#সুখের_ঠিকানা
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব১৬
সূর্য মাথার উপর। কাঠফাঁটা রোদে পু’ড়’ছে যেনো সারা শহর। প্রচন্ড গরমে কর্মব্যস্ত মানুষের জীবন অস্থির।গরমে নাজেহাল, হাঁসফাঁস অবস্থা সাধারণ পথচারীদেরও।নিউমার্কেটের পাশের একটা স্টেশনারি দোকান থেকে বের হয় লিয়া আর রুপন্তী।লিয়ার থেকে বিদায় নিয়ে নিজের বাসার পথে যেতে থাকে রুপন্তী।অপরদিকে লিয়া খানিকটা এগিয়ে এসে ফুটপাত থেকে নেমে রাস্তার একপাশে দাঁড়ায়। হাত উঁচিয়ে যেই একটা খালি রিকশাকে ডাকবে,সেই মুহূর্তে একজন বাইক নিয়ে এসে একদম লিয়ার গা ঘেঁষে থামায়।আচমকা এতোটা গা ঘেঁষে বাইক দাড় করানোয় লিয়া তড়িৎ দুইপা পিছিয়ে যায়। আশ্চর্য মানুষ!রাস্তার একপাশেই দাঁড়িয়ে আছি।এত এত জায়গা থাকা সত্ত্বেও কিনা একজনের গা ঘেঁষে বাইক থামায়।আরেকটু হলেই তো এক্সিডেন্ট হয়ে যেতো।এসব কথা ভেবেই লিয়ার মেজাজটা প্রচন্ড খা’রাপ হয়। তড়িৎ লিয়ার রা’গের পারদ সর্বোচ্চ হয় ।বাইক ওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে লিয়া স্পষ্ট রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে কন্ঠে কঠোরতা নিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলল,,
“মাথা খা’রাপ আপনার?এভাবে কেউ বাইক দাড় করায়?আরেকটু হলেই তো একটা দূর্ঘটনা ঘটে যেতো।কোনো কমন সেন্স নেই?নাকি মেয়ে মানুষ দেখলেই ইচ্ছে করে এরকম অসভ্যতামি করে বেড়ান?কোনটা?”
লিয়ার কথার মাঝেই বাইকে বসা যুবক দুইহাতে হেলমেটটা খুলে ঝাঁকড়া চুলগুলো একটু বারি দেয়।একহাত দিয়ে চুলগুলো পিছনে ঠেলে লিয়ার দিকে তাকিয়ে চমৎকার হাসে।নীলকে দেখে লিয়া বিস্মিত হয়।মুখে চমৎকার হাসি নিয়েই নীল ঠোঁট আওড়ায়,,
“উমম!ম্যাম অসভ্যতামি করার জন্য না হলেও ইচ্ছে করেই যে এটা করেছি।সেটা অস্বীকার করছি না।”
একটু আগে বলা কথাগুলো ভেবে লিয়া খানিকটা লজ্জিত হয়।লিয়া মাথাটা নুইয়ে মৃদু আওয়াজে বলে,,”সরি!আমি বুঝতে পারিনি আপনি।আর হঠাৎ এভাবে বাইক থামানোতে আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।”
“ওকে ম্যাম ব্যাপার নয়।তা বলুন কেমন আছেন?আর এইসময় এখানে।কোনো কাজ ছিলো নাকি?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।হুম। প্রাকটিক্যাল এইড কিনতে আসছিলাম।কলেজে একটা ক্লাস হওয়ার পর শুনলাম আজ নাকি বাকি ক্লাস হবে না।তাই ভাবলাম এই সময়টায় কাজটা করে আসি। প্রাকটিক্যাল খাতা প্রস্তুত করতে হবে। এগুলো নেওয়া জরুরী ছিলো তাই আসা,আরকি।”
নীল এক আঙ্গুল দিয়ে কপালে জমা ঘামটুকু মুছে নেয়। ঠোঁটে বিস্তৃত হাঁসি রেখেই ফের শান্ত গলায় বলতে থাকে,,”ওয়েল।তা লিয়া চলুন কিছু খাবেন। প্রচন্ড গরম পড়ছে তো ঠান্ডা কিছু খাবেন।লাইক কোল্ড কফি।”
লিয়া কপাল কুঁচকে সরু চাহনিতে চাইল।কিছুটা জড়তা নিয়ে বলল,,”ইয়ে মানে আমাকে এখন বাসায় ফিরতে হবে।অন্যকোনো দিন। প্লিজ আজ নয়।”
নীল স্মিত হাসল। অতঃপর অফার করে বসলো,,”চলুন আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি। এমনিতে আমার কোনো কাজ-টাজ নেই।বড় ভাইয়ের বউকে বাসায় ঠিকঠাক পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ পেলে,এটাকে আমি বড়সড় মহৎ কাজ হিসেবেই নিতাম।তো ম্যাম দেবরকে সেই মহৎ কাজের সুযোগটা দিবেন নাকি?”
