সুখের_ঠিকানা #শারমিন_হোসেন #পর্ব০২

0
505

#সুখের_ঠিকানা
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব০২

“হে ইউ, ওয়েট।আই হেভ স্পিচ ইউথ ইউ।”

গম্ভীর গলার আওয়াজ শুনে লিয়ার পা থেমে যায়।সাথে যেনো হৃদস্পন্দনও মিস হলো লিয়ার। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয় লিয়ার।লিয়ার মনে হচ্ছে,উফ্!কি এক বিশ্রী যন্ত্রনা।এতো এতো মেয়ে থাকতে এই মানুষটাকে এই বাড়ির মেয়ের জন্যই পাত্র হিসেবে আসতে হলো।এমনটা না হলে কি খুব ক্ষ’তি হতো?বড় বোনের জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসাটা কি খুবই জরুরী ছিলো।এই শহরে কি মেয়ের অভাব ছিলো? এখন থেকে সম্পর্কের খাতিরে এই মানুষটার মুখোমুখি আমাকে হতে হবে।কতসময় নিজেকে আড়ালে রাখা যায়।লিয়া চোখ বন্ধ করে ছোট করে শ্বাস টেনে নেয় । ফের মনেমনে ভাবে,আসলে সবই ভাগ্যের ব্যাপার।দাদিমনি তো সবসময় বলেন, জন্ম, মৃত্যু বিয়ে এসব কিছু আগে থেকেই নির্ধারিত। সৃষ্টিকর্তা যার সাথে যার জোড়া লিখে রেখেছেন।যেকোনো ভাবেই হোকনা কেনো তার সাথে তার হবেই।আই বিলিভ দ্যাট।আর উনি আমার ভাগ্যে নেই।তাই এই নিয়ে মনে কষ্ট পুষে রাখা বো’কা’মি।আর আমার প্রতি যেটা করেছিলেন,সেটা ওনার মানবিক গুণ থেকে,নট অন্যকিছু।আমার যায়গায় অন্যকেউ থাকলেও উনি ওনার মানবিকতা রক্ষা করতেন।

লিয়ার ভাবনার মাঝেই জারিফ হালকা কাশে লিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে।লিয়া জিহ্বা দিয়ে ঢুক গিলে নেয়।লিয়া নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করতে নারাজ। লিয়া চাইনা তার দূর্বলতা কেউ বুঝুক জানুক।লিয়া নিজের মনকে যথেষ্ট শক্ত করে।নিজেকে শক্ত খোলসে আবৃত করে ।চোখে মুখে কাঠিন্যতা নিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে মনেমনে আওড়ালো,,”উফফ!উনি চাইছেন টা কি?এখন কি আমাকে কথা শুনানোর জন্য নিজ থেকে ইনভাইট করছে?আজকে উল্টাপাল্টা কিছু বললে,মুখ বুজে সহ্য করবো না।আজকে রিপ্লাই দেবো।উনি সেদিন রঙ ছিলেন।আর ওনার রাইট নেই,আমার শিক্ষা নিয়ে কথা বলার,হুহ।”

এসব কথা মনেমনে ভেবে নিয়ে লিয়া পিছন ঘুরে জারিফের দিকে তাকায়।জারিফ লিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,,”সরি।”

ছোট্ট একটা শব্দ সরি।তবুও এই শব্দের ওয়েট ব্যাপক।জারিফের মুখ থেকে এই মূহুর্তে এই শব্দটা লিয়া একদম আশা করেনি।লিয়া অবাক হয়ে জারিফের দিকে নিরেট চাহনিতে চেয়ে থাকে।জারিফ কন্ঠে শীতলতা নিয়ে বললো,,”আমার কথায় হার্ট হয়ে থাকলে সরি।তোমাকে হার্ট করে থাকলে সরি।আর আশাকরি ফারদার কখনো,তোমার থেকে ওরকম আচরণ পাবো না। ক্লিয়ার?”

