঝগড়া। চুলোচুলি, হাতাহাতি সময়ের ব্যপার মাত্র। উক্তি আর সহ্য করতে পারছিল না। দু হাতে যথাসম্ভব শক্ত করে কান চেপে ধরলো মেয়েটা। ভেতরকার যন্ত্রণার চিত্রপট লুকাতে দাঁতে কা’মড়ে ধরলো নিম্ন ঠোঁট। মোহনীয় চোখ দু’টো তখন জলে টায়টম্বু্র। বাবা তাকে এভাবে ব°লি দিলো!
•
ঘড়ির কাঁটা নির্দেশ করছে সময় তখন বেলা এগারোটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। অফিসের সে ফ্লোরে কর্মরত উপস্থিত কর্মচারীবৃন্দ। তবে সকলে কিন্তু কর্মরত নয়। কেউ কেউ অফিসিয়াল কর্ম বাদ দিয়ে নিজ কর্ম সম্পাদন করে চলেছে। ফুসুরফুসুর করছে নিজেদের মধ্যে। কেউবা ফোনে ব্যস্ত তাদের সোনা, বাবুর সঙ্গে পিরিতি আলাপ করতে। তাদের এ আলাপণ যে আরেক জনের সহ্য হলো না। ভ্র জোড়ায় প্রকাশ পেল অসন্তোষ। তাই এলো। চলনবলনে অভিজাত প্রকাশ করে এক কর্মচারীর সন্নিকটে এলো। সে কর্মচারী তখন উদ্বিগ্ন হয়ে ফোনালাপে ব্যস্ত,
” বাবু! তুমি এখনো বেড-টি খাওনি?! ও মাই গড! কত বেলা হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠো। টি খাও বাবু। শরীর খারাপ করবে যে। তোমার কিছু হলে আমার কি হবে সোনা?”
ওপাশ হতে তার বাবুসোনা কিছু বলার পূর্বেই কর্ণ পথে পৌঁছালো গম্ভীর বিদ্রুপাত্মক স্বর,
” বহুত দুঃখের সহিত কইতাছি সৌরভ মিয়া। কোম্পানি থে আমনেরে ঝাঁটাপেটা করলে আমগো কারোরই কিছু হইতো না। ”
অল্প বয়সী কর্মচারী সৌরভ সাহেব আঁতকে উঠলেন! ত্বরিত কান হতে মোবাইল সরিয়ে তাকালেন ডানে। দাঁড়িয়ে কোম্পানির জুনিয়র অ্যাকাউন্টেন্ট জনাব মুয়ীয হাসান। পড়নে কয়েক রঙের সমারোহে তৈরি শার্ট। শার্টের ওপরের দু’টো বোতাম উন্মুক্ত। ফলস্বরূপ দৃশ্যমান লোমশ বুকের ওপরাংশ। পরিহিত জিন্স প্যান্ট বছর কয়েক আগের কেনা হলেও যথাসম্ভব যত্নে এখনো নিজ জৌলুস ধরে রাখতে সক্ষম। মুয়ীযের বাঁ হাতে বেল্টের ঘড়ি। ডান হাতে ব্রেসলেট ও হ্যান্ড ব্যান্ড। গলাতেও চেইন শোভা পাচ্ছিল। মাথার চুলগুলো হাতের নিপুণতায় এলোমেলো হয়েও কেমন পরিপাটি রূপে সজ্জিত। হালকা চাপদাঁড়ি শ্যামবর্ণ মুখশ্রী আরো সুদর্শন, নজরকাড়া করে তুলছিল! বছর ঊনত্রিশের এ নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেটা নিজেকে যথেষ্ট পরিপাটি করে রাখতে পছন্দ করে। হয়তো আর্থিক সচ্ছলতা তাকে দাবিয়ে রাখতে চায়। তবে সে নিজ সামর্থ পেরিয়ে বেশ কিছুটা উচ্চ স্টাইল নিয়েই বরাবর চলাচল করে। যা কিনা অনেকের গা জ্বালানোর কারণ। দৃষ্টিকটু, তাদের বৈষম্য মনোভাবের চোখ দুটোয়।
সৌরভ বুঝেশুনে আস্তে ধীরে শুকনো ঢোক গিললেন। গেল রে গেল। এরচেয়ে কোম্পানির ওই আধবুড়ো ম্যানেজার এলেও রক্ষে ছিল। এ যে সাক্ষাৎ খ্যাঁক শিয়াল। এই খ্যাক খ্যাক করে উঠলো বলে। ভাবতে না ভাবতেই হাতছাড়া হলো মোবাইল। আতঙ্কিত সৌরভ তৎক্ষণাৎ রে রে করে উঠলেন,
” স্ স্যার আমার মোবাইল! ”
” হয়। আমনের মোবাইল। বাবুসোনার লগে পিরিতি আলাপ তো বহুত পারলেন। এবার একডু কোম্পানির পানেও সুন্দর নজরে চান। ”
গা জ্বালানো হাসি উপহার দিয়ে বললো মুয়ীয। সৌরভ এ হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা অবলোকন করে কেমন যেন অশনিসংকেত টের পাচ্ছেন। তাই তো ফাঁকা লাগছে ভেতরটা। ঘাম গ্রন্থি হতে ছুটেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হঠাৎ এত ভয় হচ্ছে কেন? মনে হচ্ছে চারদিক হতে কতগুলো দা^নবীয় হাত তেড়ে আসছে। এই বুঝি কেড়ে নিলো তার…