নীলের কথাগুলো শ্রবণেন্দ্রিয়ে বারি খাওয়ার সাথে সাথেই তাৎক্ষনিক লিয়ার মুখটা মলিন হয়ে আসে।বড় ভাইয়ের বউ কথাটা কানে বারকয়েক বাজতে থাকে।লিয়া তাচ্ছিল্য করে মনেমনে আওড়ায়,ভাই মানে না বউ।আর দেবর আসছে
লিয়ার ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে নীল চঞ্চল কন্ঠে ফের বলে উঠলো,,”এই লিয়া।কোথায় হারিয়ে গেলেন?ভাইয়ার কথা বলতে না বলতে বলতেই অমনি দিনদুপুরে জেগে জেগেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন।”
নীলের কথায় লিয়ার অস্বস্তি হয়।লিয়া নিজেকে ধাতস্থ করে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে। ঠোঁট মেলে কিছু বলবে,তার আগেই হো হো শব্দ করে হাসতে হাসতে নীল বলে উঠলো,,”আমি কিন্তু মজার ছলেই বলেছি।আপনি সিরিয়াসলি নিচ্ছেন কেনো।আর আপনার বর আপনার পার্সোনাল প্রোপার্টি।সো আপনি তাকে নিয়ে যখন তখন স্বপ্ন দেখতেই পারেন এতে লজ্জা পাওয়ার কিচ্ছু নেই।”
নীলের মজা করে বলা কথাগুলো একদিকে যেমন লিয়াকে অস্বস্তিতে ফেলছে।ঠিক তেমনি আরেকদিকে বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যাথার সৃষ্টি করছে।লিয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ক্ষীন আওয়াজে ঠোঁট আওড়ালো,,
“আপনি তো সবটাই জানেন। আমাদের সম্পর্কটা আর সবার মতো স্বাভাবিক নয়।আর যা হয়েছে সেটা একটা দূর্ঘটনা।তাই বারবার এরকম কথা না বললেই আমার মনেহয় ভালো হয়।”
নীলের থেকে স্পষ্ট করে স্বাভাবিকভাবে জবাব এলো,,”নীল আইন মেনে চলতে পছন্দ করে।আইনের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো কাজ করায় নীলের মন সায় দেয়না। ধর্মীয় আইন বলেন আর দেশের আইন বলেন।দুই দিকের আইন অনুযায়ীই আপনি এখনো আমার ভাইয়ের বউ।তাই মনেহয় না আমি ভুল কিছু বলে ফেলেছি।”
নীলের যুক্তি দেখে লিয়া হতাশ।আর যাইহোক এই ছেলের সাথে তর্ক করেও যে তার ধ্যান ধারণা থেকে একচুল নড়ানো যাবে না তা এতক্ষণে বোঝা গিয়েছে। লিয়া হাল ছেড়ে চুপ করে রয়।এই ছেলে একটা বাক্য বললে সেখানে দুইটা শব্দ টানবে ভাইয়ের বউ বলে।লিয়াকে নিশ্চুপ দেখে নীল ফের বলল,,
“তা ম্যাম এভাবে রোদের মধ্যো দাঁড়িয়ে থাকবেন।চলুন আপনাকে ড্রপ করে দেই।”
লিয়া ইতস্তত বোধ করতে থাকে।লিয়ার মুখশ্রীতে শান্ত চাহনিতে চেয়ে নীল বিষয়টা বুঝতে পারে। অতঃপর নীল মুচকি হেসে বলল,,”লিয়া আমি কিন্তু আপনাকে বড় ভাইয়ের বউ হিসেবেই টিট করি।সেই নজরেই দেখি।তাই যাইহোক আমার ফাজলামি কথায় কখনো মাইন্ড করবেন না। আচ্ছা আপনি যখন যেতে চাইছেন না তখন আমি জোর করবো না।তবে আমাকে একটা হেল্প করতে হবে।দেবর হিসেবে ভাবীর কাছে এতটুকু এক্সপেক্ট করতেই পারি।কি বলেন?”
