#সুখের_ঠিকানা
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব০৩
“এইযে সুন্দরী!শরীর দেখাইয়া তো মনে আ’গুন জ্বা’লা’ইয়া দিছো।এইবার তো নিভানোর দায়িত্ব-ও তোমারে লইতে হইবে।তো ফুলটুসি নিবা নাকি দায়িত্ব?তুমি কইলে হোটেল বুক করতে পারি।একেবারে নামি-দামি ফাইভ স্টারে লইয়া যাবো।রাজি আছোনি?”
বখাটেদের মধ্যে ঝুঁটি করে চুল বাঁধা একটা ছেলে, কয়েক কদম সামনের দিকে এগিয়ে এসে লিয়াকে উদ্দেশ্য করে ফের বা’জে টোন দেয়।বাকি তিনজনও পিছনে এগিয়ে এসে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে বিশ্রী হাসে।এবারের কথাগুলো শ্রবণ হতেই লিয়ার হুঁশ হয়।লিয়ার বুঝতে বাকি থাকে না কথাগুলো লিয়াকেই বলছে।লিয়া বিষয়টা বোঝার সাথে সাথেই হাত নামিয়ে নেয়।তারপর দুইহাত দিয়ে লেহেঙ্গার উপরের পার্টটা টেনে ঠিকঠাক করতে থাকে।লিয়া নিজের উপর লজ্জিত হয়।লিয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবে,উফফ!নিজের অসতর্কতার জন্য,আজ আমাকে ইভটিজিং এর শিকার হতে হচ্ছে।এতো নোংরা নোংরা কথা শুনে লিয়ার ভীষণ কান্না পাচ্ছে।
এতো সময় চুপচাপ বসে থাকলেও ঝুঁটি ওয়ালা ছেলের কথা কর্ণপাত হতেই জারিফের হাতের মুঠো আপনা আপনি শক্ত হয়।জারিফ শক্ত করে মুঠ পাকিয়ে উঠে দাঁড়ায়।জারিফের কপালের রগগুলো বেশ খানিকটা ফুলে উঠেছে।জারিফের ফর্সা মুখে মূহূর্তেই অন্ধকার নেমে আসে।জারিফের ইচ্ছে করছে ছেলেটার জিহ্বা টেনে ছিঁড়তে।সব সময় শান্ত স্বভাবের উপাধি পাওয়া মানবটিও এহেন বাজে কথায় নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলো না।তাই তো চুপচাপ নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকতে না পেরে উঠে দাঁড়ালো। ঝুঁটিওয়ালা ছেলেটা আরো কয়েক পা লিয়ার দিকে এগিয়ে আসতেই,লিয়ার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। মূহূর্তেই লিয়ার ফেসে অসহায়ত্বের ছাপ ফুটে উঠে।লিয়া মনেমনে নিজেকে শক্ত করে। লিয়া সাহস যোগানোর চেষ্টা করে। অতঃপর কন্ঠে একরাশ ঘৃণা নিয়ে বলে উঠলো,,
“দেখুন।আপনারা কিন্তু খুব বাজে কথা বলে ফেলেছেন।এর জন্য আমি আপনাদের বিরুদ্ধে স্টেপ নেবো।আমার আব্বুকে আপনারা চেনেন না।আমি বললে,আমার আব্বু মূহূর্তেই আপনাদেরকে জেলে পুরে ছাড়বে,হুহ।”
“এই দেখ তোরা। ময়না তো জেলের ভ’য় দেখাচ্ছে।”
কথাটা শেষ করতেই ওরা সব কয়টা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।আর একজন বলে উঠলো,,”ময়নাপাখি ঐটুকু দেখে মন ভরেনি।তাইতো অফার দিলাম।”