জারিফের প্রথম কথা শুনে লিয়ার মনে শীতলতা বয়ে যায়। মেরুদণ্ডের শীড়দাড়া দিয়ে শীতল প্রবাহ বয়ে যায়।লিয়া ভাবে জারিফ হয়তো বুঝতে পেরেছে।সেদিনের ঘটনায় লিয়ার কোনোই দোষ ছিলো না। কিন্তু না লিয়ার এসব ভাবনা মূহূর্তেই মিছে হয়ে যায়।জারিফের শেষের কথায়।লিয়ার ভেতরের ক্ষোভটা আরো প্রকট হয়।লিয়া ঠোঁট প্রসারিত করে কিছু বলতে যাবে।তার আগেই পুরুষয়ালী মোটা কন্ঠস্বরে পেছন থেকে বলে উঠলো,,

“বাহ্ ব্রো বাহ্।এতোদিন শুনে এসেছি শালী হলো আধা ঘরওয়ালী।আজ তো নিচ চোখে দেখছি।হবু বউ নেই আর ওমনি হবু শালীর সাথে গল্প শুরু করেছিস।গুড জব ব্রো।তবে আমার মনে হচ্ছে তোর যায়গায় আমি থাকলে মানা যেতো। তোর চরিত্রের সাথে মানা যাচ্ছে না।”

নীলের কথা শুনে লিয়ার বেশ অস্বস্তি হয়।সাথে রা’গও হয়।ছেলেটার যে কান্ডজ্ঞান কম তা লিয়া অনেকক্ষণ আগেই বুঝেছে। প্রথম দিনেই ছেলেটি লিয়ার অপছন্দের তালিকায় ফার্স্ট সারিতে স্থান করে নিয়েছে।নেহাত-ই নিউ রিলেটিভ তাই কড়া করে কিছু বলতে পারছে না লিয়া।সেটা লিয়ার মুখের এক্সপ্রেশন দেখেই বোঝা যাচ্ছে।নীলের কথা শুনে জারিফের নিজেরও মেজাজটা খা’রাপ হয়।জারিফ চোখ পাকিয়ে নীলের দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে,,

“এসব কি নীল?কি ল্যাংগুয়েজ ইউজ করছিস তুই?

নীল কয়েক পা এগিয়ে এসে ব্যাকা হাসে। কন্ঠে কৌতুহল মিশিয়ে বলে উঠলো,,”খাঁটি বাংলা ভাষায়ই তো কথা বললাম ।কেনরে ব্রো শা’লী ওয়ার্ড টা তোর পছন্দ হয়নি?নাকি তোর মনে অন্যকিছু চলছে।আমি একজন ফিউচার সাইকোলজিস্ট হিসেবে দেখতে পাচ্ছি।তোর চোখ অন্যকিছু বলছে। সামথিং সামথিং ব্রো?”

জারিফের রাগের পারদটা মূহূর্তেই আকাশ ছুঁইছুঁই হয়।জারিফের ইচ্ছে করছে নীলের কানের পাশে ঠাডিয়ে একটা চ’ড় লাগাতে।তবে স্নেহ বোধে এসে আটকিয়ে যায়।জারিফ দুই আঙ্গুল দিয়ে কপালে স্লাইড করে নিয়ে অস্ফুট স্বরে বললো,,”আগে সাইকোলজিস্ট হ।তারপর নাহয় সাইক্লিক করতে আসিস।এর আগে নয়।আর হ্যা,তোর ভুলভাল ধারনা অন্তত পক্ষে আমার উপর এপ্লাই করিস না।”

এরমধ্যে এখানে তাসনিম এসে উপস্থিত হয়।এসে লিয়াকে দেখে কপাল কুঁচকে শুধালো,,”ওহ্ !লিয়া তুই এখানে। উফ্!আর আমি তোকে সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি।”

কপালের উপর আসা ঝাঁকড়া চুলগুলো একহাতে পেছনে ঠেলে দেয় নীল। অতঃপর লিয়ার দিকে তাকিয়ে কন্ঠে চঞ্চলতা নিয়ে বলে উঠলো,,”হে মিস লিয়া।আপনি আবার সব কিছু সিরিয়াসলি নেননি তো?আ’ম জোকিং। কথাগুলো আমি মজার ছলে বলেছি। প্লিজ,ডোন্ট মাইন্ড।”

লিয়া মলিন হাসে। ঠোঁট আওড়িয়ে বলে,,”আমার সিরিয়াসলি নেওয়াতে কারও কি কিছু আসে যায়?আমি নিজেকে ওতোটা ইম্পর্ট্যান্ট ভাবিনা।যে কেউ আমাকে সরি বলবে।আমার হার্ট হওয়াতে দুঃখ প্রকাশ করবে।এতটা আশা আমি কোনোকালেই কারো উপর রাখি না।তাই মিস্টার লাল নীল আপনাকে ঘটা করে সরি বলতে হবে না।”