লিয়া এবার বেশ ভাবনায় পড়ে গেলো।কিসের হেল্প চাইবে আল্লাহ মালুম।লিয়া যেনো কোনো জটিল সমীকরণ মেলাতে ব্যস্ত। এমনভাবে ভেবে যাচ্ছে।নীল কি বলতে পারে?লিয়ার ভাবনার মাঝেই নীল পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে বলে,,”আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের বোনের বার্থডে। ইনভাইট করেছে।তা কি গিফট করা যায় ভেবে পাচ্ছি না।আপনি যেহেতু একটা মেয়ে তাই মেয়ে মানুষের পছন্দ সম্পর্কে আইডিয়া আছে।এবার আপনার আইডিয়া বলে আমাকে হেল্প করুন।”
লিয়া মৃদু হাসলো। কৌতুহলী গলায় বলে উঠলো ,,”তা বেস্ট ফ্রেন্ডের বোনের বার্থডে গিফট দেওয়া নিয়ে এতোটা সিরিয়াস। বিষয়টা মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না আমার কাছে।ব্যাপার স্যাপার কি? সামথিং সামথিং?”
নীল কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে ভেবে বলে,,”এখনো বিষয়টা অতদূর আগায়নি।তবে কোথাও একটা সফট কর্নার আছে।তা দেখুন তো আপনার জা হিসেবে মানাবে কিনা।যদি হ্যা বলেন তবে ভেবে দেখবো।আগানোর একটা স্কোপ নিতে পারি,এই আরকি।”
নীল গ্যালারী থেকে ছবি বের করে।নীলের একহাতে ফোন।আরেক হাতের এক আঙ্গুল ফোনের স্ক্রিনের সামনে ধরে বলে,,”এই মেয়েটা। বন্ধুর বাড়িতে মাঝে সাঝে যাওয়া হয়।একদিন ওদের ফ্যামেলি এ্যলবাম দেখতে দিয়েছিলো।সেখান থেকে সবার আড়ালে বলা চলে এক প্রকার চু’রি করেই ছবিটা তুলেছিলাম।”
ছবিটিতে আরো অনেকেই আছে। রোদের আলোতে দূর থেকে ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না। সেইজন্য লিয়া নীলের ফোনের দিকে অনেকটা ঝুঁকে দেখতে থাকে।এমন সময় নীলের এমন কথা শুনে লিয়া খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো।
ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি দাঁড়ানোর পর।জানালা দিয়ে তাকিয়ে নীলকে প্রথমে দেখতে পায় জারিফ। অতঃপর নীলের বাইক ঘেঁষে। নীলের একদম পাশে লিয়াকে দেখতে পায় জারিফ।লিয়া নীলের ফোনের দিকে মাথা ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকায়।দূরথেকে অনেক ক্লোজলি দাঁড়িয়ে আছে এমন দেখাচ্ছে।তারপর লিয়ার এভাবে হাসি।সবটা জারিফের মস্তিষ্কে অদ্ভুত অদ্ভুত কথার সঞ্চার করছে। অটোমেটিক্যালি জারিফের দৃষ্টি সেদিকেই যেনো নিবদ্ধ হয়ে আছে।
