#সুখের_ঠিকানা
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব১১
নীল কালারের শার্ট এ্যশ কালারের প্যান্ট ইন করে পড়া। শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত ফোল্ড করা।ফরমাল ড্রেসআপে জারিফ ভার্সিটি থেকে সোজা মলে এসেছে।দোকানের দেওয়ালের সাথে সেট থাকা বড় আয়নায় জারিফের প্রতিবিম্ব দেখতে পায় লিয়া।জারিফের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। স্লিকি স্ট্রেইট ঘন চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালের উপর লেপ্টে আছে।এতে যেনো জারিফের সৌন্দর্য কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে।লিয়া মুগ্ধ হয়ে নিষ্পলক চাহুনিতে প্রতিবিম্বের দিকে ঠায় তাকিয়ে আছে।এমন সময় আয়নাতে জারিফকে দেখতে পেয়ে লিয়ার পাশ থেকে নাতাশা উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে উঠলো,,
“ইয়ে মামা চলে এসেছে।ঐতো মামা।”
নাতাশার কন্ঠকে অনুসরণ করে সেদিকে তাকাতেই জারিফের লিয়ার সাথে মিররে চোখাচোখি হয়। মূহূর্তেই লিয়া অপ্রস্তুত হয়ে যায়।লিয়া দ্রুত এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে।মাথাটা নুইয়ে দৃষ্টি ফ্লোরে নিবদ্ধ করে।জারিফ কয়েক কদম এগিয়ে আসে।নাতাশা এলোমেলো পা ফেলে দৌড়ে জারিফের কাছে যায়।তুলি সালাম দেয়।জারিফ সালামের উত্তর দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করে। তাসনিমের সাথে কথা বলার ইচ্ছা থাকলেও এখানে ছোটোমা সহ ছোটো ভাইবোনেরা থাকায় ইচ্ছটাকে চেপে রাখে জারিফ।সেদিন রেস্টুরেন্টর পর এরমধ্যে তাসনিমের সাথে দেখা হয়নি। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয়েছে।হাই,হ্যালো এতটুকুই।নিরুপমা বেগম এ শাড়ি তো ও শাড়ি বারবার তাসনিমের গায়ে মেলে ধরছে।ওনার পছন্দসই হচ্ছে না।নীল জারিফের সাথে একপাশে দাঁড়িয়ে মায়ের শাড়ি চুজ করার অবস্থা দেখে মনেমনে আওড়ালো,মনে হয়না আম্মুর কোনো শাড়ি পছন্দ হবে।এখন বুঝতে পারছি কিজন্য আমার বেচারা আব্বু আম্মুর সাথে শপিং এ আসতে চায়না।
নীল সোজা হয়ে দাঁড়ায়। নিরুপমা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বিরক্তিকর ফেস করে করুণ স্বরে বললো,,”আম্মু একটা শাড়ি চুজ করতেই যদি ঘন্টা পার করে দাও। তাহলে বাকি কেনাকাটা কখন করবে।”
নিরুপমা বেগম ছেলের কথায় চরম বিরক্ত হলেন।ধমকের সুরে তা প্রকাশও করলেন। শক্ত কন্ঠে বললেন,,”চুপ থাক।আরে দেখেশুনে নিতে হবে না।বিয়ে বলে কথা যেমন তেমন হলে তো চলবে না।একদম স্পেশাল হতে হবে।”
মায়ের এহেন কথা শুনে নীল দীর্ঘশ্বাস ফেলল।থমথমে মুখাবয়ব করে নিশ্চুপ রইলো।মেয়েদের সাথে শপিং এ আসার শখ নীলের ইহজনমে মিটে যাচ্ছে।
.