লিয়ার ঠেস দিয়ে বলা কথা কেউ না বুঝলেও জারিফ ঠিকই বুঝতে পেরেছে।কথাটা যে ইনডাইরেক্টলি জারিফকে বলেছে লিয়া সেটা জারিফ ঠিক-ই বুঝেছে। কিয়ৎকাল পরেই কপাল কুঁচকে নীল বলে,,

“শুনেছি সুন্দরী মেয়েরা খুব অভিমানী হয়।আপনার কথা শুনে প্রুভ পেলাম।তো যাইহোক ব্যাপার না।আপনার মতো সুন্দরী মেয়েদের অভিমান ভাঙ্গাতে দরকার পড়লে বস্তা বস্তা সরি বলবো।আর মিস লিয়া আপনি আমার নামটা একটু ভুল করে বলেছেন।আমি লাল নীল নই আমি অভ্রনীল। সরফরাজ অভ্রনীল।”

শেষের কথাগুলো নীল ভাব নিয়ে বলে। তাসনিম ঠোঁট টিপে হাসে।আর জারিফ তো নীলের এসব কথাবার্তা দেখে শুনে অভ্যস্ত।হাজার বলে কয়েও লাভ হয়নি।তাই আর জারিফ নীলের ফাজলামি নিয়ে বেশি কিছু বলে না।এসব ফাজলামি না-কি নীলের প্যাশন।ভাবা যায়, উফ্।

জারিফ তাসনিমকে উদ্দেশ্য করে নরম গলায় বলে,,”তাসনিম নাতাশার বিষয় নিয়ে তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

তাসনিম মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক উত্তর দেয়। অতঃপর অস্ফুট কন্ঠে বলে,,”শিয়র।”

একটা গাছের তলায় শান বাঁধানো বসার স্থানে জারিফ আর তাসনিম পাশাপাশি বসে কথা বলছে।লিয়া চলে যেতে নিলে নীল পিছু ডেকে বলে,,”হে মিস লিয়া,ওয়েট।আপনার পুরো নামই তো শোনা হলো না। সুন্দর করে আমার নামটা তো জেনে নিলেন।নিজের নামটা তো বললেন না।”

নীলের কথা শুনে লিয়া চরম আশ্চর্যান্বিত হয়।লিয়া নীলের দিকে ঘুরে তাকায়।লিয়ার নিটোল কপালে বেশ কিছু ভাঁজ পড়ে।লিয়া ভাবে,লে বাবা।আমি আবার কখন এর নাম জানতে চাইলাম। আশ্চর্য!নিজেই তো গড়গড় করে নাম বললো।এসব কিছু মনেমনেই ভেবে নেয় লিয়া। কুঞ্চিত কপাল খানিকটা সরল করে নীলকে প্রশ্ন করে উঠলো,,”এই কি বলতে চাইছেন, হ্যা।আমি আপনার নাম শুনতে চেয়েছি?কখন?আই হেভ নো ইন্টারেস্ট টু লিসেন এ্যনি থিং আ্যবাউট ইউ। ক্লিয়ার?আশ্চর্য মানুষ একটা।আর আমার নাম নতুন করে বলবো কি?বেশ তো লিয়া লিয়া করে ডাকছেন।”

বাব্বাহ!বেয়াইনকে যতটা কোমল ভেবেছিলাম অতোটাও নয়।বেশ তেজী দেখছি।এসব কথা মনেমনে বললেও মুখে প্রকাশ করে না নীল।নীল হালকা কেশে গলা ঝেড়ে নেয়। কিয়ৎক্ষন পরেই একহাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে নেয়।গলার স্বর আরেকটু নিচে নামিয়ে বলতে থাকে,,”ঐযে ভুলভাল নাম বললেন।এর মানে দাঁড়ালো,আমি যাতে সুন্দর করে ঠিক করে বলি।হুম।যাইহোক তর্কে না জড়াই।আমার আবার ইথিকস আছে।যাই হয়ে যাক না কেনো, সুন্দরী মেয়েদের সাথে কখনো ঝ’গড়া করতে নেই।লি.. য়া।”

নামটা একটু টেনে বলে নীল। অতঃপর উৎসুক ভাবে ফের বলে,,” লি…য়া সামনে পেছনে কিছু নেই।এখনকার মেয়েদের তো আবার ইয়া বড় নাম থাকে।কারো কারো নাম দেখে তো বাসার ঠিকানা মনে হয়।”