নীল লিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,,”উম!এমন কিছুর কথা বলেন যা গিফট করলে সব সময় চোখের সামনে থাকবে।আর যখনই গিফটটা দেখবে তৎক্ষনাৎ গিফট দাতার কথা অটোমেটিক মনে পড়বে।”
লিয়া স্মিত হেসে বললো,,”বাহ্! আপনার চিন্তা ধারা অনেকটা ইউনিক।ভালো।”
লিয়া ঠোঁট কামড়ে ধরে দশ সেকেন্ড ভেবে চঞ্চল কন্ঠে বলে উঠলো,,” বার্ড।বার্ড গিফট করলে কেমন হবে? জীবন্ত কিছু দিলেন।আর আমার মনেহয় পাখি তো প্রায় সবাই পছন্দ করে।”
নীল সাথে সাথেই বলে উঠলো,,”থেংকিউ। আপনার সাজেশনটা খুব ভালো লেগেছে।এবার একটা সুন্দর দেখতে পাখি চুজ করে দিবেন।সামনেই একটা পাখির দোকান আছে। প্লিজ,চলুন।নাকি এখানেও হেজিটেশন আছে।দেবর হিসাবে নিতে না পারলেও। ফ্রেন্ড হিসেবে আমাকে নিতে পারেন।”
কথাটা বলে নীল বাইক থেকে নেমে দাঁড়ায়।লিয়া ছোট করে”ঠিক আছে।চলুন।”বলতেই নীল বাইকের চাবিটা একহাতে নেয়। অতঃপর এক আঙ্গুলে চাবিটা ঘুরাতে ঘুরাতে লিয়ার সাথে পাশাপাশি হেটে যেতে থাকে।
পিছনের গাড়ির হর্নের শব্দে জারিফের হুঁশ ফিরে।জারিফ ড্রাইভ করছে।অথচ সুগভীর শান্ত নজরজোড়াতে বারংবার কিছুক্ষণ আগের দৃশ্যগুলো জ্বলজ্বল করে ছবি আকারে ভাসছে।নীলের সাথে ক্লোজলি দাড়িয়ে খিলখিলিয়ে হাসা।আবার নীলের সাথে পাশাপাশি হেটে কোথাও যাচ্ছে।না চাইতেও জারিফের মনের ভেতর আপনাআপনি রা’গের সৃষ্টি হচ্ছে।জারিফ ভাবে নীলের সাথে লিয়ার বোধহয় যোগাযোগ আছে।পরক্ষণে মনেহয়,নীল তো এমনিতেই মিশুক স্বভাবের।সবার সাথেই খুব সহজেই মিশে যায়।এটা তেমন কিছু নয়।আবার মস্তিষ্ক জুড়ে সেদিন রাতে নীলের বলা কথাগুলো বিচরণ করতে থাকে।লিয়ার মতো সুন্দরী বউ থাকলে,আমি তো জোর করে নিয়ে আসতাম।এইসকল কথা স্মরণ হতেই জারিফ অস্পষ্ট স্বরে আওড়ায়,তবে কি নীল লিয়াকে পছন্দ করে? উফ্!এসব কথা মনে হতেই জারিফের নিজেকে কেমন জানি এলোমেলো লাগছে।
প্রায় দুইমিনিট খানেক হেঁটে একটা পাখির দোকানের সামনে আসে লিয়া আর নীল।ছোটো বড় বাহারি রঙের নাম জানা আবার নাম নাজানা পাখি ছিলো। অনেক পাখিই ছিলো।তারমধ্যে লিয়ার চোখ যায় একটা সবুজ রঙের টিয়া পাখির দিকে।লিয়া ইশারা করে দেখায়। অবশেষে দামদর করে নীল টিয়া পাখিটাই নেয়।নীলের থেকে বিদায় নিয়ে লিয়া রিক্সা নিয়ে বাসায় ফেরে।
.