ছেলেটার কথাটা শেষ হওয়ার আগেই মুখের উপর ঠাস করে দাবাং মার্কা একটা চ’ড় পড়ে।ছেলেটার মাথা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।ছেলেটার ঠোঁটের কোণা বেয়ে হালকা র”ক্ত গড়িয়ে পড়ে।জারিফ শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে চ’ড় দেয়।ছেলেটির দাঁতের সাথে ঠোঁট লাগার ফলে বেশ খানিকটা কে’টে যায়। শুধু চ’ড় দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি জারিফ। দুইহাতে ছেলেটির শার্টের কলার চেপে ধরে রক্তিম চোখে তাকিয়ে দাঁত কটমট করে বলে উঠলো,,
“সৃষ্টিকর্তা চোখ দিয়েছেন নারীর শরীরের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে নয়।চোখ দিয়ে রাইট রং দেখে জীবন পরিচালনা করার জন্য।আর একটা মেয়েকে এতো নোংরা নোংরা কথা বলতে জিহ্বায় আটকালো না। মেয়ে দেখলেই টিজ করতে ইচ্ছে করে?তোদের বাড়িতে মা বোন নেই। রাস্তায় মেয়ে দেখলেই টিজ করিস।সেতো কারো না কারো বোন।কোনো পরিবারের মেয়ে।আজ তোর পরিবারের কোনো মেয়ের সাথে এরকম হলে,কি করতিস? প্রতিবাদ করতিস?নাকি মজা নেওয়ার জন্য সাথে যোগ দিতিস?”
জারিফ কলার ছেড়ে দিয়ে মুখটানটান করে স্ট্রেইট দাঁড়ালো।পাশ থেকে একজন দুই আঙ্গুলে মুখ চুলকাতে চুলকাতে বলে উঠলো,,”আরে ভাইতো দেখছি নীতিবাক্য ছাড়তাছে।কি কইলেন যেনো? ওহ্!মনে পড়ছে।বাড়িতে মা বোন নেই।মা বোন সব আছে।বউ নাই।আর না আছে এরকম হট মা..।”
জারিফের রাগের পরিমাণ সেকেন্ডেই আকাশ ছুঁইয়ে যায়।জারিফ জোরেশোরে একটা ঘু’ষি দিতেই ছেলেটি টাল সামলাতে না পেরে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়।একহাতে গালটা চেপে ধরে। অতঃপর লিডার ছেলেকে উদ্দেশ্য করে ঝুঁটিওয়ালা ছেলেটি বলে উঠলো,,”আরে ভাইজান চুপ করে আছেন যে।এই পোলা আমাগো গায় হাত উঠাইতাছে।আপনি কিছুই কইতাছেন না।আপনি একবার ইশারা করেন,আমি একাই এরে খ’ত’ম কর।
কথার মাঝেই লিডার ছেলেটি বলে উঠলো,,”এই চল তোরা।কাজ আছে।”
কথাটা শেষ করেই ছেলেটা প্রস্থান করে।বাকি ছেলেরা পিছু পিছু যায় আর বলে,,”ভাইজান ব্যাপার ডা কি? কিছুই কইলেন না।এমনি ছাইড়া দিলেন।”
“সামনে নির্বাচন আছে।এমপি সাহেবের নির্দেশ আছে।এহন যেন,আমরা নতুন কইরা কোনো ঝালেমা-টামেলা না করি।এই সময় জেলে গেলে।আমাগো হইয়া উনি কিছু করতে পারবো না।আর এই পোলারে আমি চিনি।এএসপির ভাতিজা।পরে দেখে নেবো।
.
.