এরসাথে আর কিছুক্ষণ থাকলে লিয়ার মাথাটা ধরে যাবে।আর বেকার বেকার কথা না বাড়ানোই ভালো। একটা কথা বললে এই ছেলে দশটা কথা বলবে,নো ডাউট।তাই লিয়া ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,,
“এনাবুল জান্নাত খাঁন লিয়া।”

“ওয়াও!নাইস নেইম।আপনার নামের সাথে আপনার অনেক মিল আছে।এই ধরেন আপনার সাথে পরিচিত হয়ে আমার খুব ভালো লাগছে।আপনার পাশে থাকতে আমার প্যারাডাইসের সুখানুভূতি হচ্ছে।মিস প্যারাডাইস।এবার আপনার অনুভূতির কথা কিছু বলুন।”

লিয়া যেতে যেতে বলে,,”আমি যতটা জানি,কোনো চোখ দেখেনি।কোনো কান শ্রবণ করেনি।কোনো হৃদয় কল্পনাও করতে পারবে প্যারাডাইসের সুখ- শান্তি।”

কথাগুলো বলে লিয়া থেমে যায়।ঘাড়টা ঘুরিয়ে নীলের দিকে দৃষ্টি সরু করে তাকায়।বাম ভ্রু টা উঁচিয়ে সন্দিহান স্বরে বলে,,”ব্যাপার কি বলুন তো?ভালোই তো দেখছি ফ্লার্টিং করতে পারেন।তবে যায়গাটা আপনার জন্য এপ্রুপেইট নয়।বুঝলেন?একদম রং যায়গায় আসছেন।সো বি কেয়ার ফুল। ”

নীল মুখটা কাচুমাচু করে শুকনো ঢুক গিলে নেয়।আগ পিছ না ভেবে লিয়াকে প্রশ্ন করে বসলো,,”তা মিস লিয়া বুঝলাম,যায়গাটা আমার জন্য এপ্রুপেইট নয়।তবে সেই যায়গায় কে আছে?জানতে পারি কি?জানতে চাই কে সেই পরম সৌভাগ্যবান।”

লিয়া কোনো প্রকারের ভনিতা ছাড়াই স্পষ্ট গলায় সোজাসুজি শুধায়,,”জোর করছেন?আমার মোটেও পছন্দ নয় কেউ আমার সাথে জোরাবাদি করুক।আর আপনার সাথে কিছু শেয়ার করতে আ’ম নট ইন্টারেস্টড।সো সরি। মিস্টার লাল নীল।উপপসস!সরি অভ্রনীল।”

নীল ঠোঁট উল্টে বলে,,”জোর নয় এটা আমার কিউরিওসিটি।আর বরাবরই কিওরিওসিটিটা আমার একটু বেশিই।”

লিয়া মলিন হাসে।দশ সেকেন্ড কিছু ভেবে নিয়ে ম্লান স্বরে বলে,,” বিভূতিভূষণের আহ্বান গল্প পড়েছেন?সেখানে জমির করাতির বউ নামে এক বৃদ্ধা মহিলা ছিলো।তার এরকম একটা উক্তি ছিলো,’আমার তো তেনার নাম করতে নেই।’এখন আপনাকেও বলতে হচ্ছে আমারও যে তার নাম বলতে নেই।”

লিয়ার কথা শুনে নীল শব্দ করে হাসে। ঠোঁটে হাসির রেখা রেখেই চঞ্চল গলায় বলে উঠলো,,”বাহ্!আপনিও তো দেখছি আমার মতো বেশ জোকস্ জানেন।নাইস জোকস্ ছিলো।”

লিয়া মনেমনে অস্পষ্ট স্বরে আওড়ায়,,
‘কখনো কাউকে নিয়ে আমার হৃদয়ে ভালোলাগার অনুভূতি জন্ম নিয়েছিলো সেটা সারাজীবন গোপন-ই থাক।কাউকে আমি সুখের ঠিকানা ভেবে রঙিন স্বপ্ন বুনেছিলাম।সেসব নাহয় আড়ালেই থাক।আমি যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি,তার মনের শহর জুড়ে তো অন্যকারো বসবাস।কাউকে ভালোলাগলে যে,তাকে পেতেই হবে এমন নয়।জীবনটা গল্প,সিনেমার মতো নয়। বাস্তবতা অনেক কঠিন আর নিষ্ঠুর হয়।ইরেজার দিয়ে মুছে ফেলার মতো।আমার মন থেকে তার ছবি মুছে দেবো।”

