প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা #Writer_Mahfuza_Akter পর্ব-১৩

0
355

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-১৩

“সেদিন ঝড় উঠেছিল! পৃথিবীর সকল অস্তিত্বে তোলপাড় করে তোলা এক ঝড়। ভূখণ্ডে এক ন*র*প*শু*র তান্ডবে পৃথিবীর মাটিও সেদিন কেঁপে উঠেছিল। নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে নিজের জড়তার কারণে আক্ষেপ জানিয়েছিল হয়তো! বাঁচার হাহা”কার, করুন আ*র্তচিৎ*কার তার মনে দাগ কা*টতে পারেনি। শেষমুহুর্তে পৃথিবীর কদর্য রূপটা দেখার অভিজ্ঞতাটা ভ’য়া’ব’হ ছিল। তবুও হয়তো একটু শান্তির দেখা মিলেছিল যখন নিজের অতি প্রিয় কারোর মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। কিন্তু তাকে শেষবারের মতো ছুঁয়ে দেখাটা ভাগ্যে জুটলো না। নিয়তি বড়ই নিষ্ঠুর! তবুও ঠোঁট নাড়িয়ে কয়েকটা শব্দ বের হয়েছিল,

-“ও তোকে বাঁচতে দিবে না, চাঁদ! ওর দ্বারা সব সম্ভব। ও তোকেও মে*রে ফেলবে রে, চাঁদ।”

ঘুম থেকে ফট করে চোখ খুলে ফেললো তরী। চোখের কার্ণিশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। শ্বাসপ্রশ্বাস তীব্র গতিতে চলছে তার। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে সেই গতির সাথে তাল মেলানোর চেষ্টা করছে সে। অন্ধকার ও নিস্তব্ধতার মধ্যে তরীর ফোঁপানোর আওয়াজ বেশ ভালো করেই শোনা যাচ্ছে। ঘুম কিছুটা হালকা হতেই পাশ থেকে সৌহার্দ্য লাফিয়ে উঠলো। তরীর ছটফট ভাব দেখে ঘাবড়ে গেল সে কিছুটা! তাড়াতাড়ি লাইট অন করে তরীর ঘর্মাক্ত কপালে হাত রাখলো। মেয়েটা প্রচন্ড কাঁপছে। সৌহার্দ্য ওর দুই বাহু চেপে ধরে জোরালো কন্ঠে বললো,

-“হোয়াট হ্যাপেন্ড, তরী? এরকম করছো কেন? অসুস্থ লাগছে? শরীর খারাপ লাগছে? কী হয়েছে তোমার?”

হঠাৎ-ই তখন এক অদ্ভুত কান্ড ঘটিয়ে বসলো তরী। সৌহার্দ্যকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিলো। এমন অস্বাভাবিক ধাক্কায় সৌহার্দ্য বিছানার এক কোণায় ছিটকে দেয়ালে আঘাত পেল। তরীর সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। সে এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। পুরো ঘটনার আকস্মিকতায় সৌহার্দ্য একেবারেই হতভম্ব হয়ে গেল। মাঝরাতে তরীর এমন অদ্ভুত আচরণের মানে কী?

সবকিছুর উর্ধ্বে একটা বিষয় সৌহার্দ্যের মনকে বেশ নাড়া দিলো। আর সেটা হলো তরীর দেওয়া ধাক্কাটা। বেশ দক্ষ হাতে সৌহার্দ্যের জোরালো বন্ধন থেকে এমন ভাবে নিজেকে মুক্ত করেছে সে। ব্যাপারটাকে একদমই স্বাভাবিক ও সাধারণ ভাবে নিতে পারছে না সৌহার্দ্য। এই ঘটনা সৌহার্দ্যের মনে সন্দেহের বীজকে যেন পাকাপোক্ত করে দিলো!

সেই রাতে তরী আর পাশের ঘর থেকে বের হলো। সৌহার্দ্যও তরীকে ঘাটলো না। তরীকে এখন ডাকাডাকি করা মানে এ ব্যাপারটা পরিবারের সবাইকে ঘটা করে জানানো, যেটা সৌহার্দ্য চায় না।

সকালে একেবারে বাইরে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে ডাইনিং রুমে এলো সৌহার্দ্য। আশেপাশে কোথাও তরীকে দেখতে পেল না। সুজাতাকে জিজ্ঞেস করতে চাইলেও পাশে দাদীকে দেখে আর সেই সাহস পেল না। এই এক মানুষ! মজা করার একটা সুযোগও হাতছাড়া করেন না দাদী। ওনার কাছে ঠাট্টার পাত্র হওয়ার কোনো ইচ্ছে সৌহার্দ্যের আপাতত নেই!