আজকে শুক্রবার।ঘড়ির কাঁটা দুপুর আড়াইটার ঘরে। জাহানারা বেগম আর নিরুপমা বেগম ব্যস্ত হাতে টেবিল সাজাচ্ছেন। খাবারের ডিস গুলো দুজনে মিলে সাজিয়ে রাখছেন।বাড়ির ছেলেরা জুম্মা নামাজ পড়ে এই এক্ষুনি চলে আসবে হয়তো। এরমধ্যে জারিফ ,নীল ,জারিফের বাবা নামাজ শেষ করে বাসায় ফিরে।একসাথেই সবাই লাঞ্চ করতে ডায়নিং এ আসেন।নীলের বাবা অন্য জেলাতে চাকরির সুবাদে থাকেন। কয়েক মাস পরপর ছুটিতে আসেন।নীল জারিফ পাশাপাশি চেয়ারে বসেছে।খাবার খাওয়া শুরু করার কিছুক্ষণ পর নাতাশা ডায়নিং এ দৌড়ে আসে। পিছুপিছু জারা আসে।নাতাশা জাহানারা বেগমের শাড়ির আঁচল ধরে দাঁড়ায়। জাহানারা বেগম নাতাশাকে উদ্দেশ্য করে আদূরে গলায় বলেন,,
“নাতাশা এখনো ঘুমাওনি যে।যাও সোনা ঘুমিয়ে নাও।”
নাতাশা দুদিকে মাথা ঘুরিয়ে ঠোঁট উল্টে বলতে থাকে,,
“উঁহু।আমি আজকে ঘুমাবো না।”
জাহানারা বেগম কন্ঠে কোমলতা নিয়ে ফের বললেন,,
“কেনো সোনা?না ঘুমালে শরীর খা’রাপ করবে।যাও খালামনি গল্প বলবে।আর গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়বে,কেমন।”
নাতাশার ফের স্পষ্ট কথা,,”উফ্!নানুমনি বললাম তো আমি ঘুমাবো না।
একটু থেমে জারিফের দিকে তাকিয়ে আবদার করে বলল,,”উমম!ঘুমাতে পারি তবে একটা শর্তে। মামাকে বলো আজকে বিকেলে ঘুরতে নিয়ে যেতে।এমনিতেই আজকে ফ্রাইডে।তাই আজকে মামা আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে মামীর বাসায়।আমি মামীর সাথে খেলতে চাই। অনেক দিন হয়ে গেলো মামীকে দেখি না তো।”
শেষের কথাটা বলে নাতাশা গাল ফুলিয়ে রাখে।ঘুরতে নেওয়া পর্যন্ত ঠিক ছিলো।যখন মামীর কথা বললো তখন যেনো বেঠিক হয়ে গেলো জারিফের কাছে।জারিফ মুখ তুলে নাতাশার দিকে তাকিয়ে নির্বাক থাকে। জাহানারা বেগম নাতনির এহেন আবদারে যথেষ্ট বি’র’ক্ত তা ওনার ফেসই বলে দিচ্ছে। জারিফ কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ ফেলে মৃদুস্বরে বললো,,”বিকেলে পার্কে নিয়ে যাবো।হ্যাপি?”
নাতাশা মুখটা আরো বেজার করে রাখলো।যার অর্থ এটা তার মনোঃপুত হলো না।জারিফ আড়ালে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে। জাহানারা বেগম মৃদু রা’গি স্বরে বললেন,,”আহ্! নাতাশা হচ্ছেটা কি?মামা বললো তো ঘুরতে নিয়ে যাবে।তারপরেও এভাবে গাল ফুলিয়ে রাখছো কেনো?এখন সবাই খাবার খাচ্ছে তাই আর জিদ করে থেকো না।সবাইকে খাবার খেতে দাও। আর তোমার খালামনির সাথে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”
নাতাশা আরো কাঁদো কাঁদো ফেস করলো।কখন যেনো ঠোঁট উল্টে কেঁদে দিবে এমন অবস্থা।জারা জারিফকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,,”ভাইয়া নাতাশা যখন এতো করে বলছে তখন বেচারিকে নিয়ে যা না।”
জারিফ তাৎক্ষণিক জারাকে ধমকের সুরে বলে উঠলো,,”হোপ। বললেই হলো।বলা নেই কওয়া নেই।একজনের বাসায় হুট করে চলে গেলাম।আজব!”