লিয়ার ধ্যান ভাঙ্গে নীলের আবৃতিতে,,”বিশ্ব কবির সোনার বাংলা,নজরুলেরই বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা।রুপের কভু নেইকো শেষ।”

বাগানে ফুটে থাকা ফুলের দিকে তাকিয়ে একনাগাড়ে বলে থামলো নীল। অতঃপর কন্ঠে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে বললো,,”বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য খুবই মনোমুগ্ধকর।এইযে বসন্তে গাছে গাছে কোকিলের ডাক। বাগানে ফুটে থাকে নানান ধরনের ফুল।আহ্!কত সুন্দর ফুটে আছে বাহারি রঙের ফুল।তবে আজ ফুলের সৌন্দর্যও ফিকে করে দিয়েছে কোনো এক মানবীর রুপ।জানেন মিস লিয়া আপনাকে দেখে আমার জীবনানন্দ দাশ এর বনলতাসেন এর কথা মনে পড়ছে। টানাটানা হরিণী চোখ,দীঘল কালো চুল।একদম আপনার সাথে মিলে গিয়েছে।”

লিয়া বাঁকা করে বলে উঠলো,,”যেভাবে বলছেন।শুনে মনে হচ্ছে, বনলতাসেনকে অনেকবার দেখেছেন।বা আপনার খুব করে পরিচিত কেউ ছিলো।”

কথাটা শেষ করে লিয়া গটগট করে বাড়ির দিকে চলে যায়।কিছুক্ষণ পর সবার থেকে বিদায় নিয়ে জারিফের পরিবার বাসায় চলে যায়। একতলা বাড়ির সামনে গাড়িটা থামে।বাড়ির তরনে পাথর দিয়ে খচিত নামফলক। সুন্দর আভিজাত্যপূর্ণ , রুচিশীল কারুকার্য।বাড়িটির নাম সুখের ঠিকানা।বাড়ির সামনে লোহার মেইন ফটক। পার্কিং লনে গাড়ি দাঁড়করায়। ড্রাইভিং সিট থেকে জারিফ নামে সবার শেষে। জারিফের বাবা-মা বাসায় গিয়ে কলিং বেল চাপতেই কাজের মেয়েটা দরজা খুলে দেয়।সাথে একটা বাচ্চা মেয়ে এসে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে মিষ্টি করে হাসে।জারিফ ড্রয়িংরুম দিয়ে যেতেই, বাচ্চা মেয়েটা জারিফের কোমড় জড়িয়ে ধরে।ছোটো ছোটো নরম হাতে।জারিফ মেয়েটাকে কোলে তুলে নেয়।

ধরণীর বুকে সন্ধ্যা নামনাম ভাব।দিনের আলো আবছা অন্ধকারের চাদরে মুড়ে যাচ্ছে।ব্যালকনিতে বসে থাকা এক মানবীর মনটাও অন্ধকারে ছেয়ে আছে।লিয়ার মাথাটা ধরেছে।লিয়া কড়া করে এক মগ কফি বানিয়ে ব্যালকনিতে বসে খাচ্ছে।এরমধ্যে তুলি এসে চোখে মুখে চিন্তার ছাপ নিয়ে গমগমে স্বরে বললো,,”এই লিয়া জানিস কি হয়েছে?”

লিয়ার সোজাসাপ্টা উত্তর,,”না বললে জানবো কিকরে?”