তাসনিমের জন্য হলুদ শাড়ি নেওয়া হয়। অতঃপর নিরুপমা বেগম তুলি আর লিয়াকেও নেওয়ার জন্য জোড়াজুড়ি করে। অবশেষে তুলি একটা হলুদ শাড়ি পছন্দ করে।এদিকে লিয়ার কাঠকাঠ কথা,,”সরি আন্টি আমি কখনো শাড়ি টাড়ি পড়িনি।তাই নেওয়ার কোনো মানেই হয়না।”
নিরুপমা বেগম মুখটা কিঞ্চিৎ মলিন করে ফের আদূরে গলায় বললেন,,”তাই বললে হয় নাকি।হলুদে তো সবাই শাড়ি পড়বে। সেখানে তুমি কনের বোন হয়ে পড়বে না।কেমন কথা।একদিন পড়লে কিছু হবে না।এই লিয়া তুমি একটা শাড়ি পছন্দ করো না।”
লিয়া বেশ বেকায়দায় আছে।এতো সুন্দর আদর করে যখন বলছে।তখন ফিরিয়ে দিলে কেমন দেখায়।এইভেবে লিয়া ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে ঠোঁট আওড়িয়ে বলে,,”ওকে আন্টি।তবে আন্টি আমি শাড়ি নেবো না। আমি নাহয় হলুদ লেহেঙ্গা নেই।আমি ঠিকঠাক শাড়ি সামলাতে পারবো না।”
নিরুপমা অবাক গলায় ফের শুধালেন,,”এমা কেনো?শাড়ি সামলাতে পারবে না।শিখতে হবে না। বাঙালি নারী শাড়িতেই মানায়,হুম।তাই বলছি এখন থেকেই নাহয় প্রাকটিস করো।”
নীল মায়ের কথায় বেজায় বিরক্ত।তার মা যে শাড়ির পা’গল তা নীলের ভালো করেই জানা আছে। আলমারি, ওয়ারড্রব ভর্তি বিভিন্ন ধরনের শাড়িতে।এখন তাই বলে কি একজনকে জোর করে চাপিয়ে দিয়ে শাড়ি পড়াতে হবে?স্ট্রেইন্জ!ওদিকে লিয়া পড়েছে মহা ঝামেলায়।শাড়ি নেওয়া মানে তাকে হলুদে শাড়িই পড়তে হবে।জারিফ ছোটোমা আর লিয়ার কথা শুনে একবার লিয়ার দিকে তাকায়।লিয়ার দ্বিধাদ্বন্দ্বিত মুখশ্রী দেখেই জারিফের কিছু মনে পড়ে। প্রথম যেদিন লিয়ার সাথে দেখা হয়েছিলো সেদিনের কিছু কথা স্মরণ হতেই জারিফ অস্পষ্ট স্বরে আওড়ায়,এই মেয়ের যা চালচলন তাতে শাড়ি না পড়াই বেটার।শাড়ি পড়ে ঠিকমতো সামলাতে পারবে না শেষমেষ অন্যর আমানত পাবলিক দেখবে।
কিয়ৎক্ষন পরেই জারিফ গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলো,,”ছোটোমা থাক না।ওকে জোর করো না প্লিজ।ও যেটাতে কমফোর্টেবল ফিল করে সেটাই নাহয় নিক।”
কথাটা শেষ করে জারিফ নিরুপমা বেগমের দিকে কিছুটা এগিয়ে যায়।পাশে একটা পুতুলের গায়ে হলুদ লেহেঙ্গা ছিলো সেটা দেখিয়ে দোকানের বয়কে প্যাক করতে বলে।জারিফ জানে লেইট করলে নিরুপমা বেগম আবার লিয়াকে টেনেটুনে হলেও শাড়িই নিতে বলবে।নিরুপমা বেগমের শাড়ি পড়ানোর নাছোড় সিচুয়েশন থেকে লিয়াকে বাঁচানোর জন্য জারিফ আগ পিছ না ভেবে লিয়ার জন্য লেহেঙ্গাটা প্যাক করতে বলে।লিয়া বিষয়টাতে বিস্মিত হয়।
একএক করে সব কেনাকাটা শেষ হয়।বিকেল হয়ে আসছে।ওরা সবাই রেস্টুরেন্টে বসে হালকা নাস্তা করে।জারিফ প্রথম থেকেই তাসনিমকে নোটিস করছে। তাসনিমকে অন্যমনস্ক লাগছে।তাসনিমের মুখটা মলিন।সবাই কতকত কথা বলছে।সেখানে তাসনিম নির্বিকার।জারিফ ভাবে, এমনিতেই তাসনিম সবার থেকে একটু চুপচাপ।তবে আজকে ওর ফেস বলছে কিছু নিয়ে টেনস হয়তো।কেমন যেনো স্বাভাবিক লাগছে না।বড় দেখে একটা টেবিল বেছে নিয়েছে।সবাই একটেবিলেই বসেছে।জারিফের একপাশে জারা অপর পাশে নাতাশা তারপর তাসনিম তারপর লিয়া। সামনাসামনি নিরুপমা বেগম,নীল তুলি।কফির মগে চুমুক দিয়ে জারিফ তাসনিমকে উদ্দেশ্য করে মৃদু আওয়াজে শুধায়,,
“মেডিকেল থেকে ছুটি নিতে কোনো সমস্যা হয়নি তো?”