নীল মুচকি হাসলো।হাসিটা সবার আড়ালে রেখে স্বাভাবিক ভাবে বলতে থাকে,,”একজন কেনো ব্রো?তুই তোর শ্বশুর বাড়ি যাবি। এতে এতো বলা কওয়ার কি আছে?নাকি ভাবছিস, শ্বশুরবাড়ি থেকে ইনভাইট করবে।তারপর জামাই আদর খেতে যাবি।
একটু থেমে আবার বাঁকা করে বলতে থাকে,,”আর আমার কি মনেহয় জানিস ব্রো। তোর মনেহয় অর্থের সংকট চলছে।”
জারিফ কপাল কুঁচকে বিরক্তিকর ফেস করে বললো,,”হোয়াট?তোর এরকম মনে হওয়ার কারন কি?”
নীল ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,,”আলবাত তোর অর্থের সংকট চলছে।বউয়ের ভরণপোষণ দিতে পারবিনা সেইজন্য তো বউকে বাপের বাড়ি রেখে দিয়েছিস। নিজের কাছে রাখার সাহস হচ্ছে না।”
নীলের কথা শুনে জারা মিটমিট করে হাসছে।জারিফ রা’গটাকে কন্ট্রোল করে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে স্বাভাবিক গলায় বলে,,”বাজে কথা রাখ।কারনটা তুই নিজেও জানিস।”
জারা ফোড়ন কা’ট’ল। ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে উঠলো,,
“আরে ভাইয়া নীল ভাইয়া তো মনে হয়না ভুল কিছু বলছে। আচ্ছা বাদ দিলাম যাকগে সেসব।এখনো অব্দি এবাড়ির বউ সে।মাঝে মাঝে তো ভাবীর খোঁজ খবরও নিতে পারিস।”
জারিফ আড়চোখে নীলের দিকে চাইল। গম্ভীর গলায় বলল,,”আমি খোঁজ না নিলেও তার খোঁজ নেওয়ার মানুষের অভাব নেই।”
কথাটা নীল বা জারা কারোরই বোধগম্য হলো না।আনোয়ার রহমান এতক্ষণ সবার কথা চুপচাপ শুনছিলেন। অবশেষে জারিফকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,,”জারিফ আমার মনেহয় জারা একদম ভুল কিছু বলেনি। তোমার উচিত লিয়ার সাথে কথা বলা।লিয়াকে বোঝানো।”
জাহানারা বেগম বিরক্তিকর কন্ঠে ঠোঁট আওড়ালেন,,
“আমার ছেলেকে দোষারোপ কেনো করছো আমি বুঝতে পারছি না।সব তো ঠিকই ছিলো।মাঝখানে সেদিন সবার কথার বিরোধিতা করে বেঁকে বসলো ঐ মেয়ে।সেখানে আমার ছেলের দোষটা কোথায়?আর এখন আগ বাড়িয়ে জারিফই বা কেনো যোগাযোগ করতে যাবে।যেখানে ঐ মেয়ের এতো ইগো,জিদ।”
আনোয়ার রহমান শান্ত গলায় ফের বললেন,,”মাতৃ স্নেহ ভালো।তবে অন্ধ মাতৃ স্নেহ সন্তানের জন্য সব সময় কল্যাণকর হয়না।তুমি মা তারমানে এই নয়যে, সন্তানের সকল ভুলত্রুটি আড়াল করে চলবে। এবং ভুলগুলো শুধরে না দিয়ে সাপোর্ট করবে।তোমার তো উচিত সুন্দর করে জারিফকে বোঝানো।অন্যর মেয়েকে দোষারোপ না করে। প্রায় একমাস হয়ে যাচ্ছে।একবারো জারিফকে পাশে বসিয়ে বুঝিয়ে বলেছো,এই সম্পর্কটা নিয়ে ভাবতে?আমার তো মনেহয়না বলেছো।”