লিয়া নিজের উপর ভীষণ লজ্জিত।কি দরকার ছিলো বাচ্চামি করার।যদি বাচ্চাদের সাথে খেলায় জয়েন না হতো।তাহলে হয়তো এরকমটা নাও হতে পারতো।লিয়া মনেমনে নিজেকে তিরস্কার করে।আর জারিফের উপর খুব সন্তুষ্ট হয়।জারিফের কথা-বার্তা লিয়াকে বেশ মুগ্ধ করে।লিয়া জারিফের দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কিয়ৎক্ষন পরেই মাথাটা নুইয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে মৃদুস্বরে বলে,,”থ্যাংকস।থ্যাংকস আ লট।”
লিয়ার ধন্যবাদ জানানোতে জারিফের কোনো হেলদোল নেই।জারিফ নির্বিকার ভঙ্গিতে আছে।জারিফ লিয়ার দিকে এগিয়ে আসে।লিয়ার কাছ থেকে র্যাকেট নিয়ে হাতটা সর্বোচ্চ উঁচিয়ে ফেদারটা পেড়ে দেয়।ফেদারটা নিচে পড়তেই, বাচ্চারা নিয়ে চলে যেতে থাকে।জারিফও কোনো কিছু না বলে চলে যেতে থাকে।জারিফের চলে যাওয়ার দিকে লিয়া এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।কয়েক পা যাওয়ার পর জারিফ কিছু ভেবে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়।ফলে লিয়ার সাথে চোখাচোখি হয়।লিয়া সাথেসাথে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।লিয়ার খানিকটা অস্বস্তি হয়।লিয়া মনেমনে আওড়ালো,,”উফ্! উনাকে এখনই ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকানোর ছিলো।আমার এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে আবার কিনা কি ভেবেছেন আল্লাহ মালুম।এমনিতেই একটু আগে বেশ বাজে সময় গেলো আমার। উফ্!কি বিশ্রী ব্যাপার।সব মিলিয়ে আজকের দিনটাই খুব বাজে যাচ্ছে আমার।”
লিয়া হেনতেন ভেবে চলছে।লিয়ার সেই ভাবনা ভাঙ্গে গম্ভীর গলার স্বর শুনে।জারিফ লিয়ার সামনে সোজাসুজি দাঁড়িয়ে স্পষ্টকরে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,,
“আজকাল নিউজফিড জুড়ে ধ”র্ষ”ণ, ইভটিজিং এসব খবরের ছড়াছড়ি।এসবের জন্য কোনো কোনো সময় এক পার্সেন্ট হলেও মেয়েরা দায়ী থাকে।এটা অবশ্য আমার ধারনা।তাদের অসতর্কতার জন্য অনেক সময় বড়সড় দূর্ঘটনা ঘটে।একজন মানুষ হিসেবে আপনাকে বলছি, নেক্সট কোনো কাজ করতে হলে। পোশাক আশাক তারপর পরিবেশ দেখে করবেন।”
কথাগুলো বলেই গটগট করে জারিফ চলে যায়।লিয়া আড়চোখে চেয়ে রইলো।আর মনেমনে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালো মানবটিকে। লিয়ার হয়ে প্রতিবাদ করার জন্য।আবার সুন্দর উপদেশ বাণী দিয়ে যাওয়ার জন্য।জারিফের যাওয়ার পানে চেয়ে লিয়া মৃদু হাসলো।কিছুক্ষণ আগের মন খা’রাপ, অসহায় বোধ সবটাই উড়ে যায়।সেখানে অজানা ভালালাগার সুপ্ত অনুভূতি জন্ম নিতে থাকে।
.
.