তাসনিম দুদিকে ঘাড় নাড়িয়ে জবাবে বলে,,”উঁহু!”
.
হালকা নাস্তা পর্ব শেষে জারিফ রেস্টুরেন্টের বিল পে করতে যায়।এদিকে সবাই বাইরে বের হতে থাকে।বিল মিটিয়ে জারিফ বাইরে আসে। নিরুপমা বেগমকে উদ্দেশ্য করে জারিফ নম্র স্বরে বলল,,”ছোটোমা তোমরা বাসায় যাও।আমি ওদেরকে পৌঁছে দিয়ে আসছি।এই নীল দেখেশুনে নিয়ে যাস।আর জারা নাতাশার খেয়াল রাখিস।”
জারা ঘাড় নাড়িয়ে হ্যা সূচক উত্তর দেয়।নীলও স্মিত হেসে হ্যা বলে।জারিফ একটা সিএনজি ডেকে ভাড়া পরিশোধ করে ওদের কে উঠতে ইশারা করে।নিরুপমা বেগম তাসনিমের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে মিষ্টি হেসে বলেন,,”ভালো থেকো।আর খুব শীঘ্রই দেখা হচ্ছে।”
তাসনিম হালকা হাসার চেষ্টা করে। অতঃপর নিরুপমা বেগম লিয়া আর তুলির সাথেও ভালো-মন্দ কথা বলে।জারিফকে উদ্দেশ্য করে আরো বলেন,,”জারিফ আর লেইট করিস না।ওদেরকে পৌঁছে দিয়ে তোকে তো আবার ফিরতে হবে।অনেকটা পথই তো। আর বাবা দেখেশুনে ড্রাইভ করিস কেমন। তাড়াতাড়ি দেখেশুনে বাসায় ফিরিস।ভাবী আবার চিন্তা করবে।”
জারিফ বাম হাতের এক আঙ্গুলের সাহায্যে কপালের ঘামটুকু মুছে নেয়।মৃদু হাসলো। ঠোঁট আওড়ালো,,”চিন্তা করো না। দ্রুতই ফিরবো।”
নিরুপমা বেগম আগে উঠলেন। তারপর জারা। অতঃপর জারিফ নাতাশাকে গাড়িতে তুলে দেয়।নীল সামনে বসে।নাতাশা ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে উঠলো,,”মামা তুমি কোথায় যাবে?আর মামী আমাদের সাথে আসবে না?নানুমনি তো বলছিলো এরপর থেকে মামী আমাদের সাথেই থাকবে। নানু বাসায়ই থাকবে।”
তাসনিম,তুলি, লিয়া তিনজনের দৃষ্টিই ছিলো সিএনজির দিকে।ওদের যাওয়ার দিকে।নাতাশার কথাশুনে জারিফ একনজর তাসনিমের দিকে তাকায়। ঠোঁটের কোণে বিস্তৃত হাঁসি রেখে বলে উঠলো,,”উমম!তোমার মামী এখন মামীদের বাসায় যাবে।আর মাত্র তিনদিন পর থেকে আমাদের সাথে থাকবে।”
“ওহ্!”