” কি সৌরভ মিয়া! চুপ ক্যা? মুহে ঠাডা পড়ছে নি? ”
” না না স্যার। আমি তো… ”
আর হলো না বলা। ত্বরান্বিত এক লহমায় সৌরভ পানে বেশ কতখানি ঝুঁকে গেল মুয়ীয। দু’জনের চোখে চোখ স্থির। সৌরভের চেয়ারের দু হাতল বন্দী মুয়ীযের হাতের শক্তপোক্ত-অভেদ্য থাবায়। সৌরভ নিজেকে এক ক্ষুদ্র হরিণ শাবক ভেবে অসহায় বোধ করছিলেন। সামনেই যে দাঁড়িয়ে বনের রাজা! যেকোনো মুহূর্তে গাপুস করে গিলে নিলো বলে।
” সৌরভ মিয়া! গত মাসে কোম্পানির প্রোডাকশন কস্ট কত ছিল য্যান? ”
সৌরভ তার হতবিহ্বল নয়ন জোড়া বুলিয়ে যাচ্ছিলেন মুয়ীযের মুখশ্রীতে। ওনার চোখেমুখে শোভা পাচ্ছিল ভয়াবহ ভীতি। যে ভীতি তার আত্মা অবধি কাঁপিয়ে তুলছিল। ওনার দু গাল বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝড়তে লাগলো। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সে ঘাম মোছার মতো স্বাভাবিক অবস্থায় নেই উনি। এক শক্ত পাথরে পরিণত হয়েছেন যেন। প্রোডাকশন কস্ট! হঠাৎ মুয়ীয হাসান স্যার এ বিষয়ে কেন জানতে চাইছে! তবে কি সবটা…! আর ভাবা হলো না। হঠাৎই এক টানে ঘোর হতে বেরিয়ে এলেন সৌরভ। ওনার শার্টের কলার এক ভয়াল থাবায় খামচে ধরেছে মুয়ীয। হিড়হিড় করে টেনে দাঁড় করালো। চোখের পলকে টানতে টানতে নিয়ে গেল নির্দিষ্ট গন্তব্যে। উপস্থিত বাকি সকলে এমন দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে রীতিমতো স্তব্ধ!
বেপরোয়া-ঘাড়ত্যাড়া মানুষটি নিয়ম-কানুনের বিন্দুমাত্র পরোয়া না করে ফট করে বিনা দ্বিধায় প্রবেশ করলো কোম্পানির এম.ডি এর কেবিনে। এর পরের মুহূর্তটা ছিল একদম অনাকাঙ্ক্ষিত। অবিশ্বাস্য। অকল্পনীয়। বীরের বেশে এলেন মুয়ীয। দোষীকে হাজির করলেন। নির্ভীক চিত্তে প্রমাণ সহকারে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করলেন। বয়স্ক এম.ডি তখন লজ্জিত। গত মাসে এই সৌরভের হিসাবে কারচুপির জন্য মুয়ীয হাসানকে দোষারোপ করা হয়েছিল। তার কর্ম দক্ষতায় আঙ্গুল তোলা হয়েছিল। অথচ আসল দোষী সৌরভ। উনিই কোম্পানির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে হিসাবে গণ্ডগোল করেছিলেন। যার জন্য দোষী সাব্যস্ত হতে হয়েছিল মুয়ীয নামক মানুষটিকে। আজ আরো একবার প্রমাণিত হলো ‘ মুয়ীয হাসান শিক্ষায় পিছিয়ে থাকতে পারে। মাগার দক্ষতায় নয়। ‘
” মুয়ীয! আ’ম স্যরি বেটা। আমি পুরো বিষয়টা খতিয়ে না দেখেই তোমাকে সাত পাঁচ শুনিয়ে দিয়েছিলাম। ”
বয়স্ক মানুষটা বড় স্নেহ করে এই সন্তান সমতুল্য মুয়ীযকে। ওকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে থাকেন। উনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন কাড়ি কাড়ি সার্টিফিকেট দিয়ে নয় বরং মানুষের কর্ম দক্ষতা দিয়েই দেশকে উন্নতির বিশাল উঁচু শিখরে পৌঁছানো যায়। তাই তো মুয়ীয আজ ওনার বিশ্বস্ত কর্মচারী। অথচ এই মুয়ীয কিন্তু শিক্ষাগত দিক থেকে বেশ দুর্বল। এম.ডি স্যার এই মুহূর্তে বেশ লজ্জাবোধ করছেন। উনি গতবার প্রকৃত বিষয়টা তদন্ত না করেই ছেলেটাকে বেশ কথা শুনিয়ে ফেলেছিলেন। কি করে!
