সুখের_ঠিকানা #শারমিন_হোসেন #পর্ব০৫

0
350

#সুখের_ঠিকানা
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব০৫

“ব্রো তুই হলি শান্ত স্বভাবের, ঠান্ডা মেজাজের। আবার তোর বউ।আই মিন ফিউচার ভাবিও যদি তোর মতো শান্ত শিষ্ট হয়।তাহলে কেমন হয়ে যাবেনা।তোদের দুজনের জ্বীন একহয়ে তোদের বাচ্চা তো আরো হিম শীতল হবে।একদম হিমালয় পর্বতের বরফের ন্যায় হবে তার জেনেটিক্স বৈশিষ্ট্য। ওহ্ নো।”

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামে নীল।কথা শেষ করে নীল এমন ভাবভঙ্গি করে,মনে হচ্ছে এমন হলে সাংঘাতিক বড়সড় ভুলটুল হয়ে যাবে।নীল হাঁটুর উপর কনুই ভর দিয়ে একহাত গালে রাখে।খুব সিরিয়াস ভাবভঙ্গি নিয়ে একমনে কিছু ভেবে চলছে।নাশার গবেষণা কেন্দ্রে বসেও কেউ এতটা ভাবুক ভঙ্গিমা করবে কিনা, সন্দেহ। নীলের ফেসে যতটা সিরিয়াসনেস দেখা যাচ্ছে।উফফ!ভাবা যায়।নীল মনেহয় নিজের ক্যারিয়ার গঠন করা নিয়েও এতটা সিরিয়াস নয়।এই মুহূর্তে যতটা সিরিয়াস ভাইয়ের ফিউচার বউ নিয়ে।জারিফ নীলের এসকল কথা কানে না দিয়ে নির্বিকার ভাবে থাকে। দুইহাতে ফোন স্ক্রল করতে থাকে।ওদিকে খানিকটা সময় ধরে ভেবে নিয়ে নীল টানটান হয়ে বসে। চোখেমুখে চিন্তার রেশ ফুটিয়ে তুলে বলে উঠলো,,

“ব্রো এখনও সময় আছে।তাই বলছি পছন্দ টা চেঞ্জ কর। অনেক ভাবাভাবি করে দেখলাম।দুইজনের জ্বীন একই রকম নরম কোমল স্বভাবের হলে। বাচ্চা তো একদম কাঁদা মাটির মতো হবে।আর এখনকার মেয়েরা যে ডেঞ্জারাস। উফ্!বিয়ে করতে চায়।সহজ সরল দেখে।যাতে কান ধরে উঠবস করাতে পারে।তাই নিজের কথা না ভেবে ভবিষ্যৎ বংশধর।আইমিন তোর ফিউচার ছেলের কথা ভেবে হলেও একটু চঞ্চল স্বভাবের মেয়ে দেখে বিয়ে কর।”

“একজন মানুষের নেচার নরম।তারমানে এই নয়যে,সে বো”কা।তাকে সাত চ”ড় দিলেও রা থাকবে না।এমন নয়।অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রটেস্ট করবে না,বেকবোন থাকবে না।মোটেও এরকম নয়।”

জারিফের কথার মাঝেই জারা আসতে আসতে কন্ঠে চঞ্চলতা নিয়ে বলে উঠল,,”সচারাচর আমি যদিও নীল ভাইয়ার কোনো কথায় সহমত পোষণ করিনা।তবে আজকে নীল ভাইয়ার এইকথার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করলাম।”