স্বামীর কথাশুনে জাহানারা বেগমের মুখটা থমথমে হয়ে যায়। আপনাআপনি মাথাটা নুইয়ে যায়। আনোয়ার রহমান ফের বলতে থাকেন,,” লিয়া ছোটো।তুমি তো টিনেজ নও।তবে কেনো টিনএজারদের মতো বো’কা’মি জিদ নিয়ে আছো?জারিফ তোমার উচিত লিয়ার সাথে কথা বলা। সম্পর্কটা এগিয়ে নিতে দুজনে সরাসরি কথা বলা দরকার।এভাবে গা ছাড়া ভাব নিয়ে থাকলে এর ফল কখনো ভালো হয়না।আমি আমার কথাটা বললাম।বাকিটা তোমার ইচ্ছে।বড় হয়েছো ভালমন্দ যথেষ্ট বুঝো।তারপরেও বাবা হিসেবে সতর্ক করা আমার কর্তব্য।”
জারিফ দৃষ্টি খাবারের প্লেটে নিবদ্ধ করে চুপচাপ সব কথা শ্রবণ করলো।কিছু বলার মতো সাহস হলো না।কারন কথাগুলো যথেষ্ট যুক্তিযত ছিলো। আনোয়ার রহমান খাবার শেষ করে উঠে যান।সবাই চুপচাপ এরমধ্যে জারা আবার বলে উঠলো,,”এই ভাইয়া এভাবে মৌনতা পালন করবি। নাকি নাতাশা বেবির আবদারটা রাখবি।”
জারিফ যেনো এবার বড় কোনো বেকায়দায় পড়লো।জারার প্রতি মেজাজ খা’রাপ হয়।আবার নাতাশাকে উস্কে দিচ্ছে।তবে নাতাশা বেচারি ওরকম গাশ ফুলিয়ে মুখটা বাংলা পাঁচের মতোই করে রেখেছে।জারিফ একনজর জারার দিকে তাকায়। অতঃপর নীলের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে,,”নীল নিয়ে যাবে।নাতাশা তুমি তোমার নীল মামুর সাথে যাবে,কেমন।”
সাথে সাথেই নীল বলে উঠলো,,”এই না না।আমার বিকেলে কাজ আছে।তাই সম্ভব নয়।”
জারা মুখটা অসহায় করে ম্লান স্বরে বলে উঠলো,,”চল নাতাশা। তোর মামা যাবে না।এই পৃথিবীতে তোর মা নেই।বাবা থেকেও নেই।তাই তোর কোনো আবদারের দামও নেই কারো কাছে,হু।”
যদিও কথাটা বলতে জারার কষ্ট হচ্ছিলো।তবুও জারিফকে ইমোশনালি ব্লাকমেইল করার জন্য মুখ্য অ’স্ত হিসেবে এই বাক্যটা প্রয়োগ করে জারা। জারার এমন কথা শুনে মূহূর্তেই জারিফের মনটা বিষাদে ছেয়ে যায়।একদম বুকে গিয়ে তীরের মতো বিঁধে যায়।ছোটো বোনের মুখটা ভেসে উঠতেই বুকটা হাহাকার করে উঠলো।চোখ ছলছল করে উঠলো। বোনের সবচেয়ে বড় স্মৃতি হলো এই বাচ্চা মেয়েটা।যার যেকোনো আবদার সবসময় পূরণ করে আসছে জারিফ।জারিফ অনিচ্ছা সত্ত্বেও জারাকে ডেকে বলে উঠলো,,
“নাতাশাকে বিকেলে রেডি করে দিস।নিয়ে যাবো।”
জারা মুচকি মুচকি হাসে।তারপর নাতাশার হাত ধরে যেতে যেতে বলে,,”চলো বেবি এখন ফাস্ট ঘুমিয়ে নিবে।আর ঘুম থেকে উঠে মামীর সাথে দেখা করতে যাবে।”
কিছু মনে হতেই জারিফ অস্বস্তি নিয়ে বলে,,”যাবো তো বললাম।এভাবে হুট করে গেলে,কেমন দেখাবে না।বিষয়টা বিশ্রী হবে না।”
পাশ থেকে নীল বাঁকা হেসে বলে উঠলো,,”এখনো আইন অনুযায়ী লিয়া তোর বউ।ওটা তোর শ্বশুরের বাসা।তাই সেখানে যাওয়ার পুরোপুরি হক তোর আছে।আর এতোই যদি হেজিটেশন হয়।সেটা দূর করারও উপায় আছে। যাচ্ছিস তো নাতাশাকে নিয়ে।বলবি নাতাশা বায়না ধরেছে।আর ওবাড়ির সবাই জানে নাতাশা আর লিয়ার কথা।নাতাশা লিয়া বলতেই পা’গল।তাই মনেহয়না কেউ মাইন্ড করবে। বরঞ্চ সবদিক দিয়ে ভালোই হবে।”
শেষের কথাটা একদম ক্ষীণ আওয়াজে বলে।কথাটা বলে শিষ বাজাতে বাজাতে নীল প্রস্থান করে।
.