তুলি লিয়ার আরেকটু কাছে এসে মৃদুস্বরে বলে,,”আরে পুরো কথা তো শোন আগে।একটু আগে ফোন স্ক্রল করছিলাম।সেইসময় ভাবলাম জারিফ ভাইয়ার আইডিটা খুঁজে বের করি।আমার বান্ধবীদেরকে দেখাবো যে,এতো সুন্দর হ্যান্ডসাম মানুষটা আমার জিজু হবে।যেমন ভাবা,তেমন কাজ।উফফ!অনেক খোঁজাখুঁজি করার পর ইংরেজি ফন্টে আয়মান জারিফ নামে পিক সহ আইডিটা খুঁজে পেলাম। কিন্তু সমস্যা বাঁধলো,ওনার আইডিতে একটা বাচ্চা মেয়ের ছবি।সব কয়টা ছবিই বেশ আদূরে।মেয়েটা গলা জড়িয়ে রেখেছে।একটাই তো ক্যাপশন দেখলাম,আমার মিষ্টি মামুনি।এখন তো আমার খুব টেনশন হচ্ছে।লোকটা আগে থেকেই বিবাহিত নয়তো।বউ-টউ চলে যায়নি তো?আবার এমন তো নয়,বউ গত হয়েছে। বাচ্চা আছে।এসব কিছু আড়াল করে আবার বিয়ে করতে চাইছে। আমার সহজ সরল আপুটাকে ঠকাচ্ছে নাতো।আপু সবটা শুনলে কষ্ট পাবে।তাই আগে তোর সাথে শেয়ার করছি।এখন দাদিমনি,আব্বু-আম্মু সবাইকে একএক করে বলবো।”

একনাগাড়ে গড়গড় করে কথাগুলো শেষ করে তুলি।লিয়া কিছু বলার আগেই।তুলি ওর হাতের ফোনটা লিয়ার সামনে মেলে ধরে।আর দাঁতে দাঁত চেপে বলে,,”আমার কথা বিশ্বাস না হলে নিজ চোখে দেখ।এইযে বাচ্চা মেয়েটার সাথে জারিফ ভাইয়ার ছবি।আইডিতে মেয়েটার ছবিতে ভরপুর।”

ফোনের স্ক্রিনের ছবিতে তাকাতেই লিয়ার আখিযুগল টলমল করতে থাকে।লিয়ার স্মৃতিপটে ভেসে উঠে..

ফ্লাসব্যাক,,,,

সময়টা জানুয়ারীর মাঝামাঝি। রোদঝলমলে সুন্দর একটা সোনালী দিন।শীতের দিনের রোদটা একটু বেশিই মিষ্টি হয়। ছোট্ট একটা পাবলিক মাঠ।ছোটো বাচ্চা ছেলে মেয়ে ব্যাড মিন্টন খেলছে।বয়স নয়-দশ এরকম হবে হয়তো। এমন সময় এক রমনী অফ হোয়াইট লেহেঙ্গা পড়া,কোমড় সমান ঘন কালো স্লিকি চুলগুলো জোড়ে হাঁটার ফলে পিঠ জুড়ে দোল খাচ্ছে।দুপধাপ পা ফেলে মাঠের একসাইডে শান বাঁধা বসার জায়গায় আয়েশ করে বসে। কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে পাশে রাখে।

ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে ডায়ালে যায়।ডায়ালে সামনে কাংখিত নম্বরটিতে কল দেয়।কল রিসিভ হতেই উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো,,”এই রুপু তুই কোথায় বলতো? প্রাইভেটে আসতে তোর আর কতক্ষন লাগবে?আমি ওয়েট করছি তোর জন্য।”

ফোনের ওপাশ থেকে লিয়ার বেস্ট ফ্রেন্ড রুপন্তী জবাবে বলে,,”আরে আমি আজ প্রাইভেট পড়তে যাবো না, দোস্ত।আমি এখন আউট ফিটে আছি।আর তোর না আজ দাওয়াত আছে।কার যেনো রিসেপশনের দাওয়াতের কথা বললি।”

লিয়া বিরক্তিকর ফেস করে বলে,,”আব্বুর এক কলিগের ছেলের বউভাত ছিলো।গিয়েছিলাম তো। প্রাইভেট মিস দেবো না।তাই ওখান থেকে খাওয়া দাওয়া করে চলে আসি।বাসায় গিয়ে ব্যাগ নিয়ে ওমনি আসছি। ড্রেস চেন্জ করারও সময় পায়নি। কিন্তু এসে তো দেখছি স্যার নেই।স্যারের আসতে নাকি আরো হাফ আওয়ারস লেইট হবে।আর তুই এখন শপিং করা বাদ দিয়ে আর্লি চলে যায়।”

“তুই আসবিনা তাই ভেবেই তো আমি আজ আউট ফিটে আসলাম। বাব্বাহ! হঠাৎ এতো উন্নতি যে,বেড়ানো বাদ দিয়ে পড়তে আসলি।ব্যাপারটা কি?”