কথাটা শেষ করেই জারা জারিফের পাশে ফাঁকা জায়গায় ধপাস করে বসে পড়ে।দুই আঙ্গুল মুখের সাথে ধরে পাঁচ সেকেন্ড কিছু ভেবে নিয়ে ফের কন্ঠে শীতলতা নিয়ে বললো,,”ভাইয়ার বউ হিসেবে একটা চঞ্চলা হরিণী মিষ্টি ভাবী চাই।যে সারাক্ষণ আমাদের এই সুখের ঠিকানাকে তার চঞ্চল স্বভাব দিয়ে হাসি খুশিতে ভরে রাখবে। উফ্!কোথায় পাওয়া যাবে এমন মিষ্টি ভাবী?যার টানাটানা হরিণী কালো মিচমিচে চোখের মনি।পাপড়িগুলো বেশ বড়সড়। ধবধবে সাদা ফর্সা।টুকা দিলে যেনো র”ক্ত চুইয়ে পড়বে।দীঘল কালো মিচমিচে চুল।যার হাসির ঝংকারে সবাই মুগ্ধ হবে।যার সবকিছুই হবে আকর্ষণীয়।”

“অর্ডার দেওয়া লাগবে।”

থমথমে মুখাবয়ব করে স্পষ্টকরে নীলের জবাব।ফের দাঁতে দাঁত চেপে বলে,,”এই জারা এমন বর্ণনা দিছিস।তোর বর্ণনা শুনে তো মনে হচ্ছে এমন মেয়ে অর্ডার দেওয়া লাগবে।তবে সমস্যা হলো,এখন অর্ডার দিলে ডেলিভারী পেতে পেতে তো ব্রো এর বিয়ের বয়স পার হয়ে যাবে।আর নাকি ব্রো রূপবান এর মেইল ভার্সন হয়ে বউকে কোলে পিঠে করে মানুষ করবে।রুপবান যেমন রহিমকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছিলো। ব্রো রাজি আছিস?এরকম করতে?”

নীলের কথা শুনে জারা শব্দ করে হেসে ফেলে।জারা হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে।নীল জিগ্গাসু দৃষ্টিতে জারিফের পানে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।নীলের এহেন কথাবার্তায় জারিফ নীলের দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সোজা নিজের রুমে চলে যায়।জারিফ ভালো করেই জানে এই ফা’জি’লের সাথে কথা বলা মানেই নিজের মানসম্মানের দফারফা করা।
.
ডায়নিং টেবিলের উপর দুইহাতের কনুই ঠেকিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছে লিয়া।মুখটা ভার করে। রাজিয়া সুলতানা টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখছেন।কাজের মেয়েটা হাতে হাতে সাহায্য করছে।লিয়া একটু নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসে। অতঃপর কাঁ’টা চামুচ হাতে নিয়ে সালাতের থেকে একটুকরো শসা তুলে নিয়ে মুখে পুড়ে দেয়।শসার টুকরো চিবাতে চিবাতে ম্লান গলায় বলে,,

“বলছি যে আম্মু।আমার কেনো জানি মনটা ভীষণ খা’রাপ করছে।ভালো লাগছে না।মুড সুয়িং চলছে।মুডটাকে রিফ্রেশ করতে। ইনভায়রনমেন্ট

লিয়াকে থামিয়ে দিয়ে রাজিয়া সুলতানা মেয়ের দিকে শান্ত চাহনিতে চেয়ে ভরাট গলায় বলেন,,
“ইনভায়রনমেন্ট চেন্জ করা দরকার।এতো হেয়ালি না করে সোজাসুজি স্পষ্টভাবে বললেই পারিস। দাদুবাড়িতে যেতে চাচ্ছিস।এতো ইনিয়েবিনিয়ে বলা আমার মোটেও পছন্দ নয়।যা বলবি পরিষ্কার করে,হুম।”

লিয়া দুইহাত টেবিলের উপর ভাঁজ করে রেখে ঠোঁট উল্টে ফের বলে,,”আরে নাহ্।আগে পুরো কথাটা তো শুনবে।দাদুবাড়ি থেকে তো কদিন আগেই আসলাম। অনেকদিন হলো নানুবাসায় যাইনা। নানুভাইকে দেখি না।নানুভাইকে খুব করে দেখতও ইচ্ছে করছে।”