লিয়া দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী।বাবা এনামুল খাঁন মেজর (মেডিকেল কোর)।বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার ** উপজেলায়।বাবার চাকরীর সুবাদে বিভিন্ন জেলাতে কেটেছে শৈবব থেকে কৈশোর।আজ প্রায় দুই বছরের মতো হবে এনামুল খাঁন ময়মনসিংহ ক্যান্টনমেন্টে এসেছেন।লিয়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়াশোনা করে।একজন বাইরের স্যারের কাছে ফিজিক্স প্রাইভেট পড়ে ব্যাচে।ছোটো মাঠটার পাশেই স্যারের বাসা।মাঠটা বেশি সময় জনমানব শূন্য-ই থাকে।আর থাকলেও হাতে গোনা কয়েকজন থাকে। রুপন্তীর সাথে মাঝে মাঝেই লিয়া মাঠটাতে এসে বসে।আজ হঠাৎ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে এরকম হবে জানলে।লিয়া এদিকে ছায়াও মাড়াতো না।
কিছুক্ষণ পর,,
স্যারের বাসার বড় বারান্দায় কাঠের বেঞ্চিতে শেষের সারিতে বসেছে লিয়া আর রুপন্তী।এইতো মিনিট পাঁচেক আগে রুপন্তী এসেছে। স্টুডেন্টস সংখ্যা পনেরো জনের মতো হবে হয়তো। স্যার হোয়াইট বোর্ডে আইনস্টাইনের (E=mc স্কয়ার) সূত্রটি লিখে বোঝাচ্ছেন।পিছনে বসে লিয়া আর রুপন্তী ফিসফিসিয়ে কথা বলছে।
রুপন্তী পেন দিয়ে লিয়াকে খোঁচা দিয়ে বলে উঠলো,,”এই লিয়া।তখন ফোনে বললি,অনেক কথা আছে। সামনাসামনি বলবি।কই বলছিস নাযে।”
লিয়া মৃদু আহ্ শব্দ উচ্চারণ করে। রুপন্তীর দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,,”এই রুপু। আশ্চর্য!এত জোড়ে কেউ খোঁচা দেয়।আর সময় চলে গেলো না-কি।এখন স্যার পড়াচ্ছেন।পরে বলবো।যাওয়ার সময়।”
রুপন্তী বাচ্চাদের মতো জিদ ধরে বলে উঠলো,,”আজ আসবো না আসবো না করেও পড়তে আসলাম।কারনটা কি?কারনটা শুধু তুই। ভাবলাম বিয়ে বাড়িতে গিয়ে নিশ্চয় প্রোপোজাল পেয়েছিস।সেই সব কথা আমার সাথে শেয়ার করতে চাস।তাই শোনার জন্য ছুটে এসেছি,হুম।তা দোস্ত হবু বয়ফ্রেন্ড দেখতে কেমন?কি করে?”
লিয়া ঠোঁট গোল গোল করে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলে,,” ধ্যাত ওরকম কিছুই না।আসলে ওখানে অপরিচিত সবার মাঝে থাকতে মোটেও ভালো লাগছিলো না।যতটা সময় ছিলাম।বলা চলে,আম্মুর শাড়ির আঁচল ধরে ।তার উপরে বিয়ে বাড়িতে কিছু এলার্জি আন্টি আঙ্কেল থাকেন।তাদের কাজ থাকে ঘটকালি করা।এই নিজের বোনের বা ভাইয়ের বা ননদের বা পাড়া প্রতিবেশী সবার ছেলেদের বিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব । স্বইচ্ছায় খুশি মনে নিজের ঘাড়ে চেপে নিয়ে বেড়ান।একজন এসে তো আম্মু কে মিষ্টি করে,আপা ডেকে বলছিলো।আপা কি হয় এটা আপনার? আম্মু আমার মেয়ে বলতেই, খোশগল্প শুরু করে দেয়। একপর্যায়ে তার দূর সম্পর্কের ননদের ছেলের জন্য পাত্রী খুঁজছে বলে। আম্মু তাতেও কিছু না বলায়।মহিলা তো সরাসরি আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো।এসব কিছু শুনতে মোটেও ভালো লাগছিলো না।তাই চলে আসলাম। ক্লিয়ার?”