“সে অনেক কথা।ফোনে বলা যাবে না।তুই আয় সামনা-সামনি বলবো,কেমন।”

“ওকে।ওয়েট কর।আমার আসতে তো তাও সময় লাগবে।যত দ্রুত আসা যায় ট্রায় করছি।”

একা একা লিয়ার ভালো লাগছিলো না। ছেলে মেয়েদের খেলা দেখে লিয়ার চোখ মুখ খুশিতে চকচক করতে থাকে।লিয়া সময় কাটাতে উঠে যায়।ওদের দলে গিয়ে খেলতে থাকে।

কফি কালারের ট্রিশার্ট আর অফ হোয়াইট গ্যাভারডিং ,পায়ে কেডস।ক্যাজুয়াল ড্রেস আপে জারিফ এসে একটা গাছের তলায় শান বাঁধা বসার স্থানে বসে।বাম সাইডে তাকাতেই একটা ব্যাগ দেখতে পায়।পকেট থেকে ফোনটা বের করে স্ক্রল করতে থাকে।আর মিষ্টি রোদটা উপভোগ করতে থাকে।খেলতে খেলতে একসময় ফেদারটা কিছুটা দূরে এসে পড়ে।লিয়া বলে উঠলো,,”তোমরা দাঁড়াও আমি আনছি।”

জারিফের পায়ের সামনে কিছু পড়তে দেখে।জারিফ মাথাটা ঝুঁকিয়ে কৌতুহলি দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকায়।ফেদার দেখতে পায়।তারপর কপাল কুঁচকে সামনে তাকিয়ে দেখে,অফ হোয়াইট লেহেঙ্গা পড়া একটা মেয়ে এদিকে এগিয়ে আসছে।মেয়েটার হাতের্্যাকেট।পরক্ষণেই জারিফ দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। নির্বিকার ভঙ্গিতে ফোনে মুখ ডুবিয়ে থাকে।লিয়া জারিফের সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে একবার ফেদারের দিকে তাকায়।আবার জারিফের ফর্সা খোঁচা খোঁচা দাড়িয়ালা মুখায়বে দৃষ্টি দেয়।লিয়া মনেমনে ভাবে,লোকটা সুদর্শন।বাট গম্ভীর।এর যায়গায় অন্যকেউ থাকলে,আমাকে দেখার সাথে সাথেই নিজ গর্জে ফেদারটা মাটি থেকে তুলে আমার হাতে দিতো।তবে ভালো। মেয়ে দেখলেই হেল্প করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠা ছেলেদের লো পার্সোনালিটি হয়। মেয়ে দেখলেই ছুকছুকানি স্বভাব শুরু হয় তাদের।সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে ছেলেটি প্লেস্যান্ট পার্সোনালিটি সম্পন্ন।এসব ভেবে লিয়া মনেমনেই নিজেকে তিরস্কার করে উঠলো, ওহ্,লিয়া।তোর হঠাৎ কি হলো? সামনের মানবটা যেমনই হোকনা কেনো।তাতে তোর কি যায় আসে? স্ট্রেইন্জ!দিনদিন তোর বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পাচ্ছে।আজগুবি চিন্তাভাবনা মনমস্তিষ্কে বিচরণ করছে।এসব কথা ভেবে লিয়া মাথা ঝাড়া দিলো। অতঃপর লিয়া হাঁটু ভেঙ্গে নিচের দিকে ঝুঁকে মাটি থেকে ফেদারটা হাতে তুলে নেয়।মাথা উঁচু করতে গিয়ে কিছু চুল বাতাসে জারিফের মুখের উপর আছড়ে পড়ে।জারিফ সাথে সাথেই অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,,
“কেয়ারলেস একটা।”

একটু আগে ঘটা ঘটনা না লিয়া বুঝতে পেরেছে।আর নাতো জারিফের বলা কথা শ্রবণ করেছে।লিয়া ফেদারটা হাতে তুলে ঝড়ের বেগে মাথা উঁচু করতে গিয়ে কারো চোখে মুখে নিজের খোলাচুল পড়েছে।সে সম্পর্কে লিয়া কিছুই জানে না।কারন লিয়া ওমনিই পিছনে না ফিরে পা চালিয়ে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের কাছে চলে যায়।মিনিট পাঁচেক পরে আবার ফেদারটা গাছের ডালে আঁটকে যায়।সেটা দেখে লিয়া অসহায় মুখাবয়ব করে করুণ স্বরে বলে,,”ওহ্ শিট! বারবার এক্সিডেন্টলি ফেদারটা ওদিকেই কেনো গিয়ে পড়ছে।এবার তো গাছের ডালে আটকিয়ে গেলো।”