রাজিয়া সুলতানা চেয়ার টেনে বসেন। তাচ্ছিল্যর হাসি দিয়ে শক্ত কন্ঠে বললেন,,”হুম!আসছে। নানুভাইয়ের উপর দরদ উথলে পড়ছে।ভাইবোন দুইটাই তো হয়েছিস বাপের মতো।আমার বাবার বাড়ির নামই শুনতে পারিসনা।এদিকে দাদুবাড়ির চৌদ্দ গুষ্টি বলতেই পা’গল।বছরে একবার বাবার বাড়ি যাই। তোদের ভাইবোনের জন্য দুইরাতের বেশি তিনরাতও কা’টা’তে পারিনা।”

মায়ের ব্লেইম শুনে লিয়ার মনটা আরো খা’রাপ হতে থাকে। ফর্সা মুখে মূহূর্তেই আমাবস্যা নেমে আসে।চোখমুখ আরো ভার হয়ে আসে।ধ্যাত আবার সুইচড অন করে দিয়েছি।এখন কতক্ষণ এটা চলে, আল্লাহ মালুম।মায়ের বরাবরের মতো একই অভিযোগ।এসব ভেবে লিয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাল ছেড়ে দিয়ে মুখটা বাংলা পাঁচের মতো করে রাখে।রাজিয়া সুলতানা দৃষ্টি সরু করে লিয়ার দিকে চেয়ে শান্ত গলায় বলেন,,”রাহবারের স্কুল আছে।তোরও তো কলেজ প্রাইভেট আছে।তাই এখন যাওয়া চলবে না। পরে পাছে সময় করে যাবো।”

“দুইদিন থাকবো বেশি নয়। প্লিজ আম্মু।”

“উহুম!এখন সম্ভব নয়।এখন আমার নিজেরও জার্নি করতে ইচ্ছে করছে না।”

মায়ের কথার পিঠে লিয়া ফট করে বলে উঠলো,,”আম্মু তোমরা না গেলে।আমি একাই যেতে চাই।আমার ভীষণ ট্রেন ভ্রমণ করতে ইচ্ছে করছে।এবার ট্রেনে যেতে চাই।”

লিয়া এক্সাইটেড হয়ে কথাটা বলে।লিয়ার কথা শুনে রাজিয়া সুলতানা অবাক হন।মেয়ে যেতে চাইছে একা তাও আবার ট্রেনে। বিস্ফোরিত নয়নে মেয়ের দিকে তাকিয়ে কন্ঠে কঠোরতা নিয়ে বলেন,,”তুই নানু বাসায় যাবি। তাও একা ট্রেনে। ইম্পসিবল।তোর আব্বু শুনলে তোকে সহ আমাকে শু’লে চড়াবে।এইসব পা’গ’লামি, ছেলেমানুষী আবদার বাদদে।আর এখন চুপচাপ খাবার খেয়েনে।”

লিয়া গাল ফুলিয়ে রাখে।পাশ থেকে অল্প বয়সী কাজের মেয়েটা বলে উঠলো,,”আপামনি।আপনে একলা যাইতে চান।তাও ট্রেনে। নাহ্ আপামনি ট্রেনে মেনে একলা যাইয়েন না।এমনিতেই আপনারে লইয়া আমার ভীষণ ডর করে।”

লিয়া মৃদু হাসে। কিয়ৎক্ষন পরে আশ্চর্যান্বিত হয়ে মেয়েটাকে শুধায়,,”হোয়াট?ডর মানে ভ’য় লাগে।আমাকে নিয়ে।হাউ ফানি। কিন্তু কেনো?আমাকে ভ’য় লাগার মতো আমি আবার কি করলাম। স্ট্রেইন্জ!”