নাতাশা মিষ্টি হাসে। তৎক্ষনাৎ হঠাৎ করে ডান হাতটা উঁচিয়ে গলা ছেড়ে কন্ঠে চঞ্চলতা নিয়ে বলে উঠলো,,”এই মিষ্টি আন্টি তুমিও কি আমাদের সাথে থাকবে?তুমিও যদি আমার সাথে মামার সাথে আমাদের সবার সাথে থাকো।তাহলে আমার এতো এতো আনন্দ হবে।”
নাতাশার কথাটা লিয়ার কানে বারংবার বাজতে থাকে।আমার সাথে,মামার সাথে এটুকু আওড়াতেই লিয়ার বুকের পাশে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হয়। টানাটানা হরিণী আঁখিযুগল ছলছল করে উঠে।লিয়া দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে স্বাভাবিক রাখে।ব্যাথাতুর ভগ্ন হৃদয় নিয়ে চমৎকার হাসে লিয়া।যে হাসির আড়ালে আছে বেদনা।হাসিমুখে কন্ঠে একরাশ চঞ্চলতা নিয়ে বলতে থাকে,,”কিউটিপাই নিশ্চয় দেখা হবে।আর তোমার সাথে অনেক মজার মজার গেইমস খেলবো। চুটিয়ে গল্প করবো।কেমন?তাই মন খা’রাপ করো না।লাভ ইউ কিউটিপাই।”
অতঃপর লিয়া একহাত ঠোঁটের সামনে ধরে ফ্লাইং কিস দেয়।সিএনজির সামনে জারিফ দাঁড়িয়ে ছিলো।লিয়ার ফ্লাইং কিসে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়।জারিফ ভাবে,এই মেয়ের কান্ডজ্ঞান যে কম তা বলার অপেক্ষা রাখে না।যদিও নাতাশাকে উদ্দেশ্য করে ছিলো এটা তথাপি ঠিক সামনা-সামনি তো আরেকজন দাঁড়িয়ে।সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত ছিলো কিনা?সিএনজি চলে যায়।জারিফ ওদের টয়োটা গাড়ির সামনে আসে।পিছনের দরজা খুলে লিয়া আর তুলিকে উদ্দেশ্য করে বলে,,”প্লিজ টেক আ সিট।”
লিয়া তাসনিমকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে,,”আপু তোমরা যাও।আমি বাসায় যাই এখন।আর হলুদের দিন তো এখানে আসতেই হবে।তাই সেদিনই নাহয় একবারে যাবো।”
তাসনিম ক্ষীন আওয়াজে বললো,,”বাসায় যাবি?না গেলে হয়না?দাদিমনি তোকে সাথে করে আনতে বলেছে,ইভেন আম্মুও বলেছে।”
এরমধ্যে তুলি বলে উঠলো,,”এই লিয়া।এখন বাসায় যাওয়া যাবে না।আমাদের সাথেই যেতে হবে।চলনা অনেক মজা হবে।”
অবশেষে লিয়া গাড়িতে উঠে বসে।তুলিও উঠে বসে। তাসনিম পেছনে উঠতে নিলে জারিফ হালকা কেশে সামনের ডোর খুলতে খুলতে বলে,,”এইযে ম্যাডাম সবাই পেছনে যাচ্ছেন।আপনি অন্তত সামনে বসুন।”
তাসনিম দুই শব্দে বলে,,”ঠিক আছে।”
জারিফ গাড়ির দরজার উপর একহাত রাখে।চোখে মুখে কৌহতুহল নিয়ে তাসনিমকে শুধালো,,”এই তাসনিম!তোমার কি কোনো কারনে মন খা’রাপ?আমি প্রথম থেকেই তোমাকে লক্ষ্য করছি।তোমাকে টেনস লাগছে।কিছু নিয়ে তুমি ওয়ারিড?কোনো হেজিটেশন না রেখে আমাকে বলতে পারো।”
তাসনিম ছোট শ্বাস ফেলে।জোর করে মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে তোলে। অতঃপর মৃদুস্বরে বললো,,”কই কিছু নাতো।ঠিকই আছি তো।”
জারিফ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে।একহাত ঝরঝরে চুলের মধ্যে গলিয়ে দেয়। কন্ঠে শীতলতা মিশিয়ে শুধালো,,”বিয়ের কেনাকাটা তোমার পছন্দ হয়েছে?কোনো কিছু যদি তোমার অপছন্দ হয়।তবে আমাকে বলতে পারো।এখনো সময় আছে।আমি সবটা চেন্জ করে দিবো।আমি চাই সবটা তোমার পছন্দ মতই হোক।”
তাসনিম হালকা হাসার চেষ্টা করে বলে,,”সমস্যা নেই ঠিক আছে তো।আর এখন দ্রুত যাওয়া যাক।বাসায় আম্মু,দাদিমনি সবাই টেনশন করবে। এমনিতেই বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা পার হয়ে যাবে।”
“শিয়র।”
তাসনিম গাড়িতে বসে সিট বেল্ট বেঁধে নেয়।জারিফ ড্রাইভিং সিটে বসে সুনিপুণতার সহিত ড্রাইভ করতে থাকে।
.