সৌহার্দ্যের বুদ্ধিতে পানি ঢেলে দিতে দাদীর এক মুহুর্তও লাগলো না যখন তিনি দেখলেন সৌহার্দ্য খাওয়ার মাঝে বারবার আড়চোখে আশেপাশে তাকাচ্ছে। তিনি খুকখুক করে কেশে বললেন,

-“বুঝলা, বউমা? দিনকাল ভালো যাইতেছে না। আমার নাতবৌটারে একটু কও যেন সে সবসময় আমার নাতিটার কাছে কাছেই থাকে! নাতি তো বউকে একদম চোখে হারাইতেছে!!”

খাওয়ার মধ্যে সৌহার্দ্যের কাশি উঠে গেল। সুজাতা জগ থেকে পানি ঢালতে গিয়ে দেখলেন, জগ খালি। তাই তাড়া দিয়ে তরীকে ডাকলেন,

-“তরী! একগ্লাস পানি দিয়ে যা তো! তাড়াতাড়ি!! ”

তরী তাড়াহুড়ো করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো পানি হাতে নিয়ে। বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পানির গ্লাসটা সৌহার্দ্যের হাতে এগিয়ে দিলো। তরীর এমন স্বাভাবিক ও নির্বিকার আচরনে সৌহার্দ্য প্রচন্ড অবাক হলো। কিন্তু সেটা কাউকে বুঝতে দিলো না। গতরাতের ব্যাপারটা কি তরী ভুলে গেছে? নাকি সূক্ষ্ম অভিনয়ের মাধ্যমে তা আড়াল করছে? ভেবে পায় না সৌহার্দ্য! আবার এটাও তাকে ভাবাচ্ছে যে, সে হয়তো সাধারণ একটা ব্যাপারকে নিয়ে বেশি বাড়িয়ে ভাবছে। আনমনে অনেক কিছু ভাবলো সৌহার্দ্য। কেউ সেটা লক্ষ না করলেও এক জোড়া তীক্ষ্ণ চোখকে তা ফাঁকি দিতে পারলো না।

সৌহার্দ্য হসপিটালে প্রবেশ করলো বিরক্তি নিয়ে। গাড়িতে বসে নিজের পিয়নকে পাঁচ বার কল দিয়ে ফেলেছে সে। পিয়নের প্রথম কাজ হলো সকালেই সৌহার্দ্যকে ফোনে সারাদিনের ডিউটির একটা প্রিভিউ দেওয়া। কিন্তু আজ তো সে ফোন করেইনি! আবার সৌহার্দ্য ফোন করলে সেটা রিসিভও করছে না। প্রচন্ড ঠান্ডা মস্তিষ্কের অধিকারী বলে সৌহার্দ্য হুটহাট রেগে যায় না। রাগ না হলেও বিরক্তি ঠিকই সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে।

সৌহার্দ্য নিজের কেবিনের দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলতে গেলে সেটা খুললো না। এখনো আনলক করা হয়নি সেটা। সৌহার্দ্য অবাক হলো। পিয়ন সবসময়ই ওর কেবিনের ডোর খুলে রাখে সকাল সকাল। আজ পিয়নের কী হলো? সবজায়গা থেকে গায়েব! সৌহার্দ্য চিন্তিত ভঙ্গিতে পকেট থেকে চাবি বের করে ডোর আনলক করলো। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে সামনে তাকাতেই সৌহার্দ্যের মাথা ঘুরে গেল। সাদা ফ্লোর টকটকে লাল র*ক্তে ভেসে যাচ্ছে। র*ক্ত স্রোতের মাঝে পিয়নের নি*থ*র দে*হ পড়ে রয়েছে। তার কপা*ল ও বু*ক বরাবর ছু*রি গেঁ*থে দেওয়া হয়েছে। তার খোলা চোখ দুটো তাকিয়ে আছে কোনো অনির্দিষ্ট ও অজানা কোণে। এতো বছর ডাক্তারি পেশায় থাকা সত্ত্বেও এ দৃশ্য দেখে সৌহার্দ্যের প্রতিটি শি*রা দিয়ে শীতল র*ক্ত*স্রোত বয়ে গেল।