মেয়েটা ভিতু ফেস করে।বারকয়েক চোখ টিপটিপ করে।শুকনো ঢোক গিলে নিয়ে ঠোঁট আওড়ায়,,”ঐযে আপনে মাঝে মধ্যে বেহুঁশ হইয়া থাকেন।আমিতো খালাআম্মারে বলিযে,আপনার গায়ের উপর আছড় আছে।না হইলে একজন সুস্থ সবল মানুষ একাই দাঁত লাইগা যায়।”

রাজিয়া সুলতানা ঠোঁট টিপে মিটমিট করে হাসে।লিয়া একহাত কপালে দিয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে ঠোঁট মেলে বলে,,”ওহ্!গড। অতিরিক্ত টেনশন করলে আমি সেন্সলেস হয়ে পড়ি।আর ব্লা’ডে আমার ফিলোবিয়া আছে। অতিরিক্ত ব্লা’ড এসব দেখলে আমার কেমনজানি লাগে।আর আমি সেটা সয্য করতে পারিনা তাই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। বুঝলে?”

মেয়েটা কি বুঝলো আল্লাহ মালুম।কারন ফের ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে উঠলো,,”আপনারা শিক্ষিত মানুষ।লেহাপড়া করেন।আপনেরা তো অতশত বিশ্বাস করেন না।তবে মনেহয় খালাআম্মা আপামনিরে একবার কবিরাজের কাছে নিয়ে যাওন লাগে।একখান তাবিজ দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।আপনে যে চুলটুল ছেড়ে দিয়ে রাতবিরাত বারান্দায় বইসা থাকেন।আর আপনার বারান্দার পাশেই তেঁতুল গাছ। ওনারা তো তেঁতুল গাছেই থাকে।”

কত সুন্দর সম্মান প্রদর্শন করে ওনারা বলে সম্বোধন করছে। উফ্! মনে হচ্ছে জ্ঞানী-গুণী , বিশিষ্টজনদের কথা বলছে।এর কথাশুনে লিয়া চরম বি’র’ক্ত হয়।লিয়া চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় রাগান্বিত স্বরে বলে,,”উফ্!কি এক জ্বা’লা। এমনিতেই মন মেজাজ ভালো নেই।আর এর উল্টাপাল্টা কথা।আর এমনভাবে বলছে,ওনারা।আইমিন ভুত মহাশয়রা ওর খুব পরিচিত। তাদের বাসভবনের এড্রেসও জানে। আশ্চর্য!

রাজিয়া সুলতানা মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বলে,,”তুমি থামো।আর লিয়া খাবার না খেয়ে উঠে দাঁড়ালি যে।”

“তোমাদের কথা বার্তায় খাবার খাওয়ার ইচ্ছেটাই চলে গিয়েছে।খেতে ইচ্ছে করছে না।”

রাজিয়া সুলতানা লিয়াকে কয়েকবার খাওয়ার কথা বলেন।মায়ের কথায় লিয়া অবশেষে খাবার খেতে বসে।এমন সময় মেয়েটা ফের জিগ্গাসু দৃষ্টিতে লিয়ার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে উঠলো,,”আচ্ছা আপামনি।এইযে আপনে মাইয়া মানুষ হইয়া একলা যাইতে চাইতাছেন। আল্লাহ নাকরুক কোনো বিপদ আপদ হলে কিকরবেন?”

লিয়া খাবার চিবুতে চিবুতে বলে,,”ফ্যারি টেলস দেখেছিস কখনো?নাকি রুপকথার গল্প শুনেছিস কারো থেকে কখনো?”

মেয়েটা দুদিকে ঘাড় নাড়ায়।যার অর্থ না।না টিভিতে দেখেছে আর না কারো থেকে গল্প শুনেছে।লিয়া ফের শীতল চাহনিতে চেয়ে বলতে থাকে,,”রুপকথার গল্পে রাজকন্যা যখন কোনো বিপদে পড়ে তখন রাজপুত এসে থাকে উদ্ধার করে।ঠিক তেমনি আমি কোনো সমস্যায় পড়লে রাজপুত না হলেও আমার জন্য নির্ধারিত থাকা মানবটা আমাকে হেল্প করতে আসবে,হুহ।”

রাজিয়া সুলতানা মেয়ের দিকে মোটা চোখে তাকাতেই লিয়া মুখটা থমথমে করে রাখে। ‌হালকা হাসার চেষ্টা করে বাম হাতে মাথা চুলকিয়ে বলে উঠে,,”এমনি মজা করছিলাম তো।”
.
.
রাতে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে লিয়া। বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।এমন সময় দরজার দাড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে রাজিয়া সুলতানা হালকা কেশে শুধালেন,,”লিয়া ঘুমিয়ে পড়েছিস?”