খাঁন ভিলার সামনে এসে গাড়ি দাঁড় করায়।পেছন থেকে তুলি লিয়া নামতে থাকে।সামনে থেকে তাসনিম নামে।জারিফ ড্রাইভিং সিটে বসে দুইহাত স্টেয়ারিং এর উপর ভাঁজ করে রাখে। তাসনিম নেমে ফর্মালিটিজ মেইনটেইন করতে জারিফকে বলে,,”ভেতরে চলো।”
জারিফ মৃদু হেসে বললো,,”থাক আজ আর নয়।এমনিতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে।বাড়িতে যেতে হবে। সামনে তো আসছিই।”
এরমধ্যে তুলি এগিয়ে এসে বলে উঠলো,,”ভাইয়া ভেতরে আসুন।”
জারিফ আবারও না করতেই তুলি ফের বলতে থাকে,,”আব্বু, আম্মু, দাদিমনির সাথে দেখা করে যাবেন।বাসার সামনে থেকে চলে গিয়েছেন ভেতরে না গিয়ে। এটা শুনলে দাদিমনি আমাদেরকে ব’কবে।”
লিয়া নির্বিকার থাকে।কেনো যেনো এই মানুষটাকে ভাইয়া সম্মোধন লিয়ার মুখে আসে না।তাইতো কখনো কথা বললেও উজ্জ্ রাখে।লিয়া ওর মতো বাড়ির ভেতরে যেতে থাকে। অবশেষে জারিফ ভেতরে আসে।
ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে জারিফ।সামনের টেবিলে হরেক রকমের নাস্তা রাখা। জান্নাত বেগম এক আসন বিশিষ্ট সোফায় বসে। তহমিনা বেগম ব্যতিব্যস্ত হয়ে হবু জামাইয়ের জন্য নাস্তা নিয়ে আসলেন।সবার সাথে কুশলাদি বিনিময় করে জারিফ। জান্নাত বেগমের সাথে নরমাল কার্টেসি মেইনটেইন করতে এটাসেটা কথা বলছে জারিফ। তাসনিম জান্নাত বেগমের একপাশে দাঁড়িয়ে। তাসনিম রুমে যেতে চেয়েছিলো ।বাট তহমিনা বেগম চোখ পাকিয়ে ইশারায় এখানেই থাকতে বলেন। এরমধ্যে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে লিয়া জান্নাত বেগমকে ডেকে উঠে,,
“দাদিমনি।”
জান্নাত বেগম লিয়ার দিকে তাকিয়ে ইশারায় বোঝান,”কি হয়েছে?”লিয়া জান্নাত বেগমের পাশে আসে।সোফার এক হাতলের উপর বসে জান্নাত বেগমের গলা জড়িয়ে ধরে ম্লান স্বরে বলে,,”দাদিমনি আমাকে এখন বাসায় যেতে হবে। আম্মু ফোন করেছিলো। সামনে আমার বোর্ড এক্সাম।আর কালকে নাকি কিসের একটা সিগনেচার লাগবে। রেজিস্ট্রেশন পেপারের জন্য।তাই কালকে কলেজে উপস্থিত থাকতেই হবে।”
একটু থেমে ফের ঠোঁট উল্টে বলতে থাকে,,”আব্বু নাকি অফিসের কাজে ঢাকায় গিয়েছে।এখন তো প্রবলেম হয়ে গেলো। ড্রাইভার আঙ্কেল থাকলে তাও আমাকে এসে নিয়ে যেতো।এখন একটাই পথ খোলা আছে,তুমি তোমার নাতিকে বলো আমাকে এখনই বাসায় পৌঁছে দিতে।”
তাসনিম কপাল কুঁচকে বললো,,”তুষার। তুষার তোকে পৌঁছে দিবে এখন।ও যে পরিমাণ অলস।আমার মনেহয় না এতটা পথ এখন রাতে যেতে ও রাজি হবে।”
তহমিনা বেগম ভরাট গলায় বললেন,,”তুষার তো এখন বাড়িতেও নেই।কোথায় আছে? কে জানে ?”