রুপন্তী দুদিকে মাথা ঘুরিয়ে হ্যা সূচক উত্তর দেয়। তারপর ঠোঁট উল্টে উৎসুকভাবে শুধালো,,”বুঝলাম সব। আচ্ছা লিয়া বলতো তোর কিরকম ছেলে পছন্দ। জীবনসঙ্গী হিসেবে।আর তোর বর হিসেবে ডক্টর, ইন্জিনিয়ার,নাকি ক্যাডার কোনটা হলে মানাবে।এখন তো সবার ফাস্ট চয়েজ থাকে এসবে।
লিয়া দৃষ্টিসরু করে তাকিয়ে জবাবে বললো,,
“নন-ক্যাডাররা কি দোষ করলো বোন।সবাই যদি ক্যাডারদেরকেই চায় তাহলে,নন ক্যাডারদের কিহবে?তারা তো দেখছি বউ বিনা ম’রবে।”
একটু থেমে।বড়বড় পাপড়িওয়ালা টানাটানা চোখজোড়া বারকয়েক পলক ঝাপটায় লিয়া।তারপর মৃদুস্বরে ঠোঁট আওড়ালো,,”পেশা কি সেটার থেকে বড় হলো পার্সোনালিটি।একজন প্লেস্যান্ট পার্সোনালিটি সম্পন্ন মানুষ আমার জীবনে আসুক।আমি মন থেকে চাই।আর বেঁচে থাকার জন্য খুব বেশি কিছুর প্রয়োজন হয়না। সম্মান জনকভাবে,মানসম্মতভাবে জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু থাকলেই চলবে।”
রুপন্তী মজার ছলে বলে উঠলো,,”দাঁড়া তোর জন্য সরকারী চাকরীজীবী ভুঁড়িওয়ালা টাকলা দেখে একজন নবম গ্রেডের নন ক্যাডারের খোঁজ করবো।আজকে থেকে।”
বারান্দার লোহার গ্রিল দিয়ে বাইরে দৃষ্টি দিতেই লিয়ার নজর স্থির হয় গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানবের দিকে।লিয়া আরো অবাক হয় একটা বাচ্চা মেয়েকে দৌড়ে মানবটির হাত ধরতে।জারিফ মেয়েটার হাত ধরে আছে।আর সামনে এক মেয়ে দাঁড়িয়ে কিছু বলছে। মেয়েটাকে লিয়া খুব ভালো করেই চেনে। স্যারের মেয়ে। বাচ্চা মেয়েটার কাঁধে ব্যাগ।লিয়া মনেমনে বলে,, বাচ্চা মেয়েটি সুমি আপুর কাছে প্রাইভেট পড়তে আসছিলো মেবি।তবে ঐলোকের কিহয় মেয়েটা?নিজের বাচ্চা?
এটা ভাবতেই লিয়া আরো আশ্চর্যান্বিত হয়।লিয়া বিস্ময়কর চাহনিতে চেয়ে অস্ফুট স্বরে ফের বলে উঠলো,,”বাব্বাহ!দেখে বোঝা যায়না অথচ এতবড় একটা বাচ্চার বাবা। স্ট্রেইন্জ!”
কথাগুলো রুপন্তীর কানে পৌঁছাতেই লিয়াকে শুধায়,,”কার কথা বলছিস?কোন বাচ্চা আর কার বাচ্চা?কি বলছিস? পরিষ্কার করে বল।”
লিয়া ইশারা করে দেখিয়ে বললো,,”ঐযে গেইটের কাছে দাঁড়ানো ইয়াং ম্যানের কথা বলছি।মেয়েকে পড়াতে বোধহয় সুমি আপুর কাছে আসছিলো।মনেহয় প্রেম টেম করে অল্প বয়সে বিয়ে শাদি করেছিলো।আর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাচ্চা কাচ্চাও ডাউনলোড করে ফেলেছিলো।”
রুপন্তী ঘাড় ঘুরিয়ে জারিফকে দেখে নেয়।তারপর লিয়ার দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,,”ব্যাপার -স্যাপার কি?লোকটাকে নিয়ে তোর এতো কৌতুহল কিসের দোস্ত।লোকটার উপর ক্রাশ -টাশ খাসনি তো।”
লিয়া ভাব নিয়ে বলে,,” ক্রাশ খাবো আমি।তাও আবার বিবাহিত এক বাচ্চার বাপের উপর। ইম্পসিবল।”
“আর যদি বলি,লোকটা অবিবাহিত। বাচ্চা টা ওনার না।বাচ্চাটা অন্যকারো তখন।”
রুপন্তীর কথা শুনে জারিফ আর বাচ্চামেয়েটা সম্পর্কে জানতে লিয়ার কিওরিওসিটি আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায়।লিয়া চোখে মুখে উৎসুকতা নিয়ে প্রশ্ন করে উঠলো,,”এই রুপু তুই চিনিস ওনাকে? কিভাবে?”