“নাহ্, আম্মু।ভিতরে আসো।”

রাজিয়া সুলতানা লিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।আর লিয়া চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছে।মায়ের দেওয়া খবরে লিয়ার মনটা পুরোপুরি নাহলেও অনেকটা খুশি হয়েছে। লিয়ার বাবা এনামুল খাঁন লিয়াকে নানু বাসায় যাওয়ার পারমিশন দিয়েছে।তবে একা নয় আর ট্রেনেও নয়। ড্রাইভার আঙ্কেল পৌঁছে দিয়ে আসবে।আর দুইদিন বা তিনদিন পর লিয়ার মামা নিজে লিয়াকে পৌঁছে দেবে।এরকম শর্তারোপ করেছেন।ঢাকাতে লিয়ার নানুবাসা।কাল সকাল সকাল জার্নি করে অতদূর যেতে হবে।তাই মায়ের আদেশ এখন ফোন চালানো যাবে না। আর্লি ঘুম থেকে উঠতে হবে।তাই এখন আর্লি ঘুমাতেও হবে।
.
নানুবাসায় বেশি মানুষজন নেই। বৃদ্ধ নানুভাই,একমামা মামী আর ছোটো ছোটো মামাতো ভাইবোন।কালকে দুপুরে নানুবাসায় আসছে লিয়া।অথচ রাত থেকেই আবার মনটা বাসায় ফেরার জন্য ছটফট করছে। পিচ্চি পিচ্চি দুইটা মামাতো ভাইবোন তাদের সাথে কি আর গল্প করে সময় কাটানো যায়।আসার পর থেকে নানুভাইয়ের সাথে হালকা গল্প আর পিচ্চিদের সাথে এটা সেটা খেলেই সময় কাটিয়েছে।ভোরে আজানের ধ্বনি শুনে লিয়ার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দুইহাত বুকে গুঁজে দাঁড়ায়। গায়ের উপর পাতলা শাল জড়ানো। হাড়কাঁপানো শীত পড়ছে। ঠান্ডায় লিয়ার পুরো শরীর মৃদু কেঁপে কেঁপে উঠছে। লিয়ার এখন আফসোস হচ্ছে।বাসায় থাকলে, কত্ত মজা হতো।কলেজে গিয়ে ফ্রেন্ডদের সাথে আডডা দিতে পারতো।ধ্যাত ভালো লাগে না। উফ্!কেনো যে একা একা আসতে গেলাম।এখানকার প্রতিটি সেকেন্ড আমার কাছে ঘন্টায় রুপ নিয়েছে।আরো দুইদিন কিকরে এখানে থাকবো।এটা ভাবতেই লিয়ার গলা শুকিয়ে আসছে।লিয়া মনেমনে ফের আওড়ায়,যে করেই হোক।নানুভাইকে রাজি করিয়ে চলে যেতে হবে। এখানে আরো দুইরাত থাকলে দম বন্ধ হয়ে আমি প্রাণ হারাবো।
.
জাহানারা বেগম ফজরের নামাজ আদায় করে জায়নামাজে তসবিহ পড়ছিলেন।এমন সময় দরজার দাড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে জারিফ হালকা কেশে মা বলে ডাকে। জাহানারা বেগম জায়নামাজ টা সুন্দর করে ভাঁজ করে রাখেন। তাসবিহটাও জায়গামত রাখেন।ছেলের কাছে এগিয়ে গিয়ে আদূরে গলায় বলেন,,”উঠেছিস বাবা।চল হালকা নাস্তা তৈরি করে দেই। খেয়ে তারপর যাবি।”