জান্নাত বেগম বললেন,,”এখনই যেতে হবে?রাত হয়ে গিয়েছে।কালকে সকালে যাস।আকাশে মেঘ করছে।এখন তো ঝড় বৃষ্টির কথা বলা কওয়া যায়না।যেকোনো সময় চলে আসে।তাই বলছি কাল সকালে যাস।আর আমি নিজে তুষারকে বলে রাখবো।”
লিয়া মুখটা ভার করে ঠোঁট আওড়ায়,,”নাহ্!তুমি এখনই তোমার নাতিকে বলো।আর বাসায় যেহেতু ফিরতেই হচ্ছে তাহলে কালকে প্রাইভেটে একটা এক্সাম আছে। এক্সাম টা দেওয়া যাবে।সো এখন গেলে রাতে তাও পড়া যাবে।আর দাদিমনি হলুদের প্রোগ্রাম যেহেতু শহরের কমিউনিটি সেন্টারে একসাথে হবে। সেখানে তো আপুসহ সবাইকে এখান থেকেই যেতে হবে। তারচেয়ে বরং আমি আম্মুর সাথে একেবারে হলুদ অনুষ্ঠানে যাবো।তারপর বাড়ির সবার সাথেই এখানে ফিরবো।”
জান্নাত বেগম অবশেষে বলেন,,”আচ্ছা ঠিক আছে।”
অতঃপর তুষারের কাছে ফোন করে।তুষার দাদিমনিকে কিভাবে না করে এইজন্য সহজেই রাজি হয়।তবে বলে এখন যেখানে আছে সেখান থেকে ফিরতে না হলেও এক দেড় ঘন্টা লাগবে। এরমধ্যে জারিফ বলে,,”দাদিমনি আন্টি আমি আসছি এবার।”
জারিফের কথার সাথে সাথেই তাসনিমের কিছু মনে হতেই হুট করেই বলে উঠলো,,”এই লিয়া তুই জারিফের সাথে যা। জারিফ তো ওদিক দিয়েই যাবে। তোকে ক্যান্টনমেন্টে নামিয়ে দিয়ে যাবে।”
লিয়া তৎক্ষণাৎ সাথে সাথেই বলে উঠলো,,”নাহ্।”
লিয়ার কঠোর গলার নাহ্ শব্দ শুনে সবাই অবাক চোখে লিয়ার দিকে তাকাতেই।লিয়া হালকা হাসার চেষ্টা করে ক্ষীন আওয়াজে ঠোঁট আওড়ায়,,”ইয়ে মানে ভাইয়া তো বললো আসছে।ওয়েট করা যাক।”
জান্নাত বেগমও লিয়াকে সাপোর্ট দিয়ে বললেন,,”হুম।তুষার আসুক।”
এদিকে আকাশে মেঘের গর্জন শোনা গেলো। জানালার কাঁচের গ্লাস দিয়ে বিদ্যুৎ চমকানো দৃশ্যমান হলো।যা দেখে তাসনিম ঠোঁট প্রসারিত করে বললো,,”দেখেছো বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।যদি ঝড় বৃষ্টি আসে।আর গ্রামের**রাস্তাটা বেশ খা’রাপ।একটু বৃষ্টি হলেই গাড়ি যাওয়া মুশকিল হয়ে পড়বে।তখন কিকরে যাওয়া যাবে।তাই বলছি এখনো যেহেতু বৃষ্টিপাত হয়নি আর জারিফ যাচ্ছে যেহেতু।তাই লিয়া তুই যেতে পারিস।”
তাসনিমের কথাশুনে জারিফ খানিকটা বিরক্ত হয়।কি দরকার আছে? একজন যেহেতু রাজি হচ্ছে না।আর জান্নাত বেগমও যেহেতু না করলেন। সেখানে আবার উস্কে দেওয়ার মানে কি?জারিফ মনেমনে আওড়ায়,এই মেয়ে থেকে পাঁচশো গজ দূরে থাকাই বেটার।এরসাথে দেখা হওয়ার পর থেকে ভালো কিছুই হয়নি।সবসময় দূর্ঘটনা ঘটেছে।আ’ম শিয়র এই মেয়ে সাথে থাকলে ঝামেলা না থাকলেও টেনে নিয়ে আসবে।এসব কিছু মনেমনে বললেও মুখে কিছুই প্রকাশ করলো না জারিফ।