লিয়া বাচ্চাদের কে উদ্দেশ্য করে ফের অপরাধীর স্বরে বললো,,”তোমাদের কাছে কি এক্সট্রা ফেদার আছে।তোমরা মন খা’রাপ করো না। আগামীকাল আমি তোমাদের কে ঐ একটার যায়গায় দুইটা ফেদার দেবো।আমার ভাইয়ের থেকে নিয়ে,কেমন। এক্সট্রা থাকলে সেটা দিয়ে এখন খেলা চালিয়ে যাও।”

জবাবে বাচ্চারা বলে,,”নাহ্।আপু নেই তো।বাসায় আছে।”

লিয়া ঠোঁট উল্টে বলে,,”ওকে।ব্যাপার না।চলো ওটা পারার চেষ্টা করি।”

গাছের কাছাকাছি যেতেই একটা ছেলে বলে উঠলো,,”আপু তুমি তো বড় আছো।তুমি হাত উঁচু করলে পারতে পারবে।”

লিয়া মৃদু হাসলো।হাত দিয়ে নাগাল পাবেনা লিয়া খুব ভালোই বুঝতে পেরেছে।তাই হাতে থাকার্্যাকেটটা ডান হাতে উঁচু করে চেষ্টা করতে থাকে।আর ছয় সাত ইঞ্চির মতো হলেই নাগাল পাওয়া যাবে।লিয়া বারকয়েক চেষ্টা করেই হাঁপিয়ে যায়।একে তো ভারী পোশাক পড়ে আছে।সেইজন্য অস্বস্তি হচ্ছে।লিয়া ঠোঁট উল্টে বলে,,

“এখন তো মনে হচ্ছে,পাতলুর মতো লম্বা হাত থাকলে ভালো হতো।ইশ!দরকারের সময় পাতলুর মতো হাতটা খুব জরুরী।আর যদি নবিতার মতো ডোরিমন বন্ধু থাকতো।কোনো গেজেট আবিষ্কার করে দিতো।বা উড়ন্ত পাখা দিতো।সেটাও এই মুহূর্তে কাজে লাগতো। আফসোস বড় আফসোস।লাইফে এমন কিছুই নেই।”

লিয়ার কথা শুনে নাচাইতেও জারিফের হাঁসি পাচ্ছে। জারিফ মনেমনে আওড়ায়,এতবড় মেয়ে নির্ঘাত এখনো কার্টুন দেখে। এসব কার্টুনের গল্প নাতাশার কাছ থেকে সব সময় শুনে অভ্যস্ত জারিফ।

লিয়া মাটি থেকে পায়ের পাতাটা উঁচিয়ে হাতটাও যতোটা সম্ভব উঁচু করে ধরে।এদিকে হাত বেশি উঁচু করার ফলে লেহেঙ্গার উপরের পার্ট টা উঁচুতে উঠে যায়।যার ফলে লিয়ার ফর্সা পেট খানিকটা উন্মুক্ত হয়।

রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে তিন চারটে বখাটে ছেলে।হাতে সিগারেট।দুই ঠোঁটের মাঝে সিগারেটে সুখটান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে আকাশে।ঘাড় ঘুরিয়ে মাঠের দিকে তাকাতেই বাজে নজরে তাকায়।সাথে সাথেই পাশের ছেলেদেরকে ইশারায় দেখিয়ে বিশ্রী ভাবে বলে উঠলো,,

“ভাই এই দেখেন।মাইয়া তো দরজা জানালা খুলে রাখছে।জোস লাগছে।চিকনাচাকনা দেখতে হেব্বি হট।নে’শা না করেই আমার নে’শা ধরে যাচ্ছে।”

লিয়ার ধ্যান ফেদারের দিকে থাকায় কথাগুলো বেশ জোরেশোরে বললেও লিয়ার মস্তিষ্কে সাড়া জাগায় না। বাচ্চাদের কথাতে লিয়া আরো কিছুই শুনতে পারছে না। নোংরা কথা জারিফের কর্ণদ্বয় ভেদ করতেই।জারিফের চোখমুখ শক্ত হয়ে যায়।জারিফ মাথাটা তুলে লিয়ার দিকে তাকিয়ে লিয়ার ফর্সা উন্মুক্ত পেটটা দেখে সাথে সাথেই দৃষ্টি নুইয়ে নেয়।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here