ভার্সিটি থেকে থিসিসের ডাটা কালেক্ট করতে জারিফকে ঢাকা যেতে হবে আজ।জারিফ মায়ের কথার জবাবে বলে,,”এতো সকালে খাবো না।এতো সকালে খাওয়া যায় তুমিই বলো।তুমি তো আমাকে ভালো করেই জানো।তাই এখন কষ্ট করে তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে নাহ্।আমি পথে কিছু একটা খেয়ে নেবো। চিন্তা করো না।নাতাশা ঘুমিয়ে আছে।ওকে আর তুললাম না।”

অনেক করে বলার পরও জারিফ খেয়ে যেতে রাজি হলো না। অবশেষে মায়ের হাতের এককাপ চা সাথে বিস্কুট খেলো।মায়ের আবদার খালি মুখে এতভোরে কোথাও যেতে নেই। হাতে থাকা রিচওয়াচে সময় দেখে নিয়ে জারিফ মৃদুস্বরে বললো,,”মা গাড়ির সময় হয়ে যাচ্ছে।এবার আসি তাহলে।”

“ঠিক আছে বাবা।”

কথাটা বলেই কিছু মনে হতেই জাহানারা বেগম খানিকটা অবাক হয়। অতঃপর অবাক গলায় শুধায়,,”গাড়ির সময় হয়ে যাচ্ছে মানে।তুই কি বাসে যাবি নাকি?বাড়ির গাড়িই তো আছে।”

নীল রাতে বলেছিলো ও নাকি বন্ধুদের সাথে কোথাও পিকনিকে যাবে।তাই আজকে গাড়িটা ওর লাগবে।জারিফ ছোট ভাইয়ের আবদার রাখতে বলে,ঠিক আছে।এদিকে আজকে নিজের প্রয়োজন ছিলো।সেটা আর নীলকে বলেনি। জাহানারা বেগমের কাছে নীলের বিষয়টা না বলে জারিফ এমনি খোড়া অজুহাত দিয়ে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়। জাহানারা বেগম ফের মায়াময় আদূরমাখা স্বরে বলেন,,”কখন ফিরবি বাবা।ফিরতে কি খুব বেশি দেরি হবে।বেশি রাত করিস না বাবা। এমনিতেই প্রচন্ড ঠান্ডা পড়ছে।দেখে শুনে যাস কেমন? এক্সট্রা শীতের পোশাক নাহয় সাথে নিয়ে যা।যদি প্রয়োজন হয়।”

“নাহ্।লাগবে না।পড়েছি তো।রওনা দিতে দিতে বিকেল হয়ে যাবে।বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা পার হয়ে যাবে।টেনশন করো না।”
.
ওদিকে লিয়ার দম বন্ধ হয়ে আসছে।লিয়ার পক্ষে নানুবাসা এখন জেলখানায় রুপ নিয়েছে। লিয়ার মোটেও ভালো লাগছে না।তাইতো লিয়া বৃদ্ধ নানুভাইকে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে আজকেই চলে আসার জন্য বলে।নানুভাই বেচারা পড়েছে বেকায়দায়।একে তো একলা ছাড়তে পারছে নাহ্।আবার নাতনির কথাও ফেলতে পারছে না।নানুভাই অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে করুন কাঁপাকাপা গলায় বলেন,,”আপা আজকে থেকে গেলে হতো না।তোমার মামা তো অফিসে আছে।আর ব্যাংক থেকে ফিরতে ফিরতে তো রাত আটটা বেজে যাবে।তাই আজকে আর হবেনা কালকে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে তোমাকে বাসায় দিয়ে আসবে।তোমার বাবা মার কাছে। ‌আর তোমাকে একলা ছাড়লে। তোমার কিছু হলে,তোমার বাবা আমাকে রক্ষা করবে না।এই বৃদ্ধকে কাঠগড়ায় তুলবে।শেষ বয়সে এসে জেলের ভাত খেতে হবে আমায়।আর এদিকে বয়সের ভারে অতটা পথ জার্নিও করতে পারিনা।তাই বলছি।”