তাসনিমের কথাটা জান্নাত বেগমকে বেশ ভাবাচ্ছে। তহমিনা বেগমও একই সুরে বললেন,,”আম্মা লিয়ার যেহেতু যেতেই হবে।সেহেতু তুষারের জন্য অপেক্ষা না করে জারিফের সাথেই যাক।জারিফ যেহেতু যাচ্ছেই ।আর আকাশের অবস্থাও ভালো ঠেকছে না।ভ্যাপসা গরম পড়ছে ।ঝড় হতে পারে।তাই বেশি রাত হওয়ার আগেই জারিফের সাথে যাক।”
তবুও জান্নাত বেগম সম্মতি দিচ্ছিলেন না।এমন সময় তুষার কল করে বলে, গাড়ির গ্যাস ফুরিয়ে গিয়েছে।গ্যাস ভরতে সময় লাগবে।বড়সড় সিরিয়াল পড়েছে।এই সিরিয়াল কাটিয়ে গ্যাস ভরে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বেজে যাবে। এটা শোনার পর সবারই চিন্তা বেড়ে যায়। অনেকক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দ্বে থেকে সবশেষে জান্নাত বেগম স্থির করলেন জারিফের সাথেই লিয়াকে পাঠানোর কথা।তাই গম্ভীর মুখায়ব করেই লিয়াকে জারিফের সাথেই যেতে বললেন। তাসনিম জারিফকে উদ্দেশ্য করে বললো,,”তোমার কোনো সমস্যা নেই তো।না মানে লিয়াকে পৌঁছে দিতে।”
জারিফ বিড়বিড় করে বলে,আমি তো মনেকরি এই মেয়েই আস্ত একটা সমস্যা।সেখানে নতুন করে আর কি সমস্যা থাকবে।কেবল আসতে না আসতেই তার ইমার্জেন্সি যাওয়ার কল চলে আসলো।কালকেই সিগনেচারের ডেট হওয়ার ছিলো। উফ্!
জারিফ জোরকরে হাসার চেষ্টা করে।তারপর ভদ্রভাবে বলে,,”নাহ্ ঠিক আছে।”
লিয়ার ভীষণ রা’গ হচ্ছে।ধ্যাত কালকেই কলেজে ইমার্জেন্সি যাওয়ার ডাক পড়তে হলো।আর শেষমেষ কিনা এই লোকের সাথেই আবার একাএকা ফিরতে হচ্ছে। উফ্!কি জ্বালা!কথায় আছে না যেখানে বাঘের ভ’য় সেখানেই সন্ধ্যা হয়।যার থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে নিজেকে রাখতে চাই।ঘুরেফিরে পরিস্থিতি আমাকে তার নিকটেই কেনো নিচ্ছে?আমি বুঝতে পারছিনা।
জারিফ গাড়িতে বসে।লিয়া বসে সিট বেল্ট বেঁধে নেয়।জারিফ চুপচাপ ড্রাইভিং করছে।লিয়া জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে।দুজনই চুপচাপ। সময়ের সাথে সাথে আকাশের অবস্থা আরো খা’রাপ হতে থাকে।
[চলবে…ইন শা আল্লাহ]
সবাইকে রমজানের শুভেচ্ছা রইলো 🖤