২২.
সৌহার্দ্যের কেবিনে রোগী দেখার পরিবর্তে এখন আইনি জেরা ও পর্যবেক্ষণ চলছে। পুলিশ এসেছিল প্রথমেই। কেবিনটা পুরোপুরি চেক করে লা*শ*টা সরানো হয়েছে। কিন্তু তারা প্রহরকে কেন আবার খবর দিলো, বুঝতে পারলো না সৌহার্দ্য! হ্যাঁ, সে জানে প্রহর এই পেশায় জড়িত। তবে প্রহর কেন সৌহার্দ্যের পরিবারের সাথে ঘটা সব ঘটনায় হস্তক্ষেপ করবে? প্রহরের প্রতি প্রচন্ড বিরক্ত সে। ওর এতো আগ বাড়িয়ে দায়িত্ব নেওয়াটা লোক দেখানো ঠেকছে সৌহার্দ্যের দৃষ্টিতে।

-“ডা. সৌহার্দ্য রায়হান! এই মা*র্ডা*র কেইসটার সাথে আপনি ডিরেক্টলি ইনভলভ’ড। আর আপনার পাশাপাশি আপনার পরিবারের প্রতিটি ব্যক্তিকেও জেরা করা হবে। তাই আমি চাই যে, আপনি এই মুহুর্তে তাদের এখানে ডাকুন অথবা আমাদের তাদের সাথে দেখা করার পারমিশন দিন!”

প্রহর বেশ ঠান্ডা গলায় কথাটা বললেও সৌহার্দ্য এতে তেলেবেগুনে জ্ব*লে উঠলো,

-“হোয়াট ডু ইউ মিন? আপনি এখানে আমার ফ্যামিলিকে কোন লজিকে জড়াচ্ছেন, আমি বুঝতে পারছি না। আপনার জানা থাকা উচিত যে, সৌহার্দ্য রায়হান তার পার্সোনাল আর প্রফেশনাল লাইফ আলাদাভাবে মেইনটেইন করে চলে সবসময়।”

প্রহর মনে মনে হাসলো। সৌহার্দ্যের থমথমে ভাবটা আজও যায়নি। কখনো যাবেও না হয়তো! মনের ভাবনা মনে রেখেই ওপর থেকে নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,

-“লিগ্যাল ইস্যু বিবেচনায় আমি যা বললাম, সেটাই করতে হবে। সো, আপনি আপনার ফ্যামিলিকে ডাকুন। আমি তাদের সাথে কথা বলবো!”

সৌহার্দ্য দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করলো। ফোনে তার মাকে সবটা জানালো। সৌহার্দ্যের মা, বাবা, দাদী ও তরী একসাথে এলো ঘন্টা খানেকের মধ্যে। প্রহর সবাইকে দেখে অমায়িক হাসলো। কিন্তু সৌহার্দ্যকে অবাক করে দিয়ে তার মা, বাবা ও দাদীকে কিছুই জিজ্ঞেস করলো না প্রহর। সোজা গিয়ে তরীর মুখোমুখি দাঁড়ালো। প্রহর ক্রূর হেসে বললো,

-“বলেছিলাম না? আমাদের আবার দেখা হবে! দেখলেন তো, ভা—বী!!”

তরী ভ্রুকুঞ্চিত করে প্রহরের দিকে তাকালো। প্রহর যেন ওকে ব্যাঙ্গ করে কথা বলছে! তরী প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো প্রহরের মুখের দিকে। প্রহর সোজাসাপ্টা কথা বলা শুরু করলো। সরাসরি জিজ্ঞেস করলো,

-“কালরাতে কখন কোথায় ছিলেন, কী কী করেছেন আমাদের জানান! আপনি লিখিতভাবে আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন। সেটা আরো ভালো হবে আমাদের জন্য।”