বিকেল পাঁচটা বাজতে পনের মিনিট বাকি।লাল টকটকে লং ফ্রগ পড়েছে নাতাশা। চুলগুলো মাথার উপর ঝুঁটি করে বাঁধা।জারা নাতাশাকে রেডি করে আনে।জারিফ ড্রয়িংরুমে অপেক্ষা করছিলো।জারিফ নাতাশার হাত ধরে বাইরে যেতে থাকে। ওরা গাড়িতে উঠে বসে। জারা বাসার সামনে দুইহাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে।গাড়ি স্টার্ট দিয়ে মিনিট খানেকের মধ্যেই চোখের আড়াল হয়ে যায়।জারা হেসে পিছন দিকে ঘুরতেই দেখতে পায় দরজার সাথে একপা ঠেস দিয়ে দুইহাত বুকে গুঁজে দাঁড়িয়ে নীল।নীলকে দেখার সাথে সাথেই জারার হাসি আরো বেড়ে যায়।জারা এগিয়ে যায়।নীল একহাত জারার সামনে ধরে জারা নিজের একহাত শব্দ করে মিলিয়ে হাসির ঝংকার তুলে বলে উঠলো,,
“ইয়েস। প্লান সাকসেস। নীল ভাইয়া এই প্রথম মনেহয় কোনো একটা ভালো কাজ করলি।এই ভালো কাজের অসিলায় হলেও মেয়েদের সাথে ফ্লার্টিং করার পা’পটা একটু হলেও মাফ হবে।কোনো সম্পর্ক জোড়া লাগানোতে সাহায্য করা নিশ্চয় ভালো কাজ।তোর আইডিয়া কিন্তু দারুণ ছিলো।নাতাশাকে উস্কে দেওয়া।ভাইয়াকে ইমোশনালি ব্লাকমেইল করা। সবটা জোশ ছিলো।মাঝখানে অভিনয়টা কেমন করলাম?বলতো?”
জারা এক্সাইটেড হয়ে কথাগুলো বলে।নীল জারার কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে চিন্তিত গলায় বলে,,”পাঠালাম সম্পর্কের উন্নতি করতে।না জানি তোর গম্ভীর ইগো ওয়ালা ভাই উন্নতির যায়গায় আরো অবনতি করে চলে না আসে।”
নীলের কথা শুনে জারার কপালেও চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়।জারা মলিন মুখে ঠোঁট উল্টে বলে,,”হুম।ঠিক বলেছিস।”
.
দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে ঘুম আসছিলো লিয়া। মাত্রই ঘুম থেকে উঠলো। লম্বা ঘুম দিয়ে লিয়ার মন মেজাজ দুইটাই বেশ ফুরফুরে লাগছে।লিয়া ওয়াশরুম থেকে চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়ে কেবলই বের হয়েছে।ব্যালকনিতে যাবে মুখ মোছার জন্য টাওয়েল আনতে।এমন সময় কলিংবেলের শব্দ হয়।সাথে সাথেই মায়ের গলার আওয়াজও আসে।রাজিয়া সুলতানা ডেকে বলেন,,
“এই লিয়া দেখতো কে আসছে।আমি কিচেনে কাজ করছি।যাতো দরজাটা খুলে দে।”
লিয়া আর ব্যালকনির দিকে পা না বাড়িয়ে বিছানার উপর থেকে ওড়নাটা নিয়ে গলার সাথে ঝুলিয়ে নেয়।ড্রয়িংরুমের দিকে যেতে থাকে আর বিড়বিড় করে বলতে থাকে,,এই সময় কে আসবে আবার? হয় নিচের আন্টি আর নয়তো সামনের ফ্ল্যাটের আন্টি।লিয়া একহাতে দরজা খুলে..
[চলবে…ইন শা আল্লাহ]