লিয়া তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,,”নানুভাই আজ দুইদিন আছি।আমার আর মোটেও মা বাবা ভাইকে ছাড়া থাকতে ভালো লাগছে না। আর না এখানে কেউ আছে আমার বয়সী।যে তার সাথে অন্তত গল্প করে সময় কাটাবো। পিচ্চিদের সাথে খেলি।তাও ওরা সারাদিন স্কুলে থাকে।আর নানুভাই তুমি জানো তো আমার যখন একবার যেটা থেকে মন উঠে যায়।হাজার চেষ্টা করেও মন বসাতে পারিনা।আর এখন আমার মন কিচ্ছুতেই এখানে থাকতে যাইছে না।আর বলছি তো কিছু হবে না।তুমি গাড়িতে তুলে দিবে।সোজা গাড়ি ময়মনসিংহ চলে যাবে।তারপর ড্রাইভার আঙ্কেল এসে আমাকে নিয়ে যাবে।তুমি কি আমাকে লোকাল বাসে তুলে দিবে নাকি?যে হারানোর ভয় থাকবে।”

নাতনির একরোখা জিদ আর ইমোশনাল ব্লাকমেইল এর কাছে পরাজিত হয়ে বৃদ্ধ নানুভাই লিয়াকে গাড়িতে তুলে দেয়।অবশ্য ফোনে মেয়ের থেকে সম্মতি নিয়েই।লিয়াকে লাক্সরি হিনো গাড়িতে তুলে দেয়।আগে থেকে সিট বুকিং না দেওয়ায়।সিটটা পিছনে হয়।বিকেল চারটা বাজে ময়মনসিংহ যেতে যেতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যাবে।লিয়াকে সিটে বসিয়ে দিয়ে নানুভাই আড়ালে চোখের পানিটুকু মুছে নেয়।লিয়ার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে। অজস্র দোয়া করতে থাকে।লিয়া নানুভাইকে আলতোকরে জড়িয়ে ধরে বিদায় জানায়।গাড়ির ড্রাইভার সিটে বসে। গাড়ি স্টার্ট দিবে।সেইসময় নানুভাই গাড়ি থেকে নেমে যায়।

লিয়ার পাশের সিট এখনো ফাঁকা পড়ে আছে।লিয়া কপাল কুঁচকে ভাবছে এখানে আবার কে বসবে আল্লাহ মালুম।ভালো হতো দুইটা সিটই কিনে নিলে।মেয়ে মানুষ ছাড়া যদি ছেলে মানুষ বসে তখন।হায়! আল্লাহ।এটা তো ভাবিনাই।আর নানুভাইয়েরও হয়তো তাড়াহুড়োয় এসব মনে নেই।লিয়া দ্রুত গাড়ির কন্টাক্টটরকে ডেকে বলে,,”এই সিটটা বুকিং না থাকলে।আমি কিনতে চাই।”

জবাব এলো,,”সরি ম্যাডাম। সম্ভব নয়। অলরেডি এটা বিক্রি হয়ে গিয়েছে।”

এটা শুনে লিয়া হতাশ হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি দেয়।সাথে একগাদা সংশয় মনে উদয় হতে থাকে। লিয়া মনেমনে নিজেকে সাহস যোগায়।ব্যাপার নাহ।লিয়া যথেষ্ট ব্রেভ এন্ড ক্লেভার গার্ল।যেকোনো সিচুয়েশন মোকাবেলা করতে পারবে,হু।লিয়া নিজেকে আরো আত্মবিশ্বাসী করে তোলার চেষ্টা করে।লিয়ার দৃষ্টি জানালা দিয়ে বাইরে।এমন সময়..

[চলবে…ইন শা আল্লাহ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here