তরী বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকালো। সবাইকে বাদ দিয়ে ওকে প্রশ্ন করায় প্রহরের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে। হঠাৎ সৌহার্দ্য এগিয়ে এসে প্রহরের সামনে থেকে তরীর সরিয়ে নিজের পেছনে ঠেলে প্রহরের মুখোমুখি দাঁড়ালো। শক্ত কন্ঠে বললো,

-“তুই কিন্তু এবার বাড়াবাড়ি করছিস, প্রহর! আইনের নামে মানুষকে মেন্টালি হ্যারাস করার কোনো রাইট তোর নেই। সবাইকে বাদে তুই ওকে-ই কেন জেরা করছিস? ও কাল সন্ধ্যার পর থেকে আজ সকাল পর্যন্ত আমার সাথে বাড়িতেই ছিল।”

-“আর ইউ শিয়র? মাঝরাতেও তুই ওকে দেখেছিলি যে, ও তোর বাড়িতেই আছে?”

প্রহরের প্রশ্নে সৌহার্দ্যের রাগ আরকধাপ বাড়লো যেন! সে আগের ভঙ্গিতেই বললো,

-“আমার বউ ও। মাঝরাতে আমার সাথে থাকবে না তো কার সাথে থাকবে। তোকে এখন সব খুলে বলতে হবে নাকি? এমনি মাথা গরম আছে। আর রাগ উঠাস না আমার!”

সৌহার্দ্যের কথায় হতভম্ব হয়ে গেল তরী। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সৌহার্দ্যের দিকে। প্রহরও হকচকিয়ে গেল এমন কথা শুনে। সৌহার্দ্য প্রচন্ড রেগে আছে। তাই এখন কথা বাড়ানো উচিত হবে না।

-“আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি ব্যাপারটা দেখছি। তুই মাথা ঠান্ডা কর।”

প্রহর নিজের টিমকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। সৌহার্দ্য বড় করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। যতই রেগে থাকুক না কেন? প্রহর সৌহার্দ্যকে কোনো ঝামেলায় পড়তে দেবে, এই বিশ্বাসটায় এতো বছরেও ভাটা পড়েনি সৌহার্দ্যের। তাই একটু স্বস্তি পেল সে। তরীকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-“তুমি দাদীকে নিয়ে বাসায় চলে যাও। বাবা যখন হসপিটালে চলেই এসেছে, তাহলে ওনার একটু চেকআপ করা উচিত। মা বাবাকে নিয়ে যাবে চেকআপের পর।”

তরী মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। দাদীকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে গেল হসপিটাল থেকে।

প্রহর হসপিটালের সিসিটিভির ফুটেজ কালেক্ট করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। কাল রাতে সবার অজ্ঞাতসারে সিসিটিভি অকার্যকর ছিল। যে খু*ন করেছে, সে আগেই সিসি ক্যামেরা অফ করে তারপর হাসপাতালে প্রবেশ করেছে। প্রহর হতাশ হলো। পার্কিং এরিয়ায় যেতেই তরীকে দেখতে পেল সে। দাদী আগে আগে গাড়িতে উঠে গেছেন। তরী এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ির দিকে। প্রহর হাসলো। মেয়েটা এতো সহজসরল সেজে থাকে কীভাবে?

-“এক্সকিউজ মি, মিসেস তরী!”

তরী থামলো। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকানোর আগেই প্রহর এসে ওর মুখোমুখি দাঁড়ালো। তরী বিরক্তিতে নাকমুখ কুঁচকালো। প্রহর বললো,

-“জিজ্ঞেস করবেন না, কেন আপনাকে আমার এতো সন্দেহ হয়? আসলে সন্দেহ হয় না, আমি শতভাগ নিশ্চিত! আপনি আসলে আপনি নন।”

তরী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। কিন্তু প্রহরের একটা কথা-ই তরীকে থমকে দিলো। প্রহর অদ্ভুত ভাবে রহস্যময় হাসি দিয়ে বললো,

-“কথা কি সত্যি সত্যিই বলতে পারেন না? নাকি সবটাই অভিনয়?”

-চলবে…

(গল্পের প্রতিটি প্লটে ধাপে ধাপে রহস্যভেদ হবে। গল্পটা নিজস্ব ফ্লো-তে না থাকলে এলোমেলো লাগবে। তখন সবার ভালোলাগাটা নষ্ট হবে না? সুতরাং একটু ধৈর্য ধরুন 💖)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here