রুপু সোজা হয়ে বসে।লিয়ার উৎসুক মুখাবয়বের দিকে তাকিয়ে বলে,,”হুম চিনি।আমার ভাইয়ার ফ্রেন্ড। বাচ্চাটা ওনার বোনের মেয়ে।ওনার বোন নাকি এইমেয়েকে জন্ম দিতে গিয়ে মা’রা গিয়েছে।আর মেয়েটা ওর নানু বাড়িতেই থাকে।সেই জন্ম থেকেই।”
কথাগুলো শুনে লিয়ার মনটা ব্যাথিত্য হয়। বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে অনেক মা প্রাণ হারায়। পরিবার আত্মীয়স্বজন হারায় ভালোবাসার একজন সদস্যকে। জন্ম -মৃত্যু সব কিছু সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ইচ্ছা।তারপরেও মানুষের মন আর্তনাদ করে বলে উঠে, ইশশ্!অকালে প্রাণ গেলো অমুকের।ঐ বাচ্চাকে জন্ম দিতেই প্রাণ হারালো।এরকম কথা শুনে বড় হয় মা হারা কিছু এতিম শিশু।একদিকে মায়ের স্নেহ-মমতা ছাড়া বেড়ে উঠা।আবার অন্যদিকে সমাজের মূর্খ কিছু মানুষের নির্বুদ্ধিতা সম্পন্ন কথা।যা এতিম শিশুর মানসিকতায় আঘাত করে।মেয়েটির মা নেই।এইকথাটা শোনার সাথে সাথে লিয়ার কোমল হৃদয়টা কেঁদে উঠলো। লিয়ার আখিযুগল ছলছল করে।লিয়া ভারী গলায় বলে,,
“বিষয়টা খুব প্যাথেটিক।এতো সুন্দর একটা বাচ্চা মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হলো। উফ্!আর পরিবার হারালো আদরের একজন সদস্যকে।”
রুপন্তী রাশভারী স্বরে বললো,,”হুম।ঠিক বলেছিস।তবে শুনেছি বাচ্চা মেয়েটাকে বাসার সবাই খুব আদর করে।জারিফ ভাইয়া বোনকে অনেক ভালোবাসতেন।আর সেই বোনের অস্তিত্ব এইমেয়ে।এখন নাকি জারিফ ভাইয়ার চোখের মনি এই বাচ্চা মেয়েটা।আমার ভাইয়ার কাছ থেকে মামা আর ভাগিনার অনেক গল্প শুনেছি।”
কথা শেষ করেই রুপন্তী মলিন হাসে।লিয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সোজা হয়ে বসে।খাতায় অংকটা তুলতে থাকে। তারপর কিছু মনে হতেই প্রশ্ন করে,,”উনি।তোকে চেনে।তোকে দেখেছে কখনো?”
“উনি আবার কে?হু ইজ হী অর সী?”