” স্যার! এই মুয়ীয হাসান হয়তো জন্মাইছে বস্তিতে। তয় ম°রবে ইনশাআল্লাহ্ স্বস্তির শ্বাস ফেইল্লা। একখান সাজান গোছান জীবন কাটাইয়া ফের ম°রমু। এই লেইগ্গা যা যা করন লাগে মুই করমু। মাগার চিটারি বাটপারি না। এই বিশ্বাসখান হগল সময় রাখবার পারেন। ”
প্রচুর আত্মবিশ্বাসের সহিত কথাগুলো বলে ফেললো মুয়ীয। ওর মুখভঙ্গি, কথার ধরনে প্রকাশ পাচ্ছিল দৃঢ় প্রত্যয়ী মনোভাব। ভ্রু’দ্বয়ের নীচে থাকা আঁধারিয়া-নিরংশু চোখ দু’টো প্রকাশ করছিল তার সততা। দৃঢ়চেতা ভাব। সে যে এক সংকল্প গ্রহণ করেছে আজ থেকে বহু বছর পূর্বে।
‘ হয়তো জন্মেছি গরীবের ঘরে। তবে ম°রবো গরিবকে অকাতরে দান করে… ‘
আজকের মুয়ীয হাসান গরীব। লাঞ্চিত। তবে আজ থেকে দশ বছর পরের মুয়ীয হবে এক ব্র্যান্ড। ধনাঢ্যতা থাকবে তখন তার পদতলে। ইনশাআল্লাহ্!
•
তমসায় আচ্ছন্ন গোটা ধরনী। গভীর নিদ্রায় মশগুল মনুষ্য জাতি। ঘুমের ঘোরে বেশ কাছাকাছি দু’টো প্রাণ। মধ্যকার দূরত্ব হারিয়ে অজানায়। মূক মেয়েটি তখন এক স্বর্ণালী স্বপ্নে বিভোর। চারিদিকে সুখের সমাহার। শুধু সুখ আর সুখ। আনন্দময় আমেজ। রঙধনুর সাত রঙা বাড়িতে ঠাঁই নিয়েছে সে মেয়েটি। সঙ্গী রূপে রয়েছে মা। তার জন্মদাত্রী মা। উৎফুল্ল চিত্তে মায়ের সঙ্গ উপভোগ করে যাচ্ছিল প্রাপ্তবয়স্ক উক্তি। তার মা-ও উপস্থিত প্রাপ্তবয়স্ক রূপে। দু’জনকে দেখতে প্রায় একই রকম লাগছিল। অত্যন্ত রূপসী! নজরকাড়া! রঙিন শাড়ি পড়নে তাদের। উন্মুক্ত কেশরাশি উড়ু উড়ু রূপে। মায়ের আদুরে হাতটি ধরে খিলখিলিয়ে হাসছিল উক্তি। উপভোগ করছিল সুখের উপঢৌকন। ঘুরে বেড়াচ্ছিল ঘরের এ প্রান্ত হতে ও প্রান্ত। ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিল লাল, নীল, সবুজ, হলুদ… রঙধনুর সাতটি রঙ। স্বপ্নে বিভোর মেয়েটির খুশির ছটা প্রকাশ পাচ্ছিল ওর ঘুমন্ত মুখখানিতে। বড় উজ্জ্বল হয়ে ছিল মুখটি। অধরকোলে লেপ্টে মনোরম হাস্য আভা। শক্ত করে আঁকড়ে ধরে নিদ্রায় শায়িত স্বামীর হাতটি। দু’জনে নিশ্চিন্তে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে। সমস্ত দুশ্চিন্তা, অশান্তি, ঝামেলা পালিয়ে। আকস্মিক জোরালো শব্দ। একবার, দু’বার, তিনবার। ত্বরিত ঘুম থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো মুয়ীয। বসলো সোজা হয়ে। উক্তিও ঘুম ভেঙ্গে হতবুদ্ধি নয়নে তাকিয়ে। কি হলো এটা?
চলবে।
[ কেমন লাগলো আজকের পর্বটি? মুয়ীয, উক্তি মুহুর্তটি উপভোগ্য ছিল কি? বহুত শলম পাইছি লিখবার কালে 😜
শেষে এটা কি হলো? কোনোরূপ আন্দাজ? ]
📌 আসসালামু আলাইকুম পাঠক বন্ধুরা….
তাহিরাহ্ ইরাজের লেখা গল্প-উপন্যাস সম্পর্কিত ছোট-বড় অনুভূতি ব্যক্তকরণ, গল্প নিয়ে আলোচনা, ভুলত্রুটি শুধরে দেয়া, রিভিউ প্রদান এবং গল্পের চরিত্র-দৃশ্য নিয়ে মতামত পেশ করতে জয়েন করুন আমাদের গল্প সংক্রান্ত গ্রুপে…
গ্রুপ লিংক 🍁
https://www.facebook.com/groups/499389245208190/?ref=share