রুপন্তীর কথা শুনে লিয়ার খানিকটা রা’গ হয়।এই মেয়ে ইচ্ছে করে প্রশ্ন করছে।নাকি বুঝতে পারছে না লিয়া কার কথা বলছে।লিয়া কপাল কুঁচকে দাঁতে দাঁত পিষে ফের বললো,,”এতক্ষণ যার কথা বললি।ঐযে বাচ্চা মেয়েটার মামা।তোর ভাইয়ের ফ্রেন্ড।ঐ জারিফ না কি তার কথা বলছি।”
রুপন্তী মাথা নাড়িয়ে বলতে থাকে,,”ওহ্!জারিফ ভাইয়া।হুম চেনে তো।আমাদের বাসায় কয়েকবার গিয়েছে। লাস্ট এইতো একসপ্তাহ আগে গিয়েছিলেন। চাকুরী হওয়াতে মিষ্টি মুখ করাতে। মিষ্টি নিয়ে গিয়েছিলেন।”
লিয়া জানতে আগ্রহী হয়ে শুধায়,,”কিসে চাকরী হয়েছে।”
“উনি বাকৃবিতে মাস্টার্স করছেন। সব ইয়ার মিলে ফাস্ট ক্লাস ফাইভের মধ্যে পজিশনে ছিলেন।এককথায় ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট।এগ্রিকালচার ফ্যাকাল্টিতে প্লান-প্যাথলজি ডিপার্টমেন্টে টিচার হিসেবে ওনাকে নেওয়া হবে।”
নাতাশার স্কুলের ম্যাম হলেন সুমি।আজ প্রথম নাতাশা সুমি মিসের কাছে প্রাইভেট পড়তে আসে।জারিফ মিস সুমিকে সিরিয়াসভাবে অনেক কিছুই বললো এতক্ষণ। অবশেষে বললো,,”প্লিজ,অন মাই রিকোয়েস্ট। নাতাশার উপর কখনো পড়াশোনা নিয়ে পেশার দিবেন না।আর এতক্ষণ শুনলেন তো ওর অসুস্থতার কথা।এটা একটা জটিল রোগ। উফ্!জানিনা কবে একেবারে অসুখটা কিওর হবে।”
সুমি একহাতে নাতাশার গাল আলতোকরে ছুঁইয়ে দিয়ে বলে,,”চিন্তা করবেন না।ওর অসুস্থতার কথা শুনে আমার নিজেরই খুব খা’রাপ লাগছে।কি বলে সেম্প্যাথি দিবো ভেবে পাচ্ছি না।তবে বলতে চাই, আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন।একসময় নিশ্চয় সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে।”
নাতাশা মিসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জারিফের সাথে টায়াটা গাড়ির কাছে আসে।জারিফ গাড়ির পিছন দরজা খুলে নাতাশার ব্যাগটা রাখে।তারপর সামনের দরজা খুলে নাতাশাকে সুন্দর করে বসিয়ে দিয়ে সিট বেল্ট টা বেঁধে দেয়। অতঃপর নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
.
.
ড্রয়িংরুমের সোফায় শুয়ে স্মার্ট টিভিতে স্পোর্টস দেখছে নীল।এমন সময় জারা বাইরে থেকে এসে কাঁধ থেকে স্কুল ব্যাগটা সোফার উপর রাখে।এক আসন বিশিষ্ট সোফায় গা এলিয়ে আয়েশ করে বসে। সেই সময় নিরুপমা বেগম চা নিয়ে আসেন।এসে অপর পাশের সোফায় বসেন।নীল নিরুপমা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে,,”আম্মু আমার কফি কই?”
নিরুপমা বেগম চায়ের কাপে ছোটো করে চুমুক দিয়ে বললেন,,”চারু কফির জন্য দুধ চুলায় বসিয়েছে।ওয়েট কর নিয়ে আসবে।আমার মাথাটা ভীষণ ধরেছে।তাই কড়া করে এককাপ চা খাচ্ছি। আহ্!মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে।”
জারা বলে উঠলো,,”ছোটোমা বেশি সমস্যা হলে মেডিসিন নাও।পেইন ক্লিয়ার খেয়ে নাও।দেখবে দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে।”
নিরুপমা বেগম ভরাট গলায় বললেন,,”জারা মা।সব সময় পেইন ক্লিয়ার খাওয়া ঠিক নয়। শরীরে ব্যাড ইফেক্ট পড়ে।”
নিরুপমা বেগমের কথার মাঝে নীল ফোড়ন কে’টে জারাকে উদ্দেশ্য করে বলে,,”এইযে জারা।কথা শুনে তো মনে হচ্ছে বেশ ডক্টর ফক্টর হয়ে গিয়েছিস।মেডিসিন সাজেস্ট করছেন।যার কিনা নাক টিপলে দুধ বের হবে।”
কথাগুলো শ্রবণ হতেই জারার সুন্দর ফুরফুরে মেজাজটা খারাপ হতে থাকে।জারা নাকমুখ কুঁচকে বললো,,”দেখ ভাইয়া মাত্রই কোচিং থেকে ফিরলাম।এখন তোর সাথে ঝ’গড়া করার মুড নেই।তাই মিছেমিছি আমাকে রাগানোর চেষ্টা বাদদে।একটা রিকশাও পায়নি অর্ধেক পথ পায়ে টেনে আসছি।তারপর রিকশা পেয়েছি।আমি খুব টায়ার্ড।”
জারা কথা শেষ করে পাশে থাকা স্কুল ব্যাগটা সোজা করতে থাকে।সেই সময় নীল মৃদু হেসে ফের বলে উঠলো,,”এইযে সিন্দাবাদের মতো একটা বস্তা পিঠে ঝুলিয়ে সকাল বিকেল এ প্রাইভেট থেকে ও কোচিং এ যাস।তা শুধু যাওয়া আসাই নাকি পড়াশোনাও কিছু করিস।পড়াশোনার কোনো টপিক ধরলে তো শিয়র পারবিনা।পারবি?বল পারবি?”
নিরুপমা বেগম ছেলেকে শাসিয়ে বলে উঠেন,,”আহ্!নীল হচ্ছে টাকি।ছোটো বোনের সাথে কেউ এরকম করে।জারা তোর থেকে কত ছোট না।কোথায় বোনকে স্নেহ করবে,আগলে রাখবে।তা না করে সব সময় চুলোচুলি,ঝগড়া ঝাটি বাঁধিয়ে ছাড়িস।”
জারা নাকের পাটাতন ফুলিয়ে রাগান্বিত স্বরে বললো,,”তোমার ছেলেকে প্রশ্ন করতে বলো।খুব পড়া ধরার শখ না। আচ্ছা ধর।”
জারার কথায় নীল থতমত খেয়ে বসে।জারা যে পাল্টা প্রশ্ন করতে বলবে।তা নীল ভাবেনি।নীল তো মজার ছলেই বলেছিলো।জারা বিষয়টা সিরিয়াসলি নিয়েছি।বেচারা নীলেরই বা কি দোষ।দশ সেকেন্ড ভেবে নিয়ে নীল শান্ত গলায় বলতে লাগলো,,”ওকে ফাইন।খুব তো সায়েন্স নিয়ে পড়ছিস। ডক্টর, ইন্জিনিয়ার হওয়ার শখ।দেখি তোর মেধা কতটুকু।উমম!বলতো নীল রঙের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কত?”
জারা কিছু সময় মনে করার চেষ্টা করে। অনেক চেষ্টা করেও যখন মনে করতে পারলো না।তখন হাল ছেড়ে দেয়। কিয়ৎক্ষন পরে কিছু মনে হতেই জারা ফিচেল হাসে। ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে রাখে । দাঁত কেলিয়ে ঠোঁট প্রসারিত করে বলে,,
“নীল রঙের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কত জানিনা।তবে আমার সামনে থাকা, কারেন্টের খুঁটির মতো লম্বা নীলের দৈর্ঘ্য জানি। পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি।”
চলবে…
(ফ্লাসব্যাক থেকে দ্রুতই বেড়িয়ে আসবো। ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। রেসপন্স করবেন।ধন্যবাদ সবাইকে।)